প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ পর্ব ৫ || লেখিকা-লাবিবা নুসরত

প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ পর্ব ৫
লেখিকা-লাবিবা নুসরত

প্রাচী দরজা খুলতেই দেখলো একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে সানগ্লাস পরা আর মুখে মাস্ক থাকায় চেনা যাচ্ছে না। ছেলেটার পাশেই একটা ট্রলি। দেখে মনে হচ্ছে কোথাও গিয়েছিল। প্রাচীর দিকেই তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ সেখানে ফারহান আসে। ছেলেটাকে দেখে খুশি হয়ে বলে,
“জাহিন! তুই এতো জলদি চলে এলি?”
জাহিন মুখের থেকে মাস্ক সরিয়ে বলে,
“নাহ আসার ইচ্ছা ছিলো না। বাকি জীবন ওখানেই থাকতাম।”
ফারহান~”হা হা! ভালোই হতো। চল ভিতরে যাই।”

জাহিন প্রাচীকে ইগ্নর করে ভিতরে চলে গেলো। এইদিকে প্রাচী এতক্ষনে ছেলেটাকে চিনলো। এটা ফারহানের ছোট ভাই। পেশায় একজন হার্ট সার্জন। দেশে এমনকি বিদেশেও অনেক নাম-ডাক তার। সুইজারল্যান্ডে একটা মিটিং এ গিয়েছিল প্রায় ছয় মাস আগে। অন্য দেশের নামি-দামি ডক্টরও ছিল। সেখানে ঝামেলা হওয়ার কারনে আসতে এতো দেরি হয়েছে।
প্রাচী দরজা আটকিয়ে সবার কাছে যায়। জাহিন বরাবরই শান্ত স্বভাবের। কথা একটু কম বলে। তবে হাসি-খুশি থাকে সব সময়। এখনো সে খুব বেশি কথা বলছে না। যে যা জিজ্ঞেস করছে তার উওর দিচ্ছে।
প্রাচী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। জাহিন আজ একটু বেশি হাসি-খুশি। যদিও বেশি কথা বলছে না। তবুও চোখে-মুখে একটা উচ্ছাস দেখা যাচ্ছে। ছেলেটা প্রাচীকে কিছুটা ইগ্নোর করতো শুরু থেকেই। যদিও প্রাচীও খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতো না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

প্রাচী জাহিনের দিকে তাকিয়ে ছিল। আগের থেকে কিছুটা বদলে গিয়েছে সে। হঠাৎ জাহিনও প্রাচীর দিকে তাকায়। এতে করে দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। প্রাচী নিজের চোখ নামিয়ে ফেলে। একটা অস্বস্থিকর পরিস্থিতি ছিল! আর প্রাচীর মনে হচ্ছে কেন তাকাতে গেলো সে।
প্রাচী সেখান থেকে চলে যাচ্ছিল তখনই মিসেস লারা বলেন,
“কিরে মা? কোথায় যাচ্ছিস?”
প্রাচী নিচু কণ্ঠে উত্তর দিল,
“মা আমি একটু ঘরে যাই। আবার আসবো।”
মিস্টার ইজাজ ~”ব্রেকফাস্ট করে যা?”
প্রাচী~”আমি একটু পরেই আসছি।”
প্রাচী চলে যেতেই ফারহানা বলে ওঠেন,
“মেয়েটার মন খারাপ মনে হয়? আসলে যা হয়েছে এতে মন খারাপ তো হওয়ারই কথা!”
মিসেস লারা ~”আসলে ভাগ্য ছিল এটা। কিছু করার নেই।”
প্রহর সবাইকে থামিয়ে বলে,

