প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৫৩ (২)

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৫৩ (২)
জান্নাত নুসরাত

ইসরাত ভার্সিটি থেকে এসেই হন্তদন্ত পায়ে কিচেনে ঢুকলো। আশে-পাশ তাকিয়ে যখন দেখলো চাচিরা কেউই নেই কিচেনে মায়ের দিকে রাগী দৃষ্টি ছুঁড়ল। দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড়িয়ে বলল,”আম্মু তুমি নুসরাত কে নিয়ে যাওনি ডাক্তার আঙ্কেল এর ওখানে।
নাজমিন বেগম মাথায় হাত দিলেন। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ইসরাতের দিকে তাকিয়ে বললেন, “একদম মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। নিয়ে যেতাম কিন্তু আজ যাব কাল যাব করে যাওয়া হচ্ছে না।
ইসরাত মায়ের উপর বিরক্ত হলো। চারপাশে না তাকিয়ে চিকন গলায় চিৎকার করে বলল,”এটা কোনো ভুলে যাওয়ার জিনিস? আঙ্কেল তোমাকে কি বলেছিল? তিন-মাস অন্তর নুসরাত কে উনার ওখান থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসার জন্য। আর তুমি এইট মান্থ হয়ে গিয়েছে এখনো যাওনি।
নাজমিন বেগম জিহ্বায় কামড় মারলেন। একদম মাথায় নেই তার!
নাজমিন বেগম মিনমিনিয়ে বললেন,

“নুসরাত টা ওতো আমায় মনে করিয়ে দিল না।
ইসরাত ভেঙ্গাতক হেসে বলল,
” ও বলবে তোমায়! তুমি ওর কাছ থেকে আশা করছো। তোমার মনে নেই আমার বিয়ের আগে কত কষ্ট করে নুসরাত কে নিয়ে ওখানে গিয়েছিলাম। তোমার মেয়ে যেতেই চায় না ওখানে আর তুমি ভাবছো ও তোমাকে মনে করিয়ে দিবে। হাসালে আম্মু!
নাজমিন বেগম যুবতীদের মতো নাক ফুলালেন।
“ও তো আর পাগল নয়, যে ওকে ওখানে নিয়ে যেতে হবে। না গেলে না যাক।
” আরে আম্মু, তুমি বুঝো না কেন?
“তাহলে বোঝাস না কেন?
ইসরাত নাজমিন বেগমের দিকে তাকিয়ে নাক ফুলিয়ে বলল,” উফ তুমি বুঝবে না। ভালো লাগে না! যাও তো যাও…..

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইসরাত কিচেন থেকে বের হয়ে গেল। আবার ফিরে এসে বলল,”তোমার শপিংয়ে যাওয়া আজ কেনসেল।
শপিং করার বদলে আজ ওকে নিয়ে আমরা সাইকিয়াট্রিস্ট কাছে যাবে।
নাজমিন বেগম বললেন,
“আচ্ছা নুসরাত কে কল দিয়ে বলে দেই সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যাব।
ইসরাত চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
” আম্মু তুমি কি পাগল? ও এটা জানলে ভার্সিটি থেকে জীবনে বাড়িতে আসবে না। আর আসলে জীবনে ও যাবে না ওখানে। আগেরবার তো টাকার লোভ দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলে। এবার টাকায় তোমার মেয়ে পটবে না। শপিং এর নাম করে নিয়ে যেতে হবে। আমি আঙ্কেলের সাথে ফোনে কথা বলে এপোইনমেন্ট বুক করে নিব। তুমি শুধু আল্লাহর ওয়াস্তে তোমার মেয়ের সামনে মুখ খুলবে না।

“পরে যদি ওখানে গিয়ে ঝামেলা করে।
” আমি আর তুমি কেন? ধরে ওকে টেনে নিয়ে যাব।
ইসরাত কিচেন থেকে বের হয়ে গেল। দরজার সামনে থেকে সরে গেল ফরমাল শার্ট-প্যান্ট পরা আরশ। মুখ গম্ভীর করে এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। হাতে ভাঁজ করে রাখা কোট। কিছুটা পা চালিয়ে সিঁড়ির উপরে উঠলো। নিজের কাজেই সে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে। নুসরাতের কথা শুনতে গিয়ে থাকে কান পাততে হচ্ছে দরজার বাহিরে। এ জীবনে আরো কি কি করতে হবে এক আল্লাহ ভালো জানে?

আরশ গোসল করে ফ্রেশ হওয়ার পর থেকে এদিক-সেদিক হাঁটছে। শরীরের ভিতর অশান্তি টাইপ ফিলিং হচ্ছে। রুম থেকে এক পা বের হয়ে আবার ফিরে এলো। অস্বস্থি বোধ হচ্ছে। আবার পা বাড়ালো ইসরাতের রুমের দিকে। আবার দু-পা পিছিয়ে গেল। নিজেকে ধাতস্ত করে অগ্রসর হলো ইসরাতের রুমের দিকে। রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে গলা পরিস্কার করে নক করলো। ইসরাতের নড়চড় না দেখে দরজার পাশ দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে ইসরাতকে খুঁজলো। ইসরাতকে রুমে না খুঁজে পেয়ে ভ্রু বাঁকা করে রুমের ভিতরে গেল। চোয়াল ঝুলিয়ে স্টাডি টেবিলের দিকে পা বাড়ালো। ইসরাত রুমের কোথাও নেই? চোখ একবার বুলিয়ে সামনে আগাতেই টেবিলের উপর কিছু মেডিকেল রিপোর্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখলো। সাইকোলজিস্ট মোহাম্মদ চৌধুরী। ফাইল হাতে নিয়ে ২য় পৃষ্টা পালটানোর আগেই ইসরাতের শান্ত গলা ভেসে আসলো।

