প্রেমপিপাসা পর্ব ১৩

প্রেমপিপাসা পর্ব ১৩
সুমাইয়া সুলতানা

অন্ধকারে নিমজ্জিত একটি অচেনা জায়গা, যেখানে গোডাউনের বিশালাকার লোহার দরজাগুলো ক্রমাগত ভাঙাচোরা দেখাচ্ছে। বাইরে সূর্যের কি প্রখর দীপ্তি অথচ বিশালকার গোডাউন ঠিক ততটাই তিমিরে ঢাকা। প্রবেশমুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ব্যবহৃত প্লাস্টিক, ভাঙা কাঠ আর ধূলার স্তূপ। গোডাউনের আশেপাশের পরিবেশ যেন এক পুঞ্জীভূত অবহেলা ও অপরাধের প্রতীক। দূরে থেকে এটি নিছক পুরনো এক কারখানা বলে মনে হলেও, গভীরে লুকিয়ে আছে মাদক ও অস্ত্রের ভান্ডার। সেখানে ত্রাস আর লোভের দুনিয়া রাজত্ব করে।

গোডাউনের ভেতরে ট্রাকটি প্রবেশ করার সময় এর ইঞ্জিনের গুরুগুরু শব্দ আশেপাশের নীরবতাকে খানিকটা ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। তবে সে শব্দের সাথে পরিচিত দলের লোকেরা তাড়াহুড়ো করে মাল নামানোর কাজে লিপ্ত হয়। গোডাউনের মধ্যে ভাঙাচোরা কাঠের বাক্সের পাশে দাঁড়িয়ে লোকেরা দ্রুত হাতে মাল নামাতে ব্যস্ত। ট্রাকটির গায়ে কালচে দাগ আর ক্ষতচিহ্ন এর অনেক দিনের অবৈধ অভিযানের সাক্ষ্য বহন করে। ট্রাকের ওপর বেঁধে রাখা মোটা ত্রিপল সরিয়ে যখন মাল নামানো শুরু হয়, তখন দেখা যায় সেগুলোতে প্যাকেট করা অস্ত্র আর হেরোইন, যা শীতল ভয় জাগায়। জনসাধারণ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তখন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

গোডাউনের অভ্যন্তরে অসংখ্য ধুলো জমা কাঠের বাক্স, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোহা, এবং পুরনো প্লাস্টিকের ড্রাম যেন অপরাধের চিহ্ন বহন করে। দেয়ালে দাগ, ছোপ, আর পচনশীল গন্ধ মিশ্রিত এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। সেখানকার বাতাসে নিকোটিনের বিষাক্ত ধোঁয়ার স্তর যেন গোটা জায়গাটিকে অশুভ এক আবহে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
গোডাউনের মালিক, যাকে বস বলে সম্বোধন করা হয়, যখন প্রবেশ করলেন, তখন তার চলন বলন আর চোখের দৃষ্টি এক অদ্ভুত ঠান্ডা এবং শয়তানি মনোভাব প্রকাশ করে। তার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা আধভাঙা সিগারেট থেকে নির্গত ধোঁয়া পুরো পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলছিল। উপস্থিতি শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের ভয় এবং সম্মানের সংমিশ্রণে কাজ করার তাগিদ সৃষ্টি করল।
বস ধীর পায়ে কর্মরতদের দিকে এগিয়ে গিয়ে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,

” মাল সব ঠিকঠাক? কেউ সন্দেহ করেনি তো?”
তার প্রশ্নে স্পষ্ট ছিল সন্দেহের গন্ধ, যদিও সে নিজেই জানে তার পুরো অপরাধ চক্র নিখুঁত। এক লোক মাথা নিচু করে বিনয়ের সুরে উত্তর দিল,
” না বস, কেউ সন্দেহ করে নি। মাল সব ঠিক আছে। কেউ দেখলে কি নিয়ে আসতে পারতাম?”
এমন দৃশ্যে বসের মুখে এক চিলতে স্নায়ুহীন হাসি ফুটে উঠল, যা তার শয়তানি মনোভাবের আরেকটি প্রমাণ। গোডাউনের প্রতিটি কোণ তার অপরাধের ক্ষমতাকে নীরবে সম্মান জানায়। পরিবেশ, পরিস্থিতি, এবং তাদের কর্মকাণ্ড এক গভীর ষড়যন্ত্রের দিকেই নির্দেশ করে। এ এক এমন জগৎ, যেখানে লোভ, ভয়, আর নিষ্ঠুরতা একত্রে মিলিত হয়েছে।