“আচ্ছা বাদ এসব। এখন আমাকে নিয়ে কেউ কথা বলো? বাহ! আমাকে ভুলে গেলে? ইটস নট ফেয়ার।”
সবাই হেসে উঠলো প্রহরের কথায়। জাহিন বলল,
“তোমাকে কিভাবে ভুলি ভাবি সাহেবা? একমাত্র ভাবি তুমি!”
প্রহর~”হুম এখন একটা জা দরকার আমার। সেটার দায়িত্ব কি নিতে হবে না?”
ফারহান~”প্রহর কি যে বলো না! আমার ছোট ভাইটার বয়স তো মাত্র আঠাস! এখনো বাচ্চা।”
জাহিন~”ভাইয়া আমাকে অপমান করলা নাকি?”
ফারহান~”এই না না! অপমান কেন করবো? জাস্ট এমনি বললাম।”
জাহিন~”আচ্ছা যাইহোক আমি তো সেই এয়ারপোর্ট থেকে এখানে চলে এসেছি। তো চেইঞ্জ করতে হবে।”
ফারহান~”হুম আয় আমার সাথে। গেস্ট রুমে নিয়ে যাই তোকে।”
জাহিনকে নিয়ে ফারহান চলে গেলো। মিস্টার ইজাজ বললেন,
“লারা ব্রেকফাস্ট দাও। আমার বেরোতে হবে।”
মিসেস লারা চলে গেলেন কিচেনে। সাথে ফারহানাও গেলেন। প্রহর প্রাচীর কাছে গেলো। প্রাচী একা বসে ছিল। প্রহর প্রাচীর কাধে হাত রাখে।

“মন খারাপ তোর?”
প্রাচী~”নাহ!”
প্রহর~”তো একা বসে আছিস কেন? আর ওখান থেকে চলে আসলি কেন? হুম?”
প্রাচী~”এমনি আপুনি।”
প্রহর~”আচ্ছা। ঠিক আছে। আজতো চলে যাবো৷ একসাথে ব্রেকফাস্ট কর?”
প্রাচী রাজি হলো। প্রহর ওকে নিয়ে নিচে আসলো। ফারহানা বললেন,
“জাহিনকে একটু ডেকে নিয়ে আসো তো প্রাচী মা।”
প্রাচীর যদিও যেতে ইচ্ছা করছিল না। তবুও গুরুজনের কথা তো মানতে হবে। তাই অনিচ্ছা সত্বেও সে জাহিন যে ঘরে আছে সেটায় গেলো। ফারহান বারান্দায় ছিল। আর জাহিন দাঁড়িয়ে চুল মুছছিল। ছেলেটা এতো জলদি গোসল করে ফেলল! প্রাচী মনে মনে ভাবে যে কতোই না টাইম মেইনটেইন করে চলে জাহিন।
সে দরজায় নক করে বলল,
“আসবো?”
জাহিন~”হুম আসো।”
প্রাচী ভিতরে এসে জাহিনকে বলে,
“ফারহান ভাইয়া আর আপনাকে খেতে আসতে বলেছে। আসুন।”
এই বলে সেখান থেকে চলে আসে প্রাচী। জাহিনকে দেখে কেমন যেন একটা লাগছিল তার। নিজেও জানে না এমন কেন হচ্ছিল।

সবাই মিলে ব্রেকফাস্ট করে নিল। এবার প্রহরের যাওয়ার পালা।
যদিও বিকালে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু তারা দেরি করতে চায় না।
সবাই মিলে প্রহরদের গাড়ি অব্দি নিয়ে গেলো। মিসেস লারা আর মিস্টার ইজাজ ফারহানকে ভালো মতো বলে দিয়েছে যাতে করে প্রহরের খেয়াল রাখে।
সবাই দাঁড়িয়ে এসব নিয়েই কথা বলছিল তখনই জাহিন ডাক দিল।
“মা? বাবা? তোমরা আসো জলদি। আজ আমার হস্পিটালে যেতে হবে। কতোদিন ডিউটি থেকে বাইরে ছিলাম।”
ফারহান আর আনোয়ার বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। ফারহান আর প্রহর যাবে ফারহানের গাড়িতে। তাই জাহিন আগেই চলে গেলো। প্রহর যাওয়ার আগে প্রাচীর কাছে গিয়ে বলল,
“বোন, সবসময় মাথা ঠান্ডা রাখবি৷ ছোট বা বড় যাই হয়ে যাক না কেন কখনো ভেঙে পরবি না। আর নিজের ক্ষতি হয় এমন কাজ করার কথা মাথায়ও আনবি না। কেমন?”
প্রাচী~”হুন আপুনি! আর তুইও নিজের খেয়াল রাখিস। আর চ্যাম্প পার্টনারের অপেক্ষায় থাকবো।”
প্রহর মুচকি হেসে গাড়িতে গিয়ে বসলো। বিদায় নিয়ে ফারহান গাড়ি স্টার্ট দিল।

