ফেরারি প্রেম পর্ব ৫১

ফেরারি প্রেম পর্ব ৫১
নিশাত জাহান নিশি

“আহ! শান্তি। নীহু আজ তো তুমি আমার মন খুশি করে দিলে।”
রাগে ভেতরটা রি রি করছিল উজ্জ্বলের! তবে তা বাইরে প্রকাশ করার মত পরিস্থিতি নেই এখন। খুবই স্বাভাবিকভাবে পরিস্থিতি সামলে নিতে হবে তার। প্রথম দেখাতেই তিক্ততা প্রকাশ করা যাবেনা। নিজের সম্মান নিজেকেই বজায় রেখে চলতে হবে। সবকিছু ভেবেচিন্তে সে জোরপূর্বক হাসল। সুমিষ্ট গলায় নীহারিকাকে বলল,

“আপনার ভাইয়াকেই জিজ্ঞেস করুন না আমি কে? মেবি আপনার ভাইয়া আমার বিষয়ে আপনাকে এখনও কিছু জানায়নি। দেট’স হোয়াই আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না।”
তখনি নীহারিকা উজ্জ্বলের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নিহালের দিকে তাকালো। নিহাল মৃদু হেসে নীহারিকা ও উজ্জ্বলের দিকে এগিয়ে এলো। উজ্জ্বলের কাঁধে হাত রেখে সে চওড়া হেসে নীহারিকাকে বলল,
“ইট’স উজ্জ্বল নীহা। আমার অফিসের কলিগ। তবে সম্পর্ক বদলাতে হয়ত সময় লাগবেনা! মা তোর জন্য উজ্জ্বলকে পছন্দ করেছেন।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পিয়াসাও তখন মৃদু হেসে এগিয়ে এলো নীহারিকার দিকে। সমস্ত ক্ষোভ যেন নিমিষেই ভুলে গেল সে! মনে হলো তার ভালো ভাবি পৃথিবীতে আর দুটো নেই। নীহারিকার পাশে দাড়িয়ে সে হেসে হেসে নীহারিকাকে বলল,
“উজ্জ্বল ভাইয়া তোমার উডবি হতে চলেছেন নীহারিকা! খুব শীঘ্রই তোমাদের বিয়ে।”
উপরে উপরে নীহারিকা অবাক হওয়ার মত ভান ধরলেও ভেতরে ভেতরে সে রাগে ফোঁসতে লাগল! নাক ফুলিয়ে বিড়বিড় করে বলল,

“আমি তো প্রথম দেখাতেই চিনে গেছি ছেলেটি কে! রূপল তো আগেই আমাকে তার সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে ছেলেটির এটিটিউট আমার পছন্দ হয়নি! মনে হচ্ছে লোকটি ভেতরে এক তো বাইরে আরেক। এই আপদ আমি ঘাড় থেকে কীভাবে দূর করব? মোটে ও ভালো লাগছেনা তাকে আমার!”

নিরুপায় হয়ে নীহারিকা তখন পিছু ঘুরে রূপলের দিকে তাকালো! ভ্রু উঁচিয়ে রূপল কপালে কয়েক দফা ভাজ ফেলে নীহারিকার দিকে তাকালো। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝতে চেষ্টা করল নীহারিকার মনের ভাব। নীহারিকা ঠোঁট উল্টো আকার ইঙ্গিতে রূপলকে বুঝালো উজ্জ্বলকে তার সহ্য হচ্ছেনা! তা বুঝা মাত্রই রূপল এগিয়ে এলো নীহারিকার দিকে। নীহারিকার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সে উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসল। ক্ষোভ চেপে রেখেও মলিন স্বরে বলল,

“আই থিংক আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন। এম আই রাইট?”
“ইয়াহ্। মেবি গতকালই আপনার সাথে আমার দেখা হয়েছিল।”
“ইয়াহ্ ইয়াহ্। ইউ আর অ্যাবচুলুয়েটলি রাইট।”
“ওকে। বাট হু আর ইউ? এখানে কী করছেন?”
নিহাল পাশ থেকে উত্তর দিলো। উজ্জ্বলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“রূপল আমার শালা হয় উজ্জ্বল।”

রূপলের দিকে পুনরায় স্থবির দৃৃষ্টিতে তাকালো উজ্জ্বল। জিজ্ঞাসু গলায় বলল,
“ওহ্ আচ্ছা। বুঝতে পেরেছি। তার মানে নীহারিকা আপনার বেয়াইন হয় তাই তো?”
মাথা চুলকে রূপল বলল,
“হ্যাঁ। ঐ আর কী।”