“কি করছেন ওখানে ভাইয়া?
আরশ পিছন ফিরে তাকালো। ইসরাত তার দিকে কীভাবে তাকিয়ে আছে ঠাওর করতে পারল না। নিজের গম্ভীরত্ব বজায় রেখে আরশ ইসরাতকে উদ্দেশ্য করে বলল,”আগে বললে না কেন?
দু-পাশ নিশ্চুপ। দু-জন ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ একে অপরের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। কারোর মুখে কোনো রা নেই। নীরবতা কেউ ভাঙল না! শুধু দাঁড়িয়ে রইলো দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে। অপেক্ষা করল দু-জন দুজনের নীরবতা ভাঙার। সময় গড়াল, সূর্য মধ্য আকাশ থেকে কিছুটা সরে গেল। নিজের আবাস্থলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। উত্তরে হাওয়া বইতে লাগলো। শীত মৌসুম হওয়ায় কুয়াশায় ভিজে উঠতে লাগল সৈয়দ বাড়ির আঙ্গিনা। ধীরে ধীরে প্রকৃতি ঢেকে গেল কুয়াশার চাদরে।

সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। মাগরিবের আজান প্রায় হয়ে যাবে। কুশায়ায় রাস্তার পাশের দূর্বা ঘাস গুলো ভিজে উঠেছে। ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে আসায় নুসরাতের পা ও সামান্য ভিজে উঠেছে। নুসরাত পা চালিয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলো। নাজমিন বেগম নুসরাতের অপেক্ষায় দরজার সামনের সিঁড়িতে বসে ছিলেন। নুসরাতের ছায়া দেখতেই তিনি ধমক ছুঁড়ে দিলেন। নুসরাত মায়ের দিকে বাঁকা চোখে তাকাতেই নাজমিন বেগম হাত তুলে তেড়ে আসলেন। শাসানো গলায় বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আদেশের স্বরে বললেন,”যা গোসল করে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়! আমি ভাত বাড়ছি।
নুসরাত মিনমিন করে বলল,

” ভাত খাবো না!
“চুপচাপ রেডি হয়ে এসে খেতে বসবি।
নুসরাত আরশের রুমে ঢুকে পর্দা টেনে দিল। দরজা ভালোভাবে লাগিয়ে দিয়ে অগ্রসর হলো ওয়াশরুমের দিকে। ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে মুখ দিয়ে হু হু শব্দ করে ওয়াশরুমের বাহিরে বেড়িয়ে আসলো। পাপুশে পা মুছে হাহাকার করে উঠলো। টাওয়াল দিয়ে চুল বেঁধে নিয়ে হুডি মাথায় দিয়ে দিল। হুডির ফিতা গলায় বেঁধে তিড়িং বিড়িং করে গান গাইতে লাগলো।
” সম্পর্ক বদলে গেল একটি পলকে
জামাই আপন আর সবই পর হলো রে
জামাই বেশে বর যখন এলো রে
যেন দুঃখের বন্যা বয়ে গেলো রে….
নুসরাতের গানের রফাদফা হয়ে গেল যখন দেখলো আরশ সোফার উপর পায়ে পা তুলে আরাম করে বসে
উরুর উপর ল্যাপটপ রেখে নুসরাতের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আচগে। নুসরাত নিজের হা হয়ে যাওয়া মুখ নিজে হাত দিয়ে বন্ধ করে দিল।

নুসরাতের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরশ টাইপিং করতে করতে নির্লিপ্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো, “কোথাও যাচ্ছিস?
নুসরাত নিজের অবাকতা এক-পাশে ফেলে দিয়ে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত পায়ে লোশন লাগিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বলল,”শপিংয়ে যাচ্ছি!
আরশ ভ্রু বাঁকিয়ে নুসরাতের দিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”কেন?
পায়ে শু পরে নিয়ে বলল,
” জানি না আম্মা যাবে বলেছে তাই যাব।
আরশ চোখ তুলে তাকিয়ে নুসরাতকে আদেশের স্বরে বলল,”গলায় স্কার্ফ পেঁচিয়ে যা!
নুসরাত কেন জিজ্ঞেস করতে চাইলো, কিন্তু আরশের ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাকা দেখে কথা গিলে নিল। চুপচাপ কাবার্ড খুলল। ততক্ষণে আরশ নুসরাতের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। নুসরাত তাড়াতাড়ি খোঁজার চেষ্টা করলো স্কার্ফ। মনে মনে ভাবল এখানেই তো রেখেছি স্কার্ফ গেল কই? আরে ভাই বেড়িয়ে আয়! কী রকম লাগছে? নুসরাত অগোছালো হাতে স্কার্ফ খোঁজতে লাগলো।

