প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১৫

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১৫
লাবিবা ওয়াহিদ

একহাতে পাসপোর্ট, টিকিট কাগজ এবং অন্য হাতে ট্রলি টেনে এয়ারপোর্ট থেকে বের হচ্ছে সোনিয়া। তার চোখে বিশাল সানগ্লাস, চুলগুলোও ছেড়ে দেয়া। এয়ারপোর্টের বাইরে এসে সে তার বাবাকে কল করলো,
-“ড্যাড! বিডিতে পৌঁছে গেছি!”
-“গুড! এখন কোথায় উঠবে? হোটেল নাকি আমার ফার্মহাউজে!”
-“কোথাও না ড্যাড! শ্বশুড় বাড়ি যাবো!”

বলেই কল কেটে একটি ক্যাব ডেকে রওনা হলো রায়াফের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
রায়াফ বিষন্ন মনে তার দাদীর কোলে শুয়ে আছে। তার চোখদুটো ছলছল করছে। দাদী রায়াফকে সান্ত্বনার বুলি দিয়ে বললো,
-“এভাবে মন খারাপ করে বসে থেকো না নাতি, কিছু অর্জন করতে হলে বাধা আসবেই এভাবে থেমে গেলে তো চলে না?”
-“আর কতো দাদী বলবা? ৩টা দিন ভেতরে ভেতরে পুড়ে ছাড়খাড় হচ্ছি আমি। ও আমায় এভোয়েড করছে। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে কীভাবে কী করবো আমি বলো তো? এখন নিজের প্রতি-ই রাগ লাগছে, কেন নাম হলো আমার? কেন এতো মানুষ আমায় চিনে, আমায় জানে? কেন আমি আর ৫টা ছেলের মতো সকলের মাঝে চলাচল করতে পারি না?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“কারণ, তুমি স্পেশাল! তাই আল্লাহ তোমায় সকলের মাঝে স্পেশাল করে পাঠিয়েছে। অনেকের আইডলও তুমি নাতি। এভাবে ভেঙ্গে পরিও না, যেভাবে পারো আফনাকে একটা টাইট দেও, ওর ফ্যামিলি আমি সামলে নিচ্ছি!”
এবার রায়াফ মাথা উঁচু করে দাদীর দিকে তাকালো। রায়াফ অস্ফুট সুরে বললো,
-“তুমি পারবে দাদী?”
দাদী চোখ দিয়ে আশ্বাস দিলো সে পারবে। রায়াফের চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক দেখা গেলো। সে একমুহূর্তে না বসে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে ছুটলো।

আফনা ক্যান্টিন থেকে ক্লাসে ফিরছিলো তখনই তাকে কেউ হেঁচকা টানে একটি ফাঁকা ক্লাসে নিয়ে গেলো। আকস্মিক ঘটনাটি আফনার মাথার উপর দিয়ে গেলো। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সামনের আগন্তুক তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। আফনা এবার ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো এবং নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো।
-“কে আপনি? সাহস তো কম না আমায় এখানে নিয়ে এসেছেন। ছাড়ুন!”

-“হুঁশ…!” খুবই শীতল সুরে বলে উঠলো রায়াফ। এমন শীতল কন্ঠ শুনে আফনা যেন জমে গেলো। কিছু বলতে পারলো না।
-“আমার সাহস অনেক, বুঝলে? এতোই সাহস যে তোমার বিরুদ্ধে গিয়ে আমি এখনই তোমায় বিয়ে করতে পারি!” রায়াফের এমন কথায় আফনা থমকে গেলো। আফনা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
-“আআপ…নি?”
-“তো কাকে আশা করছিলে?”
-“কাউকেই না। আর বিবিবিয়ে ককককরবেন মামামানে ক..কী?” রায়াফ হাসলো আফনার তোতলানো শুনে। হাসিটা খুবই ক্ষুদ্র, খুব। রায়াফ আবারও শীতল কন্ঠে বললো,

-“এত তোতলাচ্ছো কেন হু? মজা করছি নাকি আমি!”
-“সেটা তো আপনি ভালো জানেন!”
-“ওকে, বেশ। তাহলে আজ আমি তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিবো!”
-“ন..নাহ! আপনি আমার থেকে দূরে থাকুন!”
রায়াফ আফনার আরেকটু কাছে গিয়ে বললো,
-“আবার বলো!”

এভার আফনা সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলো। আফনার নিঃশ্বাসও ভারী হয়ে আসছে ভয়ে। এখন কী রায়াফ তাকে গলা টিপে মেরে দিবে? এ বিষয় তো অবিশ্বাসও করা যায় না! আফনা মিনমিন করে বললো,
-“আপনার জন্য আম্মু এই প্রথম আমায় অবিশ্বাস করেছে, আমার বিয়ে নিয়ে কথাও উঠিয়েছে তাই প্লিজ দূরে থাকুন!”
রায়াফ আরেকটু আফনার দিকে ঝুঁকে বললো,
-“তোমার মায়ের এতো সাহসও নেই যে আমার পারমিশন ছাড়া তোমায় বিয়ে দিবে। চিন্তা করো না, সব ঠিকঠাক আছে!”
-“এতো নিশ্চয়তা কী করে দিচ্ছেন?”