আরোহি বসে আছে। আয়ুসের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু আয়ুস আসছেই না। ফ্লাট বাসা হওয়ায় ড্রয়িংরুম থেকেই আয়ুসের ঘর দেখা যাচ্ছে। অনেকক্ষন পর আয়ুস বের হয়ে আসলো। আরোহি আয়ুসের কাছে দৌড়ে গেলো। ন্যাকা সুরে বলল,
“বেবি? এতো দেরি করলে কেন? আমি সেই কখন থেকে ওয়েট করছি?”
আয়ুস~”সরি! আমি একটু ব্যাস্ত ছিলাম।”
আরোহি~”আর এক সপ্তাহ পরে আমাদের বিয়ে। আর এখন যদি আমাকে টাইম না দাও!”
আয়ুস~”ওকে ওকে! বলো কি করতে হবে?”
আরোহি~”শপিংয়ে যেতে হবে! অনেক কিছু কেনা বাকি!”
আয়ুস~”আচ্ছা চলো। আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিব।”
আরোহি~”ওকে বেবি। লাভ ইউ!”

প্রাচী ফোনটা হাতে নিতেই আরিয়া কল করে। রিসিভ করতেই বলে,
“প্রাচী কেমন আছো?”
প্রাচী মেকি হাসি দিয়ে বলে,
“এইতো ভালো।”
আরিয়া~”শোনো আগামীকাল আমার জন্মদিন। তো বাড়িতে ছোট করে একটা পার্টি রেখেছি৷ তুমি আসলে খুশি হতাম।”
প্রাচী~”আরিয়া আসলে আমার মনটা না ভাল না। এখন পার্টি এটেন্ড করা আমার জন্য সম্ভব হবে না।”
আরিয়া~”আমি জানি তোমার মন খারাপ। এখানে আসলে ভালো লাগবে। প্লিজ আসো?”
প্রাচী~”ওকে! আমি আসার চেষ্টা করবো৷ কখন পার্টি?”
আরিয়া~”সন্ধ্যায়।”
প্রাচী~”আচ্ছা। আমি আসবো। এখন তাহলে রাখি? বায়!”
ফোন রাখতেই মিসেস লারা রুমে আসেন।
“কিরে মা? কই যাবি?”
প্রাচী~”মা আসলে আগামীকাল আরিয়ার বাসায় ইনভাইটেশন দিয়েছে। সেখানেই যাবো।”
লারা~”হুম যা। এখন একটু ঘোরাঘুরি কর। ভালো লাগবে।”
প্রাচী~”আচ্ছা মা।”

একটু পরে প্রাচী আরিয়ার বাসায় উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে। রেডি হয়ে বসে আছে। একাই যাবে সে। কিন্তু গাড়ি নিয়ে যেতে চাচ্ছে না। এই নিয়ে মিসেস লারা ঝামেলা করছেন।
“তুই গাড়ি নিয়ে কেন যাবি না? তোর বাবা যদি জানে একা একা গিয়েছিস তাও আবার গাড়ি ছাড়া। কি হবে বলতো?”
প্রাচী~”উফফ মা! কিছুই হবে না। আর এমন করলে আমি যাবোই না বলে দিলাম।”
লারা আর মেয়ের জেদের কাছে টিকে থাকতে পারে না। প্রাচী একাই বেরিয়ে যায়।
পার্টি শেষ হতে হতে রাত দশটা বেজে যায়। প্রাচী সেখানে একাই চুপ করে বসেছিল। আরিয়া অনেকসময় পাশে ছিল। প্রাচীকে সবাই যেভাবে ট্রিট করছিল তাতে করে ওর মনে হচ্ছিল যে চিপ গেস্ট হিসেবে মনে হয় সেখানে গিয়েছে।
আরিয়া বলেছিল ওর ছোট ভাইকে যে প্রাচীকে যেন বাসায় দিয়ে আসে। যেহেতু সে একা এসেছে। আর বাড়িটাও কিছুটা দূরে। কিন্তু প্রাচী রাজি হয় নি৷ একাই বেরিয়ে গিয়েছে।

