প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১৬

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১৬
লাবিবা ওয়াহিদ

বিষন্ন মধ্যরাত,
আফনা হাতে ফোন নিয়ে বসে আছে। আজ তার কেন যেন ঘুমই আসছে না। বারংবার রায়াফকে ফোন দেয়ার জন্য মনটা আনচান করছে। অস্থিরতায় তার অবস্থা খারাপ। ওদিকে রিক্তা আন্টি সেই যে দরজা লাগিয়ে বসে আছে, দুপুর থেকে এই অবধি সামান্য এক ফোঁটা পানিও মুখে তুলেনি। আফনা এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না রিক্তা আন্টি-ই রায়াফের মা। ওনার সাথে বেশি মিশেছে এই আফনা, আফনার মন বলছে তার রিক্তা আন্টি এমন চরিত্রের মহিলা নন। যদি এমন হতেন তার তো এতিমখানার সামনে এভাবে পরে থাকতে হতো না, এতদিন ঠিকই দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াতেন। সেসব না করে সেই এতিমখানাই কেন? নাহ সব প্রশ্নের উত্তর তাকেই খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু তার জন্যে যে রিক্তা আন্টিকে প্রয়োজন।
তখনই আফনার ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। আফনা ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে রায়াফ কল করেছে। আফনা সাথে সাথে রিসিভ করে,

-“হ্যালো!”
-“নিচে আসবে?” আকুতি ভরা কন্ঠে বলে উঠলো।
আফনা ঘড়ির দিকে তাকালো। ঘড়ির কাঁটা প্রায় ১টা ছুঁইছুঁই। আফনা অবাক হয়ে বলে,
-“এই মাঝরাতে নিচে কেন?”
-“প্লিজ?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রায়াফের এমন আকুতি ভরা কন্ঠস্বর শুনে আফনার মন গলে গেলো। সে রায়াফের মুখের উপর আর না বলতে পারলো না। আফনা কল কেটে আস্তে ধীরে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। ফ্ল্যাটে সুনসান নীরবতা। আফনা মাথায় ভালোভাবে ওড়নাটা জড়িয়ে আস্তে ধীরে সদর দরজার দিকে এগোতে লাগলো। সদর দরজা খুব সাবধানে খুলে আফনা বেরিয়ে গেলো। নিচে গিয়ে দেখলো দারোয়ান নাক টেনে ঘুম দিচ্ছে। প্রত্যেক ফ্ল্যাটেই বড় গেইটের এক্সট্রা চাবি আছে। আফনা বুদ্ধি করে সেটাই নিয়ে এসেছে।

আফনা আস্তে করে খুলে বাইরে চলে আসলো। বাহিরে এসে দেখলো রায়াফ গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি স্থির। ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় রায়াফের অবস্থা দেখে আফনা শকড। সারাটাদিনে ছেলেটা নিজের কি হাল করেছে। চুল এলোমেলো, গায়ের টি-শার্টটিও সেম। ফর্সা নাক এবং গাল কেমন লাল বর্ণ ধারণ করেছে। আফনা রায়াফের দিকে কিছুটা এগিয়ে যেতেই রায়াফ আফনার দিকে তাকালো। আফনা, রায়াফের চোখাচোখি হয়ে গেলো। চোখাচোখি হতেই আফনা আরেক দফা চমকে উঠলো। রায়াফের চোখজোড়া টকটকে লাল হয়ে আছে। এর মানে কী রায়াফ কেঁদেছে। আফনা নির্বাক হয়ে রায়াফের দিকে তাকিয়ে রইলো।

রায়াফ বিনাবাক্যে গাড়ির পেছন সিটের দরজা খুলে আফনাকে ভেতরে বসার ইশারা করলো। আফনা কিছু না বলে ভেতরে গিয়ে বসলো। আফনা উঠে বসতেই রায়াফও উঠে বসে দরজা লাগিয়ে দিলো এবং কোনো কথা ছাড়াই আফনার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলো। রায়াফের এহেম কান্ডে আফনা পুরোই জমে গেলো। রায়াফ এমন কিছু করবে আফনা কল্পনাও করেনি।
-“মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে?”

