প্রেমপিপাসা পর্ব ১৪
সুমাইয়া সুলতানা
” নামান বলছি। আপনার কি কোনো আক্কেল নেই? সবাই দেখছিল। ”
” হু কেয়ার্স! ”
অরুর ঝাঁঝালো কথায় হ্যাভেনের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আস্তে করে অরু’কে বিছানায় বসিয়ে দিল। টুটুলের রুমে থাকা অবস্থায় খেয়াল করেছিল, অরুর পা কিছুটা পূর্বের তুলনায় ফুলে রয়েছে। জিজ্ঞেস করলে জানায়, ছাদে টবের সাথে বারি খেয়ে আঘাত পাওয়া পায়ে পুনরায় ব্যথা পেয়েছে। তক্ষুণি টুটুল’কে পড়া কমপ্লিট করতে বলে, অরু’কে কোলে তুলে চলে আসে হ্যাভেন। ড্রয়িংরুমে সায়রা, রুবিনা ছিলেন। তারা দেখে ফেলেছিলেন এই দৃশ্য। সেজন্য অরু চেঁচামেচি করছে।
হ্যাভেন ঠাস করে অরু’কে নরম তুলতুলে বিছানায় ফেলে দিল। অকস্মাৎ ফেলে দেওয়ায় বিছানা অরুর শরীরের ভারে নিচের দিকে ডেবে গিয়েছে। অরু রাগান্বিত চোখে তাকায়। দাঁত কিড়মিড় করে। মুখবিবর বিকৃতি করে ফেলল। হ্যাভেন গরম পানি আর একটা পাতলা সুতির কাপড় নিয়ে আসে। অরু বসে ছিল। হ্যাভেন ধাক্কা দিয়ে শুইয়ে দেয়। অরু হকচকানো দৃষ্টি তাক করল। বাচ্চাদের মতো টুকুর টুকুর গোল গোল নয়ন মেলে চেয়ে রইল। হ্যাভেন বসলো অরুর পায়ের কাছে। ঠান্ডা হাত বাড়িয়ে অরুর আঘাত প্রাপ্ত পা তুলে নিলো স্বীয় উরুর উপর। অরু বিস্মিত হলো নিমেষে। তৎক্ষনাৎ পা সরিয়ে নিতে চাইল। তক্ষুণি নজর পড়ল হ্যাভেনের কঠিন চাহনির চোখ রাঙানো। সহসা দমে গেল রমনী। অতঃপর স্থির হয়ে বসে থাকল। তবে অন্তঃকরণে চলছে তীব্র আন্দোলন। হ্যাভেনের স্পর্শ কাঁটার মতো বিঁধছে সর্বাঙ্গে। হ্যাভেন গরম পানির মধ্যে কাপড় চুবিয়ে, মুচড়ে পানি ফেলে সেটার উষ্ণ তাপ দিচ্ছে অরুর পায়ে। এতে দ্রুত ব্যথার উপশম হয়। অরুর সত্যি আরাম লাগছে। আঁখি যুগল বুঁজে নিলো। মনে মনে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” এই মানুষটা আসলে কি? যার ছোঁয়া আমার কাছে মরণ বিষের ন্যায়, তবুও তার ছোঁয়া ভালো কেন লাগে? কেন অস্বস্তি অনুভব হয় না? যার জন্য আজ আমার পরিবারের সঙ্গে মনমালিন্য, তার একটুখানি যত্নের আশায় কেন ছটফট করে বেহায়া মন? ইদানীং কেন হচ্ছে এমন? এরকম তো হওয়ার কথা না! এই বজ্জাত লোক কি ভালোবেসে আমায় আগলে রাখার চেষ্টা করে, নাকি সবটা সম্পর্কের দায়বদ্ধতা? কখনও তার কাজকর্মে ভালোবাসা অনুভব করতে পারি, আবার কখনও পারি না। তার উপস্থিতি আমার জীবনে এক অনাহূত বাস্তবতা। ”
” মাথায় কোন শয়তানি বুদ্ধি লাড়া দিচ্ছে ম্যাডাম?”