অমনি রূপলকে উপেক্ষা করে উজ্জ্বল বেশ গাঁ ছাড়া ভাব নিলো। নিহালের কাছে প্রস্তাব রেখে সে বেশ নম্র স্বরে বলল,
“ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড ভাইয়া আমি কী নীহারিকার সাথে পার্সোনালী কথা বলতে পারি? জাস্ট ফর ফিফটিন মিনিটস।”
নিহাল যদিও দ্বিমনায় ভুগছিল আদো উজ্জ্বলের সাথে নীহারিকার এখনি পার্সোনালি কথা বলাটা ঠিক হবে কীনা তবে পাশ থেকে পিয়াসার চোখ রাঙানোতে নিহাল রাজি হতে বাধ্য হলো! সংকোচ হীন গলায় সে বলল,

“ইয়াহ্ ইয়াহ্ শিউর! হোয়াই নট?”
নীহারিকা আপত্তি প্রকাশ করল! বিব্রতকর গলায় সে নিহালকে বলল,
“কিন্তু ভাইয়া?”
নীহারিকার আপত্তিকে গ্রাহ্য করলনা নিহাল! পকেটে হাত গুজে সে কঠিন ভাব নিলো। বলল,
“যা কথা বলে আয়। আমরা ওয়েট করছি।”

উজ্জ্বলের পিছু পিছু যেতে বাধ্য হলো নীহারিকা! পিছু ফিরে সে রূপলের দিকে একবার তাকালো। তাকানো যাচ্ছেনা রূপলের দিকে। ফর্সা মুখটা লাভার রূপ ধারণ করেছে! এসির নিচে থেকেও মাত্রাতিরিক্ত ঘামাচ্ছে সে। অস্থির দেখাচ্ছে তাকে। নীহারিকার আর সাহস হলোনা রূপলের দিকে তাকানোর। সঙ্গে সঙ্গেই নীহারিকা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। মাথা নুইয়ে সে উজ্জ্বলের পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। বুকে ভয় নিয়ে সে বিড়বিড় করে বলল,

“আমি মাঝে মাঝে আপনাকে বুঝতে পারিনা রূপল! কখনও মনে হয় আপনি আমাকে পছন্দ করেন! তাই হয়ত আমার সবকিছুতে আপনি এত রিয়েক্ট করেন। আবার কখনও মনে হয়, না! আপনার সাথে আমার কোনোদিক থেকেই যায়না! কোথায় আপনি, আর কোথায় আমি। যদিও এই পার্থক্যটা আমি নিজেই ফিল করি! জানিনা আপনি কী ফিল করেন। তবে কোনো দিক থেকে আপনার সাথে আমার ম্যাচ হয়না রূপল! আমার নিজেকে খুব ছোটো মনে হয়!”

উজ্জ্বলের পিছু পিছু নীহারিকা শপিংমলের চার তলায় ওঠে গেল। নিরিবিলি ও মনোরম একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল। মুখোমুখি বসে আছে দুজন। উজ্জ্বল যদিও নীহারিকার দিকে সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তবে নীহারিকা মাথা নুইয়ে বসে আছে। তাই নীহারিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল উজ্জ্বল। গলা খাকিয়ে বলল,
“আমি এখানে মিস নীহারিকা। নিচে তাকিয়ে আপনি কী দেখছেন?”
চোখ তুলে নীহারিকা এবার সংকুচিত দৃষ্টিতে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। নীহারিকার জড়তাগ্রস্ত চাহনি দেখে উজ্জ্বল মৃদু হাসল। বলল,

“ঠিকভাবে তাকান না আমার দিকে। ওয়েট ওয়েট আর ইউ সাই?”
সঙ্গে সঙ্গেই নীহারিকা চোখ দুটো নামিয়ে নিলো। কী বলবে কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলনা সে। উজ্জ্বলের সাথে কথা বলতেই তার ইচ্ছে করছেনা। হাসফাস লাগছে। নীহারিকার ব্যবহারে ক্রমশ বিরক্ত হতে লাগল উজ্জ্বল! তবুও সে নিজেকে স্থির রেখে নিচু গলায় নীহারিকাকে বলল,
“আচ্ছা এখানে আমিই তো আছি। এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে? প্লিজ আপনি আমার দিকে তাকান। নরমালি কথা বলুন। তাছাড়া এর আগে কী আপনি কখনও কারো সাথে মিট করেননি?”

