প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২২

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২২
রাজিয়া রহমান

উপমা ভেবেছিলো শফিক উপমার সন্ধান করবে।কিন্তু উপমাকে অবাক করে দিয়ে শফিক একবারও কল করে নি। রুমা উপমাকে বললো, “তুই চিন্তা করিস না।আমি দেখবো।জান্নাতের ডানা গজাইছে নতুন করে। ওগুলো ও আমি কেটে দিবো।”
উপমার বোনের কথায় আশ্বস্ত হতে পারে না। ভেতরে ভেতরে উপমার ভীষণ ভয় ঢুকে গেছে।শফিক কী তাকে বাসায় নিবে?

রুমাকে বলতেই রুমা বললো, “তুই সে নিয়ে ভাবছিস কেনো?তুই আমার বাসায় থাকবি তুই।”
উপমা রুমার কথা শুনে সাহস পায়।রুমার এখানে থাকতে পারলে অবশ্য ভালোই লাগবে উপমার। রুমার একার সংসার। শ্বশুর শাশুড়ীর ঝামেলা নেই।দুই ছেলেকে নিয়ে রুমা একা থাকে।
রুমার স্বামী থাকে চিটাগাং চাকরিসূত্রে। মাসে,দুই মাসে একবার আসে হয়তো।
রুমাকে প্রতি মাসে মোটা টাকা দেয়।
দুইজন ছুটা বুয়া কাজ করে রুমার বাসায়।
উপমা ঘুমাতে গেলো নিশ্চিন্তে। বিছানায় পিঠ ঠেকাতেই উপমার হাত আপনাতেই পেটের ওপর চলে গেলো।
কি আশ্চর্য!
বুকের ভেতর এতো শূন্য শূন্য লাগছে কেনো?
কি যেনো নেই, নেই লাগছে।
উপমা উঠে বসলো।পেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে উপমার দুই চোখ ভিজে উঠলো। এতো যন্ত্রণা হচ্ছে কেনো?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

উপমা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।
বুক ভাঙা যন্ত্রণায় উপমার মনে হলো প্রাণ বুঝি বের হয়ে যাবে।
কেনো ছোট্ট সোনাটাকে সে এভাবে শেষ করে দিলো?
উপমার কেমন হাঁসফাঁস লাগে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠে উপমা।
সারাদিন নিজের চিন্তায় এতো কিছু মনে ছিলো না। এখন শোয়ার পর হঠাৎ করে উপমার মনে পড়ে গেলো। উপমার চোখ দিয়ে আপনাতেই জল গড়াতে শুরু করে।
পরদিন সকালে রুমা ভাইকে কল করে। শফিককে বাসায় আসতে বললো রুমা।
দুপুরে শফিক আসবে ভেবে দুই বোন অপেক্ষায় ছিলো। কিন্তু শফিক আসলো না।
রুমা মা’কে কল দিলো।

শফিকের মা বাবা দুজনেই নিরুপায়। জান্নাত তাদের বলেছে তারা যদি চায় নিজেদের মেয়েকে নিজেদের কাছে রাখতে তাহলে সে তার ছেলেকে নিয়ে এই সংসার ছেড়ে চলে যাবে।এরকম কালনাগিনী ননদ নিয়ে সংসার করবে না।
গত পরশু রাতের ঘটনার পর শফিকের বাবা মা’য়ের ও উপমার উপর বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে। এতটা জঘন্য মানুষ হতে পারে?
তাই তারা ও জান্নাতের কথা মেনে নিলো।
এই বৃদ্ধ বয়সে নিজেদের দুই মেয়ে যে তাদের সেবাযত্ন করবে না তান্তারা দু’জনেই জানে।তাই পুত্রবধূকে চটালো না।