একজন একটি ভারী প্যাকেট নামিয়ে গোডাউনের ভেতর দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল। লোকটার দিকে বস এগিয়ে যায়। সরু চোখে চেয়ে আদেশ ছুঁড়ে বলে,
” শোন, মাল সব জায়গায় মতো রেখে লুকিয়ে রাখবি। একটু এদিক-ওদিক হলে খবর আছে। গতবারের মতো ভুল হলে তোদের কপালে দুঃখ আছে। তোদের বোকামির জন্য আমার কতগুলো টাকা জলে গিয়েছিল! ”
দলের লোক মাথা নেড়ে বলল,
” জি বস, চিন্তা করবেন না। এইবার কোনো ঝামেলা হবে না। সব জায়গায় লোক আছে আমাদের। কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পাবে না। ”
আরেকজন লোক প্যাকেটগুলো নামিয়ে এক পাশে দাঁড়াল। মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলল,
” বস, মালগুলো খুব ভালো করে প্যাক করা। ভেতর থেকে কিছু বোঝার কোনো সুযোগ নেই। এবার পার্টি থেকে বেশ বড় টাকার অর্ডার এসেছে। সময়মতো পাঠিয়ে দিলে তারা আরও কাজ দেবে।”
বস সিগারেটের শেষ অংশটি ছুঁড়ে ফেলে পায়ের নিচে পিষে নিলো। ক্রূর দৃষ্টি তাক করল। অতঃপর গলা নীচু করে উত্তর দেয়,

” অর্ডার বড়ো হলে সমস্যা বড়ো হয়। পুলিশ আর পার্টির লোকজনের ফাঁকফোকর ঠিক মতো সামলাতে হবে। ঝামেলা হলে তোরা কেউ রেহাই পাবি না। বুঝলি? ”
লোকগুলো একসঙ্গে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। দলের আরেকজন লোক, বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ, গোডাউনের কোণ থেকে এগিয়ে এসে সিরিয়াস ভঙ্গিতে জানায়,
” এবার আমাদের রুট বদলানো দরকার। আগের রুটে দুবার তল্লাশি হয়েছে। নতুন গাড়ি আর নতুন চালক দরকার হবে। ”
বস গভীর দৃষ্টিতে তরুণের দিকে কিছুক্ষণ চাইল। ঠোঁটের কোণে একটা ক্ষীণ হাসি ফুটে ওঠে। কূটনৈতিক মনোভাব প্রকাশ করে বলে,

” তুই ভালো বলেছিস। কিন্তু এই কাজ আমি বিশ্বাসী লোক ছাড়া অন্য কাউকে দিই না। রুট নিয়ে ভাবতে হবে। তোরা এখন কাজ শেষ কর, বাকি কথা পরে হবে। ”
এরপর বস পকেট থেকে ফোন বের করে কোথাও কল করল। তার নিচু স্বরে কথাগুলো দলের লোকদের নিকট কান পর্যন্ত না গেলেও, তার চোখে-মুখে স্পষ্ট ছিল পরিকল্পনার এক গভীর চিহ্ন। গোডাউনের ভেতরের কর্মচাঞ্চল্য থেমে ছিল না। সেই নীরবতায় সিগারেটের ধোঁয়া আর শয়তানি পরিকল্পনা একসাথে মিশে যাচ্ছিল।