অমনি নীহারিকা বিচলিত দৃষ্টি ফেলল উজ্জ্বলের দিকে। সানির কথা মনে পরে গেল তার। প্রায় অনেকবারই সানির সাথে মিট করেছে সে। তবে তখন তো সে সানিকে ভালোবাসত। তাই ভালোবাসার স্বার্থেই তার সাথে মিট করেছিল। কিন্তু উজ্জ্বলকে তো তার কোনোভাবেই পছন্দ হচ্ছেনা! সে নরমালি কথা বলবে কীভাবে? স্মিত হেসে উজ্জ্বল পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“প্লিজ সে অনেস্টলি নীহারিকা। এর আগে আপনার কারো সাথে রিলেশন ছিলনা?”
নীহারিকা পূর্বের তুলনায় আরও বেশী ঘাবড়ে গেল! কী বলবে ভেবে পাচ্ছিলনা সে। নীহারিকার হাবভাব বুঝে উজ্জ্বল নিজেই আবার প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,

“আচ্ছা অতীতে যা হইছে হইছে! তবে বর্তমানে যেন শুধু আমিই থাকি! একচুয়েলি আমার পরিবার আপনাকে এতটাই পছন্দ করে বসেছে যে তারা চাইছে আপনার সাথেই আমার বিয়েটা হোক। সেজন্য আমিও চাই আমার বিয়েটা আপনার সাথেই হোক। যদিও আমি জানিনা আপনার মনে কী চলছে।”
শুকনো ঢোঁক গিলল নীহারিকা। আগ্রহ থেকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“আপনার পরিবারের হঠাৎ আমাকে এত পছন্দ করার কারণ কী? আপনার সাথে তো আমার কোনোদিক থেকেই মিলছেনা! আপনি চাইলে তো সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করতে পারেন। বাট আমিতো কালো।”
ফিচেল হাসল উজ্জ্বল। নীহারিকার দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। হেয়ো স্বরে বলল,

“সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই আমার! তারা রূপ দেখিয়ে মানুষ ঠকায়! বাড়াবাড়ি রকমের অহংকার দেখায়। বিয়ের পর স্বামীর উপর ও ক্ষমতা দেখায়। আর একটু এডুকেটেড হলে তো কথাই নেই! চাকরী বাকরীর বাহানা দিয়ে না জানি কী কী করে বেড়ায়!”

“সুন্দরী মেয়েদের প্রতি এত রাগ কেন আপনার? আপনার লাইফেও বুঝি কোনো সুন্দরী মেয়ে ছিল?”
নীহারিকার কঠিন প্রশ্নে খামোশ খেয়ে গেল উজ্জ্বল! তড়িঘড়ি করে সে নীহারিকার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। মেন্যু কার্ডের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
“কী খাবেন? কোল্ড নাকি হুট?”

পিয়াসা এখনও হন্ন হয়ে তার রিসিপশনের লেহেঙ্গা খুঁজে বেড়াচ্ছে। পছন্দসই কোনো লেহেঙ্গাই সে খুঁজে পাচ্ছেনা। রূপলের যেন শান্তি নেই কিছুতেই। নীহারিকার উপর প্রচণ্ড রাগ জমা হলেও নীহারিকাকে একা ছাড়তে ইচ্ছে হয়নি তার! রেস্টুরেন্টের ভেতর রূপল সশরীরে প্রবেশ না করলেও রেস্টুরেন্টের ওয়েটারকে সে উজ্জ্বল ও নীহারিকার পেছনে হায়ার করেছে! ওয়েটার তাদের দুজনকে চোখে চোখে রাখছে ও প্রতিটা মুহূর্তের আপডেট দিচ্ছে রূপলকে! কথা বলতে বলতে উজ্জ্বলের সাথে নীহারিকা প্রায় অনেকটাই মিশে গেল! এই পর্যায়ে এসে উজ্জ্বলকে খারাপ মনে হলোনা নীহারিকার। তবে মন থেকেও মানতে পারছিলনা তাকে! ভালো বন্ধু মনে হলো তার। এভাবেই প্রায় আধ ঘণ্টা পাড় হয়ে গেল। কথা শেষে দুজনই রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে এলো।