-“বিকজ আই উইল ম্যারি ইউ! বাহিরে অপেক্ষা করছি, ক্লাস শেষে চলে এসো!!”
বলেই এক অপ্রস্তুত ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো রায়াফ। অতঃপর সে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আর আফনা কপালে হাত দিয়ে সেখানেই পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। তার কপালটা যেন বরফের ন্যায় ঠান্ডা হয়ে আছে। তার শিউরে উঠায় ওষ্ঠ জোড়া মৃদ্যু কাঁপছে। তার মনে অদ্ভুত সব চিন্তা-ভাবনা আসছে। আফনা কাঁপা গলায় মিনমিন করে বললো,
-“ডি ডি ডিরেক্ট বি বি বিয়ে? মানুষ ফাস্ট হয় জানতাম তাই বলে এতো? আচ্ছা আমি কেন তাকে এসব করতে বারণ করলাম না? কেন প্রতিবাদী হতে পারলাম না? উনি এতো বড় মাপের মানুষ হয়ে কেন আমার মতো সাধারণ মানুষকে..? আর পরিচয়ও যে সবে ৬ মাসের!!”

সোনিয়া অনেকক্ষণ রায়াফের বাড়িতে অপেক্ষা করেও যখন রায়াফকে দেখলো না সে রেগেমেগে রায়াফের রুমে চলে গেলো। তার ধারণা কাজের লোকগুলি তাকে মিথ্যে বলছে। সে রায়াফের রুমে গিয়ে অনেক খুঁজেও রায়াফকে পেলো না। এর মানে কী সত্যিই রায়াফ বাড়িতে নেই? সোনিয়া রায়াফের বিছানার বসতে নিবে ওমনি জিনি কোথা থেকে এসে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো। জিনিকে দেখে সোনিয়ার ভয়ে চোখ কপালে উঠে যাওয়ার জোগান। এই একটা কুকুরই বারবার তাকে ঝামেলায় ফেলেছে। সোনিয়া দাঁড়িয়ে রক্তচক্ষু দৃষ্টি নিয়ে জিনির দিকে তাকিয়ে বললো,

-“হেই ডগ! হুঁশ হুঁশ! এটা আমার রায়াফের রুম সো আমি এখানে থাকবো, তুই সর এখান থেকে। হুঁশ হুঁশ!”
বলে তাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো। জিনিকে আবারও কুকুর বলায় জিনি ক্ষেপে গেলো। সে গিয়ে সোনিয়ার হাঁটু অবধি পরা টপসটা দাঁত দিয়ে টানতে লাগলো। সোনিয়া চিৎকার করে তার টপস ছাড়াতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। একপর্যায়ে সোনিয়ার টপসের অনেকাংশ জিনি ছিঁড়ে ফেললো। সোনিয়া রেগেমেগে এক লাথি দিতে গেলেই জিনি তার পেছন দুই পা উঁচু করে সোনিয়াকে ধাক্কা দিলো যার ফলে সোনিয়া মেঝেতে লুটিয়ে পরলো।

আফনা আজ ভয়ে ভয়ে বাসায় প্রবেশ করে দেখলো এক বৃদ্ধ তাদের লিভিংরুম ছেড়ে উঠছে। ওনার গেটআপে বেশ আভিজাত্য ভাব ফুটে উঠেছে। তার সামনেই আফনা মা হাসিমুখে তাকে আরও কিছুক্ষণ বসতে বলছে। বৃদ্ধ মহিলা সামনে এগোতেই আফনাকে দেখতে পেলো। উনি মুচকি হেসে আফনার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“তুমিই কী আফনা?”
আফনা তার মায়ের দিকে তাকালো। আম্মু তাকে ইশারায় কিছু বললো। আফনা সেসব বুঝতে পেরে নম্র সুরে বললো,
-“আসসালামু আলাইকুম, জ্বী। আমি-ই আফনা!”
-“মাহশাল্লাহ!”

বলেই থুঁতনিতে হাত রেখে চলে গেলেন উনি। উনি চলে যাওয়ার পরপর আম্মু আফনার দিকে এসে আফনার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো,
-“তুই বড়ই ভাগ্যবতী রে মা!”
-“হঠাৎ এসব বলছো কেন? আর উনি কে?”
-“উনি তোর এক দাদী হন, আর এমনিই বললাম। এখন যা ফ্রেশ হয়ে আয় আমি খাবার বাড়ছি।”
আফনা মাথা নাড়িয়ে ভেতরে চলে গেলো। সে যেন আজ শূন্যে ভাসছে। তার সাথে কী ঘটছে না ঘটছে আফনা কিছুই বুঝতে পারছে না।