আরশ পিছন থেকে নুসরাতকে টেনে সরিয়ে দিল। নুসরাত নিজেকে ধাতস্ত করে দাঁড়াতেই আরশ নিচের ড্র‍য়ার খুলে স্কার্ফ সাথে মাথায় বাঁধার জন্য টুপি বের করলো।
নুসরাত হাত পাতল,আরশ দিল না। নুসরাতের মাথা থেকে হুডির ক্যাপের ফিতা ছুটিয়ে ক্যাপ এক হাতে সরিয়ে দিল। চুল থেকে টাওয়াল ছাড়িয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে গলায় জিজ্ঞেস করলো,”সাইকিয়াট্রিস্ট মোহাম্মদ চৌধুরীর ফাইল দেখলাম ইসরাতের রুমে ওইটা কার?
নুসরাত নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো আরশের সামনে। আরশ নুসরাতের পৃষ্ঠদেশে হাত রেখে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এল। সামনে আসা বেবি হেয়ার গুলো কানের পিছনে গুজে দিয়ে বেন্ট দিয়ে ঢিলে করে খোপা করে দিল চুল ভিজে থাকায়। গলায় স্কার্ফ পেঁচিয়ে দিয়ে মাথায় টুপি পরিয়ে দিতে নিল।

নুসরাত আরশের বুকে হাত দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে দূরে সরানোর চেষ্টা করে কর্কশ গলায় চিৎকার করে বলল,
“আমি বাচ্চা নই যে আপনি আমাকে এভাবে ট্রিট করছেন। আমি নিজের কাজ নিজে করতে পারি। নিজেকে ক্যারি করার আমার যতেষ্ট সামর্থ্য আছে। স্টপ ট্রিটিং মি লাইক আ চিল্ড, আই এম নট আ চিল্ড।
আরশ হাসল। টুপি পরিয়ে দিতে গেলে,নুসরাত রুম থেকে বের হয়ে গেল। আরশ পিছন পিছন বের হয়ে আসলো টুপি হাতে। ইসরাতের রুমের সামনেই আসতে পিছন থেকে এক হাত দিয়ে ঝাপটে ধরলো নুসরাতের কোমর। নুসরাত নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো আরশ বল প্রয়োগ করে ধরে রাখলো আষ্টেপৃষ্টে নিজের সাথে।
এক হাত দিয়ে কোমর চেপে আরেক হাত দিয়ে টুপি মাথায় ভালো করে পেঁচিয়ে দিল। নিচ তলায় নাজমিন বেগম চিৎকার করে নুসরাত কে ডাকছেন খেতে আসার জন্য। নুসরাত রুঢ় গলায় বলল, “হয়েছে,এবার আমি যেতে পারি।

আরশ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। নুসরাত অগ্রসর হতেই আরশ সন্দেহিত গলায় বলল, “তুই সিউর, চাচি তোকে নিয়ে শপিংয়ে যাচ্ছে?
নুসরাত পিছনে না তাকিয়ে মাথা নাড়ালো। আরশ ব্যথাতুর দৃষ্টিতে চুপচাপ তাকিয়ে থাকলো নুসরাতের যাওয়ার দিকে। নুসরাত কে নিচে দেখতেই নাজমিন বেগম বললেন,
” তাড়াতাড়ি খা! আমি রেডি হয়ে আসছি।
নুসরাত মাথা নাড়ালো। হাত ধুয়ে ভাত মাখাতে লাগলো। ইসরাত এর মধ্যে রেডি হয়ে নিচে নেমে আসলো। নুসরাত ইসরাত কে আসতে দেখে ভ্রু বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুই ও যাবি?
ইসরাত ধীরে বলল,

“হু!
বাহিরের দরজার দিকে হাঁটা ধরতেই নুসরাত পিছন থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো,” কোথায় যাচ্ছিস তুই?
সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে বলল,
“গাড়ি বের করতে!
নুসরাত মাথা নাড়িয়ে খেতে লাগলো। প্লেটের ভাত খেয়ে হাত ধুতেই নাজমিন বেগম এসে হাজির হলেন ডায়নিংয়ে। নুসরাত কে তাড়া দিলেন বের হওয়ার জন্য। হাত মুছে ডায়নিং রুম থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই চোখ পড়ল দু-তলার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আরশকে। যে নিশ্চল চোখে তাকিয়ে আছে এদিকে। নুসরাত চোখ ফিরিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আরো একবার ফিরে তাকালো।
নাজমিন বেগম নুসরাতকে রেখে কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু নুসরাতকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পিছনে তাকাতে দেখে এগিয়ে এসে হাত চেপে ধরলেন। নুসরাতের যেদিকে চোখ ছিল সেদিকে দৃষ্টি দিতেই চোখে পড়ল আরশকে।

” আরশ যাবে তুমি?
আরশ গম্ভীর গলায় বলল,
“আপনারা যান! কিন্তু আমার আমানত যেভাবে সহি-সালামত নিয়ে যাচ্ছেন, সেভাবে সহি-সালামত ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন। এটা আপনার কাছে আশা করবো চাচি।
নাজমিন বেগম হাসলেন। নুসরাতের হাত চেপে ধরে নিয়ে বাহিরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
ইসরাত গাড়ি বের করে নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে। নুসরাত আর নাজমিন বেগমকে আসতে না দেখে গাড়ির হর্ণ বাজাল। নাজমিন বেগম দূর থেকে গলার জোর বাড়িয়ে বললেন, “আসছি আসছি! আর হর্ণ বাজাস না। কানের তেরোটা বেজে গেল।
গাড়ির সামনে এসে নুসরাত বলল,