রায়াফের কথায় আফনার ধ্যান ভাঙলো। সে আলতো হাতে রায়াফের ঘন চুলের আনাচে কানাচে হাত বুলাচ্ছে। দুজনের মাঝেই নিরবতা। আফনার কেন যেন রায়াফের এমন কষ্ট পাওয়াটা সহ্য হচ্ছে না। আফনা চুপ থাকতে না পেরে বলে উঠলো,
-“আমার বিশ্বাস রিক্তা আন্টি নির্দোষ!”
রায়াফ অবাক চোখে আফনার দিকে তাকালো। রায়াফের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে আফনা বুঝলো রায়াফ কী বলতে চাইছে।
-“আমি আগে থেকেই জানি, সবটা। ফাহান ভাই থেকে জেনে ছিলাম!”
রায়াফ আর কিছু বললো না। সে ভেতর থেকে তৈরি হয়ে এসেছিলো তার কালো অতীতটা আফনাকে বলার জন্য। এখন যেহেতু জেনেই গেছে বলে আর কাজ নেই। আফনা আবারও বললো,

-“রিক্তা আন্টি কিছু করেনি, আপনি ভুল ভাবছেন!”
আফনার কথায় এবার রায়াফ চটে যায়। সে উঠে বসে রাগান্বিত স্বরে বলে,
-“কোনটা ঠিক উনি আরেক লোকের সাথে পালিয়েছে, স্বামী-সন্তান থাকা সত্ত্বেও এটা নাকি আমার বাবাকে লোক লাগিয়ে খুন করা? চুপ কেন এন্সা মি!”
শেষোক্ত কথাটি রায়াফ অতি উচ্চস্বরে বলে যা শুনে আফনা খানিক কেঁপে ওঠে। রায়াফের রাগি রূপের সঙ্গে আফনা অপরিচিত। তবে সে এও বুঝেছে পাগলা ক্ষেপলে দুঃখ আছে। তাই আফনা অতি ঠান্ডা মাথায় বিষয়টি হ্যান্ডেল করার চেষ্টা করার জন্য বললো,

-“দেখুন, বুদ্ধিমানরা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে। আর একপাক্ষিক কোনো কথা শুনে আরেকজনকে বিবেচনা করাটা ঠিক না। যদি রিক্তা আন্টি এমনই হতো তাহলে সে দেশ-বিদেশে ঘুরে না বেড়িয়ে কেন গ্রামের সেই এতিমখানায় পরে থাকতো? কেন এতিমখানার খাবারে তার পেট চলতো বলতে পারেন?”
রায়াফ নির্বাক হয়ে তাকালো আফনার দিকে।
-“এসব তুমি কী বলছো?”

-“আমি যেসব ঘটনার সাক্ষী সেসবই আপনার সামনে তুলে ধরছি! আন্টি আজ আপনায় কতবার পিছুডাক দিয়েছিলো বলতে পারেন? আপনি তো রাগের পাহাড়, একবার দাঁড়িয়ে ওনার কথাগুলো শুনলে কী আপনার সম্মান চলে যেত?”
-“উনি যে মিথ্যা বলবেন না তার গ্যারান্টি কী?”
আফনা কিছু বললো না, অপরপাশ থেকে ডোর খুলে বেরিয়ে যেতে নিলে রায়াফ আফনার হাত ধরে হেঁচকা টান দিলো!
-“কী?”
-“কোথায় যাচ্ছো?”
-“বাসায়। আপনার সাথে সারারাত এখানেই বসে থাকবো নাকি?”
-“পুরো কথাটা তো বললে না!”
-“কিছু না, আপনি কাল ৯টায় বাসায় আসবেন। এখন ছাড়ুন!”
-“৯টায় আসলে?”
-“রহস্য ভেদ হবে। এখন যাই? দরজা খুলে এসেছি।”