হ্যাভেনের গম্ভীর চওড়া কণ্ঠে অরু তড়াক করে চোখ খুলল। বেরিয়ে আসে স্বীয় অযাচিত ভাবনা থেকে। ভ্রু কুঁচকে তাকায়। হ্যাভেন পানির পাত্র আর কাপড় যথাস্থানে রেখে আসে।
” আমি আপনার মতো না। আপনি নিজেই আস্ত একটা শয়তান। আপনার মাথায় যা শয়তানি চলে তার ধারেকাছে আমি নেই। ”
হ্যাভেন কোনো কথা না বলে চুপচাপ অরুর পাশে বসলো। মৃদু হাতে অরুর পায়ে হাত বোলালো। অরুর কেমন সুড়সুড়ি লাগছে। কিন্তু হ্যাভেনের কঠিন মুখশ্রী নজর পড়তে আওড়াল না নিজ চঞ্চল বুলি। তবে হ্যাভেনের ছোঁয়ায় একধরনের কোমলতা ফুটে উঠল। পায়ের ক্ষতটায় একটু জোরে স্পর্শ লাহতেই অরু কেঁপে ব্যথাতুর শব্দ তুলল,
” ব্যথা লাগছে। ”
হ্যাভেন কণ্ঠে স্নিগ্ধ উদ্বেগ,
” সেরে যাবে। ”
অরু ফট করে আচমকা প্রশ্ন করলো,
” আপনার আগের বউ কি দেখতে খুব সুন্দর ছিল?”
অরু কথাটা কেন বলল, নিজেও জানে না। কিন্তু অকস্মাৎ অবাঞ্ছিত বাক্যে হ্যাভেনের মধ্যে কোনো ভাবান্তর পরিলক্ষিত দেখা যাচ্ছে না। এতে অরু বেশ অবাক হলো।
হ্যাভেনের আপন ছন্দে বলা প্রত্যুত্তরে তিরস্কার ভাব,
” সৌন্দর্য দিয়ে ভালোবাসার বিচার করতে চাইছো?”
” সিরিয়াস হচ্ছেন কেন? জাস্ট জানতে চেয়েছি। না বললে নাই। আমার এত শোনার আগ্রহ নেই। ”
হ্যাভেন ঠোঁট বাঁকায়। মৃদু হেসে কটাক্ষ করে বলে,
” আগ্রহ আছে কি না, সেটা তোমার কথার ধরণ দেখে বোঝা যাচ্ছে। ”
অরু প্রত্যুত্তর করল না। চুপটি করে রইল। হ্যাভেন ফের বলতে লাগলো,
” অনেক সময় আমাদের জীবনে কিছু মানুষের উপস্থিতি, আমাদের জীবনের অনিচ্ছাকৃত এক অধ্যায় মনে হয়। মন থেকে মেনে নেওয়া যায় না। দিনশেষে একটা সময় আমরা বুঝতে পারি, সেই অধ্যায় নিকষকালো আধার নয়, বরঞ্চ উজ্জ্বলতার সূত্রপাত। ”
অরুর মাথায় ঢুকল না, হ্যাভেনের কাঠিন্য বাক্যদ্বয়। শুধু মস্তিষ্ক ক্যাচ করল হ্যাভেন ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে তাকে মেনে নিতে বলছে। অরু জানে, এভাবে দিনের পর দিন নিজেকে গুটিয়ে রেখে, যন্ত্রণা আর দ্বিধার মধ্যে বেঁচে থাকা কতটা কঠিন। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবন মুহূর্তে পরিবর্তন করতে পারলে, দুঃখ মানুষকে কখনও ছুঁতে পারত না।
অরু হাতে ভর দিয়ে হেলানো বালিশের সঙ্গে আরেকটু সেঁটে যায়। করতলে ছোঁয়া লাগে শক্ত কোনো বস্তু। নেত্রদ্বয়ের সম্মুখে তুলে ধরতেই নজর পড়ল ছাদে পাওয়া আংটি টা। হ্যাভেন তখন জিনিস গুলো দেখে নিজের কাছে রেখেছিল। কিন্তু ভুলবশত আংটি বালিশের পাশে রয়ে যায়। সেটা খেয়াল না করে টুটুলের রুমে চলে গিয়েছিল।
অরু আংটিতে দৃষ্টি স্থির রেখে আনমনে বলে,
” এটা তো ড্রেসিং টেবিলে ছিল। এখানে আসলো কিভাবে? ”
হ্যাভেন তুরন্ত আংটি টা অরুর হাত থেকে ছিনিয়ে নিলো। ঢুকালো ট্রাউজারের পকেটে। অরু ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেলল। জিজ্ঞেস করল সবেগে,
” এটা আপনার? ”
হ্যাভেন গভীর চাউনী নিক্ষেপ করে অরুর প্রশ্নবিদ্ধ হরিণী নেত্রে। বালিশের ডিজাইন করা ফুলের পাতার উপর একপল চেয়ে প্রত্যুত্তর করে,
” না। ”
” তাহলে কার? ”
” যার আংটি তার। ”
হ্যাভেনের ভাবলেশহীন জাবাব। অরু অসন্তোষ হয়। এটা কোনো উত্তর হলো? ত্যাড়া মার্কা লোক!
