প্রেমময়ী বর্ষণে তুই গল্পের লিংক || লাবিবা ওয়াহিদ

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১
লাবিবা ওয়াহিদ

পাঁচ তারকা হোটেলের টপ ফ্লোরের একটি রুমে দুজন ছেলে-মেয়ে ঘনিষ্ঠ হওয়ার আগ মুহূর্তে ছেলেটি মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে নিজের দিক থেকে সরিয়ে দিলো। মেয়েটি তাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে গিয়ে পরলো। ছেলেটির চোখে-মুখে রাগ স্পষ্ট। ছেলেটি আর কেউ না বাংলাদেশের সেরা অলরাউন্ডার রায়াফ সানভি। রায়াফ টিস্যু দিয়ে গালের লিপ্সস্টিক মুছতে মুছতে চেঁচিয়ে বললো,

-“হাউ ডেয়ার ইউ!! আমার রুমে আমার পারমিশন ছাড়া প্রবেশ করার অধিকার তোমায় কে দিলো? হু!! নষ্টামী সব জায়গায় এলাউ না!”
মেয়েটি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে চোখ রাঙিয়ে বললো,
-“আমি কেন পারমিশন নিবো, হোয়াই? তোমার রুমে আমি যখন তখন আসতে পারি বিকজ আই লাভ ইউ!”
রায়াফ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“এই তিনটা ওয়ার্ডে কখনোই লাভ সাইট প্রুভ হয় না। তোমার মতো ক্যারেক্টারলেসের সাথে তো একদমই যায় না। তোমরা টাকা জিনিসটার জন্য সব করতে পারো, যতোটা না এখন নিচে নামতে যাচ্ছিলে!””
-“তোমার প্রব্লেম কী রায়াফ, একটাবারের জন্য বেড শেয়ার করলে কী এমন হয়? তোমায় ইংল্যান্ড এনেও আমার প্ল্যান ফ্লপ হয়ে গেলো।”
-“ভুল বললে, আমি তোমার জন্য না আমার ম্যাচের জন্য এসেছি৷ নাও লিভ!! নয়তো আমি বাধ্য হবো গার্ডকে দিয়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করতে!”

মেয়েটা রায়াফের কথায় পাত্তা না দিয়ে আবার রায়াফের দিকে এগোতে লাগলো। এবার রায়াফ তার রাগ দমাতে না পেরে গার্ডকে জোরে হাঁক ছাড়লো। দুজন গার্ড ছুটে আসলো। রায়াফ হুংকারের সুরে বলে,
-“এই নির্লজ্জ, বেহায়া মেয়ে আমার রুম থেকে বের করো ফাস্ট! আর তোমাদের তো আমি পরে দেখে নিচ্ছি!”
বলেই রায়াফ তার ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। আজ বাংলাদেশ ভার্সেস ইংল্যান্ডের সিরিজ চলছে। রায়াফ বের হতে গিয়েও সোনিয়ার জন্য লেট করে ফেলেছে। দুই গার্ড শুকনো ঢোক গিলে সোনিয়াকে টেনে হিঁচড়ে বের করলো রুম থেকে। সোনিয়া নিজেকে ছাড়াতে চেয়েও পারেনি। এবারও সে রায়াফকে পেলো না।
রায়াফ ছুটছে এবং রাগে ফুঁসছে। মিনমিন করে বললো,

-“সব মেয়েই এক রকম। এরা ভালোবাসার মর্ম বুঝে না, চিনে স্পেশালিটি আর মানি। আই হেইট গার্লস। এই রায়াফ সানভির জীবনে আমি কোনো মেয়েকে কখনোই এলাউ করবো না। যেখানে নিজের মাকেই ঘৃণা করি সেখানে…”
পরের কথা বলার আগেই রায়াফ ক্যাবে গিয়ে উঠলো।
বাংলাদেশের সকলের মুখেই চিন্তার ছাপ, টার্গেট একদমই ভালো যাচ্ছে না। সকলের একটাই চিন্তা, বাংলাদেশ এবার জিতবে তো? এদিকে প্লেয়ারদের মনেও একইরকম চিন্তা। বাংলাদেশের ক্যাপ্টেন ইমন কিছুক্ষণ পরপর বোতলে চুমুক দিচ্ছে আর কপালের ঘাম মুছছে৷ কোচ ইমনের কাছে এসে বললো,