রায়াফ আফনার হাত ছেড়ে দিলো। আফনা দ্রুত নেমে ভেতরে চলে গেলো। রায়াফ সেখানে কিছুক্ষণ বসে থেকে পেছন সিট থেকে ড্রাইভিং সিটে বসলো এবং নিজের বাড়িতে চলে গেলো। আফনা এবারও সাবধানে তালাটা লাগিয়ে উপরে চলে গেলো।
ফজরের নামাজ শেষে আফন রিক্তা আন্টির দরজায় নক করলো। রিক্তা আন্টি খুলে দিতেই আফনা ভেতরে প্রবেশ করলো। রিক্তা আন্টি নম্র সুরেই বললো,

-“কিছু বলবে?”
-“একচুয়ালি হ্যাঁ!”
-“সত্যিটা জানতে চাও তাইতো?”
-“হুম। আপনার ছেলেকে বলেছি ৯টায় আসতে।”
রিক্তা আন্টি এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল এবং বললো,

-“বেশ আমি বলবো! সেই ঘটনা আমারও বিয়ের আগে। হিমেল(রায়াফের বাবা) এবং আমার তখন সম্পর্ক ছিলো। তখন ও সবে তার বাবার ব্যবসার কাজে হাত দিয়েছে আর আমি তখনো পড়াশোনা করছি। হিমেল তার জয়েনের কিছু মাস বাদেই আমার বাসায় রায়াফের দাদীকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। হিমেলরা ভালো পরিবার ছিলো বিধায় আমার বাবা-মা আপত্তি করেননি। অবশেষে আমাদের বিয়ে হলো, আমার কোল আলো করে রায়াফ এলো। কিন্তু বিপত্তি এক জায়গায়। এই বিপদের আরেক নাম হিমেলের এক কাছের বন্ধু, নাম কৌশল! সে সবসময় চাইতো তার ছোট বোনকে হিমেলের সাথে বিয়ে দিয়ে সব সম্পত্তিতে নিজের নাম বসাতে। কিন্তু আমি যেন তার প্ল্যানে ফ্লপ হয়ে রইলাম। সে বছর সাতেক চুপ করে ছিলো।

চুপ করে থাকলে ভুল হবে, নীল নকশা আঁকছিলো। সেদিন আমি রান্না করছিলাম, হুট করেই এই কৌশল আমাদের বাড়িতে হাজির হয়। রায়াফ তখন ক্লাস টু তে পড়তো। হিমেল ছিলো অফিসে, মা তার ঘরে ঘুমোচ্ছিলেন আর আমার দেবর’রা ছিলো ফাহানের নানুবাড়িতে। তো সেদিন এসে আমায় সব খুলে বললো ওনার মনের শয়তানি, সাথে আমায় খারাপ প্রস্তাবও দিলো। আমি সেসব প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় আমায় বললো তার সাথে হাত মেলাতে, তাহলে এই বিশাল সম্পত্তির মালিকের অর্ধেক ভাগ আমাকেও দিবে। কিন্তু আমি সেদিন রাজি হওয়া তো দূর তাকে কষে চড় মেরে দেই।

আমি এতোগুলো বছরে নিজে থেকে দেখেছি আমার হিমেল কতোটা শ্রম দিয়ে ব্যবসা উঠিয়েছে সেখানে তারই কাছের বন্ধু এসব বলে ষড়যন্ত্র করছে? আমি বিষয়টি একদমই মানতে পারিনি তাই যা পেরেছি তা বলে অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়েছিলাম। সেদিনের পরই যেন আমার জীবনে কাল নেমে আসলো। বছরখানেকে হিমেলের আরও সাফল্য আসলো। একদিন কৌশল আমায় ফোন দিয়ে বলে,
-“তুমি যদি আমার কথা না শুনো তোমার বাচ্চাকে আমি চিরতরে ওপারে পাঠিয়ে দিবো!”

