প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১৭

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১৭
লাবিবা ওয়াহিদ

রায়াফ নিশ্চুপ হয়ে রিক্তাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। এতদিন ভাবতো তার মা থেকেও নেই, ঘৃণা করতো এই মাকে অথচ কতটা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে গেছে। এজন্যই যে এই “মা” সেরা। তারা সন্তানের জন্য নিজের জীবন বাজি রাখতেও প্রস্তুত। রায়াফ ভাঙ্গা গলায় বলে,
-“আমায় ক্ষমা করতে পেরেছো তো মা?”
-“কী বলছিস তুই রায়ু? তুই তো কোনো ভুল করিসনি, তোকে ভুল বোঝানো হয়েছে!”
মুহূর্তেই রায়াফের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।

-“আমি ওই কৌশলকে ছাড়বো না, নিজ হাতে তাকে মারবো!”
আফনা আগেই তার পরিবারকে অন্য ঘরে রেখেছিলো যাতে ওদের কথোপকথন তারা শুনতে না পায়। আফনা এতক্ষণ নিরব থাকলেও এবার মুখ খুললো,
-“আপনি ঠান্ডা মাথায় না ভেবে এমন পকপক করেন কেন? ওরা এতো ধামাকাদার প্ল্যানিং তো আপনার মতো নাকের ডগায় রাগ নিয়ে করেনি, বেশ ঠান্ডা মাথায় করেছে। তাই প্লিজ মাথা ঠান্ডা করুন, ভাবুন কীভাবে নিজের হাতে না মেরেও বড় ধামাকা ওদের উপহার দিতে পারেন!”
রিক্তা রায়াফকে ছেড়ে আফনার দিকে তাকালো। এবার রায়াফের দিকে দৃষ্টি স্থির করে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“ঠিক বলেছে আফনা। যা করার ঠান্ডা মাথায় করতে হবে। তা শুনলাম সোনিয়া নামের একটা মেয়ে নাকি ইদানীং তোর পিছে পরেছে?”
-“ইদানীং কী বলো? লন্ডনে পড়তে গিয়ে সেই থেকেই পিছে লেগেছে। কিন্তু সোনিয়ার কথা তুমি জানলে কী করে?”
-“আমি বলেছি!”
হঠাৎ পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে সকলে দরজার দিকে তাকালো। রায়াফ অস্ফুট সুরে বলে উঠলো,
-“চাচ্চু?”
চাচ্চু মুচকি হেসে বললো, “কী ভাতিজি চমকে দিলাম? আমি কিছু বললে তো আরও চমকাবা!”
রায়াফ অবাক হয়ে বললো,”তুমি এ বাড়ি চিনলে কী করে? আর মায়ের সাথে কীভাবে কী?”

-“আমার দেবর সাহেবই এতদিন আশেপাশের খবর লিক করেছে!” মুচকি হেসে বললো রিক্তা!
-“মানে?”
-“সোনিয়া কে জানিস?”
-“না তো!”
-“কৌশলের মেয়ে। কৌশল লন্ডনে ব্ল্যাক মানির ব্যবসা করছে।”
আফনা মনে মনে ভাবলো,
-“নামও যেমন কৌশল তেমনই বাজে কাজে সে কৌশলের রাজা! ঠাডা পরুক এই বেডার উপর। আবার কী বললো সোনিয়া না ঘুনিয়া চুন্নি রায়াফের পিছে পরসে? এতো সাহস? সামনে পাই চুল টেনে কাঁদায় ভূত বানাবো!”
-“হোয়াট!”

-“হু ভাতিজি! সব কিন্তু তোমার এই চাচ্চুর ক্রেডিট। তোমার চাচ্চু আজীবন ভার্সিটি নিয়ে নয় এসব ইনভেস্টিগেটও করতো। আর এই মেয়েটাকে(আফনাক) কেমন চেনা চেনা লাগছে!?”
রায়াফ হেসে বললো,”তোমার লাল নীল ইলিশ, অপদার্থ এবার ফিনিশ এর লেখিকা!”
আফনা খেয়াল করেনি যে এটা ওর ফিজিক্স টিচার। পরবপর্তীতে রায়াফের মুখে এমন কথা শুনে আফনা লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে। চাচ্চু ভ্রু কুচকে বললো,
-“এটাই কী তাহলে…!”