“আমি ব্যাক সিটে বসছি! তুমি ফ্রন্ট সিটে বসো।
নাজমিন বেগম রাজি হয়ে গেলেন। ইসরাত বলল,
” সিট বেল্ট বেঁধে নাও? এমনিতেই অনেক লেট হয়ে গিয়েছে।
নাজমিন বেগম ধীরে সুস্থে সিট বেল্ট বেঁধে নিলেন। নুসরাত গাড়ির জানালা খুলে বাহিরের দিকে মুখ বের করে বসলো। আরশের রুমের বারান্দার দিকে চোখ পড়তেই মেয়েটার ভ্রু কুঁচকে গেল। মাথা বের করে তাকাতেই ঝড়ের গতিতে পুরুষ দেহের অবয়ব সরে গেল। নুসরাত চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলো বারান্দার দিকে। চোখে ঝাপসা লাগলো তাই প্যান্টের পকেট থেকে চশমা বের করে চোখে আটলো। চোখের পাতা ফেলে ভালোভাবে তাকালো দো-তলার বারান্দার দিকে। ততক্ষণে ইসরাত গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিল। টান দিয়ে বের হয়ে গেল গেটের বাহিরে। নুসরাত মাথা উল্টে তাকিয়ে রইলো আরশের বারান্দার দিকে। বার বার মনে হতে লাগলো ও ওখানে কিছু একটা দেখেছে! যা থাকে গভীর চোখে পর্যবেক্ষণ করছিল।

হসপিটালের সামনে গাড়ি থামতেই নুসরাত চোখ বাঁকা করে মা আর বোনের দিকে তাকালো। নাজমিন বেগম নুসরাতের বাঁকা চোখে তাকানো দেখে পাত্তা দিলেন না। সিট বেল্ট খুলে আলগোছে বের হয়ে গেলেন। ইসরাত ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে নিজের ল্যাদার জেকেট ঠিক করে নিল। দরজা খুলে দিয়ে নুসরাত কে বের হওয়ার জন্য বলল। নুসরাত দু-হাত বুকে বেঁধে বসে রইল। সে এখান থেকে এক পা নড়বে না। তাকে বোকা বানিয়ে নিয়ে আসা। সে ছাড়বে না কাউকে? হঠাৎ নুসরাতের ঠনক নড়ল ওই আরশের বাচ্চা জানে তাকে নিয়ে পাগলের ডাক্তারের কাছে আসছে। হায় আল্লাহ,এরা তার মান-সম্মান রাখল না।
নুসরাত কে মুখ গুরিয়ে রেখে কিছু ভাবতে দেখে ইসরাত হাত ধরে টেনে ধরল। কিছুটা রুঢ় গলায় বলল, “হয়েছে নাটক শেষ! এবার গাড়ি থেকে নাম।
নুসরাত ইসরাতকে গালি দিতে গিয়ে থেমে গেল। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ” তুমি আমাকে পাগল মনে করো তাই না?
নাজমিন বেগম থতমত খেয়ে বললেন,

“দূর তোকে কে বলেছে এটা?
“বলতে হবে কেন? পাগল মনে করো তাই তো পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসছো। তুমি আমার মা হতেই পারো না।
” তোর ইমোশনাল ডায়লগ বন্ধ কর! আম্মু পটে গেলে ও আমি কিন্তু পটবো না নুসরাত। মানুষকে খুব ভালো কথা দিয়ে আটকে ফেলতে পারিস তুই। আয় নাম এবার!
নুসরাত জিদ্দি গলায় বলল,
“নামবো না।
” তুই নামবি এবং চুপচাপ ডাক্তার এর কাছে যাবি।

নুসরাত কে নামতে না দেখে ইসরাত এক হাত দিয়ে হেচকা টান মেরে নামিয়ে নিল। ইসরাতের আকস্মিক এমন টান দেওয়ায় অপ্রস্তুত নুসরাত কিছুটা ছিটকে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো। হালকা পায়ে ব্যাথা পেল। আবার গাড়িতে গিয়ে বসতে চাইল ইসরাত দু-হাত দিয়ে নুসরাতের হাত চেপে ধরল। এক -প্রকার টেনে নিয়ে যেতে লাগলো মোহাম্মদ চৌধুরীর কেবিনে। করিডোরে দেখা হওয়া সবাই তাদের দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিল। ইসরাত সেসবে পাত্তা দিল না। মানুষের তো চরিত্রই নিজের চরকায় তৈল না দিয়ে অন্যের চরকায় তৈল দেওয়া। এরা দেখবে,তারপর এটা নিয়ে জাজমেন্ট করবে। এরা কেন সে আর নুসরাত অনেক সময় অনেক কে নিয়ে জাজমেন্ট করে। তাই জীবনে এদের এতো পাত্তা না দেওয়াই ভালো।
“ইসরাত আমার সাথে পাঙ্গা নিচ্ছিস আমি তোকে ছাড়ব না!
ইসরাতের ঠান্ডা গলায় জবাব দিল,
” আচ্ছা ছেড়ে দিস না। ধরে রাখিস!

