প্রেমপিপাসা পর্ব ২৪
সুমাইয়া সুলতানা
তীব্র ঘোরানো বাতাস অন্ধকার রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে চলেছে। প্রকৃতি সবকিছু একযোগে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। বাতাসের দুঃস্বপ্ন-যন্ত্রণায় বাতাস চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে যাচ্ছে। সৃষ্টির সীমানা ছাপিয়ে বেরিয়ে আসছে ধ্বংসের পরাকাষ্ঠা। প্রখরতা বাতাস যখন ধেয়ে আসে, তখন রাস্তার উপর স্থবির সমস্ত কিছু এক মুহূর্তে যেন অস্থির হয়ে ওঠে। রাস্তার পাশের উঁচু বিল্ডিংগুলো একে একে ঘুরে ফিরে দেখছে তাদের ছায়া, মনে হচ্ছে প্রকৃতি তাদের শ্বাসের মাধ্যমে বিপদের সংকেত দিচ্ছে। রাস্তায় পড়ে থাকা শুকনো পাতাগুলোর মধ্যে মৃত-চেতনার হাহাকার শোনা যাচ্ছে, পাতাগুলো ছিঁড়ে উড়ে যেতে চায়, কিন্তু বাতাসের প্রবাহ তাদের সীমারেখা ছুতে দেয় না।
তার নিচে রাস্তার প্রতিটি স্ফটিক থেকে আলো বের হয়ে আসছে, তবে সেগুলো অন্ধকারের ভয়ংকর অভ্যন্তরে তলিয়ে যায়, যেন আলোও ভয় পেয়ে ছুটে পালাচ্ছে। এমনকি চারপাশের যে এক নিঃশব্দ মৃত্যু বিরাজ করছে, সেই নিস্তব্ধতা চিরতরে বসে পড়েছে। শহরের রাস্তা এখন শূন্যভূমি নয়, রাতের বেলা কতশত যানবাহন নিজস্ব গতিতে চলছে। যানবাহনের বিরক্তিকর খটখটে আওয়াজ এক ধরনের ভয়াবহ ঝঞ্ঝাটের মতো অদৃশ্য শক্তি প্রতিটি প্রস্থানে মিলিয়ে যেতে চায়। এখানে বেঁচে থাকার কোনো চিহ্ন নেই, শুধু হারিয়ে যাওয়া শব্দগুলোর প্রতিধ্বনি, বাতাসে মিশে যাচ্ছে।
রাতের এই সময়টা সচারাচর মানবকূল তন্দ্রাঘোরে থাকে। সারাদিনের ক্লান্তিকর শরীরটা আরামের অভিলাষে এলিয়ে দেয় শক্ত কিংবা নরম তুলতুলে বিছানায়। কিন্তু বাচ্চা বেলেল্লাপনা টুটুল এখনো টুকুর টুকুর গোল গোল চোখে চেয়ে ছোটাছুটি করছে। এ সময় রান্নাঘরে লাইট জ্বালানো আর টুংটাং শব্দ কর্ণগোচর হতেই হ্যাভেন ভ্রু কুঁচকে সেদিকে পা বাড়াল। সায়রা রান্না করছেন। চুলায় গরম পানি টগবগিয়ে ফুটছে। হাত যুগল স্থির নেই। ছুরি দিয়ে মুরগীর মাংস ছোট ছোট টুকরো করতে ব্যস্ত।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
হ্যাভেন ভরাট স্বরে প্রশ্ন করলো,
” কি রান্না করছো কাকীমা? ”
সায়রা নিজ কার্যক্রম সচল রেখে প্রত্যুত্তরে জানালেন,
” নুডলস রান্না করছি। ”
” কার জন্য? ”
” তোমার আদরের ছেলে বায়না ধরেছে নুডলস খাবে। রুবিনা আপাকে বিরক্ত করছিল। বেচারি কাজ শেষে ঘন্টাখানেক আগে ঘুমিয়েছে। তাই ভাবলাম, আমি রান্না করি। ”
হ্যাভেন কিচেন থেকে দরজার বাইরে উঁকি দিয়ে দেখল, টুটুল সায়রের কাঁধে উঠে চুল টানছে আর খিলখিল করে হাসছে। খুনসুটিতে মেতে আছে চাচ্চু ভাতিজা। দুষ্টু ছেলের চোখে ঘুম পরী হানা দেয়নি। ঘাড় ঘুরিয়ে সায়রার উদ্দেশ্যে শুধাল,
” রাত প্রায় দু’টো বাজতে চলল, অথচ টুটুল জেগে আছে। অবিশ্বাস্য! ”
নুডলস এ মসলাগুঁড়ো প্যাকেট ছিঁড়ে ছিটিয়ে দিতে দিতে জবাব দিলেন সায়রা,
” জানোই তো দিনে ঘুমালে টুটুল রাতে দেরি করে ঘুমায়। আজকেও তার ব্যাতিক্রম নয়। দুপুরে ঘুমিয়ে ছিল, উঠেছে মাগরিবের পর। সেজন্য লাফালাফি করছে। ”
হ্যাভেনের ভাবুকতা সমেত নির্লিপ্ত ছোট উত্তর,
” ওহ। ”
নুডলস বাটিতে ঢেলে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে হ্যাভেনের নিকট তাকালেন সায়রা। কন্ঠে অস্বস্তিকর উদগ্রীব,
” বাগান হতে শোরগোলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। অরু চিৎকার করছিল কেন? ”