অরু কন্ঠ নিচুতে নিয়ে শুধায়,
” অন্যের আংটি নিজের কাছে কেন রেখেছেন? এগুলো আমি পেয়েছি, আমাকে দিন। যার জিনিস আমি তাকে ফেরত দেবো। ”
হ্যাভেন সরু চোখে তাকাল। টান টান ললাট কুঁচকে ফেলল সহসা। নজর আটকে যায়, অরুর স্নিগ্ধ মুখশ্রী জুড়ে লেপ্টে থাকা কৌতূহলে। হ্যাভেন তা পরোক্ষ করে নিগূঢ় ভাবে। জানতে চাইল পরপর,
” চেইন, চিরকুট, এই আংটি তুমি পেয়েছো? ”
অরুর সরল সাবলীল স্বীকারোক্তি,
” হ্যাঁ। ”
হ্যাভেনের জানার উদ্বেগ,
” কোথায়? ”
” ছাদে। ”
” ছাদে কোথায়? ”
অরু বিরক্ত হয়। ফোঁস করে লম্বা শ্বাস টানল।
” ছাদের যে দিকটায় একটা বদ্ধ কক্ষ রয়েছে?”
হ্যাভেন রাশভারি কন্ঠে জানালো,
” স্টোর রুম ওটা। ”
” সেখানে একটা বড়ো টব রয়েছে। টবের পাশেই পেয়েছি। তবে….”
হ্যাভেন আগ্রহ প্রবল হয়। ছটফট সমেত শুধাল,
” তবে? ”
” তবে আংটি স্টোর রুমের দরজার কাছে পেয়ে ছিলাম। ”
হ্যাভেনের কুঁচকানো ললাট আরও কুঞ্চিত হয়ে প্রগাঢ় ভাঁজ পড়ল। কামড়ে ধরল নিচের ঠোঁটের এক পাশ। হিসাব মেলানোর মতো চোখের মণি ঘোরালো এদিক ওদিক। এলোমেলো দৃষ্টির বিচরণ ঘটানোর মধ্যেই বলে ওঠে,
” ছাদে গিয়েছিলে কেন? ”
” ইচ্ছা। ”
” আর যাবে না। ”
” হুকুম করছেন? ”
” তোমার যা মনে হয়। ”
” রুমে কতক্ষণ বসে থাকতে ভালো লাগে? ”
” পুরোপুরি যেতে নিষেধ করিনি। সুস্থ হও আগে। তারপর যাবে। ”
” আপনার প্রথমে বলার ধরণ এমনটি ছিল না। ”
হ্যাভেন বিড়বিড় করে বলল,
” বিয়ে করার সাধ মিটে গিয়েছে। ”
অরু শুনল। পাত্তা দিল না৷ সন্দেহী অস্বস্তি মাখা গলায় জানতে চাইল,
” চেইনের সাথে লকেটের ভেতর একটা নারীর প্রতিচ্ছবি দেখেছিলাম। সে কে? ”
পরিচিত মুখাবয়ব আবারও হানা দিল চক্ষুদ্বয়ে। ভেসে উঠল কিছু তিক্ত, ভয়াবহ স্মৃতি। হ্যাভেনের বুক মুচড়ে উঠল। শুষ্ক ঢোক গিলল। ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
” আমার খুব কাছের একজন মানুষ। ভীষণ ভালোবাসি তাকে। ”
হ্যাভেনের তৃপ্তিময় দাম্ভিক সমেত কাটকাট জবাব অরুর অন্তঃকরণ নাড়িয়ে দিল। অদৃশ্য এক যন্ত্রণার বেড়াজাল বেষ্টনী করল আচমকা। অচিরে ভাঙন ধরল ক্ষুদ্র সময়ের ভালো লাগার রেশ। বুকের ভেতর কারণ ছাড়াই চিনচিন সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করল। ঘনঘন শ্বাস টানল বারকয়েক। বিরস মুখে স্বীয় মনে ভাবল,
” মেয়েটা কি হ্যাভেনের আগের স্ত্রী? সে কোথায়? আবার ফিরে আসবে হ্যাভেনের জীবনে? হ্যাভেন কি তাকে ফিরে পেয়ে অরু’কে ডিভোর্স দিয়ে দিবে? ভুলে যাবে অরু’কে? ”