চোখে চশমা এটে বসে আছেন মধ্য বয়স্ক এক লোক। লোকটা দেখে টাওর করা মুশকিল বয়স কত তাই মধ্য বয়স্ক বলা চলে। ইসরাতকে হালকা ধমকালেন তিনি। নুসরাত কে টেনে নিয়ে আসার জন্য! ইসরাত ধমক খেয়ে চোয়াল ঝুলিয়ে বসে রইল।
মোহাম্মদ চৌধুরী নুসরাতের দিকে তাকাতেই তার চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে গেল। নুসরাত নাক কুচকে চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে বাঁকিয়ে তাকে তাচ্ছিল্য করে হাসছে। নিজেকে সামলে নিয়ে মোহাম্মদ চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন আছো নুসরাত?
নুসরাত হাসল শব্দ করে।

” জি ভালো আছি! আপনি?
“এই তো ভালো! তা তুমি কি ডিপ্রেসড কোনো বিষয় নিয়ে?
নুসরাত মুখ হাসি হাসি করে বলল,
” আমি কোনো বিষয় নিয়ে ডিপ্রেসনে যাই না। আমি অলওয়েজ চিল থাকি। আমি মানুষ কে ডিপ্রেশন দেই।
চৌধুরী মোহাম্মদ বললেন,
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তুমি ডিপ্রেশনে না ভুগলে তোমার চোখের নিচ এতো কালো হলো কিভাবে?
নুসরাত থতমত খেল। ইসরাত চোখ ছোট থেকে ছোট করে নুসরাতের চোখের নিচের দিকে তাকাল। শ্যামলা হওয়ায় চোখের নিচের কালো হয়ে যাওয়া জায়গা অতোটা বুঝা যায় না। কিন্তু ভালো করে তাকালেই বুঝা যায় চোখের নিচে কিছুটা না না অনেকটা দাগ বসে গর্তে মতো হয়ে গিয়েছে।

” ওটা কিছু না! শালা আরশে ঘুমের মধ্যে চোখে মেরে দিয়েছিল তাই কালো হয়ে গিয়েছে। এমনিতেই কমে যাবে।
“দেখো নুসরাত, তুমি যদি তোমার ডিপ্রেশনে ভোগার কারণ না বলো আমরা কিভাবে বুঝব তোমার সমস্যা গুলো? আমার তো অন্তরযামী নই!
নুসরাত হে হে করে হেসে বলল,
” কীসের ডিপ্রেশন? আর আমি কি বলব? আমার বলার মতো কিছু নেই।
“নুসরাত একবার তাকিয়ে দেখো, উনি তোমার মা, তোমার বোন,আর আমি তোমার আব্বুর বন্ধু। এক প্রকার তোমার আব্বুর ভাই! সবাই তোমার আপন। তুমি বলো আমরা চেষ্টা করব তোমার সমস্যা সমাধানের।
নুসরাত শরীর ছেড়ে দিয়ে বসে রইল। মোহাম্মদের চৌধুরী দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,

” সমস্যা থাকলে তো সমস্যার সমাধান করবেন। আমার কোনো সমস্যা নেই?
মোহাম্মদ চৌধুরী হাল ছাড়লেন না। নুসরাতের দিকে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর গলায় বললেন,
“আপা আর ইসরাত বাহিরে অপেক্ষা করুন। ঠিক এক ঘন্টা পরে আপনারা ভিতরে ঢুকবেন।
ইসরাত ঝটপট উঠে দাঁড়াল। নাজমিন বেগম কে টেনে নিয়ে বের হয়ে গেল। নুসরাত কে মোহাম্মদ চৌধুরী বললেন,” একটা গেইম খেলবে নুসরাত। জিতলে তুমি যা চাইবে তাই দিব। হারলে আমি যা চাইব তা দিতে হবে?
নুসরাত যা চাইবে তা পাওয়ার আশায় রাজী হলো। কিন্তু, মনে খুঁত খুঁত থেকে গেল। কিছুটা সন্দেহ নিয়ে চেয়ারে সুন্দর হয়ে বসল।
মোহাম্মদ চৌধুরী হাতে গোল চক্র টাইপ কিছু নিলেন। নুসরাত কে দেখিয়ে বললেন, “এটার দিকে এক মিনিট চোখের পাতা না ফেলে তুমি তাকিয়ে তাকতে পারলে এই গেইমের উইনার তুমি? না পারলে তুমি লোজার!
নুসরাত আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল,

” আরে, এটাতে তো আমি পারদর্শী। আপনি হারবেন পাগ… আই মিন আঙ্কেল।
চৌধুরী মোহাম্মদ হাতে চক্র রেখে নুসরাতের চোখের সামনে রাখলেন। ঘড়ির টিক টিক শব্দ কানে ভাজছে।নীরবতা ভেদ করে ঠান্ডা শীতল বাতাস প্রবেশ করল কেবিনের ভিতর।
প্রায় ২০ সেকেন্ড পার হওয়ার পর নুসরাতের হঠাৎ মনে হলো আঙ্কেল থাকে সামান্য একটা কালার কালার চক্রের দিকে এক মিনিট তাকানোর জন্য যা চাইবে তাই দিবেন। এটা তো সন্দেহ জনক। এখানে নিশ্চই কোনো ঘাঁপলা আছে? নুসরাত গাঁধির মতো চক্রের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবতে লাগল। কানের মাঝে বাজতে লাগল শুধু টিক টিক ঘড়ির শব্দ। শরীর ছুঁয়ে গেল ঠান্ডা হিমেল বাতাসের ছোয়া। নুসরাত যতক্ষণে বুঝতে পারল, লোকটা তাকে সম্মোহন করার জন্য ফাঁদ পেতেছে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। নুসরাত নড়চড় করার চেষ্টা করল কিন্তু চক্রের দিকে তাকিয়ে তাকতে তাকতে শরীর অসাড় হয়ে চেয়ারের উপর ঢলে পরল।