ভার্সিটি শেষ হয়ে গিয়েছে অনেক আগে। প্রাইভেট পড়ায় আজ কিছুটা লেট হয়েছে। ক্যাম্পাসের চায়ের দোকানে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে অঙ্কিতা। ক্ষুধা পেয়েছিল, তাই হালকা শুকনো খাবার খাওয়ার জন্য এখানে এসেছে। এই সময়টা উন্মুক্ত আকাশ দেখতে বেশ মনোমুগ্ধকর লাগে। অঙ্কিতা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে প্রকৃতির সেই সুন্দর দৃশ্যপট উপভোগ করছে। দোকানের ছাউনি থেকে গাছের ঝরে যাওয়া পাতা মৃদুমন্দ বাতাসের দাপটে ভূমিতে পড়ছে।
অঙ্কিতা যখন আপন ছন্দে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, তখন সায়র সেখানে এসে হাজির হয়। একদম অঙ্কিতার পাশে গিয়ে গা ঘেঁষে বসে পড়ল। অঙ্কিতা চকিতে তাকাল। তৎক্ষনাৎ ছিটকে দূরে সরে দাঁড়ায়। চোখমুখ শক্ত করে ঠাস করে আধ খাওয়া চায়ের মাটির কাপ দোকানদারের নিকট দিয়ে, হনহনিয়ে চলে যায়। সায়র হকচকিয়ে উঠল। সহসা উঠে দাঁড়ায়। দোকানদারের কাছে গিয়ে অঙ্কিতার রেখে যাওয়া, আধ খাওয়া চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দুই চুমুকে সেটা পান করে নিলো। মধ্যম গরম চা ছিল। সায়রের ঠোঁটে কিঞ্চিৎ ছেঁকা লাগলো। লাল হয়ে গিয়েছে নরম অধর। হা করে লম্বা শ্বাস টানল। বারকয়েক হা করে শ্বাস টেনে, জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে গরম দূর করার চেষ্টা করল। নিজেকে সামলে দ্রুত ছুটল অঙ্কিতার পিছু।

অঙ্কিতা বেশ খানিকটা দূরে। সায়র দৌড়ে তার কাছাকাছি আসলো। অঙ্কিতা দেখেও না দেখার ভান করে আপন চিত্তে হাঁটতে থাকল। সায়র সম্মুখে গিয়ে পথ রোধ করল। অঙ্কিতা কঠিন দৃষ্টিতে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। নাকের পাটাতন ফুলিয়ে ঝাঁঝ নিয়ে বলল,
” কি চাই? ”
সায়রের সাবলীল উত্তর,
” তোমাকে। ”
” ফাজলামো করছেন? ”
” একদম না। ”
” পথ ছাড়ুন। ”
” সম্ভব না। ”
অঙ্কিতা তর্জনী উঁচিয়ে বলে,
” দেখুন! ”
সায়র নিজের ঠোঁটের দিকে ইশারা করে। আরেকটু দূরত্ব ঘোচায়। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে জবাব দিল,

” তুমি দেখো। কি হাল করেছো আমার ঠোঁটের। বিয়ের আগেই এ অবস্থা। বিয়ে হলে আমার নিষ্পাপ ঠোঁটের কি হাল করবে, ভাবতেই আমার কান্না পাচ্ছে। ”
অঙ্কিতা তড়াক হকচকানো দৃষ্টি ফেলল। কন্ঠে অবিশ্বাস ঢেলে শুধায়,
” মাথা ঠিক আছে? কি বলছেন এসব? ”
সায়র মাথা নাড়ল। দুর্বোধ্য হেসে বলে,
” দুধের শিশু তুমি? কি বলছি বুঝতে পারছো না?”
অঙ্কিতার কাটকাট জবাব,
” না পারছি না। ”

” তোমার আধ গরম চা খেয়ে আমার ঠোঁটের এই দশা। যখন চা গলাধঃকরণ করেছি, তখন গলা জ্বলে যাচ্ছিল। সেটা বাদ দিলেও ঠোঁটের দহন সহ্য হচ্ছে না। ফাস্ট ফাস্ট আমার ঠোঁটের জ্বালা নিবারণের ব্যবস্থা করো। ”
” আপনার এসব উগ্র আচরণে আমি অতিষ্ঠ। প্লিজ, পথ ছাড়ুন। ”
সায়র নড়ল না। সড়লও না। দৃঢ় কন্ঠে জানায়,
” ঠোঁটের জ্বলন কমানোর সুরাহা না করে এক পা-ও নড়তে পারবে না। আমি সেটা হতে দেবো না।”
অঙ্কিতা আশেপাশে নজর বোলালো। কন্ঠ খাদে এনে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
” আপনাকে আমার এঁটো চা খেতে কে বলেছিল? আমি বলেছিলাম? নিজ ইচ্ছায় খেয়েছেন, এবার নিজে নিজে সমাধান বের করুন।”
সায়র বাঁকা হাসল। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,