অরুর কি হলো কে জানে? ভাবনার সুতো ছিঁড়তে দিল না। সেথা মস্তিষ্কে সচল রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল হঠাৎ। অক্ষিপট অশ্রু জলে টইটম্বুর হয়ে গেল মুহূর্তে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না সংবরণ করতে চায়, পারে না। গলায় আটকে রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। হ্যাভেন বিচলিত হয় তৎক্ষনাৎ। আচানক নোনা জলের উৎসের কারণ, উপলব্ধি করতে সক্ষম হলো না। নিগূঢ় চাউনীতে টলমলে জলরাশিময় নয়নে নিবদ্ধ করে। আলিঙ্গন করল এক হাতে সহধর্মিণীকে। অরু ঝাড়া মেরে ভরসা যোগ্য হাত সরিয়ে দিল অতিব অবহেলায়। ফুরসৎ পেলো না রমণী। এটা হ্যাভেন! দমে যাওয়ার মানুষ না। সে তো জানে না, তার সাথে নরম আচরণ করলেও হ্যাভেনের মনস্টার রূপ ঠিক ততটাই ভয়ংকর।
হ্যাভেনের খসখসে করতল জায়গা দখল করল, অরুর মসৃণ কপোল। ললাট জুড়ে ছড়িয়ে থাকা, ছোট ছোট চুল গুছিয়ে দিল সন্তর্পণে। পলকহীন বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিয়ৎপরিমাণ। অরু অনুভূতিহীন শূন্য চোখ বোলালো, সম্মুখের পুরুষের। অসহ্যকর পুরুষের সেই তীর্যক চাহনির ভাষা বুঝতে পারলো না অতি আবেগে ভেসে থাকা অরু। হ্যাভেন গভীর ভাবে অবলোকন করছে স্বীয় নারীর মুখবিবর। সময়ের পলকে ছুটে আসে হালাল নারীর ওষ্ঠদ্বয়ের সঙ্গে মিলন ঘটানোর অভিলাষে। অরু মুহুর্তে চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। শ্বাস নিতে ভুলে গেল মেয়েটা। নিঃশ্বাস ছাড়ল না। মুখমণ্ডলের কোথাও কোনো পুরুষালী সংস্পর্শ অনুভব না পেয়ে, ফট করে দৃষ্টি মেলল। তৎক্ষনাৎ উষ্ণ ওষ্ঠপুট ছুঁয়ে গেল অরুর থুতনি। হালকা না, ছোঁয়া একটু বেশি গভীর। অরু বিহ্বলিত ফাটা চক্ষুদ্বয় বড়ো বড়ো হয়ে যায় সহসা। আপনা-আপনি পেলব হাত স্থান পায় নিজ থুতনিতে। সেখান হ্যাভেনের ঠোঁটের ভেজা চুমুর পরশ এখনো লেপ্টে।
অরু অধর ফাঁক করে কিছু বলতে চাইল, অমনি বাঁধা পড়ল কন্ঠনালীতে। গিলে নেয় ঠোঁটের ডগায় আসা বুলি। কারণ হ্যাভেন শক্ত বেষ্টনী দ্বারা আটকে রেখেছে অরুর নেতানো শরীরটা। বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে না উঠতে পুনরায় হোঁচট খেলো অরু। উন্মুক্ত ঘাড়ে অধর চেপে, চুপ করে আছে হ্যাভেন। জোরে জোরে শ্বাস টানছে। না, এটা স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস না। অরুর মেয়েলী শরীরে শিহরন জাগানোর মতো উষ্ণ শ্বাস নয়। এই শ্বাস হতাশ, কাতর, আহত, কষ্টের ভারিক্কি নিঃশ্বাস। অরু রাগান্বিত, বিরক্তিকর রিয়াকশন দিতে ভুলে গিয়েছে। অচিরে এগুলোকে পেছনে ঠেলে, কাঁপা পেলব হাত আলতো করে রাখল, হ্যাভেনের পেটানো বলিষ্ঠ পৃষ্ঠদেশে। এতে হ্যাভেন আস্কারা পেলো। হাতের বন্ধন দৃঢ় করল পূর্বের চেয়ে। বলল বিড়বিড় করে,