নুসরাত কে সুন্দর করে রকিং চেয়ারে বসিয়ে দিলেন মোহাম্মদ চৌধুরী। হাতের চক্র চোখের সামনে গুরাতে গুরাতে জিজ্ঞেস করলেন, “নুসরাত তুমি ঠিক আছো?
নুসরাত প্রথমবার কোনো রেসপন্স করল না। চৌধুরী মোহাম্মদ ধৈর্য্য হারালেন না। নুসরাত কে আবার জিজ্ঞেস করলেন।
নুসরাত এবার ধীরে ধীরে বলল, “আমি ঠিক আছি।
চৌধুরী মোহাম্মদ জিজ্ঞেস করলেন,
” তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?
নুসরাত ধীরে ধীরে বলল,
“হ্যাঁ!
” তুমি কি কোনো কারণে ডিপ্রেশনে ভোগছ?
নুসরাত প্রচুর সময় নিল এর উত্তর দিতে। বার বার আটকে গেল বলতে গিয়ে। অবচেতন হওয়ায় মস্তিষ্ক জং ধরে থাকা কথা গুলো বলতে গিয়ে গলা ভেঙে গেল।
মোহাম্মদ চৌধুরীর ওই কথার উত্তর না দিয়ে আরেকটা কথা ধীরে ধীরে বলল, “সাল মেবি আট নয় হবে। আমার ঠিক মনে নেই! তখন বয়স কত ছিল?
চৌধুরী মোহাম্মদ ভেবে বললেন,

” উমম, পাঁচ, ছয় ছিল!
নুসরাত মনে হওয়ার মতো বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ পাঁচ ছিল। আমি খুবই শান্ত ছিলাম। চুপচাপ নিজের মতো থাকতাম। আরশ মেবি ও শুধু আমার সাথে ঝগড়া আর মারামারি করত। কিন্তু আমি ওর ঝগড়া আর মারামারির বিপরীতে কোনো দিন প্রতিবাদ করিনি। প্রতিবাদ করব কিভাবে? কারোর তো আমার কথা শোনার সময়ই ছিল না। সবাই সবার কাজে বিজি ছিল।
নুসরাতের গলা এবার কিছুটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল।
” জায়িন ভাইয়া, উনি যখন হঠাৎ হঠাৎ আমাকে মারতে দেখতেন তখন দু-একটা বেত দিয়ে বারি দিতেন আরশ কে। যাক গে এসব কথা! এসব অনেক পুরোনো। এসব ভুলে গিয়েছি আমি।

তো আমার বড় বোনের জন্ম হয়েছিল তখন নাকি ও অনেক বেশি মায়াবী সাথে সুন্দর ছিল? সবাই তো সৈয়দ বাড়ির সবথেকে সুন্দর বাচ্চা বলতো ওকে। আমার জন্মের সময় নাকি সবাই আশা করেছিল নাছিরের ছেলে হবে। দেখুন ভাগ্য! তাদের আশায় পানি ঢেলে আমি জন্ম নিয়ে নিয়েছি। এটা ও কি আমার দোষ?
আচ্ছা তারা মেনে নিল নাছিরের দুই মেয়ে হয়েছে কিন্তু যখন আমার ফুফু আর দাদিরা আমাকে দেখতে আসলো তখন নাকি নাক ছিটকাল,আমি কালো বলে। মুখ চোখ বিকৃত করে বলল, “এ্যা ছি কি বিচ্ছিড়ি দেখতে হয়েছে মেজ ভাইয়ের মেয়ে। এটা আমি নানু বাড়ি থেকে শুনেছি। আমার নানু নাকি হা করে তাকিয়ে ছিলেন তাদের দিকে। একটা নবজাতক কে তারা কিসব বলছে?আমার দাদি নাক মুখ উলটে ওয়াক ওয়াক করে বমি করার মতো করে রুম থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন।

এসব ও আমি ভুলে গেলাম। আমার বয়স তখন নয় পেরিয়ে দশ। মাহমুদা আসলেন উনার স্বামীর সাথে। ইসরাতের সাথে আমাকে দাঁড় করালেন। তখন আরেকটু রং আমার ময়লা হয়েছে রোদে পুড়ে। উনার স্বামীকে দেখিয়ে বললেন,”দেখো সরওয়ার, নুসরাত কে ইসরাতের পাশে অমবস্যার চাঁদের মতো মনে হচ্ছে না।
আমি শুধু হা হয়ে তাকিয়ে দেখেছি শুধু মাহমুদার ওই-দিনের হাসি। আমি নিরুপায় ছিলাম! ওখানে থাকা আমার দাদা মেয়েকে কিছু না বলে মেয়ের সাথে তাল দিয়ে হে হে করে হেসেছেন।
যেখান থেকে বাবার সাইডের রিলেটিভ আসতো বলতো,”নাছির তোমার বড় মেয়ের তো ভালো ঘরে বিয়ে হয়ে যাবে এর কি করবে? এমনিতে তো রঙ ময়লা তার উপর গঠন ভালো না।
তখন বাবাকে দেখতাম মুখ কালো করে আমার দিকে তাকিয়ে তাকতে। তারপর চুপ করে কিছুক্ষণ থেকে বলতেন,” আল্লাহর সৃষ্টি, আল্লাহ ওকে বানিয়েছেন ওর সাথে জোর ও মিলিয়ে বানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর হুকুম হলে এমনিতেই বিয়ে হবে। আর নাহলে না হবে!