দুপুরে ও যখন শফিক এলো না রুমা তখন শফিককে কল করলো।শফিক তখন থানায় ছিলো।
রুমার কল পেয়ে ডিক্লাইন করে দিলো।থানায় বসে এখন ঝামেলা করতে ইচ্ছে করছে না।
রুমা আবারও কল দিলো, শফিক আবারও ডিক্লাইন করে দিলো।
রেগে গিয়ে রুমা আবারও কল দিলো।
বিরক্ত হয়ে শফিক ব্লক করে দিলো রুমার নাম্বার।
হতভম্ব হয়ে রুমা উপমাকে বললো, “দেখলি ভাইজান কী করলো?”
উপমার হতাশ লাগে।ভাইজান বুঝি আস্তে আস্তে চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে!
কই সে তো সাগরকে পারে নি বশ করতে!
ভাবী কীভাবে ভাইকে বশ করে ফেললো!
উপমার বুকে শঙ্কা জাগে।তার কী কপালে আর সুখ আসবে না?
কি করবে উপমা?

সকাল হলো একটা মিষ্টি অনুভূতি নিয়ে। ইশতিয়াক জেগে জেগে শুধু ইরাকে দেখছে।
ইরা!ইরা!ইরা!
ইশতিয়াকের বুকে সুখের ঝড় উঠে।এই যে ইরা তার পাশে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে এটুকুই ইশতিয়াকের মনকে বারবার আন্দোলিত করে।
সম্পর্ক কী ইশতিয়াক জানে না।
সম্পর্কের মায়া কেমন তা-ও তেমন একটা বুঝতো না ইশতিয়াক। অথচ বিয়ে করার সবে এক রাত হয়েছে।না কাছাকাছি হয়েছে স্ত্রীর সাথে না কোনো অন্তরঙ্গতা। তবুও মনে হচ্ছে তার সাথে আত্মার বন্ধন।
ঠিক যেমন রূপকথার গল্পে পড়ে থাকে রাক্ষসের প্রাণ ভোমরা অন্যত্র থাকে লুকায়িত তেমনই সে-ই যেনো ইশতিয়াকের প্রাণ ভোমরা।ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইশতিয়াকের মনে হলো তার খুব ভয়ংকর একটা অসুখ হয়ে যাচ্ছে।

ইরাকে দেখার অসুখ।
কি মিষ্টি যন্ত্রণাদায়ক ভয়ংকর একটা অসুখ,যেই অসুখে ইশতিয়াকের মতো কাঠখোট্টা একজন যুবকও নুইয়ে যায়।
ইশতিয়াকের ভীষণ ইচ্ছে করে ইরাকে একটা গভীর চুমু খেতে। ইংলিশ মুভিগুলোতে যেমন খায়।
যতটা চুমু খেলে বুকের ভেতরের সবটা শুধু ভালোবাসায় মাখামাখি হয়ে যায়।
নিজের লোভ সংবরণ করে ইশতিয়াক ইরার হাত তুলে নেয় তারপর আলতো করে চুমু খায়।
ইরা চমকে উঠে যায় ঘুম থেকে। হকচকিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। তারপর ইশতিয়াককে বলে, “কয়টা বাজে?”
“ভোর ৫.১০।”
“ইশ!এত্তো দেরি হয়ে গেলো? আপনি আমাকে ডাকলেন না কেনো?”
“কেনো ডাকবো?তুমি ঘুমাচ্ছিলে তো!”
“আজান দিয়েছে না?নামাজের জন্য ডাকবেন।”
ইশতিয়াক লজ্জিত হয়।
নামাজ!

কতো বছর হয়ে গেছে সে নামাজ পড়ে না!
ইরা দ্রুত বিছানা ছাড়ে।অযু করে এসে ইশতিয়াককে বললো, “আপনি পড়ে নিয়েছেন?”
ইশতিয়াক মাথা নাড়িয়ে বললো, “তুমি পড়ে নাও।”
ইরা কথা বাড়ালো না।
এখানে কোনো জায়নামাজ নেই।ইরা একটা তোয়ালে দিয়ে ফ্লোর মুছে নিলো।তারপর ফ্লোরে দাঁড়িয়ে ফজরের নামাজ আদায় করে নিলো।
ইশতিয়াক ইরার দিকে তাকিয়ে রইলো। কী ভীষণ মিষ্টি, স্নিগ্ধ লাগছে ইরাকে!
যেমন চেয়েছিলো সে।ইরা ঠিক তেমনই।
ইরা নামাজ পড়ে উঠে ইশতিয়াকের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন।”
“আমিই তো তোমার বাসা ইরা।তুমি আমার কাছে থাকবে।কোথাও তোমাকে নিরাপদ মনে হয় না আমার, আমি ছাড়া।”
“বাজে কথা বন্ধ করুন।আমাকে যেতে দিন।”
“তুমি আমার সাথে আমার বাড়িতে যাবে।”
ইরার চমকে তাকায় ইশতিয়াকের দিকে।
ইশতিয়াক উঠে আসে। ইরার সামনে দাঁড়িয়ে ইরাকে বললো, “তুমি আমার বউ ইরা।আমি তোমাকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি নিয়েই আমার অর্ধাঙ্গিনী করেছি।তোমাকে অসম্মান করার জন্য যে হাত বাড়াবে,ইশতিয়াক সেই হাত কেটে নিবে।”