” থ্যাঙ্কিউ অরু পাখি। থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ। থ্যাঙ্কিউ সো মাচ। ”
অরু শুনতে পায়। ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে ধীম স্বরে শুধায়,
” থ্যাংকস? হোয়াই? ”
” ছাদে পাওয়া জিনিস গুলো খুঁজে চলেছি কয়েক বছর ধরে। পাইনি। তুমি পেয়েছো। ইউ আর ভেরি লাকি ফর মি। থ্যাংক ইউ, জান। ”
আরও কিছু সময় পর সরে আসে হ্যাভেন। এক হাতের করতল স্পর্শ করল অরুর গাল। অন্য হস্তে নিরদ্বিধায় মুছে দিল অরুর অশ্রুসিক্ত নয়ন। মন পোষণ করে অরুর ললাটে পরম যত্নে আদুরে পরশ এঁটে দিতে। কিন্তু বিবেক বাঁধ নির্মাণ করল।
” অশ্রু জলের উৎসের সন্ধান কোথায়? ”
হ্যাভেনের শান্ত বিনম্র প্রশ্ন। অথচ অরু ঘাবড়ে যায়। নিজেকে দ্রুত সামলে মিহি স্বরে বলে,
” পায়ে ব্যথা করছিল। ”
ললাটের ভাঁজ গাঢ়তর করে জানতে চায় হ্যাভেন,
” আর ইউ শিওর? ”
অরু থমথমে খায়। হ্যাভেনের জহুরি তীক্ষ্ণ চাহনি বুঁদ হলেও বাইরে প্রকাশ হতে দিতে নারাজ মস্তিষ্ক। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে দিল অঢেল জবাব,
” ইয়েস। ”
হ্যাভেন ঘাটল না। এত নিগূঢ় ভাবল না। সবসময় মানুষের মন এক থাকে না। কিন্তু অরুর ভোঁতা মুখ দেখতে ভালো লাগছে না।
গলা খাঁকারি দিল হ্যাভেন। ফিচেল হেসে বলে উঠলো,
” প্রেমিক পুরুষ পছন্দের রমণীর কাজল টানা ডাগর ডাগর আঁখি যুগল’কে উপাধি দেয় হরিণের চোখ। আচ্ছা, গরুর চোখ কেন বলে না? গাধার চোখ কেন বলে না? তারাও তো অবলা প্রাণী। তারা কি দোষ করল? ”
হ্যাভেনের অদ্ভুত প্রশ্নে অরুর শান্ত চোখ বড়ো হয়ে গেল নিমিষে। তাজ্জব বনে গেল। আজগুবি চিন্তাভাবনায় মূহূর্তে তব্দা খেলো অরু। মেয়েটা চোখে-মুখে হতভম্ব ভাব নিয়ে তাকিয়ে রইল। কিছু বলতে গিয়েও কথাগুলো যেন আটকে গেল গলায়। পিটপিট করে তাকায়। এরকম অযাচিত আশ্চর্য কথায় কিঞ্চিৎ ভড়কালো মেয়েটা। কন্ঠনালী ভেদ করে বেরিয়ে আসে হতবিহ্বল বাক্য,
” পাগল টাগল হয়ে গিয়েছে নাকি? ”
হ্যাভেন নিজের ফিচেল হাসি ধরে রেখে নিস্প্রভ গলায় বলল,
” কী হলো? ভাবছো, হঠাৎ এতো ফিলোসফি কেন? আসলে আমি লজিক দ্বারা ভাবার চেষ্টা করছি। মানুষের মন তো অদ্ভুত! যা দেখে ভালো লাগে, সেটাকে দামী, সুন্দর, অর্থপূর্ণ সব বিশেষণে ভরিয়ে দিতে চায়। তাই হয়তো হরিণের চোখ হয়ে গেলো ভালোবাসার রূপক। কিন্তু, গরু বা গাধা? ওদের জন্য মায়া লাগে। হায়রে! ওরা বেচারা তো সৌন্দর্যের তুলনায় কোনো অংশে কম না। তবুও কেউ তাদের সাথে মনুষ্য জাতিকে তুলনা করতে নারাজ। এটা তো রীতিমতো পশু বৈষম্য! ”