হ্যাভেন চমকে উঠল। পুনরায় নেত্রপল্লবে জেঁকে বসেছে সেই বিদঘুটে পরিস্থিতি। অজানা এক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল দেহ জুড়ে। মনে এক অস্বাভাবিক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু তা বাইরে প্রকাশ করার জন্য প্রস্তুত হতে দিচ্ছে না। অক্ষিকোটরের ভেতর উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট হলেও, মুখাবয়বে কোনো পরিবর্তন ঘটাল না, যেন সে অন্তর্গত অশান্তি কৃত্রিমভাবে আড়াল করার জন্য সচেতন। উচাটন ভাবভঙ্গি তেমনই থাকল, যেমনটি সে সর্বদা রাখে। একটুও অস্থিরতা না দেখিয়ে, সাবলীল আদল বানিয়ে রাখল। এটি একটি মুখোশের মতো, যা তার আসল অনুভূতিকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। যদিও বক্ষপটে উত্তাল এক মোলায়েম গভীর উদ্বেগ ঘুরপাক খাচ্ছে।
সায়রা’কে কোনো টেনশন দিতে চাইল না হ্যাভেন। এমনিতেই তিনি হ্যাভেন’কে নিয়ে তটস্থ থাকেন সর্বক্ষণ। কৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে গেল। ঠান্ডা স্বরে জানায়,
” সিরিয়াস কিছু না। অরুর সঙ্গে বল খেলছিল। ”
উদাসীন সায়রা কর্ণপাত করলেন না। উনি ঠিক শুনেছেন ভয়ার্ত গা কাঁপানো আর্তচিৎকার। বিরস মুখে নির্জীব চাউনি হ্যাভেনের উপর বর্তালেন।
” বড়ো হয়ে গিয়েছো। কাকী কখনো মা হতে পারে না। সে জায়গা দখল করতে পারিনি। ”
হ্যাভেন চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এক হাতে সায়রা’কে আলিঙ্গন করে অত্যন্ত নরম কন্ঠে বলল,
” কে বলেছে পারো নি? কাকীমা এমনি এমনি বলি না, কথাটা মনে রেখো। মারাত্মক ঘটনা হলে তোমাকে জানাতাম না বলো? শুধু শুধু চিন্তা করো না। ”
হ্যাভেন বেডরুমে এসে সরু চক্ষু জোড়া একবার বুলিয়ে নিলো পুরো কক্ষে। রুম ফাঁকা লাগছে কেন? চঞ্চল রমণী লোকাছুপি খেলছে নাকি? একা একা খেলার কি দরকার? হ্যাভেন আছে তো। ঠোঁট গোল করে গরম নিঃশ্বাস ছেড়ে ওয়াশরুমের দিকে তাকায়। অতঃপর ললাটে প্রগাঢ় ভাঁজ ফেলে হাঁক ছেড়ে ডাকল,
” অরু পাখি, হোয়্যার আর ইউ? ”
সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টিময় চিকন একটি কন্ঠস্বর ভেসে এলো তৎক্ষনাৎ,
” আমি বেলকনিতে। ”
হ্যাভেন তব্দা খেলো। হোঁচট খেলো ছোট করে। নেত্রদ্বয় কোটর ছেড়ে কপালে উঠার উপক্রম। এত কিউট ভাবে সাড়া দিল ধানিলংকা? এটা আজও তার বউ অরু তো? নাকি কোনো রক্ত চোষা ডাইনি নামক পেত্নী? হ্যাভেন লালা দ্বারা কন্ঠনালী ভেজায়। মনে মনে দুরুদ শরীফ পাঠ করতে করতে বেলকনির উদ্দেশ্যে ধীর কদমে এগিয়ে যায়।
হ্যাভেন বেলকনিতে এসে দাঁড়াল। নজর গিয়ে পড়ল অরুর উপর। বেলকনিতে নীল রঙের ছোট কম পাওয়ারফুল ডিম লাইট জ্বালানো। সুস্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে অরু’কে। শীতল বাতাস অরুর চুলগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে আপন ছন্দে। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেলকনির এক কোণে। অরুর চোখে এক গভীর বিষণ্নতার ছাপ। নিজের ভুবনে কোথাও হারিয়ে গিয়েছে।
উদাসীন মানসপটে চিন্তার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত এক প্রতিভূ। মস্তিষ্কের পরতে পরতে দোদুল্যমান ভাবনার ঘূর্ণিঝড়। চিন্তার অতলান্তিকে নিরন্তর তরঙ্গায়িত ভাবাবেগ, যার জটিল সমীকরণ বোধগম্যতার সীমা ছাড়িয়ে চলে যায় এক অজ্ঞাত মহাদেশ। ঠোঁটের উপর দাঁতের অদৃশ্য দৃঢ়তর কর্তৃত্ব, যেন এক অন্তর্গত অস্থিরতা গ্রাস করে নিয়েছে চেতনার প্রতিটি অণু-পরমাণু। অগণন দ্বিধার দোলাচলে ক্রমাগত নিক্ষিপ্ত এক প্রহেলিকাময় সত্তা, যে আবেগের অগ্নিগর্ভ স্রোতে নিমজ্জিত, অথচ নীরবতার খাঁচায় আবদ্ধ। চোখের গভীরে এক অনবদ্য শূন্যতা, যা অনিবার্য ক্লান্তির উপাখ্যান রচনা করে চলেছে নিঃশব্দে। হৃদয়ের অনির্ধারিত এক শূন্যস্থান পূরণের নিরন্তর আকুতি, কিন্তু প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে অপ্রকাশিত বেদনার এক অব্যক্ত সঙ্গীত বেজে চলেছে অবিরাম।
হ্যাভেনের উপস্থিতি বুঝতে পেরে অরু তার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে চাইল একপল। পরপর নজর ফিরিয়ে নিলো। হ্যাভেনের কপালে ভাঁজ দৃঢ় হলো। মনের গভীরে কোথাও একটা অস্বস্তি হয়। সে ধীরে অরুর দিকে এগিয়ে গিয়ে শরীরের সাথে লেগে পেছনে দাঁড়াল। অরু দূরে সরে গেল না, ঠায় দাঁড়িয়ে। হ্যাভেন গ্রীবা বাঁকিয়ে দেখে চলেছে নৈঃশব্দ্যে অরু’কে। এবারের জন্যও অরুর মুখ হতে দৃষ্টি সরাল না। চাহনিতে ছিল এক অদ্ভুত মায়া। তবে সেই মায়াকে লুকিয়ে রেখে নিজের মুখে সাবলীল আভাস বজায় রাখল। বুকের ভেতর একটি চাপা উত্তাল তরঙ্গ বারবার ধাক্কা দিচ্ছিল, কিন্তু মুখে কিছু বলার সাহস পেলো না। অরু’কে এতটা শান্ত দেখে হ্যাভেন কেশে গলা পরিষ্কার করল। শব্দটা শুনে অরুর মধ্যে তখনো ভাবান্তর দেখা গেল না। অন্য সময় হলে তড়িঘড়ি করে তাকাতো, এখন সে নির্জীব!
একটু বিব্রত হয়ে অরুর কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করল হ্যাভেন,
” এত কি ভাবছো বউ? ”
” আপনার কথাই ভাবছি। ”
কথা বলেই অরু এবার ঘুরে তাকায়। মুখোমুখি হয় কাছ ঘেঁষে দাঁড়ানো মানুষটির। অরুর চোখে মুখে অনিচ্ছার স্পষ্ট ছাপ। সে বুঝতে পারছিল না হ্যাভেন কেন এইভাবে তাকে সর্বক্ষণ গোলকধাঁধায় জড়ায়? অরু আরেকটু দূরত্ব ঘোচায়। হস্ত যুগল দ্বারা আলতো করে জড়িয়ে ধরে স্বীয় পুরুষের গলা। হ্যাভেন ঈষৎ ভড়কে গেল। আকস্মিক উত্তরে এবং কাজে বিব্রত কিছুটা। অরুর চোখের ভাষাহীন বাক্য বুঝতে দেরি হলো না, বাজ-পাখির মতো নিগূঢ় চাউনির অধিকারী হ্যাভেন। চট করে বউয়ের অভিব্যক্তি ধরে ফেলল। নারী জাতি খুব ভয়ংকর মায়ারানী হয়। আহ্লাদী আবদার জানে। সহজেই মোহনীয় সৌন্দর্যের মাধ্যমে প্রিয়তমকে আকৃষ্ট করে কথার জালে ফাঁসাতে পটুত্ব তারা। কিন্তু এটা হ্যাভেন, সহজে কারো বাঘে আসার পাত্র নয়।
হ্যাভেন হাত ছাড়িয়ে এড়িয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়, অরু তৎক্ষনাৎ পেছন থেকে হাত টেনে ধরে। তেতে উঠল মুহূর্তে। দাঁত চিড়বিড়িয়ে তেড়ে এসে কলার চেপে ধরল। রাগে ফুঁসছে সে। হ্যাভেন শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়। অত্যন্ত শীতল চাহনি অথচ ধ্বংসাত্মক কাঠিন্যতা মুখশ্রী জুড়ে। ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
” তোমার জায়গায় এই হাত অন্য কারোর হলে, এতক্ষণে শরীর থেকে আলাদা হয়ে যেত। শুধু আমার জান বলে বেঁচে গেলে। ”
অরু থমকে যায়। শান্ত গলার নীরব হুমকিতে পিলে চমকে উঠল। বিস্ময়ের তোড়ে আলগোছে নিজে থেকে মুঠোয় থাকা কলার ছেড়ে দিল। দু কদম পিছিয়ে গেল সহসা। পরপর মস্তক চিবুকে ঠেকাল। কন্ঠে নেপাত ক্ষুব্ধ জেদ প্রকাশ পেলো,
” আমার একটা জিনিস চাই। বিয়ের পর কাবীননামার টাকা আমার নামে একাউন্টে পাঠানো ছাড়া তেমন কিছু দেননি। এখন যা চাইব দিবেন? ”
হ্যাভেন চামড়ার স্যান্ডেল জুতা খুলে কাউচে গিয়ে আয়েশ করে বসলো। তীক্ষ্ণ চাহনি বর্তায় অরুর উপর। অতঃপর গম্ভীর ভাবে ধ্রুব গলায় বলে ওঠে,
” চেয়ে তো দেখো বউ, বান্দার জান হাজির। ”