রায়াফ মাথা নাড়ালো যার উত্তর “হ্যাঁ!” চাচ্চু হাসলো। এই দুষ্টু যে তাদের পরিবারে আলো হয়ে আসবে কে জানতো? রিক্তা আজ বেশিই প্রসংশা করেছে এই আফনার। এই মেয়েটির দর্শন পেতেই সে রিক্তার দেয়া ঠিকানায় এসেছে।
কিছুক্ষণ বাদে রিক্তা পরিবারের সকলের থেকে বিদায় নিয়ে রায়াফ এবং চাচ্চুর সাথে চলে গেলো তাদের নিজের বাড়িতে। এদিকে আদনান লাফাচ্ছে রায়াফকে তাদের বাসায় দেখে। আগেও দেখেছিলো তবে আজ একটু বেশিই খুশি কারণ, আজ আদনানের সঙ্গে রায়াফ বেশ মজা করেছে। এখানেজ নাস্তা খেয়ে বেরিয়েছে ওরা।

বিকালে আফনা তার ঘরে বসে রায়াফের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোই ভাবছিলো। কেন যেন সবকিছু তার স্বপ্নের মতোই লাগছে। রায়াফের প্রতি তার ভালো লাগা কাজ করে এখন। আফনার ভাবনার মাঝেই কল আসলো তার। আফনা ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো রায়াফ কল করেছে! আফনা দ্রুত কল রিসিভ করলো।
-“আমাকে ভাবছিলে বুঝি?”
আফনা কিছুটা চমকে উঠলেও স্বীকার করলো না।
-” আপনাকে নিয়ে ভাববো কেন? আশ্চর্য!”
-“এতো বোকাও আমি নই ওকে?”
আফনা কথা ঘুরিয়ে বললো,”মাকে পেয়ে কেমন যাচ্ছে আপনার দিন?”
-“অসাধারণ। তুমি না থাকলে যে এসব কিছুই সম্ভব হতো না। তোমার জন্য একটি উপহার আছে, আমার তরফ থেকে!”
-“কী?”
-“সারপ্রাইজ!”

ইদানীং আফনা টের পাচ্ছে তাকে কেউ ফলো করছে। তবে আফনার এরকম ফিল হলেও সে এখন মনে-প্রাণে রায়াফকে ভাবতে ব্যস্ত। সে বুঝেছে রায়াফের জন্য তার মনের গহীনে কিছুটা হলেও জায়গা হয়েছে। যদিও রায়াফ এখনো তা স্বীকার করেনি, তবে তার ইঙ্গিতে সে ঠিকই বুঝে। রায়াফ সেদিন তাকে সারপ্রাইজ বলে নিজেই হাওয়া হয়ে গেছে যা আফনাকে বেশ ব্যথিত করেছে। লজ্জায় নিজ থেকে কল দিতে পারেনি এখনো। আফনার আবারও মনে হলো কেউ তাকে ফলো করছে। আফনা পিছে ফিরতেই কেউ ভীরের মাঝে হারিয়ে গেলো।

আফনা তার কোমড়ে হালকা হাত রাখলো। কোমড়ে সে মরিচের গোলানো স্প্রে রাখে সবসময়। আফনা হালকা চাপ দিয়ে আবারও সামনে এগোতে লাগলো। সন্ধ্যার আবছা আলো আস্তে আস্তে অন্ধকারে পরিণত হয়। হাঁটতে হাঁটতে সে নির্জন একটা জায়গায় চলে আসে। এদিকে মানুষজন নেই বললেই চলে। এদিকে আসতেই সে আরও কিছু মানুষের উপস্থিতি টের পায়। এবার আফনার ভয়টা যেন আরও বেড়ে যায়। সে মনের মধ্যে “আল্লাহ”-র নাম জোপ করতে করতে সামনে এগোচ্ছে। তখনই কয়েকজন কালো মুখোশ পরিহিত লোক তাকে ঘিরে ধরলো। তাদের সামনে একটা ছেলে এসে দাঁড়ায় যার মুখে শুধু একটি মাস্ক! আফনা তাকে দেখে অনেকটা ভয় পেয়ে যায়! সকলের দিকে তাকাতে তাকাতে বললো,