বলে উঠে চলে যেতেন। সবাইকে এরকম প্রশ্নের বিপরীতে এই উত্তর দিতেন এরপর চুপ করে উঠে যেতেন। উনি যদি ওই সময় সঠিক জবাব দিতেন তাহলে তো আর এই কথা ওরা বলত না। উনারা পশ্রয় দিতেন বলেই ওরা পশ্র‍য় পেত। এদের বিন্দুমাত্র লজ্জা ছিল না। একটা নয় বছরের বাচ্চার সামনে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলতে তাদের মুখে বাঁধতো না। তারা বুঝতো না যে এটা একটা বাচ্চার মাথার মধ্যে কিরুপ আঘাত আনতে পারবে।
আমার কাছে মনে হতো এরা আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতো না আসতো আমাকে নিয়ে হাসার জন্য। ইসরাতের পাশে দাঁড় করিয়ে যোগ্য অযোগ্যের কথা বলার জন্য। আমাকে জাজ করার জন্য।
আমি মেনে নিয়েছিলাম আমার রঙ কালো। আল্লাহ আমাকে রঙ কালো দিয়েছে তাতে আমার দোষটা কি? আল্লাহর কাছে আমি সুন্দর ছিলাম তাই তিনি আমাকে ভালোবেসে এটা দিয়েছেন। অন্যের এতো পেটে ব্যাথা কেন আমার রঙ নিয়ে?

দ্যা গ্রেট মেহেরুন নেছা মায়া তো আমাকে দেখতেই পারতেন না। আমি ছিলাম উনার দুই চোখের বিষ। উনার আশে-পাশে গেলেই দূর ছাই করতেন। যাই বলি আর তাই বলি, উনার কিন্তু ইসরাতের জন্য অনেক ভালোবাসা ছিল। মানুষ দেখলেই বলতো ইসরাতকে দেখতে সেম উনার মতো। তখন বুড়ি প্রচুর খুশি হতো। আর দাঁত কেলিয়ে হেহে করে হাসত।
বুড়ির বড় মেয়ে লুৎফা বেগম ও কম যেত না। ইসরাতের জন্য অনেক ভালোবাসা ছিল আর আমাকে দেখলেই চ্যাত করে উঠতো মনে হতো ওর পিত্তি জ্বলে উঠছে।

একবার কি হয়েছিল ঠিক মনে নেই? কিন্তু ওখানে দোষটা ইসরাতের আর আরশের ছিল। আমি দু-তলার বারান্দা থেকে দেখেছিলাম উনি ইসরাতদের সাথে ছিলেন। আমি ওখান থেকে সরে আসার পরে কি হয়েছিল? আমি জানি না! বুড়ি সব দোষ আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছিল। সেদিন নাছির মিয়া আমাকে এক থাপ্পড় মেরেছিলেন যে দু-দিন জ্বরে ভুগে ছিলাম। আমি এখনো ভেবে পাই না আমার দোষটা কি ছিল ওখানে?

বুড়ি আমার আর ইসরাতের সৌর্ন্দয্য দিয়ে সব সময় তোলনা করত। আমার তখন কান্না আসতো। তবুও কাঁদতাম না। কারণ আমার স্ট্রং হতে হবে। মানুষের থেকে সহানুভূতি নেওয়া বন্ধ করলাম। ধীরে ধীরে এদের থেকে নিজের দূরত্ব বাড়ালাম। নিজের দুঃখ লুকাতে শুরু করলাম। দুঃখ প্রকাশ করা বন্ধ করে দিলাম। আমার দুঃখ মানুষ কে দেখিয়ে কি লাভ? মানুষ মজা নিবে! কথা বলা বাড়িয়ে দিলাম। মুখে মুখে তর্ক করতে লাগলাম। কার কার কেমন লাগল তা আমি দেখা বন্ধ করে দিলাম? আমাকে অপমান করবি তুই তার বদলে আমি দ্বিগুণ অপমান ফিরিয়ে দিব তোকে? পিছনে কথা বলা বাঁধ দিলাম,মুখের উপর ইন্সাল্ট করার ক্ষমতা রাখতে শুরু করলাম।
লুৎফার একবার বলেছিলেন,

