প্রিয়কাহন পর্ব ২৩

প্রিয়কাহন পর্ব ২৩
লেখিকা – কায়ানাত আফরিন

ম্লান বিকেল। বেবিট্যাক্সিতে বসে আছে প্রিয়তা। তা ঝিমুচ্ছে আর এগোচ্ছে। পাশে অভী নীরব, নির্বিকার৷ তার উথাল-পাতাল ঢেউ খেলানো মনে এখন কি চলছে তা প্রিয়তার অজানা। তবে প্রিয়তার মন প্রশ্নে জর্জরিত। কি করতে চাইছে অভী? প্রিয়তা তা তো কথামতো গুটিয়েই ফেলেছে নিজেকে যাতে পরবর্তীতে কষ্ট না পায়। তন্মধ্যেই বেবিট্যাক্সি ছাড়িয়ে গেলো শহরতলি। এবার অভী সচকিত হলো। যেন এটারই অপেক্ষায় ছিলো। গাম্ভীর্য টেনে ধরানো গলায় বললো,

‘ কি হয়েছে তোমার?’
প্রিয়তা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। বললো,
‘ আমার আর কি হবে? আই’ম টোটালি ফ্রি এন্ড ফাইন। মেয়ে হয়ে জন্মেছি তো, প্রথম থেকেই কম্প্রোমাইজ করা শিখাচ্ছে পরিবার। এখনও সেটা ধরে রেখেছি।’
‘ এসব ফিলোসোফিক্যাল কথা বলে আমায় ভং চং বুঝাবে না৷ মোবাইলের কল লিস্ট চেক করো তুমি। দেখেছো বিগত কয়েকদিনে কয়টা কল দিয়েছি?’
‘ কেন কল দিবেন আপনি আমায়?’
নিজের রূঢ় গলায় নিজেই সচকিত হলো প্রিয়তা। এর আগে নিজেকে বাহ্বা দিলেও এখন তাকে কিছু বলাতে নিজেরই কষ্ট লাগে। তবুও নিজের প্রতিমূর্তি বহাল রাখলো সে। বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ যদি ভেবে থাকেন সে সেদিনকার বিকেলে আপনার বাবার কথার জন্য আমায় এক্সপ্লেনেশন দেওয়া উচিত তাহলে ভুল ভাবছেন। যেখানে আমার পরিবার বিয়ের সময় আর বিয়ে স্থগিত রাখার সময় – এ দু’ মুহূর্তেই আমার মত নিলো না সেদিকে আমার মতো তুচ্ছ একজনের কাছে আপনার সাফাই না দিলেও চলবে।’
রোদ্দুরের শেষ রশ্নিটা আছড়ে পড়ছে ট্যাক্সির ভেতর। কাচ নামিয়ে রাখায় শো শো করে এসে হানা দিতে থাকলো শীতল, স্নিগ্ধ বাতাস। অভী পুরোপুরি মাথা ঘুরিয়ে অবলোকন করলো প্রিয়তাকে। প্রিয়তার ভঙ্গি ঋজু, মুখ নত। আর সেই নত মুখের ব্যার্থভাবে লুকানো চোখজোড়ায় চিকচিক করছে বিন্দু বিন্দু পানি৷ কোনোভাবেই সেটা সে যেন আড়াল করতে পারেনি। প্রিয়তাকে কাঁদতে দেখেনি অভী, কখনোই না। আর আজ তার চোখে যখন অশ্রু হাতছানি দিলো তা যেন বিদ্ধ করলো অভীকে। সামনে ট্যাক্সিচালক নিজের আনন্দেই গাড়ি চালাচ্ছে। রিক্সাচালক আর ট্যাক্সিড্রাইভার- এ দু’জাতির মানুষের মাঝেই কোনো ভাবান্তর হওয়ার বৈশিষ্ট্য নেই। তাদের পেছনে অজস্র মানুষ বসে, বৈচিত্র্যময় নানা কথা বলে। শুরুতে তাদের আগ্রহ থাকলেও পরে তারা আগ্রহ হারায়৷ গাড়ি চালায় আস্ত রক্তমাংসে গড়া রোবটের মতো করে।
অভী তাই আর কোনো দ্বিধা রাখলো না৷ প্রিয়তার দিকে পুনরায় ফিরে সম্ভিত গলায় বললো,