নীহারিকার মুখোমুখি হলোনা রূপল! তার থেকে অনেকটাই দূরে দাড়িয়ে রইল। সবার থেকে বিদায় নিয়ে উজ্জ্বল তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। পিয়াসাও সিদ্ধান্ত নিলো আজ সে লেহেঙ্গা কিনবে না। বাড়ি ফিরে যাবে। কাল বা পরশু এসে লেহেঙ্গাটা কিনে নিয়ে যাবে। পিয়াসা নিজে থেকেই তার পছন্দ করা লেহেঙ্গাটির প্যাকেট নীহারিকার হাতে তুলে দিলো! মনে কোনো ক্ষোভ রাখলনা সে! পিয়াসার ব্যবহারে নীহারিকা বেশ অবাক হলো। এত ভালো মানুষির কারণ সে বুঝল না। শপিংমল থেকে সবাই বের হওয়ার সময় রূপল হঠাৎ পেছন থেকে নিহাল এবং পিয়াসাকে ডাকল। নিহালের কাছে আবদার রেখে সে বলল,

“জিজু। আপনারা বাড়ি ফিরে যান। পিয়াসাকে নিয়ে আমি একটু পরে বাড়ি ফিরছি!”
রূপলের প্রস্তাবে অবাক হলো নিহাল। কৌতূহলী গলায় শুধালো,
“কেন? কোনো বিশেষ প্রয়োজন?”
নির্লিপ্ত গলায় রূপল বলল,

“ভাবলাম পিয়াসাকে একটু সময় দিই! অনেকদিন হলো পিয়াসার সাথে তেমন সময় কাটানো হচ্ছেনা আমার।”
রূপলের কথায় আবেগপ্রবণ হয়ে গেল পিয়াসা! রূপলের হাত চেপে ধরে দাড়ালো সে। আবদারের স্বরে নিহালকে বলল,
“হ্যাঁ নিহাল। আমিও ভাইয়ার সাথে কিছুক্ষণ থাকতে চাই। নীহারিকাকে নিয়ে আপনি বাড়ি ফিরে যান।”
অপারগ গলায় নিহাল বলল,
“ওকে। তোমাদের ইচ্ছে।”

নীহারিকাকে নিয়ে নিহাল বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। রূপলের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না নীহারিকা। চোরের মত সে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে! কোনো রকমে একবার রূপলের মুখোমুখি হলে খবর আছে তার। যদিও সে তার অনুমান থেকে উপলব্ধি করতে পারছে। রূপলও একটি বারের জন্য ফিরে তাকাচ্ছে না নীহারিকার দিকে। সহ্যই করতে পারছেনা যেন সে নীহারিকাকে।

নিহাল ও নীহারিকা চলে যেতেই রূপল পিয়াসাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল। পিয়াসার পছন্দের চকলেট ফ্লেভারের আইসক্রীম অর্ডার করল সে। সাথে বার্গার ও কোল্ড ড্রিংকস। পিয়াসা তার পছন্দের খাবার পেয়ে বেশ খুশি হয়ে গেল। আইসক্রীম খেতে খেতে সে প্রফুল্ল চোখে রূপলের দিকে তাকালো। উদ্বেলিত গলায় বলল,
“থ্যাংকস ভাইয়া। আমিতো ভেবেছিলাম তুমি আমার পছন্দের কথা ভুলেই গেছ!”
স্মিত হেসে পিয়াসার মাথায় গাড্ডা মারল রূপল। প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্ন ছুড়ল,

“উজ্জ্বলকে তুই-ই ডেকে এনেছিস তাইনা?”
অমনি পিয়াসা আইসক্রীম খাওয়া বন্ধ করে দিলো! জিদ্দি হয়ে সুস্পষ্ট গলায় বলল,
“হ্যাঁ এনেছি! তো?”
“তাকে ডেকে আনার কারণ?”
“কারণটা তো তোমার না বুঝার কথা নয় ভাইয়া! তোমার সাথে নীহারিকাকে আমার মোটেও সহ্য হয়না!”
“তার গাঁয়ের রঙ কালো বলেই কী তাকে তোর সহ্য হয়না?”
“হ্যাঁ তাই! তাছাড়া আজ তুমি তার পছন্দকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমার পছন্দকে অগ্রাহ্য করেছ! তোমার ব্যবহারে আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি ভাইয়া।”

“তুই তখন কী যেন বলেছিলিস তাকে? ঐ রঙটা তাকে মানাবে না তাই তো? এই কথাটা কী তার কাছে অপমান মনে হয়নি? তাকে ছোটো করা হয়নি? কষ্ট পায়নি সে? তেমনি আমিও তোকে অপমান করে এটাই বুঝাতে চেয়েছিলাম যে, অপমানিত হওয়ার পর অনুভূতিটা কেমন হয়! তুইও তো সবার সামনে তাকে অপমান করতে ছাড়িস নি তাইনা? ভাই বলে যে আমিও তোকে সবসময় ছাড় দিব এমনটা কিন্তু নয়! তুই যখন একজনকে অপমান করার ক্ষমতা রাখবি তেমনি নিজেও অপমানিত হওয়ার সহ্য ক্ষমতা রাখবি!”