“দিন দিন এর গঠন মরে যাচ্ছে? আমার মমো কত সুন্দর?
আমি বলেছিলাম, তোমার মেয়ে সুন্দর হয়ে কি করবে? একে তো সাদা রঙ, কোনো গঠন নেই, তার উপর আবার মুটকি। এর তোর আমার থেকে আরো খারাপ অবস্থা।
সেদিন লুৎফা বেগমের মুখ কিরকম হয়েছিল বলার মতো না? আমার প্রচুর আনন্দ লেগেছিল। ভিতরে ভিতরে আমি খুশিতে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছি। জীবনে প্রথম বার কথা ফিরিয়ে দিয়ে আমি বিজয়ী হওয়ার মতো আনন্দ পেয়েছিলাম মানুষের দুঃখ দেখিয়ে সহানুভূতি নেওয়া আমার কাছে বিরক্তিকর মনে হতো। কিছু মেয়েরা আছে না, কিছু হলেই প্যা প্যা করে কান্না করে। এদের দেখলে আমার সহ্য হয় না। হাত নিষ পিষ করে পিটানোর জন্য। তুই শালি কাঁদবি কেন? আমি কাঁদি! আমার এতো কষ্ট আমি কখনো কাঁদি? আমার কান্না আসে না! আসলে ও আমি ওটাকে চোখের ভিতরে আটকে দেই। বার বার নিষেধ করি বের হবি না। হলে তোকে মেরে ফেলব।
আমি গত বারো বছরে এই ঘাঁ টা আমি কাটিয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু, বলতে গিয়ে নুসরাতের চোখের কোণ ঘেঁষে পানির ফোয়ারা বের হয়ে আসলো। অবচেতন মনে কান্না করতে গিয়ে বার বার কান্না থামানোর চেষ্টা করল।
মোহাম্মদ চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন,

“তারপর কি হয়েছে?
ছয় মাস আগে আরশের বাচ্চা আবার সেই রঙ নিয়ে কথা বলল। আমাকে কে বিয়ে করবে,আমি নাকি তার পায়ের যোগ্য নই এসব নিয়ে কথা বলল? আমি শুধু ওইদিন তাকিয়ে থেকেছি ওর দিকে। একটা মানুষ কিভাবে অন্যের রঙ নিয়ে খোটা দিতে পারে তা সৈয়দ বাড়ির মানুষ ভালোই জানে? পুরোনো ঘা তাজা করার জন্য আরশকে আমার ইচ্ছা হচ্ছিল ওই জায়গায় মেরে ফেলি। আমি নিজের হাত কোনো রকম থামিয়েছি। নাহলে ওই দিন আরশের বুক ছুড়ির আঘাতে রক্তাক্ত হতো। এতে কিন্তু আমার কোনো দোষ থাকতো না। সব দোষ থাকতো ওই আরশের। আমি সেদিন সারারাত ভেবেছি কি করা যায়? একবার ভেবেছিলাম ঘুমের মধ্যে পাঠিয়ে দেই আল্লাহর বাড়ি কিন্তু পরে প্ল্যান চেঞ্জ করে নিয়ে বিয়ে করে নিলাম।বলেছিল না বিয়ে হবে না, যে বলেছে থাকেই বিয়েটা করেছি। আমার ডিপ্রেশনের কারণ ওই বেটা আরশ। শালা আমার জীবনের সব শান্তি হারাম করে দিয়েছে।আমি ওকে ছাড়ব না।

আর আমার এই ছোট্ট জীবনে আমি সব থেকে বেশি ঘৃণা করি ওই বেটি মেহেরুন নেছা, ওর বলদা দুইটা মেয়েকে। এদের দেখলেই আমার ইচ্ছা করে পিটিয়ে ছাল তুলে ফেলি। এরা আমার জীবন তছনছ করে দিয়েছে। এদের আমি ঘৃণা করি এবং যতদিন আমি বেঁচে আছি আমি ঘৃণা করব।
নুসরাত কিছুটা এবার উত্তেজিত হলো। টেনে শ্বাস ফেলল। কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। শরীর ছেড়ে দিল, চেয়ারের উপর। চোখ বেয়ে পানি পরা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে বের হওয়া পানি গুলোর রেশ রয়ে গেছে গালের উপর।
মোহাম্মদ চৌধুরীর পারমিশন দিতেই আরশ এসে কেবিনে ঢুকল। নুসরাতের হাঁটুর নিচে হাত ঢুকিয়ে পাজো কোলে তুলে নিল। বুকের সাথে মাথা চেপে ধরে চোখের পানি মোছার চেষ্টা করে অগ্রসর হলো কেবিনের বাহিরে যাওয়ার জন্য। পিছন থেকে মোহাম্মদ চৌধুরী ডেকে উঠলেন।

“আরশ….
আরশ ফিরে তাকাল না। মোহাম্মদ চৌধুরী বললেন,
” সবই শুনলে! ওর খেয়াল রেখো। আর মাথায় কোনো বিষয় নিয়ে চাপ না নেয় সেদিকে খেয়াল রেখো। ওর কিন্তু তোমার উপর অনেক অভিযোগ। অভিযোগ গুলো একদিন বসে জানার চেষ্টা করো। আর ওকে মানুষিক ভাবে ট্রমাটাইজ করো না। একবার যে ভুল করেছ আশা করি আর সেই ভুল ফিরে করবে না। আর অনেক কথা কিন্তু নুসরাত পেটের ভিতর লুকিয়ে রেখেছে খুলে বলেনি।
আরশ সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৫৩

“আপনি কিভাবে বুঝলেন?
” আমি কিন্তু এর আগেও অনেক কে সম্মোহন করেছি। নুসরাত অনেক কথাই বলেনি। অবচেতন হলে কি হবে? নিজের অবচেতন মস্তিষ্ক ওকে অনেক কথা বাহিরে বের করতে দেয়নি। ভিতরে চেপে রেখেছে।
আরশ কথা না বলে বড় বড় পা ফেলে দরজার বাহিরে বেড়িয়ে গেল। মোহাম্মদ চৌধুরী বিড়বিড় করে বললেন, “গড ব্লেস দেই।

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৫৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here