‘ তুমি কি কোনোভাবে আমার যাওয়াতে খুশি না প্রিয়তা?’
সরাসরি প্রশ্ন অভীর। প্রিয়তা ভাবতে পারেনি অভী এভাবে সরাসরিই তাকে প্রশ্ন ছুঁড়বে। তাই কিছুটা অবাক হলো। দৃষ্টি পথে নিবদ্ধ করে বললো,
‘ আমার খুশি অখুশি বেশি গুরুত্ব বহন করে না৷ গুরুত্ব বহন করে আপনার ক্যারিয়ার,আপনার ইচ্ছে। আর আপনি খুবই ভাগ্যবান যে ইউএসএ থেকে জব এক্সেপ্টেন্স লেটার পেয়েছেন। দু’দিন বাদে ভার্জিনিয়া চলে যাবেন, আসবেন কয়েক বছর পর। তারপর এরমধ্যে কোনো বিদেশিনীর সাথে সম্পর্কে থাকলেও কেউ বুঝবে না। আর দেশে তো আমি রেডি আছিই- এসব ভাবছেন না?’
অভী যেন স্তব্ধ হয়ে গেলো। প্রিয়তা যে ব্যাপারটা এতটা গভীরভাবে নিবে জানলে কখনোই আগাতো না সে ওদিকে। জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিলো সে তপ্ত ঠোঁট। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। মন খারাপ হলে কি সবারই এমন হয়? অভীর তা জানা নেই। অভী ভানিতা করলো না। সরাসরিই বললো,

‘ আমার যাওয়াতে যদি কোনো আপত্তি থাকে বলো আমায়। আমি তাহলে যাবো না৷ এখানেই আবার নিজের কোনো একটা ঠাই খুঁজে নিবো।’
বাধঁ ভাঙলো প্রিয়তার। সত্যি সত্যিই চোখ দিয়ে অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। অভীকে মাঝে মধ্যে পাষাণ মনে হয়৷ ভীষণ পাষাণ। ইচ্ছে করে কষ্ট দেয় প্রিয়তাকে। প্রিয়তা চাপা গলায় বললো,

‘ আমার আপত্তিকে আপনি যদি এতই গুরুত্ব দিতেন তবে আমায় একটিবার হলেও জানাতেন যে আপনি ইউএসএ তে জবের জন্য এপ্লাই করছেন। অথচ কি করলেন? এক্সেপ্টেন্স লেটার পাওয়ার পর এসে বললেন ব্যাপারটা আমাদের হাতে। অথচ কেউ কি একটা বারও জানতে চেয়েছিলো যে আমি কি চাই? আমার মতামত কি? না কেউ জানতে চায়নি৷ সবাই শুধু নিজের ভালোমন্দ ইচ্ছা অনিচ্ছাই আমার ওপর আরোপ করতে লাগলো। এখন আপনার কাছে আমার এসব বলে কি লাভ? আমি হলাম কাঠের পুতুল। যে যেভাবে নাচাবে- সেভাবেই নাচবো। আপনি চলে যেতে চান না? চলে যান, আমি কি চাই না চাই বিন্দুমাত্র ভাবতে হবে না। চিন্তা নেই আপনাকে ঠকাবো না। তবে আপনি যদি পরিস্থিতির কবলে পড়ে আমায় ঠকান তবে আমি সেটা আমার দুর্ভাগ্য মনে করবো। আপনি নির্দ্বিধায় চলে যেতে পারেন কোনো পিছুটান ছাড়া।”

তারপর প্রিয়তা নীরব। ট্যাক্সি এগোচ্ছে নিজের চলমান ধারায়। পথও ম্লান। শুধু শোনা যাচ্ছে ইন্জিনের ঘ্যাড় ঘ্যাড় শব্দ। অভীর কাছে প্রিয়তার প্রতিটা বাক্য ভারী শোনালো। এত ভারী যে সে ভার বইতে পারবে না বুকে বিদ্ধ করা এক টন স্বরুপ প্রতিটা শব্দ। অভী নিনির্মেষে বললো,
‘ সুযোগটা আমায় কাছে এসেছিলো তোমার সাথে সবকিছু হয়ে ওঠার আগে। তাই তখন এপ্লাই করেছিলাম। জব এপ্লাই না, ওখানে মাস তিনেকের একটা ট্রেনিং নিবো তার এপ্লাই। তবে আমার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়াতে সিজিপিএ দেখে তারাই আমায় অফার করলো। তাই ভুল বুঝো না প্রিয়তা৷ তোমার অভী এতটাও অনুভূতিহীন না যে এভাবেই স্বার্থপরের মতো তার মায়ারাণীকে ছেড়ে স্বপ্নরাজ্যে পাড়ি জমাবে।’