-“এটা কী হচ্ছে ইমন? রায়াফ কোথায়? ফিল্ডিং-এর পর থেকে আশেপাশে দেখা কেন যাচ্ছে না?”
কিছুটা দূর থেকে রায়াফের একমাত্র সঙ্গী ফাহান কোচের কথা শুনতে পায়। ফাহান কোচের দিকে যেয়ে বললো,
-“রায়াফ কিছু কাজে হোটেল গিয়েছে৷ চিন্তা করবেন না চলে আসবে।”

কোচ আরও কিছু বলার আগেই আরেকটা উইকেট পরলো। এই একজন প্লেয়ারই ভালো খেলছিলো কিন্তু সে-ই আউট হয়ে গেলো। এবার যেন চিন্তায় সকলের অবস্থা যায় যায় অবস্থা। প্লেয়ার মাথা নিচু করে কোচদের কাছে আসতেই দূরে দেখা গেলো একজন মাঠে নামছে। সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখে নিরব বাঙালিরা যেন প্রাণ ফিরে পেলো এবং চেঁচিয়ে চিয়ারআপ করতে লাগলো। হ্যাঁ রায়াফ নেমেছে। কোচ কিছুক্ষণ একপলক রায়াফের দিকে তাকিয়ে ইমনকে সাইডে নিয়ে বললো,

-“এটা কেমন হলো ইমন? রায়াফ একবারের জন্যেও আমাদের সাথে দেখা করার প্রয়োজনবোধ করলো না?”
ইমন স্মিত হেসে বলে,”রায়াফকে কখনো দেখেছেন প্রয়োজন বাদে দেখা বা কথা বলতে। এই মুহূর্তে ও খেলা চিন্তিত, তাই হয়তো সেই সৎ সুযোগ পায়নি!”
কোচ কিছু বললো না৷ সে নিজেও জানে রায়াফ কেমন প্রকৃতির ছেলে। তাও মানুষ মানুষের সাথে মিশতে চায়, এটাই স্বাভাবিক৷

আমি পপকর্ন খাচ্ছি আর আমার সামনের মানুষগুলার কান্ড-কারখানা দেখছি। লিভিংরুমে সব কাজিন, ফ্রেন্ড আর ছোট ভাই মিলে মরণের খেলা দেখছে। বুঝি না, এই ক্রিকেটে কী এমন মধু আছে? একটা ব্যাট-বল বাইরাইলেই তো মহৎ খেলা হয়ে যায় না। এ তো বাচ্চারাও পারে। যত্তোসব রঙঢঙ!
-“তা টিভির থেকে এতো দূরে বসে আছিস কেন তোরা? টিভির ভিতরে ঢুকলে মৌমাছিগুলা ভালোভাবেই তোদের মধু বিলাইয়া দিতো।”

আমার কথা শুনে কলি আমার দিকে একটা কুশন ছুঁড়ে মেরে চোখ রাঙিয়ে বললো,
-“বাংলাদেশ হারার পথে আর তুই কিনা এই বেটাইমে মজা নিচ্ছিস? ডোবায় গিয়ে মর!”
-“কেন কেন? তোদের না সাদা ইলিশ আছে, সে নাকি কোনো ম্যাচ হারতেই দেয় না? হাহ! ন্যাকা!” কুশনটা এক হাতে ধরে বললাম।

আমার বলতে দেরী কিন্তু ওদের চেঁচাতে দেরী নাই। সব একসাথে লাফ দিয়ে উঠলো। টিভিতেও অনেক সাউন্ড হচ্ছে বিধায় আমি সেদিকে তাকালাম। এক প্লেয়ার মাঠে নামছে। স্ক্রিনে প্লেয়ারের নাম ভাসতেই আমি মুখ বাঁকা করে পপকর্ন খেতে শুরু করলাম। আমার ছোট ভাই আদনান চেঁচিয়ে বললো,
-“আম্মু! জলদি আসো, আমাদের হিরো খেলায় নামছে! এবার মাঠ কাঁপবে!”

আম্মু যেন সাথে সাথে একপ্রকার ছুটে আসলো লিভিংরুমে। হাতের খুন্তি দেখেই বোঝা গেলো রান্না ফেলেই মা চলে এসেছে। খেলা এগোচ্ছিলো না বলে না রাঁধতে চলে গেছিলো। এখন মা যেহেতু এসেছে আমার আর এখানে থেকে কাজ নেই কারণ, মায়ের সামনে খেলা নিয়ে বেড কমেন্টস করতে পারবো না। করলে হাতে যে গরম খুন্তিটা আছে, সেটা আমার পিঠে বসতে দু’সেকেন্ডও লাগবে না। তাই আমি ওদের ফেলেই রুমে চলে আসলাম। আহ! এখন কিছুটা শান্তি লাগছে। এই মেয়ে-ছেলেগুলার জ্বালায় বাঁচি না। বাংলাদেশের খেলা হলেই কাজিনগুলা চলে আসে। আরও দল ভারী করতে আদনান আমার ফ্রেন্ডগুলারে কল করে বাসায় নিয়ে আসে। এদিকে যে কাল পরীক্ষা সেদিকে মহা-রানীদের কোনো খেয়ালই নেই।