রসালো কথায় অরুর মন গলল না। কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। চক্ষু কোটর সংকুচিত করে মুখনিঃসৃত হয় রূঢ় সুরে,
” ভেবে বলছেন? ”
হ্যাভেন ভ্রু গোটায়। মাথা নেড়ে ঘাড়ের হাড্ডিসার ফোটাতে ফোটাতে রাশভারী কন্ঠে জানায়,
” ডিভোর্স বাদে যা খুশি চাইতে পারো। ”
অরু বাঁকা হাসে। নিজেও গিয়ে হ্যাভেনের পাশে দূরত্ব বজায় রেখে বসে পড়ল। উচ্চারণ করল অবিশ্বাস্য বাক্য,
” যদি বলি আপনার জীবন? ”
হ্যাভেনের মুখমন্ডলের কোনো পরিবর্তন ঘটলো না। সে কপাট হাসল। ফিচেল গলায় বলে,
” সেটা তুমি কখনো চাইবে না, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ”
অরু এবার ভণিতা ছাড়া সরাসরি প্রশ্ন ছুড়ল,
” কে আপনি? মুখোশ পড়ে আছেন কেন আমার সামনে? ”
অরুর মুখে এমন কথা শুনে হ্যাভেনের মুখবিবর বদলে গেল। কিছু একটা উপলব্ধি করল। ও ভেবেছে সেই পুরোনো প্রশ্ন অরু’কে বিয়ে কেন করেছে জানতে চাইবে। কিন্তু মেয়ে তো উল্টো গান গাইছে। সে একটু চুপ থেকে গভীর স্বরে জবাব দেয়,
” কি বলছো কিছুই বুঝতে পারছি না? ”
” টুটুল’কে কিডনাপ করতে কারা এসেছিল? টুটুলের কাছে তারা কি চায়? আপনার বাড়িতে এতটা কঠোর সিকিউরিটি থাকা সত্ত্বেও কিডনাপার ঢুকল কিভাবে? দারোয়ান বাদে রাতের বেলা যারা বাড়ি পাহারা দেয়, সকল গার্ড আজ নেই কেন? কোথায় তারা? ”
কথাগুলো বেরিয়ে আসল ফিনিক্সের পাখির মতো। যেন আগুনে পুড়ে, কিন্তু তার রাগ চিরকাল বেঁচে থাকবে। অকস্মাৎ বিস্ফোরিত বাক্যবহরে হ্যাভেন বিস্মিত হলো। সরু নজর নিভে এলো। বাইরের প্রকৃতির রূপ অবলোকন করে সেথায় দৃষ্টি গেঁথে রাখল। জিভের ডগায় ঠোঁট ভিজিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” তুমি এসব জানলে কিভাবে? ”
অরুর ভাবলেশহীন অটল জবাব,
” ল্যাপটপে দেখেছি। ”
হ্যাভেন মৃদু চটে ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
” কখন দেখলে? ”
” ল্যাপটপ ওপেন রেখে কোথাও গেলে কাছে থাকলে যে কেউ দেখতে পারবে। আর রাত্রির শেষ প্রহরে প্রায় ঘুম ভাঙলে বেলকনিতে আসতাম, তখন স্পষ্ট দেখেছি গার্ডদের। ”
” বিচক্ষণ রমণী! না বলে কারো প্রয়োজনীয় জিনিসে হাত দিতে নেই। ”
অরুর ত্যাড়া কর্কশ আওয়াজ,
” আমি আপনার বউ। আমাদের মাঝে প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই। থাকা উচিত না। ”
অরু একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে তাকাল হ্যাভেনের দিকে। কথাটা বলতে গিয়ে অরুর দেহ কাঁচের টুকরো বিঁধবার মতো জ্বলে উঠল। অধিকার সমেত কথা বললেও মনে মনে তটস্থ। এই ছেলে তো আবার একটা কথা শুনলেই পেয়ে বসে! হ্যাভেনের চোখের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে সে কিছু বুঝতে পারলো না। উচাটন হৃদয় ভাবল, এই লোকটা আসলেই রহস্যে মোড়া। এত কঠোর, অথচ তার ভেতরে যেন অনেক কিছু চাপা পড়ে আছে। কি দরকার গুমরে মরার? অরু’কে বললে কি খুব ক্ষতি হয়? উঁহু, বরং অরুও একটু স্বস্তি পায়।
হ্যাভেন হঠাৎ একটু ঝুঁকে নিরুদ্বেগ বলল,
” যখন বউ বউ ডাক পাড়ি, তখন বউ তুমি থাকো কার বাড়ি? ”
যা ভেবেছে তাই! পাজি লোক ভালো হবার নয়। মুখাবয়বে দুষ্টুমির আনাগোনা। অরু ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। মনগহীনে অদৃশ্য ভাঙাচোরা গভীর দাগ কাটল সবেগে। নিষ্প্রভ নেত্রে আওড়াল রয়েসয়ে,