” তা বললে তো শুনবো না। তোমার চা ছিল, সেজন্য সমাধান তুমি বের করবে। ”
” আমি কি খেতে বলেছি? ”
” বলতে হবে কেন? ময়লা জিনিসও অপচয় করা অপরাধ, সেখানে খাবার অপচয় করা মারাত্মক দণ্ডনীয় অপরাধ। ”
অঙ্কিতা ফোঁস করে ভারিক্কি শ্বাস ছাড়ল। ভোঁতা মুখে জানতে চাইল,
” আপনার সত্যি ঠোঁটে জ্বালা করছে? ”
সায়র ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” এনি ডাউট? ”
” অফকোর্স। ”
” রীজন? ”
” জ্বালা করলে এত বকবক কিভাবে করছেন? ”
সায়র ঠোঁট উল্টে বলে,
” সাধে কি বকবক করছি? তুমি কথা শুনলে চুপ হয়ে যাব। ”
” কি করতে হবে? ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি এনে দিবো?”
সায়র মুখ কুঁচকায়। চোখের উজ্জ্বলতা নিভে যায়। অধরে কুটিল হাসি ফুটিয়ে বলল,

” এরচেয়ে চরম ঠান্ডা জিনিস তোমার কাছে আছে। ঝটপট সেটার ছোঁয়া আমার ঠোঁটে দেও। তাহলেই জ্বলন উড়ে গিয়ে সেথায় ঠাই পাবে প্রশমণ।”
অঙ্কিতা চোখ সংকুচিত করল। ললাট টান টান করে প্রশ্ন করে,
” কোন জিনিস? ”
সায়র প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। অঙ্কিতা’কে টেনে একটা ফাঁকা ক্লাস রুমে নিয়ে আসে। অঙ্কিতা হাত মোচড়ামুচড়ি করছে।
” কি করছেন এসব? ”
সায়র নির্বিকার। অঙ্কিতা’কে বেঞ্চের সাথে ঠেসে ধরল। অঙ্কিতার বুক কাঁপছে। নিমিষে সাহস উবে গিয়ে সেথায় ঠাই পেয়েছে একরাশ আতঙ্ক। চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। প্রকম্পিত কন্ঠে বলল,
” যেতে দিন। ”

সায়র শুনল না। অঙ্কিতার সুগভীর দৃষ্টিতে চেয়ে, নিজ অধর এগিয়ে নিলো কাঁপতে থাকা রমণীর অধরে। অঙ্কিতা চোখ খিঁচে বন্ধ করে, ডুকরে কেঁদে ওঠে। ঠোঁট ভেঙে কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে, অথচ তেজস্বী কন্ঠে জানালো,
” আজকের পর আমার চোখে আপনার প্রতি ঘৃণা দেখতে পাবেন। আমার দৃষ্টিতে নিচুতে গিরে যাবেন। ”
চার জোড়া ওষ্ঠদ্বয় ছুঁই ছুঁই ভাব। নিজ চাহাত’কে মাটি চাপা দিয়ে সায়র গ্রীবা বাঁকায়। অঙ্কিতার বক্তব্যে তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দিল তাকে। হাসল জ্বলজ্বল করে। কানের নিকট মুখ নিয়ে হিসহিসিয়ে বলে,
” এই না হলে আমার জানটুস? সায়র তালুকদারের চয়েস এতটা ঠুনকো হতে পারে না। সর্বদা বেস্ট টা খুঁজে নেয় সে। আই লাইক ইয়োর এ্যাটিটিউড অ্যান্ড পার্সোনালিটি। আজকের অসম্পূর্ণ কাজ, খুব শীগ্রই সম্পূর্ণ করবো। বি প্রিপেয়ার্ড জানটুস।”