আমি কিছু না ভেবে পড়তে বসে গেলাম। এই অপদার্থ এমনেই মগজে ঢুকে না তার উপর বাইরের চিল্লাচিল্লি। উফফ কান ধরে গেলো।
পাক্কা এক ঘন্টা এই চিৎকার-চেঁচামেঁচি হজম করলাম৷ এদিকে পড়ায় লাড্ডুও মারলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ১১টার বেশি বাজে। হায় আল্লাহ! কাল সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরু, কী দিবো?
ভেবেই যতো রাগ জমলো আদনানের উপর। দরজার দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বললাম,
-“আদনাইন্না! তোরে হাতের কাছে পাই!! হাড্ডিসহ কিমা বানামু তোরে! তোর জন্য আমার ফিজিক্স আসমানে!”
বলেই রাগে ফুঁসতে লাগলাম। তখনই কলি, ইরা আমার রুমে আসতে আসতে বললো,

-“কীরে লিলি!! ঘুমিয়ে গেছিস?”
-“না তো! তোদের না কেলিয়ে ঘুমোতে পারি?”
-“রাগিস কেন? এখন তো ফূর্তি করার কথা। উফফ রায়াফ দ্যা হিরো কী ম্যাচটাই না খেলসে দোস্ত।”
-“তুই চুপ কর! কাল আমাদের ফিজিক্স ইক্সাম! অপদার্থের “প” টাও পারি না। কোন অপদার্থ যে প্যারা দিতে এই প্যারা আবিষ্কার করলো!”

-“সারাবছর না পড়ে ঘুমালে এই অবস্থাই হবে।” ইরা বিছানায় হেলান দিতে দিতে বললো। এবার আমায় পায় কে। পা থেকে স্যান্ডেল খুলে উঠে দাঁড়ালাম৷ আমার হাতে স্যান্ডেল দেখে দুজনই একেবারে স্ট্রিট হয়ে বসলো। কলি কাঁপা গলায় বললো,
-“স্যান্ডেল হাতে নিছিস কেন দোস্ত? ওটা রাখ, ফেল বলছি!”
-“যেসব হারামী আমার রুমে বসে আমাকেই ইনসাল্ট করে তাদের এটাই প্রাপ্য। এখন দুটোয় আমার ঘর থেকে বের হ, নয়তো স্যান্ডেলের বারি একটাও মাটিতে পরবে না!”

-“কিরে লিলি! তুই স্যান্ডেল নিয়ে ওদের ধমকাচ্ছিস কেন?” রুমে আম্মু ঢুকতে ঢুকতে বললো। তখনই লিলির বান্ধুবি ইরা ন্যাকামি করে বললো,
-“দেখেন না আন্টি, আমাদের রুম থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। আপনি-ই বলেন এতো রাতে বাসায় যেতে পারবো!”
লিলি ইরার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই মা কোমড়ে আঁচল বেঁধে হাতে থাকা খুন্তিটা লিলির দিকে দেখিয়ে বললো,
-“এই ঘর থেকে যেন একদমই চেঁচামেচি না শুনি লিলি! ওরা এখানে থাকবে, তোর তাতে কী সমস্যা? স্যান্ডেল জোড়া দে। তোরে আমার বিশ্বাস নাই।”

আমি করুণ চোখে একবার মায়ের দিকে তো আরেকবার ওদের দিকে তাকাচ্ছি। দুই শয়তান্নি মুখ চেপে হাসছে। আমি একপ্রকার রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে অন্য স্যান্ডেলটাও পা থেকে খুলে মাকে দিয়ে দিলাম। মাঝেমধ্যে মনে হয় আম্মু যেন আমার না, ওদের মা। ধপ করে আবারও চেয়ারে বসে পরলাম। দুই বান্দাকে কিছুক্ষণ কিলাতে পারতাম, হালকা লাগতো। দুইজন কয়েকবার আমায় পড়ায় হেল্প করতে চেয়েছে বাট আমি ওদের পাত্তা দেইনি। রাগ যেন যাচ্ছেই না। কিছুক্ষণ বাদে বাবাই এক সারপ্রাইজ নিয়ে হাজির হলো যা দেখে সবাই হুররে করে চিৎকার দিয়ে উঠলো।

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ২