ফেরারি প্রেম পর্ব ৯

ফেরারি প্রেম পর্ব ৯
নিশাত জাহান নিশি

“যা হয়েছে সব ভুলে যাও পিয়াসা। আমি যেমন তোমার ফাস্ট মনে রাখতে চাইনা তেমনি আমিও চাইনা তুমিও গতকালের ঘটা কোনো ঘটনা মনে রাখো!”
মুখটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে রেখেই পিয়াসা আড়ষ্ট গলায় বলল,

“আপনি বা আপনারা হয়ত আমাকে এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না যে আসলেই আমি সতী কী-না! বা আমার চরিত্রে আদোতেই কোনো দাগ আছে কী-না। হয়ত বা আমাকে মন থেকে মেনে নিতেও আপনাদের অনেক দ্বিধাবোধ কাজ করতে পারে। কিন্তু সত্যিটা হলো এইযে, আমি সত্যিই আমার দিকে থেকে শতভাগ বিশুদ্ধ আছি। হলফ করে বলতে পারি আমার চরিত্রে কোনো দাগ নেই। তবে এটা সত্যি যে, আমি একটা সময় কারো সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলাম। তবে সেটাও শুধুমাত্র মনের দিক থেকে। শারীরিক কোনো সম্পর্ক থেকে নয়।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এই মুহূর্তে পিয়াসার মন থেকে এই অপ্রয়োজনীয় চিন্তাগুলো দূর করার জন্য নিহাল ঠাণ্ডা মাথায় পিয়াসাকে বুঝিয়ে বলল,
“দেখো পিয়াসা। প্রেম ভালোবাসা জগৎ জুড়েই আছে। আমিও একটা সময় কারো প্রেমে পরেছিলাম! কারো ভালোবাসায় গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের হেরে ফেরে তাকে হারিয়েও ফেলেছি! আবার সেই ভাগ্যের জোরেই তোমাকে বৌ হিসেবে পেয়েছি।

এমন সবার লাইফেই একটা না একটা ফাস্ট থাকেই। তেমনি তোমার লাইফেও ছিল। হয়ত মাঝখান থেকে তোমার বোকামির জন্য বিরাট বড়ো একটা ভুল বুঝাবুঝি হয়ে গিয়েছিল। সেই ভুল বুঝাবুঝির যেহেতু অবসান ঘটেই গেছে তো আমার মনে হয়না আর এসব বিষয় মনে রেখে আমাদের বর্তমান বা ভবিষ্যৎ নষ্ট করার। যত দ্রুত সম্ভব তুমি সুস্থ হয়ে উঠো। বাড়ির বৌ বাড়িতে ফিরে এসো। প্রথম প্রথম আমাদের সাথে তোমার মানিয়ে নিতে হয়তবা একটু কষ্ট হতে পারে। তবে একসাথে থাকতে থাকতে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার পরিবার কখনও তোমাকে হেলাফেলা করবে না সেই বিশ্বাস আমার আছে। তুমিও এই বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।”

নিহালের কথায় আশ্বস্ত হয়ে পিয়াসা মাথাটা ঘুরিয়ে শিথিল দৃষ্টিতে নিহালের দিকে তাকালো। তবুও কেমনে যেন বেসুরো গলায় বলল,
“এখনও ভালোবাসেন তাকে?”
ফিচেল হেসে নিহাল পিয়াসার বাঁ হাতটি তার হাতের মুঠোয় নিলো। পিয়াসার প্রশ্নবিদ্ধ দু’চোখে সে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। মলিন গলায় বলল,

“উঁহু। যবে থেকে সে অন্যের ঘরে পা রেখেছে তবে থেকেই আমি তাকে মন থেকে মুক্তি দিয়েছি। এখন আমার সবটা জুড়ে শুধু তুমি আছো। আর তুমিই থাকবে।”
ফট করে পিয়াসা তার হাতটা নিহালের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো। আনমনা হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার সময় লাগবে!”
প্রত্যত্তুরে নিহাল বেশ নরম স্বরে বলল,

“যত পারো সময় নাও। তবে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মাথাতেও আনবেনা!”
নিহালের কথায় তেমন ভ্রুক্ষেপ করলনা পিয়াসা। বরং চোখ দুটো বুজে সে ঘুমানোর চেষ্টা করল। মাথাটা কেমন যেন ঝিম ধরে আছে তার। একটু ঘুমুতে পারলে হয়ত ভালো লাগত। পিয়াসার শরীরের অবস্থা বুঝে নিহাল তার আদুরে হাত দ্বারা পিয়াসার মাথায় হাত বুলাতে লাগল। নীরব স্বরে বলল,
“তুমি বরং একটু ঘুমুনোর চেষ্টা করো। আমি আছি পাশে ডোন্ট ওরি।”

বিকেল গড়িয়ে ধরণীতে সন্ধ্যে নেমে এলো। চারিদিকে মাগরিবের আযান পড়তেই নীহারিকার ঘুম ভাঙল! সেই যে সকাল এগারোটায় বাড়ি ফিরে এসে সে অভুক্ত অবস্থাতেই ঘুম দিয়েছে সেই ঘুম মাত্র ভাঙল তার। বালিশের তলা থেকে অনবরত ফোন বেজেই চলছে তার। এক প্রকার তিক্ততা নিয়েই নীহ্রিকা নাকমুখ কুঁচকে বালিশের তলা থেকে ফোনটা হাতড়ে বের করল। স্ক্রীনের দিকে না তাকিয়েই সে বেখেয়ালি হয়ে ফোনটা তুলল। ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
“হ্যালো কে?”

অমনি ঐ পাশ থেকে নীহারিকার ক্লোজ ফ্রেন্ড তুলি দাঁত বের করে হেসে নীহারিকাকে জিজ্ঞেস করল,
“কী রে? কী খবর তোর? শুনলাম তুই নাকী ঐ রূপলের সাথে ভালোই ঘুরাফেরা করছিস?”
অমনি ফট করে মাথাটা গরম হয়ে গেল নীহারিকার। খিটখিটে মেজাজ নিয়ে সে শোয়া থেকে ওঠে বসল। উচ্চ আওয়াজে বলল,

“তোকে এসব কে বলল হ্যাঁ? কোত্থেকে এসব আজগুবি খবর পাস?”
“আজগুবি কীসের? সত্যিই তো তুই তার সাথে বাইকে করে ঘুরছিলি। হাজার হলেও ক্রাশ তোর।”
“হ্যাঁ ক্রাশ তো? কী হয়েছে এতে? আমাদের মধ্যে এরকম কোনো সম্পর্ক নেই যে কোনো স্পেসেফিক উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা একসাথে বাইকে ঘুরেছি। বাধ্য হয়ে উনি আমাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছেন ব্যস এতটুকুই। তাছাড়া এসব আজাইরা খবর তুই কোথা থেকে পাস? কে বলে তোকে এসব?”

“দিশা বলেছে!”
দিশা নামটি শোনা মাত্রই নীহারিকার রাগটা যেন পূর্বের তুলনায় আরও অধিক বেড়ে গেল! দাঁত গিজগিজিয়ে সে মৃদু চিৎকার করে বলল,
“কেন? তার কী জেলাস ফিল হয় আমি অন্য কোনো ছেলের সাথে বাইকে করে ঘুরলে? আমার বয়ফ্রেন্ডকে কেড়ে নিয়েও তার সাধ মিটেনি? এখন আবারও আমার পেছনে লেগেছে? আর তুই কীনা সেই স্বার্থপর মেয়েটার কথা বিশ্বাস করে আমার উপরেই আঙুল তুলছিস? এই তুই আমাকে চিনিস? তোরা সবকটা এক! কেউ আমাকে বুঝিস না। সবাই শুধু নিজের প্রয়োজনেই আমাকে ইউজ করিস! আর প্রয়োজন শেষ হলে আমাকে ছুড়ে ফেলে দিস।”

কান্নাজড়িত গলায় কথাগুলো বলেই নীহারিকা ফট করে কলটি কেটে দিলো। বিছানায় মাথা নুইয়ে বসে সে চোখের জল ফেলতে লাগল। এক প্রকার ডুকরেই কাঁদতে লাগল সে। নীহারিকার কান্নার আওয়াজ শুনে পাশের ঘর থেকে নীহারিকার মা ছুটে এলেন। নীহারিকাকে কান্না জড়িত অবস্থায় দেখে তিনি পেরেশান হয়ে নীহারিকার পাশে বসলেন। নীহারিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“কী হয়েছে মা? তুই কাঁদছিস কেন?”
“তুমি এখন যাও এখান থেকে। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।”
“আগে বল তো কী হয়েছে? না জেনে আমি কীভাবে এখান থেকে যাব?”
“কিছু হয়নি আমার। মা প্লিজ তুমি এখান থেকে যাও।”
“সানির কথা মনে পড়েছে?”

অমনি কান্নার ঢেউ বেড়ে গেল নীহারিকার! তার মাকে জড়িয়ে ধরে সে হেঁচকি তুলে কেঁদে বলল,
“আল্লাহ্ আমাকে এত বিশ্রী করে কেন বানালো মা? আমি দেখতে অসুন্দর আর বেটে বলেই তো সানি আমাকে ছেড়ে আমার ফ্রেন্ডের কাছে চলে গেল! আমাকে ধোঁকা দিলো!”

“এটা তোর ভুল ধারণা মা। আল্লাহ্ তোকে মোটেও বিশ্রী করে বানায়নি! বরং যথেষ্ট সুন্দর করেই বানিয়েছে। যে একবার তোর দিকে সুনয়নে তাকাবে বিশ্বাস কর সে এই ইহজীবনেও তোকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাববেনা! সানি তোর জন্য সঠিক পছন্দ ছিলনা। সানি তোকে মন থেকে কখনও ভালোবাসেনি তাই খুব সহজেই তোকে ছেড়ে যেতে পেরেছে। অন্য কাউকে ভালোও বাসতে পেরেছে। কিন্তু যে তোকে সত্যিকারের ভালোবাসবে সে কখনও তোকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মাথাতেও আনবেনা।”

“মাঝে মাঝে নিজেকে খুব ছোটো মনে হয় মা! আমি যাদেরই পছন্দ করি বা ভালোবাসতে শুরু করি তাদের জীবনেই আমার চেয়েও বেটার বেটার অপশন থাকে। আমি তাদের তুলনায় খুবই তুচ্ছ। মনকে মানাতে পারিনা তখন। কেন আল্লাহ্ আমাকে একটু সুন্দর করে তৈরী করলনা? তাহলে তো নিজেকে এতটা ছোটো মনে হতো না।”
“তুই যে এসব বলছিস? আল্লাহ্ খুব নারাজ হচ্ছে মা। প্লিজ এসব নাফরমানি কথা আর বলিস না। আমার মেয়ের জন্য রাজকুমার আসবে! যে দেখতে শুনতে লাখের মধ্যে এক হবে! যে আমার মেয়েকে মন থেকে ভালোবাসবে। যে যেমন তাকে তেমনভাবেই ভালোবাসবে।”

অমনি কান্নার মাঝে বিদ্রুপের হাসি হেসে দিলো নীহারিকা। তার মায়ের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে অট্ট হেসে বলল,
“দিবাস্বপ্ন দেখছ মা! এসব কিছুই হবেনা। আমার জীবনে কোনো রাজকুমার আসবেনা। সবাই আমার বাহ্যিক গঠন দেখেই দৌঁড়ে পালাবে! ভেতরটা দেখে কেউ আমাকে ভালোবাসবে না। সবাই সুন্দরের পূজারি। এসব বাদ দিয়ে বরং তুমি আমার জন্য খাবার নিয়ে এসো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

বিছানা ছেড়ে ওঠে নীহারিকা সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল। নীহারিকার দিকে তাকিয়ে মারজিনা হক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মনের সুপ্ত বাসনা থেকেই বললেন,
“আসবে মা। রাজকুমার নিশ্চয়ই আসবে। হয়ত অনেকটা সময় নিচ্ছে। তবে তাকে আসতেই হবে।”
মারজিনা হক চলে গেলেন নীহারিকার জন্য খাবার আনতে। ফ্রেশ হতে গিয়ে নীহারিকা একেবারে গোসল সেরেই ভেজা শরীর নিয়ে তার রুমে প্রবেশ করল। অমনি তার বেডের দিকে তাকিয়ে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল! কোনো রকমে ওড়নাটা গাঁয়ে জড়িয়ে সে অবিশ্বাস্য গলায় চেঁচিয়ে বলল,

“রূপল আপনি??”
তড়তড়িয়ে রূপল তার ক্লান্ত অবসন্ন শরীর নিয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মাথার অগোছালো চুল গুলো টেনে ধরে অস্থির গলায় নীহারিকাকে বলল,
“এই অসময়ে এসে আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য সরি। তবে এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলনা!”
চিন্তিত হয়ে নীহারিকা রূপলের দিকে এগিয়ে এলো। অধীর গলায় বলল,
“কী হয়েছে বলুন? আপনাকে দেখতে খুব চিন্তিত লাগছে। ঘুমুন নি মনে হচ্ছে। নিশ্চয়ই খাওয়া দাওয়াও করেন নি। কী হয়েছে বলুন?”

“আপনার একটা হেল্প লাগবে আমার।”
“কী হেল্প?”
“সুহাসিনীকে বুঝাতে হবে।”
“কী বুঝাতে হবে?”
“যে আমি তাকে বিয়ে করতে চাই!”
“কেন? সে আপনাকে বিয়ে করতে চায়না?”
“না!”
“স্ট্রেঞ্জ! ভালোবাসলে বিয়ে করতে চাইছেনা কেন?”
“অনেক কারণ আছে তাই!”
“ডিটেলসে বলা যাবে?”
“তাহলে আরও একবছর আগে ফিরে যেতে হবে!”
“সমস্যা নেই। আপনি বলুন। আমি শুনব।”
“একটু পানি হবে?”
“বসুন। আমি আনছি।”

নীহারিকা ছুটে গেল রূপলের জন্য পানি আনতে। ঘামে সিক্ত গাঁয়ের নোংরা শার্টটা ঝেড়ে রূপল মাথায় হাত দিয়ে বিছানার উপর বসল। বড়ো বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল সে। বুকে টনটনে ব্যথা হচ্ছে তার। কাউকে সেই ব্যথাটা বুঝাতে পারছেনা সে। মিনিট দুয়েকের মধ্যে নীহারিকা গ্লাস ভর্তি পানি নিয়ে রূপলের সামনে এসে দাঁড়ালো। মারজিনা হকও ট্রে ভর্তি নাশতা নিয়ে এলেন রূপলের জন্য। বিষয়টা রূপল মোটেও পছন্দ করলনা। সে শুধু প্রয়োজনে নীহারিকার সাথে কথা বলতে এসেছে। যে জায়গায় তার এই জীবনে আসার কথাই ছিলনা! রূপলের চোখেমুখে বিরক্তি ভাব দেখে নীহারিকা তার মাকে বলল রুম থেকে বের হয়ে যেতে। মারজিনা হক রুম থেকে বের হয়ে যেতেই নীহারিকা রূপলের মুখোমুখি এসে বসল। শান্ত গলায় বলল,

ফেরারি প্রেম পর্ব ৮

“এবার বলুন?”
গড়গড় করে গ্লাসভর্তি পানিটুকু খেয়ে রূপল আ’হ’ত দৃষ্টিতে নীহারিকার দিকে তাকালো। বিরামহীন গলায় বলতে শুরু করল,
“সেদিন আমার চাকরীর ইন্টারভিউ ছিল। রাস্তায় বাইক নিয়ে বের হতেই হঠাৎ একটি বাচ্চা মেয়ে এসে আমার রিকশার নিচে পড়ল! যদিও বাচ্চাটির তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি তবে হাত-পায়ের অনেক অংশ কেটে ছিড়ে গিয়েছিল। সেদিন প্রথম বারের মত আমি সুহাসিনীকে দেখি! আমার সুহাসিনীকে দেখি!”

ফেরারি প্রেম পর্ব ১০