ইরার কেমন অস্থির লাগছে।
ওই বাড়িতে গেলে সেই ইকবালের মুখোমুখি হবে,লিনার মুখোমুখি হবে,শায়লার মুখোমুখি হবে!
আতঙ্কে ইরা জমে যায়।
ইশতিয়াক ইরার চিবুক তুলে ধরে।
ভয়,শঙ্কা ইরার দুই চোখে ফুটে উঠে। মধুর সুরে ইশতিয়াক বললো, “তুমি ভয় পেও না ইরা।ভয় পেলে এই দুনিয়ার মানুষ তোমাকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিবে না।সাহস রাখো।যেই তোমাকে কটু কথা বলবে তাকে এক বিন্দু ও ছাড় দিবে না।মনে রেখো,তোমার হাজব্যান্ড তোমার পাশে আছে সবসময়, সব অবস্থায়।তোমার নিজের জায়গা নিজেকে দখল করে নিতে হবে।”
“কেনো আমাকে এসবে জড়ালেন?”
“তুমি কেনো আমাকে তোমার মায়ায় জড়ালে ইরা?আমি তো ছিলাম মুক্ত বিহঙ্গ, কোনো পিছুটান ছিলো না।তুমি এসে কেনো আমাকে এই জগৎ সংসারের মায়াজালে আবদ্ধ করলে?”
ইরা জবাব দিতে পারলো না।

সাগর সারারাত বাসায় ফিরলো না।বাকি সময় কাটালো তার ছোট্ট রাজকন্যার কবরের পাশে বসে।আর কলিজার টুকরোকে সে নিজ হাতে শুইয়ে দিয়ে এসেছে কবরে।
কতো পাষাণ মন তার!
সাগরের কান্না পাচ্ছে।কান্না করতে করতে সাগর মাটিতে বসে পড়ে।
মসজিদের পাশেই মেয়ের কবর দিয়েছে।
ফজরের নামাজের অযু করতে বের হয়ে ইমাম সাহেব দেখলেন কেউ একজন একটা কবরের পাশে বসে আছে।
ইমাম হারুন মোল্লা এগিয়ে গেলেন সেদিকে। ছোট্ট একটা কবরের সামনে একজন লোক বসে আছে।
চিনতে পারলেন ইমাম সাহেব লোকটাকে।গতকালই এই কবর দেওয়া হয়েছে।
ইমাম সাহেব সাগরের কাঁধে হাত রাখেন।
সাগর পেছনে ফিরে তাকায়।

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২১

“এখানে, এভাবে বসে আছো কেনো বাবা?”
“কোথায় যাবো হুজুর? আমার জীবনের সব সুখকে যে এখানেই মাটিচাপা দিয়ে গেছি আমি নিজের হাতে।আমার আর কোনো জায়গা নেই যাওয়ার মতো।”
“যিনি দিয়েছেন, তিনি-ই নিয়ে গেছেন বাবা।সবাইকেই ফিরতে হবে তার কাছে।তুমি, আমি কেউ বাদ যাবো না।আসো,আজান হবে এখন।নামাজের জন্য তৈরি হয়ে নাও।আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো।সেই পরম দয়ালু, মহান আল্লাহ তোমার অশান্ত মনকে শান্ত করে দিবেন।”

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২৩