একমুহূর্তে রাস্তার এক কিনারে দাঁড়িয়ে আছে সে। বেশি মানুষ নেই। কারন ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি পরছে। হঠাৎ প্রাচীর মনে হলো কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে। পাশে তাকাতেই দেখলো তিনটা ছেলে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে মাতাল। এই এতো রাতে একলা একটা মেয়ে তিন বখাটের সামনে পরলে যে কোনো মেয়েরই ভয় লাগবে। প্রাচীরও লাগছে। তবে সে প্রকাশ করছে না। ছেলেগুলোর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে একটু কিনারে সরে আসে। ছেলেগুলো মিটমিট করে হাসছে। হাসিতেই যেন পৈচাশিকতার ছাপ। হঠাৎ একটা ছেলে প্রাচীকে বলল,
“কি ম্যাডাম? কই যাওয়া হইতাছে?”
প্রাচী কোনো উত্তর দিচ্ছে না। চুপ করে মাথা নিচের দিকে করে রেখেছে।
প্রাচীকে চুপ থাকতে দেখে আরেকটা ছেলে বলল,
“হায় হায়! মাইয়াডা তো দেহি বোবা! আরে মাম্মা দেখছস? কত ভালো ভাগ্য আমাগো? চিল্লাইতে পারবো না।”
প্রথম ছেলেটা বলে,
“আসলেই। চল কাছে যাই।”

প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ পর্ব ৪

এই বলে তিনটা ছেলে প্রাচীর সামনে চলে আসলো। প্রাচীর ভয়ে গলা শুকিয়ে গিয়েছে। এখন এতো রাতে কে তাকে সাহায্য করবে! কান্না পাচ্ছে প্রচুর। কিন্তু করতে পারছে না। মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছে না।
ছেলেগুলো চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে প্রাচীকে। প্রাচী নিজের গাউন শক্ত করে ধরে রেখেছে। এবার তৃতীয় ছেলেটা বলল,
“আচ্ছা চল জলদি ওরে নিয়া যাই। এইহানে থাকা যাবো না। লোকজন চইলা আসতে পারে।”
ছেলেগুলো এগিয়ে আসতে গেলে প্রাচী কোনোমতে নিজেকে সামলে শান্ত গলায় বলে,
“দেখুন কোনো অসভ্যতামি করার চেষ্টা করবেন না। আমাকে এখান থেকে যেতে দিন!”
প্রথমের সেই ছেলেটা এবার একটা বিরক্তিকর হাসি দিয়ে বলল,

“আরে ফুল কলি! কথা কইতে পারো? বাহ ভালো তো। এহন চলো আমাগো লগে।”
প্রাচী~”আমার বাবাকে আপ্নারা চেনেন না। আমার গায়ে একটা টাচ করলে একটাও বেঁচে থাকতে পারবেন না।”
প্রাচীর কথায় ছেলে তিনটা হো হো করে হেসে ফেলে। এতে প্রাচীর বাকি সাহস টুকুও চলে যায়।
দ্বিতীয় ছেলেটা বলে,
“আরেহ! এইহানে বাপ টানো কিল্লা? আমরা তো তোমারে চাই!”
ছেলেটা প্রাচীর হাত ধরতে গেলে কেউ ওই ছেলের হাতর উপর একটা ছুরি বসিয়ে দেয়। মুহূর্তেই ছেলেটার বেদনাদায়ক চিৎকারে পুরো পরিবেশ স্তম্ভিত হয়ে যায়।

প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ পর্ব ৬