” কষ্ট পেতে পেতে, খারাপ সময় দেখতে দেখতে প্রত্যেক মানুষ এক সময় অভ্যস্ত হয়ে যায়। স্ট্রং হয়ে যায়। খারাপ সময় আসলেও সেটা নিয়ে ভাবে না। তখন কেউ ছেড়ে গেলেও কষ্ট লাগে না। কেউ ইগনোর করা শুরু করলে ‘পাত্তা দিলাম না’ মুড নিয়ে নিজের মতো থাকা শুরু করে। আমাদের খারাপ সময়গুলো আমাদের প্রচুর কষ্ট দিলেও এই সময়গুলার প্রতি কৃতজ্ঞ আমরা। খারাপ সময় আমাদের মানুষ চিনতে শেখায়, স্ট্রং করে তোলে। আজকাল যাইহোক, আমরা ‘পাত্তা দিলাম না’ মুড নিয়ে চলতে থাকি। তাই মাঝে মধ্যে খারাপ সময় আসা দরকার। অনেক কিছু শেখা যায়। ”
হ্যাভেন বাইরে থেকে নজর সরিয়ে অরুর উপর নজর নিবদ্ধ করল। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ভ্রু উঁচায়,
” আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি? ”
অরু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরপর তাচ্ছিল্য হাসে।
” সেটাই বলছি, আঘাত পেয়ে বদলে যাওয়ার পূর্বে বিদীর্ণ করা বন্ধ করুন। ”
” কি করতে বলছো? ”
” করতে না, শুনতে চাই, জানতে চাই। ”
” কোন ব্যাপারে? ”
” টুটুল’কে? আপনার প্রথম বউ কোথায়? বেঁচে আছে নাকি মারা গিয়েছে? আপনি নিজেকে বারংবার ভার্জিন দাবী করেন, হোক মজার ছলে কিংবা সিরিয়াস ভঙ্গিতে, করেন তো? একটা কথা মিথ্যা হলে কেও বারবার রিপিট করে না। সত্যি বলুন, আপনি পূর্বে বিবাহিত? টুটুল আপনার ছেলে? ”
হ্যাভেন পরিতোষ নির্বিকার। নাকমুখ বিকৃত হয়ে উঠে। অরু নিষ্পলক ঔৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় উত্তরের আশায়। পরক্ষণেই এক নীলিমা সমান আশাতে জল ঢেলে আশাহত করে গা জ্বালিয়ে বলে উঠল হ্যাভেন,
” আহ! এত প্রশ্ন করো কেন? স্বামী অফিস থেকে সেই সন্ধ্যায় ফিরেছে। কোথায় তাকে ভালোবেসে আদর যত্ন করে সারাদিনের ক্লান্ত শরীরে একটু এনার্জি এনে দিবে, তা না করে অভিযোগ প্রশ্নের ঝুলি সাজিয়ে বসেছো! একটু জড়িয়ে ধরো। শরীর বড্ড টায়ার্ড লাগছে। রাত তো কম হলো না। ঘুমাবে না? ”
বলতে বলতে হ্যাভেন আলতো ভাবে অরুর একটা হাত স্পর্শ করল। তক্ষুনি অরু ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে দিল। চোখে মুখে অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। হ্যাভেনের ভাবলেশহীন অমন নির্বিকার শূন্য চাউনিতে আগ্রাসী হয়ে উঠে অরু। মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। বিরক্তির চরম পর্যায়ে গিয়ে বজ্র ধ্বনিতে চেঁচিয়ে উঠল তৎক্ষনাৎ। প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে বলে,
” উইথাউট বিটিং অ্যারাউন্ড দ্য বুশ, গিভ দ্য কারেক্ট অ্যানসার টু মাই কুয়েশ্চন? ”
এবারও নিশ্চুপ হ্যাভেন। শূন্য অভিব্যক্তিতে চারপাশে চোখ ঘোরালো শুধু। কষ্টের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নাসারন্ধ্র ভেদ করে। ভাসা ভাসা চক্ষু গহ্বরে চিরচেনা হিং’স্রতার বদলে হানা দিয়েছে অসহনীয় যন্ত্রণা। সেদিকে কয়েক মূহুর্তের বেশি তাকিয়ে থাকতে পারলো না অরু। ঝটপট চোখ নামিয়ে নিলো। লম্বা দম ফেলল। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেও ঠোঁটে কুলুপ এঁটে রাখল।
কিয়ৎক্ষণ পর সম্মুখে বসে থাকা ভারাক্রান্ত রমণীর মলিন চোখে চেয়ে, হ্যাভেন ছোট্ট করে জানান দিল নিজস্ব অভিব্যক্তি,
” টুটুল আমার ছেলে। বউ নেই। নাউ হ্যাপি? ”
অরুর ভেতরটা তৎক্ষনাৎ মাত্রাতিরিক্ত ক্রোধে চিড়িবিড়িয়ে উঠল। রাগে শরীর কাঁপছে। ফর্সা মুখশ্রী জুড়ে ছেয়ে রয়েছে রক্তিম আভায়। বাইরের নরম তনু সত্তাটা সামলে নেয় দ্রুত। চোখে মুখে কিছুটা থমথমে ভাব করে হ্যাভেনের মুখের উপরই কথা ছুঁড়ে মারল অরু,
” আমাকে কি আপনার মাথা মোটা মনে হয়? ”
হ্যাভেনের ভণিতা ছাড়া সাবলীল স্বীকারোক্তি,
” অবশ্যই। কোন সন্দেহ আছে? ”
চোখ বড়ো করে তাকায় অরু। দাঁতে দাঁত পিষলো। গলবিল হতে বেরিয়ে আসে ক্ষুদ্ধ ক্ষেপা স্বর,
” আমি মজার মুডে নেই। সিরিয়াস ভঙ্গিতে জানতে চেয়েছি, আমার উত্তর দিন। ”
” দিলাম তো। ”
” সঠিক ভাবে দেননি। বলুন আপনি আগে বিয়ে করেছেন? আপনার বউ বর্তমানে কোথায়? ”
হ্যাভেন মেকি হেসে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে জানালো,
” আমার সুন্দরী বউ আমার সামনে। ”
অরু জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করার ক্ষুদ্র প্রয়াস চালাল। অতঃপর কিড়মিড়িয়ে গর্জে ওঠে,
” আগের বউ? ”
হ্যাভেন অতিরিক্ত অযাচিত যন্ত্রণায় তিরিক্ষি মেজাজ সহিত আনমনে কপালে ভাঁজ ফেলে মুখ ফসকে বলে উঠলো,
” আরেকটা বউ পাবো কোথায়? জীবনে বিয়েই করলাম একটা! ”
অরু চমকে থমকে গেল। মুখে দু’হাত চেপে চেঁচিয়ে অবিশ্বাস্য সুরে বলে,
” তাহলে মিথ্যা কেন বলেছেন এতদিন? ”
অরুর বাজখাঁই চিৎকারে হ্যাভেনের টনক নড়ল। সম্বিত ফিরল মুহূর্তে। অধরে অমায়িক হাসি টেনে, ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে আমতা আমতা করে অযুক্তিযুক্ত কথাবার্তা আওড়াল তৎক্ষনাৎ,
” আই মিন, তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে একটাই বিয়ে করেছি, সেটা বলতে চেয়েছি। ”
অরুর মনঃক্ষুণ্ন হলো। বোধশক্তি খোয়ালো ক্ষণিকের জন্য। তড়িৎ গতিতে উঠে এসে হ্যাভেনের কোলের উপরে বসে পড়ল। অকস্মাৎ মুখশ্রী কাঠিন্য রূপ ধারণ করল। মোটামুটি শরীরের সর্বস্ব শক্তি প্রয়োগ করে হ্যাভেনের গলা টিপে ধরল। ঝড়ের বেগে ঘটমান ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেল হ্যাভেন। বাকরুদ্ধ হয়ে মুখ খুলে হা করে নিঃশ্বাস নিয়ে জবরদস্তি অরুর হাত ছাড়িয়ে নিলো। হাত যুগল মুঠো বন্দী করে হতবিহ্বল অক্ষিপট প্রসারিত করে, অরুর সূর্যের ন্যায় তেজি মুখাবয়বে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। পরপর হুড়মুড়িয়ে জানতে চাইল,
” বিধবা হওয়ার খুব শখ? ”
অরু অসন্তোষ প্রকাশ করল। ফুঁসতে ফুঁসতে ঝাঁঝালো গলায় প্রতুত্তর করে,
” হ্যাঁ। ভ্রান্ত ধারণা দিচ্ছেন? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে যা জিজ্ঞেস করেছি স্পষ্ট বলুন? ”
” খেয়েছো? ”
” কথা ঘোরাচ্ছেন। ”
রুক্ষ আওয়াজ কর্ণগহ্বরে পৌঁছাতেই হ্যাভেন ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ল। অরুর ধারালো বাক্যবাণে প্রত্যুত্তরে কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্থ সে।
” স্বামীর আদর খাচ্ছো, হোক সম্মতিতে কিংবা অসম্মতিতে, স্বচ্ছলতা স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করছো, আর কি চাই? ”
” মানসিক শান্তি চাই। আমার জানার রাইট নেই?”
” আজাইরা ঢং রংচংগা বেশি হয়ে যাচ্ছে। তোমার বিদঘুটে যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ আমি। চুপচাপ থাকতে পারো না? সবসময় উদ্ভট কাজ…..”
হ্যাভেনের চওড়া বাক্য সম্পন্ন হলো না, যবনিকার আগেই অরুর টলমলে নেত্রের আহত চাহনির মাঝে থমকে গেল দৃষ্টি যুগল। আচানক বক্ষঃস্থলে সুক্ষ্ম রেখার ন্যায় চিনচিন ব্যথাতুর ক্ষত সৃষ্টি করল। এক লহমায় বাষ্পীভূত হলো অগ্নি তান্ডব। অসাড় হয়ে এলো মুঠোয় রাখা হাতের দৃঢ় বাঁধন। নিভে আসা হরিণী কাজল চোখ দু’টোর মাঝে দৃষ্টিস্থাপন করে হ্যাভেনের স্মৃতিজুড়ে জাগ্রত হলো, একটু আগে কাটকাট গলায় কি বলে ফেলল?
হ্যাভেন হতাশ নেত্রে চেয়ে বিরস মুখে শুধাল,
” কি জানতে চাও? ”
অরু আলগোছে হাত ছাড়িয়ে কোল থেকে উঠে দাঁড়ায়। চোখের জল ময়লা ঝাড়ার মতো আঙুল দ্বারা ছিটকে ফেলে দিল। বিদ্রুপ গলায় দুর্বোধ্য হেসে বলে,
” ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এক বাক্য! কি জানতে চাও? আপনি জানেন না কি জানতে চাই? ”
একটু থামল। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। বুক ভেঙে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। অরু’কে উচ্চস্বরে বাজে কথা শোনালে ছোট বেলা থেকেই ওর ব্রেইন সেটা সহ্য করতে সক্ষম হয় না৷ গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে। শুষ্ক ঢোক গিলে চিবিয়ে চিবিয়ে ধরাশায়ী কন্ঠে ফের বলতে লাগলো,
” যা জিজ্ঞেস করলাম সঠিক উত্তর দিন। প্লিজ হ্যাভেন, ধোয়াসায় রাখবেন না। আমারও ছোট্ট জীবন এটা। এরকম লাইফ ডিজার্ভ করি না আমি। টেনশনে মাথা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। গলা দিয়ে খাবার নামে না। মরে যাব আমি এত টেনশনে থাকলে। ”
অরুর করুণ স্বরে বলা কথায় কর্ণপাত করে হ্যাভেন এবার ঘাড় উঁচিয়ে চাইল। নিগূঢ় দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ভাবে বর্তায় মেয়েটির নিষ্প্রভ মুখশ্রীতে। ক্ষনিকের জন্য নিজের আকর্ষণীয় অনুভূতি শূন্য চোখ দুটো স্থাপন করল, নমনীয় সরলতার সমুদ্রের মতো গভীর হরিণী ছলছল জ্জ্বলজ্বলে চোখে। কতটা ভঙ্গুর লোচনে প্রত্যুত্তরের আশায় সে তাকিয়ে ওরই পানে। এ যেন খাঁ খাঁ মরুভূমির বুকে আঁকাবাঁকা স্বচ্ছ এক সুগভীর ঢেউ বিহীন নদ। যেথায় অগণিত না বলা অভিযোগের বাক্যবহর।
চোখের দৃষ্টি অবিচল রেখেই অনিমেষ গমগমে কন্ঠে প্রতিধ্বনি তুলে ধমকে উঠল হ্যাভেন,
” চুপ বেয়াদব নারী! আর একবার মরার কথা বললে থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে দেবো। ”
অরুর পরাজিত সৈনিকের ন্যায় কাতর গলার ভঙ্গুর আওয়াজ,
” আমি সত্যি জানতে চাই। যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার। ”
হ্যাভেন কথাগুলো ধৈর্য্য ধরে শুনল। এরপর কাউচ ত্যাগ করে শান্ত ভাবে এগিয়ে এসে এক ঝটকায় অরু’কে নিজের কাছে টেনে নিলো। অরু হতবাক হয়ে গেল। তাদের কপাল এক হলো, শ্বাস এক হয়ে উঠল।
হ্যাভেন মোলায়েম কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
” তুমি এতটা অধৈর্য কেন অরু পাখি? ”
অরুর চোখে অশ্রু জমে। ঠোঁট কাঁপছে কিন্তু কোনো কথা বলতে পারছে না। হ্যাভেনের নিরেট স্বরে বলা বাক্যে হৃদয়ের সমস্ত প্রতিরোধ গলিয়ে দিচ্ছিল। না অরু তা হতে দেবে না। ঝাড়া মেরে হ্যাভেন’কে সরিয়ে দিল। খেই হারিয়ে রুষ্ট জোরালো শব্দ মুখনিঃসৃত ঘটল,
” ভণিতা না করে বলুন? নয়তো সত্যি সত্যি কোনো একদিন অফিস থেকে ফিরে এসে দেখবেন, আমি মরে পড়ে আছি আপনারই বিশাল বেডরুমের মেঝের অল্পসংখ্যক জায়গা দখল করে। ”
এ পর্যায়ে বদলে গেল হ্যাভেনের অভিব্যক্তি। বক্ষপিঞ্জর কেঁপে উঠে। এতক্ষণের দমনকৃত রাগটা চিড়বিড় করে মস্তিষ্কে হানা দিল সবেগে। তৎক্ষনাৎ দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরল অরুর জরাজীর্ণ শরীর। অরু ঘাবড়ে গেল। হ্যাভেনের চক্ষুকোটরে যেন কেউ আলতা ঢেলে দিয়েছে। অথবা নদীর মধ্যে বেশিক্ষণ ডুবে গোসল করার দরুন চোখ যে পরিমাণ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে, হ্যাভেনের আঁখি যুগল সেরকম রক্তিম হয়ে গিয়েছে। মুখমন্ডল কাঠিন্য, যা দেখে কম্পিত হয় অরুর দেহশ্রী।
অরু’কে দেয়ালের সঙ্গে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা ধরায়, তার মেরুদণ্ডের কশেরুকা এবং মাথার পেছনের তন্তুতে তীব্র ব্যথার অনুভূতি হলো। এই চাপের কারণে শিরা-উপশিরাগুলোর মধ্যে সৃষ্ট চাপ শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রবাহিত হয়ে, অরুর শারীরিক অবস্থার অবনতির সূচনা ঘটছে। সে বিদীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, মুখাবয়বে কোনো পরিবর্তন আনতে নারাজ। দুর্বলতা চটে যাওয়া হ্যাভেন’কে দেখাবে না। তার প্রতিরোধী মনোভাব এতটাই দৃঢ় যে, সে নিজেকে সংকটে ফেলে দিয়েও বাইরের দৃশ্যে কোনো দুর্বলতা বা কষ্টের আভাস প্রকাশ করতে প্রস্তুত নয়। চেহারায় চাপ, ক্ষোভ, এবং অদৃশ্য যন্ত্রণা জমা থাকলেও, কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না, যেন সে এক অদৃশ্য শক্তি দ্বারা শাসিত হয়ে নিজের যন্ত্রণা সযত্নে গোপন রাখছে।