-“কে আপনারা? কী চাই?”
-“তোমাকে ডার্লিং! তুমি তো ওয়ান এন্ড অনলি রায়াফের প্রেমিকা!”
আফনা আতকে উঠে ছেলেটির কথা শুনে। আফনার তখনই কৌশল মাথায় আসলো।
-“আপনারা কী চান আমার থেকে!”
-“বেশি কিছু না, তোমায় অতিথি আপ্যায়ন করবো!”
-“আমি আপনার ফেস দেখতে চাই, আমিও জানতে চাই আমি কার অতিথি।”
সামনের লোকটা ফিক করে হেসে দেয়। হাসতে হাসতে বললো,
-“ওয়েল! মৃত্যুর আগে তোমার এই ইচ্ছে নাহয় পূরণ করলাম!”

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১৬

বলেই লোকটা মাস্ক খুলে ফেললো। শাকিলকে দেখে আফনা স্তব্ধ। এ তো দেখি আরেক খেলোয়াড়। আফনার এবার নিজের মাথা ফাটাতে মন চাইছে। কেন যে এই ক্রিকেটের গুষ্টি তাকে ধাওয়া করলো? আফনা এবার সবিকটারে গোল খাইয়ে পালিয়ে যায়। শাকিল গুন্ডাগুলারে চিৎকার দিয়ে বলে,
-“এখানে কী নাটক করতে দাঁড়ায় আছিস? এক মেয়ে মানুষ তোদের বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে পালিয়ে গেলো আর তোরা বেক্কলের মতো দাঁড়িয়ে আছিস? যা গিয়ে এরে ধরে আন!”
সাথে সাথেই ওরাও আফনা পিছে দৌড় দিলো। এদিকে শাকিলের মাথায় হাত। এ যে এমন চতুর মেয়ে তার আগেই বোঝা উচিত ছিলো। যদি রায়াফের ডেরায় যায় তাহলে তো সর্বনাশ! নাহ এর পালানোর কথা সোনিয়াকে জানানো যাবে না। এও জানানো যাবে না যে আফনাকে শাকিল তার চেহারা দেখিয়েছে।

এদিকে রায়াফ তার এক ইনফর্মারের থেকে জেনেছে আফনাকে ধরতে কিছু গুন্ডা ধাওয়া করেছে। এ শুনে রায়াফ বাসায় একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে কিছু গার্ড নিয়ে তখনই ছুটেছে। এরা আফনার পিছে এতো জলদি লাগবে কে জানতো! রায়াফ তো তার প্ল্যান মতোই এগোচ্ছিলো। নাহ জলদি কিছু করতে হবে, হাতে বেশি সময় নেই। রায়াফ মাঝরাস্তা যেতেই কোনো যুবতী তার রাস্তা আটকালো! রায়াফ তাকে চিনতে পেরে জলদি গাড়ি থামিয়ে গাড়ি থেকে নামলো।
আফনা রায়াফকে দেখে দৌড়ে গিয়ে রায়াফকে জড়িয়ে ধরলো।

-“আপনি কোথায় ছিলেন হ্যাঁ? ওরা আমায় আরেকটু হলেই মেরে ফেলতো। জানেন আমি কতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম? মুহূর্তের মাঝে মনে হয়েছিলো আমি আপনাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাবো। অনেক দূরে। আমি চাই না রিক্তা আন্টির মতো কঠিন সমস্যায় পরতে, আমি এসব একদমই সহ্য করতে পারি না!” কাঁদতে কাঁদতে বললো আফনা। রায়াফ চোখ বুজে তার চোখের জল থামানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তার ফাঁকা বুকটা এখন ভর্তি লাগছে। এই মেয়েটার যদি আজ কিছু হিয়ে যেত তাহলে রায়াফ কী নিয়ে বাঁচতো? রায়াফ চাইলেও আফনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারছে না। পারছে না ভালোবাসার কথা বলতে। তার জন্য যে সময়ের বড় প্রয়োজন। আর মাত্র কয়েকটা দিন, এই মেয়েটাকে সে আপন করে নিবেই, নিবে। সে আর পারবে না, তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে!

-“খালি হাতে ফিরে এলি কেন?”
-“মাঝ রাস্তায় রায়াফ চলে আসে তাই তাকে আনতে পারিনি স্যার!”
-“ড্যাম ইট!” বলেই সামনে থাকা কাঠের টেবিলে থাবা দিলো!

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১৮