“আমার থেকে ঐ মেয়েটা তোমার কাছে বেশী ইম্পর্টেন্ট হয়ে গেল ভাইয়া? তাকে আমি অপমান করেছি বলে তুমি ও তার হয়ে আমাকে অপমান করবে।”
“লিসেন পিয়াসা? তুই এখন ছোটো না। কমবেশী ভালোই বুঝিস। নীহুর প্রতি আমার আলাদা এক অনুভূতি তৈরী হয়েছে তা তুই ভালো করেই বুঝিস! নতুন করে তোকে বুঝানোর কিছু নেই। যদি আজকের পরিস্থিতি এমন হতো যে নীহু তোকে আমার সামনে অপমান করেছে তখন আমিও নীহুকে এর যোগ্য জবাব দিতাম! কেউ ছাড় পেতো না আমার থেকে। তবে এর বিপরীতে তোর উচিৎ হয়নি উজ্জ্বলকে ডেকে আনা! আমাকে হার্ট করা।”

“কেন উচিৎ হয়নি? একদম উচিৎ হয়েছে! নীহারিকার সাথে উজ্জ্বলের বিয়ে ঠিক হচ্ছে ভাইয়া। তুমি তাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো। তাছাড়া তোমার রুচি এত থার্ড ক্লাস হলো কীভাবে শুনি? শেষমেশ তুমি কী-না একটা কালো বেটে মেয়ের দিকে নজর দিতে গেলে? যেখানে সুন্দর সুন্দর মেয়েরা তোমার জন্য পাগল।”
নিজেকে যথেষ্ট সংযত রাখার চেষ্টা করল রূপল! পিয়াসার গাঁয়ে হাত তুলতে গিয়েও সে থেমে গেল। রুদ্ধকর শ্বাস ফেলে সে পিয়াসার দিকে ঝুঁকে এলো। স্থির গলায় পিয়াসাকে বুঝানোর চেষ্টা করে বলল,

“পাবলিক প্লেসে আমি তোর গাঁয়ে হাত তুলতে চাইনা পিয়ু। ঠাণ্ডা মাথায় বুঝাচ্ছি তোকে শোন? গাঁয়ের রঙ কালো হওয়াটা কোনো পাপ নয়। যে আল্লাহ্ তোকে এবং আমাকে নিজের হাতে নিজের ইচ্ছে মত ফর্সা করে তৈরী করেছেন তেমনি তাকেও নিজের হাতেই নিজের খুশিতেই কালো করে তৈরী করেছেন। আল্লাহ্’র ইচ্ছা এবং খুশিতেই সে কালো হয়ে পৃথিবীতে এসেছে। এখানে তুই বা আমি সুন্দর বলে অহংকার করার কিছু নেই। এসব কালো সাদার পার্থক্য করে তুই নিজের পাপ বাড়াচ্ছিস। আল্লাহ’কে নারাজ করছিস।”

চুপ হয়ে গেল পিয়াসা। কোথাও না কোথাও সে তার ভুল বুঝতে পারল! তবুও সে উঁচু গলায় নিজেকে বড়ো রাখার জন্য বলল,
“এখন আর এসব বলে লাভ নেই ভাইয়া। নীহারিকার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমার রিসিপশনের পরই তার বিয়ে লাগবে! যত দ্রুত সম্ভব তুমি তাকে ভুলে যাও। এতে তোমার জন্যই ভালো হবে। দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক থাকবে!”
বলেই পিয়াসা বার্গার খেতে ব্যস্ত হয়ে পরল। কপালে হাত দিয়ে রূপল মাথা নুইয়ে বসে রইল। সত্যিই কী তার আর কিছু করার নেই? নীহারিকা ও তো কী সুন্দর উজ্জ্বলের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিলো! উজ্জ্বলকে হয়ত তার ভালো ও লেগে গেছে। সে কী এখন তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে তাদের মাঝখানে রয়ে গেছে? তার কী এখন উচিৎ তাদের মাঝখান থেকে সরে আসা?