পরেরদিন আফনা ব্যাগে বই ভরছিলো ভার্সিটির জন্য। তখনই আম্মু এসে বললো,
-“তুই সেদিন বলেছিলি না, তুই রায়াফ সানভির সাথে বাড়ি ফিরিস? আজ তুই আমায় প্রমাণ দিবি। তুই আজ রায়াফ সানভিকে বাসায় নিয়ে আসবি। যদি আনতে পারিস তাহলে মানবো আর যদি না পারিস তাহলে মানবো না!”
আফনা খুশি হয়ে বললো,
-“ঠিক আছে আনবো। আমি প্রমাণ করে দিবো তোমার মেয়ে মিথ্যেবাদী না!”
বলেই আফনা ব্যাগ নিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে চলে গেলো।
ভার্সিটি ছুটির পর গাড়িতে রায়াফ আড়চোখে বারংবার আফনার চিন্তিত মুখশ্রী খেয়াল করছে। অবশেষে কৌতুহল দমাতে না পেরে রায়াফ বললো,

-“এমন চিন্তিত লাগছে কেন তোমায়?”
-“আম্মু বলেছে আপনাকে যদি বাসায় নিয়ে যাই তাহলেই আমার কথা বিশ্বাস করবে নয়তো না!”
-“ও এই ব্যাপার? তা এই সামান্য ব্যাপারে এতো আপসেট হওয়ার কী ছিলো? শ্বাশুড়িকে বলে দিও শ্বশুড়বাড়িতে যাওয়ার জন্য এই রায়াফ দুই পায়ে রাজি!”
-“মোটেও আমার আম্মু আপনার শ্বাশুড়ি নন! তাই ফাউ চিন্তা বাদ দেন!”
রায়াফ হাসলো এবং গাড়ি ঘুরিয়ে আফনার বাসার দিকে চলে গেলো।

-“কী ভাবী আজ আপনাকে বেশ খুশি দেখাচ্ছে!”
-“আজ আমি অনেক খুশি ভাবী…!” আফনার মা পরেরটুকু বলার আগেই কলিংবেল বেজে উঠলো। আফনার মা রিক্তা আন্টিকে বসতে বলে বললো,
-“আপনি বসুন, আমি দেখি গিয়ে হয়তো আফনা চলে এসেছে।”
-“ঠিক আছে যান!” বলেই মুচকি হাসলো।
আফনার মা গিয়ে সদর দরজা খুললেন। আফনার পাশে দাঁড়ানো লম্বা করে ছেলেটাকে দেখে উনি বিস্মিত হলেন। কখনো কল্পনাও করেননি বাস্তবে এই রায়াফকে সে দেখতে পারবেন তাও একমাত্র তার মেয়ের কারণে। আফনা তার মায়ের চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১৪

-“ও আম্মু, ভেতরে ঢুকতে দিবে না?” আফনার মায়ের ধ্যান ভাঙলো এবং ব্যস্ত হয়ে বললো,
-“দুঃখিত আসলে বুঝতে পারিনি, এসো বাবা ভেতরে এসো।” রায়াফ মুচকি হেসে ভেতরে প্রবেশ করলো। রিক্তা লিভিংরুমে বসেই বাইরের মানুষের উপস্থিতি টের পেলো। সে উঠতে নিবে তখনই রায়াফসহ আফনার মা প্রবেশ করলো। রায়াফ এবং রিক্তার একমুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হয়ে গেলো। দুজনের দৃষ্টিই নির্বাক, স্থির একে অপরের পানে। রিক্তা অস্ফুটে সুরে বলে উঠলো,
-“রায়ু!”
রায়াফও অস্ফুট সুরে বলে উঠলো, “মা!”

আফনা এবং তার মা দুজনেই হতবাক হয়ে গেলো। এতো বছর পর রায়াফের মুখে “মা” ডাক শুনতে পেয়ে তার চোখের কোণ বেয়ে নোনাজল পরতে শুরু করলো। রায়াফের কালো দিনগুলির কথা মুহূর্তেই মনে পরে গেলো। তার চেহারার ব্যাকুলতা ভাব নিমিষেই ক্রোধে রূপান্তরিত হলো। সে তার রাগ দমাতে না পেরে তৎক্ষণাৎ লিভিংরুম থেকে বেরিয়ে সদর দরজার দিকে চলে গেলো। রিক্তা রায়াফকে অনেকবার পিছু ডাকলো কিন্তু রায়াফ একবারের জন্যেও পিছে ফিরে তাকায়নি। ঘৃণা করে সে এই মানুষটাকে, চরম ঘৃণা!

রিক্তা তার কান্না থামাতে না পেরে মেঝেতে বসেই কেঁদে দিলো। এদিকে আফনা এবং আফনার মা কিছুতেই কিছু বুঝতে পারছে না। রিক্তা মিনমিন করে বলছে,
-“আমি আমার স্বামীর খুনি নই, তোর বাবার খুনি নই, বিশ্বাস কর। আমি কারো সাথে পালাইনি, আমার পৃথিবী যে তোকে ঘিরেই!”

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১৬