অরুর সকল কথা অগ্রাহ্য করে ক্ষুদ্ধ দৃষ্টিপাত ঘটাল হ্যাভেন। অরুর চিবুকে আঙুল ছুঁয়ে দিল আলতো করে। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। বেরিয়ে এলো রাগান্বিত সুর,
” নিষেধ করেছি না? পুনরায় আমার সামনে মরার কথা উচ্চারণ করতে বুক কাঁপলো না? তাও রীতিমতো এক-প্রকার হুমকি দিলে? এটার হিসাব বরাবর কিছুক্ষণের মধ্যেই করছি, আর তোমার প্রশ্নের জবাব পরে সময় করে একদিন দিবো। তার আগে বলো, পথিমধ্যে তোমার উপর অ্যাটাক হয়েছিল আমাকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করলে না কেন? ”
অরু কাচুমাচু হয়ে দাঁড়ায়। ভয়হীন অটল জাবাব দিল,
” আপনি কি আমাকে সব কথা বলেন? জিজ্ঞেস করলেও বলেন না। তাহলে আমার সাথে ঘটা সকল বিষয়বস্তু আপনাকে জানাবো ভাবলেন কিভাবে? ”
মুখের উপর যোগ্য ত্যাড়া উত্তর পছন্দ হলো না হ্যাভেনের। মেজাজের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো তৎক্ষনাৎ। অরুর হাতদুটো মাথার উপরে তুলে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। ওর গলার কাছে মুখ নিয়ে দাঁতে দাঁত চাপলো হ্যাভেন। কন্ঠে কঠিন ভাবভঙ্গি সরূপ তিক্ততা,
” বলতে হবে না। না বললেও আমি জানতে পারি। এবার হিসাব বরাবর করে শাস্তি দেওয়ার পালা। ”
ভীতিগ্রস্ত অরু কোনোরকম হাত আলগা পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে সজোরে ধাক্কা দিল হ্যাভেন’কে। ভাবল, আবারও কামড় দিয়ে সুক্ষ্ম দন্তপাটি দ্বারা দেহের নরম চামড়া ক্ষতবিক্ষত করবে। নতুন বিদীর্ণ চামড়ায় এখনো কালচিটে দাগ স্পষ্ট। অরুর আর সহ্যশক্তি নেই, তাই ভয় পেয়ে ধাক্কা মেরেছে।
অরু কন্ঠ বিধিবাম কম্পমান। কাতর স্বরে আর্জি জানায়,
” মরার কথা আর জীবনেও বলবো না। সেদিনের মতো ভয়ংকর বেদনাদায়ক কষ্ট দিবেন না। ”
অকস্মাৎ ধাক্কায় পিছিয়ে গেল কিঞ্চিৎ হ্যাভেন। নিক্ষেপ করল ধারালো তীক্ষ্ণ চাহনি। মৌমাছির মতো মধুরস আহরণের ন্যায় জিভের ডগায় ঠোঁট ভেজালো সে। পরপর বলিষ্ঠ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে অধরে লেগে থাকা অবশিষ্ট তরলাংশটুকু মুছে ফেলল নির্দ্বিধায়। লোহা দ্বারা বেষ্টিত গ্রীলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ঘাড়টা সামান্য কাত করে সম্মুখের মেয়েটার পানে নিগূঢ় দৃষ্টিপাত ঘটাল। বাতাসের দাপটে গোছানো চুল অল্পস্বল্প এলোমেলো হয়ে নেমে এসেছে কপালের অগ্রভাগে।
অরুর আদ্রতাশূন্য পদ্মকুড়ির ন্যায় ওষ্ঠদ্বয়ে নিগূঢ় চাউনি নিক্ষেপ করে নেশালো গলায় আওড়াল হ্যাভেন,
” যন্ত্রণা দিবো না, শুধু শাস্তি স্বরূপ চুমু খাবো। ”
ভয়ার্ত অরু হকচকিয়ে গেল। বারকয়েক পলক ঝাপটায়। কানে বারংবার বেজে যাচ্ছে হ্যাভেনের মাতাল স্বর। হতাশ নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে চায়। বিরস মুখে বিড়বিড়িয়ে বলল,
” মানুষ রেগে গেলে চেঁচামেচি করে, বকুনি দেয়, মারধর করে, আর এই লোকের কি না রোমান্স পায়? চুমু খেতে ইচ্ছে করে? আল্লাহ এ আমি কার পাল্লায় পড়লাম? ”
প্রেমপিপাসা পর্ব ২৩
অরুর অন্যমনস্ক ভাবনার মধ্যিখানে আচমকা এক জোড়া উষ্ণ ওষ্ঠপুট তেড়ে এসে ওর মাখন নরম তুলতুলে ওষ্ঠদ্বয়ে বসে গেল। নিঃশ্বাস আটকানো শক্ত ওষ্ঠ চুম্বন। আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব অরু। ড্যাবড্যাব করে খুলে রাখা চক্ষুদ্বয় খিঁচে বুজে ফেলল মুহূর্তে। ছাড়ানোর চেষ্টা করল না, বরং অচিরেই পেলব হস্ত যুগল খামচে ধরল বেসামাল পুরুষের কোমর এবং পৃষ্ঠদেশ। বক্ষঃস্পন্দন ধকধক শব্দে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। পূর্বে সতর্ক সংকেত ব্যতীত, অরু হিমশিম খাচ্ছে একপল ফুরসৎ না দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে ছুটে এসে চুমু খাওয়া হ্যাভেন’কে সামলাতে। প্রথমবারের ন্যায় পুরুষালী সংস্পর্শে এসেছে ও। ভালো লাগা, খারাপ লাগা সংমিশ্রণে টালমাটাল রমণী। এ কেমন অনুভূতি? এ কেমন সুখ যন্ত্রণা?