হ্যাভেন বাড়িতে ফিরেছে বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অরু’কে কোথাও দেখছে না। রুমে থাকার কথা। সে রুমে নেই। পুরো রুম, বেলকনিতে নজর বুলিয়ে দেখেছে। ধানিলংকার টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। পাখি কোথায় ফুরুত করে উড়াল দিয়ে বাসা বেঁধেছে, বলা মুশকিল। অরু সচারাচর রুম হতে বের হয় না।
হ্যাভেন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজ মুখবিবর পর্যবেক্ষণ করছে। ভ্রু কুঁচকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে দর্পণের সম্মুখে যায়। স্কিন কেমন নেতিয়ে পড়েছে। ড্রাই দেখাচ্ছে। শীতকালে বিষয়টা স্বাভাবিক। সারাদিন জার্নি করার পর ফেইস গ্লো হারাচ্ছে। ইটস ন্যাচারাল। অথচ হ্যাভেনের মন খুঁত খুঁত করছে। যত যাই হোক না কেন, স্কিন সর্বদা গ্লো থাকতে হবে। বউয়ের পাশাপাশি বাইরের মেয়েদেরও হার্টবিট বাড়িয়ে দিতে না পারলে, এমন মুখমন্ডল থেকে কি লাভ? ঝটপট ম্যানলি ফেইস ক্রিম বের করে পুরো মুখমন্ডল জুড়ে মাসাজ করতে লাগলো। আরেকটু ক্রিম নেওয়ার জন্য ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়াতেই, নজর পড়ল অরুর ছাদে পাওয়া জিনিস গুলোর উপর।

ভাসা ভাসা চক্ষু জোড়া সংকুচিত করল সহসা। ললাটে প্রগাঢ় ভাঁজ ফেলে, নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। জিনিস গুলো হাতে তুলে নিলো। লকেট বিশিষ্ট চিকন চেইন টা দেখে মাত্র অভিব্যক্তি বদলে গেল। কুঁচকানো ললাট টান হলো মুহূর্তে। থমকে গেল হৃৎস্পন্দনের গতি! নিগূঢ় নয়ন জোড়া হতে কষ্টের দাবানল ছড়িয়ে পড়ল সর্বাঙ্গে। আকস্মিক কেঁপে উঠল বক্ষস্থল। মাথা ভার ভার লাগছে। শরীরে ঘাম ছুটে গিয়েছে। পা টলছে। শক্তপোক্ত মানুষটা দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। কিয়ৎপরিমাণ থম মেরে পাথর খন্ডের ন্যায় বসে থাকল। অযাচিত ভাবনার ইতি টেনে, দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো। খুলল সবেগে চিরকুট। চিরকুটের লেখা পড়ে চিন্তায় বিভোর হলো। এবার তার মন এক অদ্ভুত আতঙ্কে ভরে গেল। এ যেন কোনো স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি। গত কয়েকদিন ধরে সে অদ্ভুত স্বপ্নগুলো দেখছিল, তার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে সবকিছু। হ্যাভেন স্বপ্নে দেখেছিল, প্রিয় কাছের মানুষটা ওর নিকট কিছু পৌঁছে দিতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। অতঃপর অন্য কেউ সেটা পেয়ে গিয়েছিল।

হ্যাভেন জোরে জোরে শ্বাস টানল। গভীর ভাবে ভাবছে, এগুলো এখানে কিভাবে আসলো? আংটি টা নাড়াচাড়া করছে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে। এই আংটি কারো আঙুলে দেখেছিল। তবে কার আঙুলে মনে পড়ছে না।

অরু টুটুলের রুমে পা সটান করে আধ শোয়া অবস্থায় পড়ে আছে। পাশে টুটুল বসে পড়াশোনা করছে। পড়ার ফাঁকে অরু’কে ওটা সেটা দেখিয়ে জানতে চাইছে, হয়েছে কি না? কবিতা কেমন হয়েছে? সুন্দর হয়েছে তো? লেখা ভালো লাগছে দেখতে? এরকম কতশত প্রশ্ন করছে। অরুও হেসে হেসে জবাব দিচ্ছে। টুটুলের মাঝারি সাইজের গোছানো চমৎকার বাচ্চাদের সাজসজ্জা দ্বারা গঠিত আলাদা রুম আছে। সে ওখানে পড়ে। আর রাতে ভয় পায় বলে বড়ো কারোর সাথে ঘুমায়। হ্যাভেনের সাথেই বেশি ঘুমাতো। মূলত হ্যাভেন টুটুল’কে কাছ ছাড়া করতো না। মাঝে মাঝে সায়র এর সঙ্গে ঘুমালে রাতে এসে নিয়ে যেত। কিন্তু অরুর সাথে বিয়ের পর থেকে সায়রের সাথে বেশিরভাগ ঘুমায়। হ্যাভেন আনতে চাইলে দেয় না। জবরদস্তি রেখে দেয়।