মন ভেঙে গেল রূপলের! মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো নীহারিকা ও উজ্জ্বলের মাঝখানে আর যাবেনা সে। যতটা সম্ভব নীহারিকার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলবে। পিয়াসাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে রূপল তার বাড়িতে ফিরে এলো। বাড়ি ফিরে দেখল শাকিল ও সজল হৃদির সাথে খেলছে! হৃদিকে কিছুক্ষণ আদর করে রূপল সোজা তার রুমে চলে গেল৷ রূপলের উদাসীনতা দেখে অবাক হলো শাকিল ও সজল৷ দুজনই অস্থির হয়ে রূপলের পিছু নিলো। রুমে প্রবেশ করেই দুজন দেখতে পেল রূপল দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে তার বাঁ হাতটিকে মুষ্টিবদ্ধ করে বার বার দেয়ালের সাথে আঘাত করছে! হাত কেটে টপটপিয়ে রক্ত পরছে তার! উদ্বিগ্ন হয়ে শাকিল ও সজল ছুটে গেল রূপলের কাছে। রূপলকে থামিয়ে দুজন সমস্বরে বলল,
“এসব কী ধরণের পাগলামি ভাই? তোমার আগের স্বভাবটা এখনও গেলনা?”

দুজনকে ধাক্কা মেরে রূপল রাগে ফোঁস ফোঁস রক্ত চক্ষু দ্বারা দুজনের দিকে তাকালো। ঝাঁজালো গলায় বলল,
“একটা কাজও ঠিকঠাক মত করতে পারিস তোরা? তোদের দুজনকে বলেছিলাম উজ্জ্বলের হিস্ট্রি খুঁজে বের করতে। করেছিস কিছু? আর ঐটা কোন মেয়ের নাম্বার দিয়েছিস আমাকে? তাকে ট্রেসই করা যাচ্ছেনা। বলেছিলি সে শপিং মলে থাকবে। কোথায় ছিল সে?”

রূপলের রাগ দেখে ভয় পেয়ে গেল সজল ও শাকিল। ভীতু গলায় শাকিল শুকনো ঢোঁক গিলে রূপলকে বলল,
“অফিসের কাজে মেয়েটা আটকে গেছে ভাইয়া। তাই আজ তোমার সাথে মিট করতে পারেনি।”
“তো সেটা আমাকে আগে বলিসনি কেন? এখন এসব বলেও আর লাভ নেই! সব শেষ হয়ে গেছে। হাতের বাইরে চলে গেছে সব। নীহু ঐ ছেলেটাকে গ্রহণ করে নিয়েছে! খুব শীঘ্রই তাদের বিয়ে। বের হয়ে যা তোরা আমার রুম থেকে। আমাকে একা থাকতে দে।”

সজল ও শাকিলের কোনো কথাই কানে তুলল না রূপল। দুজনকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে রুম থেকে বের করে দিলো। উদোম শরীরে সে ধপ করে ফ্লোরে বসল। খাটের কার্নিশে মাথা ঠেকিয়ে একের পর এক সিগারেট ফুকতে লাগল। তখনি নীহারিকার নাম্বার থেকে অনেকগুলো কল এলো! কলগুলো দেখেও রূপল তুলছিল না। উল্টো ভীষণ রাগ হচ্ছিল তার। সেই রাগ থেকে সে নীহারিকার নাম্বারটা ব্লক লিস্টে ফেলে দিলো! চোখ জল নিয়ে অবিচল গলায় বলল,

“আজ থেকে আপনার এবং আমার পথ সম্পূর্ণ আলাদা নীহারিকা! অযথা আপনাকে বিরক্ত করে দুই পরিবারের শান্তি নষ্ট করার কোনো মানে হয়না! আমি দূরে সরে যাব আপনার জীবন থেকে! অনেক দূরে।”

ফেরারি প্রেম পর্ব ৫০

নীহারিকা যখন বুঝতে পারল রূপল তাকে ব্লক লিস্টে ফেলে দিয়েছে তখন অজান্তেই তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরল! লেহেঙ্গাটা গাঁ থেকে খুলে ফেলল সে। রূপলকে দেখানোর জন্যই সে লেহেঙ্গাটি পরেছিল! ভেবেছিল কলটি রিসিভ সে রূপলকে বলবে ভিডিও কলে আসতে। লেহেঙ্গাটি তাকে কেমন মানিয়েছে রূপলের কাছ থেকে জানতে চাইবে!

ফেরারি প্রেম পর্ব ৫২