এ-কথা শুনে আমার পায়ের মাটি যেন ফাঁকা হয়ে গেলো। আমার একমাত্র সন্তানকে হারালে আমি কী নিয়ে বাঁচবো? কীভাবে আমি এতটা স্বার্থপর হবো? একদিকে স্বামী আরেকদিকে সন্তান। সেসময়ে দুটো পথ একসাথে বেছে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না কারণ আমার সবটা জুড়ে এই দুটো মানুষের বসবাস। তাই আমি তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। কৌশল আমায় কয়েকমাস পরকীয়া করার অভিনয় করতে বলে। আমি রায়াফের জন্য তাও করি।

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১৫

একসময় আমায় একটা ঠিকানা দিলো সেখানে আমি যেতেই আমায় দীর্ঘদিন ভাঙ্গা সুনসান ঘরে বন্দি করে রাখলো। সেখানে কৌশলের এক ভাড়া গুন্ডার থেকে শুনেছি সে হিমেলের কাছে বলেছে আমি নাকি কোন খ্রিস্টান লোকের সঙ্গে পালিয়েছি। সবটাই ছিলো সাজানো। আমাকে তাদের চোখে বাজে থেকে বাজে বানানোর জন্য সবটা করেছে এই কৌশল, শুধুমাত্র তার বোনকে হিমেলের বউ বানানোর জন্য। যখন দেখলো কোনোভাবেই কিছু হচ্ছিলো না তখন কৌশল নিজেই লোক লাগিয়ে হিমেলকে…!”

বলেই আঁচল দিয়ে চোখ মুছলো রিক্তা। অতঃপর আবার বলতে শুরু করলো,
-“ওর ভাড়া করা একটি গুন্ডা হিমেলের মৃত্যুর দিন এসে আমায় সব বলে, এও বলে, কৌশল বানিয়ে আমার পরিবারের সবাইকে বলেছে আমি নাকি সম্পত্তির লোভে পরে ওকে লোক লাগিয়ে খুন করিয়েছি। ভাবতে পারছো তখন আমার কী অবস্থা হয়েছিলো? আত্মহত্যা যদি মহাপাপ না হতো আমি সেদিনই মৃত্যুবরণ করতাম। অতঃপর সেই ছেলে আমায় সেদিনই কৌশলে সে-জায়গা থেকে মুক্ত করে বলেছে আমি কোনোদিনও যেন ও-মুখো না হই, নয়তো এই কৌশল সব ধ্বংস করে ফেলবে।

ও তখনই লোক নিয়ে আমায় মারতে আসছিলো। আমি ছেলেটার মাথা হাত বুলিয়ে জঙ্গলের মাঝে হারিয়ে যাই এবং অনেক দূরে সেই গ্রামে চলে আসি। তুমি যেই এতিমখানায় আমায় দেখতে না? সেটা আমার রায়াফের জম্ম উপলক্ষে বানানো হয়েছে। ওই এতিমখানা থেকেই আমি আমার ছেলের খবর জানতাম, রায়াফ মাঝে মাঝে আসলে দূর থেকে তাকে দেখতাম, দূর থেকে আমি আমার ছেলের জন্য দোয়া করেছি, যেদিন দেখলাম আমার ছেলে সাফল্যের উচ্চস্তরে আছে সেদিন সারারাত নামাজে বসে কান্নাকাটি করেছি, নিজের মতো করে আনন্দ করেছি, অনেক অনেক চেয়েছি যেন আল্লাহ আমার ছেলেকে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়।”

-“এসবের কোনো প্রমাণ আছে আপনার কাছে?”
-“হ্যাঁ! ওই গুন্ডা ছেলেটা আমায় একটা মেমরি কার্ড দিয়েছিলো যা আরও আমি সুরক্ষিত রেখেছি!”

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১৭