অরু অজান্তে ফিক করে হেসে ফেলল। টেকনিক্যালি ভাবতে গেলে হ্যাভেনের কথায় লজিক আছে। অরুর সেই প্রাণ জুড়ানো স্নিগ্ধ মুখশ্রীর হাসি হ্যাভেন মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখল। বিয়ের পর আজ প্রথম অরু’কে মন থেকে হাসতে দেখছে। হাসির ঝলকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠল অরুর টোল পড়া থুতনি, আর পদ্মকুড়ির ন্যায় পীবর ঠোঁট। হ্যাভেনের ঘোর লেগে যাচ্ছে। চটজলদি নজর ফিরিয়ে নেয়। এই হাসি হ্যাভেন’কে বশীভূত করতে সক্ষম।
অরু খিলখিল হাসি বজায় রেখে প্রত্যুত্তর করে,
” এসব কথা আপনি পান কোথায়? মাথায় কি সবসময় উদ্ভট চিন্তা ঘোরে? আপনার ব্রেইন কি দ্বারা গঠিত? ”
হ্যাভেন কাঁধ ঝাঁকালো। এ্যাটিটিউড ছড়িয়ে পড়ল সর্বাঙ্গে। গ্রীবা বাঁকিয়ে বলল বিরস মুখে,
” যেদিন আমি জানতে পারবো, সেদিন তোমাকে বলবো। ”
একটু থেমে, লম্বা শ্বাস টানল। পুনরায় ভরাট কন্ঠে বলল,
” কি চাই? ”
অরু চমকে উঠল। মুহূর্তে উড়ে মিয়িয়ে গেল অধরের ঝরঝরে হাসি। বিস্ময় ঢেলে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল,
” কখন বললাম আমি কিছু চাই? ”
” তুমি চাও নি। কিন্তু আমি দিতে চাই। ”
” হঠাৎ এত পরিবর্তন? আর কি বা চাইব? ”
” যা খুশি চাইতে পারো। ছাদে পাওয়া জিনিস গুলোর জন্য একটু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাইছে। নয়তো তোমার প্রতি আমার বিন্দু মাত্র ইন্টারেস্ট নেই। ”
সময়ের পলকে হ্যাভেন পূর্বের গুরুগম্ভীর অভিব্যক্তি ফিরে আসে। কন্ঠে তীব্র তেজ, দীপ্তিময় ভাব।
অরু তাচ্ছিল্য হাসে। মলিন চোখে চেয়ে বলে,
” লাগবে না কিছু। ”
হ্যাভেন ঝুঁকে আসে খানিকটা। অরুর অপর পাশে এক হাত রেখে বেড়াজাল সৃষ্টি করে। অরু নড়তে পারে না। চোখে চোখ রেখে গমগমে স্বরে বলল হ্যাভেন,
” তোমার বাবা-র সাথে দেখা করবে? ”
অরু তপ্ত শ্বাস ছেড়ে মস্তক নিচু করল। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। হ্যাভেন আঙুল দিয়ে অরুর থুতনি স্পর্শ করে, নিচু করা মুখ উঁচু করল। অরুর চোখ ছলছল।
হ্যাভেন শান্ত দৃষ্টি তাক করে। মুচকি হেসে জানায়,
প্রেমপিপাসা পর্ব ১৩
” এখানে আসতে বলবো, নাকি ও বাড়িতে যাবে?”
অরু নিশ্চুপ। মুখমন্ডল জুড়ে অন্ধকার।
” সে সামথিং? ”
অরু হাত সরিয়ে দিল। ঠোঁট নেড়ে বলল না কিছু। মাথা নেড়ে নির্বিঘ্নে সায় জানায়। যার অর্থ, যেখানে খুশি দেখা হলেই হলো। হ্যাভেন প্রফুল্ল সজীব হাসল। অরুর ঘাড়ে সরু নাক ঘষে। চনমনে কন্ঠে আশ্বস্ত করে বলে,
” কাল ব্যবস্থা করছি। ”