সায়রের মা বলে দিয়েছেন, হ্যাভেনের নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে। যতই হোক পড়ের বাড়ির মেয়ে বলে কথা! বাচ্চা সমেত স্বামীকে মেনে নেওয়া ততটা সহজ নয়। সায়র মার কথা মেনে নেয়। এমনিতেও টুটুল তার বড়ো আদরের। সায়রের কাছাকাছি না থাকলে ভাতিজা’কে তার মতো লাভগুরু বানাবে কে?
টুটুল মনোযোগ সহকারে পড়ছে। হ্যাভেন দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। অরু’কে একপল দেখে টুটুলের কাছ ঘেঁষে বসলো। হ্যাভেন’কে দেখে মাত্র ঠাস করে বই বন্ধ করে বাবার গলা জড়িয়ে ধরল। হ্যাভেন এক গাল হাসল। ছেলের গালে, কপালে আদর দিল।
টুটুল বাবার নাকে চুমু খেল। জিজ্ঞেস করে আধো আধো বুলিতে,

” কখন এসেছ? ”
হ্যাভেন ছেলের খাতায় নজর রেখে জানায়,
” কিছুক্ষণ আগে। ”
টুটুল উৎফুল্ল চিত্তে সরল স্বীকারোক্তি জানালো,
” আব্বু, সুন্দর আম্মু খুব ভালো। আমাকে পড়ায়, আদর করে। এত্তগুলো ভালোবাসে। ”
ছোট ছোট হাত দুটো দু’দিকে মেলে দেখাল। অরুর দিকে চোখ পড়তেই জিভ কাটল। অরু একদিন বলেছিল, ওদের দু’জনের ভাব হয়েছে সেটা কাউকে না বলতে। আর টুটুল বলে দিল? সুন্দর আম্মু কি রাগ করবে? আর ভালোবাসবে না? টুটুলের শিশুসুলভ অক্ষিকোটর জলে টইটম্বুর হলো সহসা। বাবার কাঁধে মুখ গুঁজে ঠোঁট উল্টে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। হাস্যোজ্জ্বল হ্যাভেনের মুখখানা অন্ধকারে ঠিকরে পড়ল ওমনি। বিচলিত হলো তৎক্ষনাৎ। অকস্মাৎ কান্নার কারণ বোধগম্য হচ্ছে না। পিঠে স্নেহময় হাত বোলালো। জানতে চাইল আদুরে ভঙ্গিতে,

” আমার আব্বু কাঁদে কেন? ”
টুটুল নিশ্চুপ। শুধু ফোঁপানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
” বলবে না তার আব্বুকে? ”
টুটুল কেঁদে যাচ্ছে, কিছু বলছে না। অরু এক হাত উঠিয়ে টুটুলের গালে রাখল। টুটুল গোল গোল চোখে তাকায়। বলল অপরাধী সুরে,
” সরি সুন্দর আম্মু। ”