শেষ কথা শুনে কেঁপে উঠলো প্রিয়তা। হ্যাঁ কেঁপে উঠলো। অভীর মতো গুমোট স্বভাবের মানুষও যে প্রেম নামক অনুভূতিতে কতটা সিক্ত হতে পারে আজ আরও একবার তা ধারনা হলো। তার আচার আচরণ সবকিছুতেই মুগ্ধতা। মুহূর্তে মুহূর্তে মুগ্ধ হতে মন চায়। অতঃপর প্রিয়তা নীরবই রইলো। কেটে গেলো সময়। অভী গেলো না প্রিয়তাকে দিয়ে আসতে। বরং নেমে গেলো। ড্রাইভারকে বললো দিয়ে আসতে। তারপর আর কোনো কথা হলো না দুজনের৷ তবে অভীর চোখ স্পষ্ট বলে দিলো অন্যপন্থা নিবে সে। প্রিয়তাকে নিয়ে আর অনিশ্চয়তায় থাকবে না।

সকালটা রোজই সুন্দর হয়। চনমনে রোদ উঠলো সেই সুন্দরটা যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। দুদিন জ্বরে জ্বরেই দিন পার হয়েছিলো প্রিয়তার। জ্বরটা কেনো হলো, কিসের সংস্পর্শে হলো- তা সে নিজেও জানেনা। বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে আকাশে মেঘের খেলা দেখতো শুধু। মা আসতো, একটু খাইয়ে দিতো, বাবা আর বড় আব্বু খোঁজখবর নিতো এসে এই ব্যাস। জ্বর কেটেছে গতসকাল। এখন মোটামুটি সুস্থ হলেও আজব এক কারনে কেউ ওকে রুম থেকে বের হতে দিচ্ছে না গতকাল থেকে। নিচে মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে হট্টগোল। মানুষদের কথাবার্তা মনে প্রশ্ন আনলেও রুদ্র অদ্রি আর অরিন মিলে যেসব কথা সাজিয়ে গুছিয়ে শোনাচ্ছে সেগুলো বিশ্বাসযোগ্য না হলেও মেনে নেয়।

আজ সকালে উঠে নিজের ঘরে সকল ভাইবোনদের দেখে সে বিস্ময়ে ছেয়ে গেলো। রুদ্র আজ সাদা পান্জাবি পড়েছে। বাকি সবারও রমরমা ভাব৷ প্রিয়তা ভড়কে গেলো। ঘুম থেকে উঠে এমন দৃশ্য অবাক না হয়ে পারলো না৷ অপ্রস্তুত কন্ঠে বললো,
‘ কি হয়েছে তোদের? সব ঠিক আছে তো?”
অদ্রি কথা না বলে একটা ছোট ব্যাগ রাখলো খাটে। ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
‘ এখানে তোর যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস আছে। ফ্রেশ হয়ে পড়ে নে। আজ বিয়ে পড়াবে তোর আর অভী ভাইয়ার। নিচে সব আত্নীয়স্বজনরা আছে।’

প্রিয়কাহন পর্ব ২২

জীবনে এতটা বিস্ময়ের শিকার প্রিয়তা কখনও হয়নি আজ যতটা হলো। মনে পড়লো দুদিন আগের সেই প্রিয় মানুষটার মুখের অবয়ব। বিয়ে, আর আজ? অতিকাঙ্খিত জিনিস কখনও কি অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া যায়? চোখমুখ চকচক করছে অদ্রির। স্পষ্ট বোঝা যায় এর পুরো ঘটনাই তার নখদর্পনে। বলে উঠলো,
‘ তুইও ইউএসএ চলে যাবি রে! খুশিতে আমার নাচতে মন চাচ্ছে। এখন মোবাইল একটু চেক কর।অভী ভাইয়া তোকে কি যেন মেসেজ পাঠিয়েছে। উঠ ছেড়ি জলদি উঠ!’

প্রিয়কাহন শেষ পর্ব