অরু ফিক করে হেসে ফেলল। বুঝতে পারলো টুটুল কেন কাঁদছে। এত কিউট কেন বাচ্চাটা? আস্ত একটা চিনির দলা। চোখের ইশারায় বোঝাল, ঠিক আছে। মুহূর্তে টুটুলের কান্না থেমে যায়। হ্যাভেনের কোল থেকে নেমে অরুর কাছে যায়। অরু এক হাতে আগলে নিলো। অরুর বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকল, জড়িয়ে ধরে। হ্যাভেন হতবিহ্বল নেত্রদ্বয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে মা ছেলের দিকে। ব্যাপারটা কি হলো? টুটুল হুট করে কাঁদছিল আবার হুট করে কান্না শেষ? হ্যাভেনের মগজে ঢুকল না। তবে টুটুলের সঙ্গে অরুর স্বাভাবিক আচরণ দেখে খুশি হয়েছে।
হ্যাভেন বিছানায় উঠে অরুর অপর পাশে বসলো। অরু বিরক্ত মুখ করে ভেংচি কাটল। হ্যাভেন হাত বাড়িয়ে ওদের দুইজনকে একসাথে জড়িয়ে ধরল। অরু তৎক্ষনাৎ কটমটিয়ে ওঠে। কন্ঠ খাদে এনে দাঁত পিষে বলল,

” হাত সরান। ”
হ্যাভেনের ভাবলেশহীন গমগমে জবাব,
” তোমাকে ধরেছি? আমার ছেলেকে ধরেছি। ”
” ধরা লাগবে না। সরান হাত। নয়তো ভেঙে ফেলবো।”
হ্যাভেন শব্দ করে বিদ্রুপ হাসে। আরেকটু দূরত্ব ঘোচায়। কাছে আসে। অরুর গা ঘেঁষে বসে। ধীম স্বরে আওড়াল,
” প্রথমে নিজের ভাঙাচোরা হাত, পা শরীর ঠিক করো। পরে আমার হাত ভাঙার কথা ভেবো। ”
অরু ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকায়। রাগত্ব চাহনিতে যেন হ্যাভেন’কে ভৎস করে দিবে। হ্যাভেন ভয় পাওয়ার অভিনয় করে বলল,

” এভাবে তাকিও না বউ। পরাণ পাখি ছ্বলাত করে ওঠে। তোমার ডাইনি, না না রাক্ষসী চাউনী আমায় আধমরা করে ফেলবে। নজর নামাও সোনা। অন্যদিকে তাকাও। তোমার মাসুম বর টার জান ভিক্ষা দেও। ”
অরুর মুখশ্রী কাঠিন্যে রূপ নেয়। রক্তিম আভায় ছেয়ে যায় মুখবিবর। ধারাম করে হ্যাভেনের পেশিবহুল ইস্পাত-দৃঢ় বাহুতে কিল বসায়। মাথার চুল টানল জোরে। চুল মুঠোয় রেখে প্রত্যুত্তর করলো,
” ভালো হচ্ছে না কিন্তু! আপনার মাথার একটা চুলও আস্ত রাখবো না। ”

হ্যাভেনের প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে। আলগোছা চুল ছাড়িয়ে নেয়। অগোচরে ঠোঁট কামড়ে মিটিমিটি হাসল। মাথাটা সন্তর্পণে এলিয়ে দিল নিরদ্বিধায় অরুর কাঁধে। ঘাড়ের নিকট মুখ ডুবিয়ে, টেনে নিলো নাসারন্ধ্রে অরুর চুল আর মেয়েলী শরীরের ঘ্রাণ। হ্যাভেনের ভারিক্কি উষ্ণ শ্বাস ঘাড়ে পড়ায়, অরুর শরীর ঝংকার দিয়ে উঠল। শিহরিত হলো মেয়েলী নাজুক কায়া। হ্যাভেন’কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিবে, সেই শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই। বজ্জাত লোকটা যেন নিমিষে শুষে নিয়েছে অরুর সকল শক্তি।
অরুর ঘাড়ে মাথা রেখেই, হ্যাভেন ঘোর লাগা ভঙ্গিতে ব্যঙ্গাত্মক করে হাস্কিস্বরে বলল,

প্রেমপিপাসা পর্ব ১২

” এক্ষুনি চুল টেনে সব উঠিয়ে ফেললে, ইন ফিউচারে আদর করার সময় চুল খামচে ধরার জন্য চুল পাবে কোথায়? সেদিনের কথা চিন্তা করে কিছু চুল বাঁচিয়ে রাখা উচিত। ভবিষ্যতে তোমারই কাজে লাগবে। উপকারে আসবে। রিমেম্বার দ্যাট! ”

প্রেমপিপাসা পর্ব ১৪