বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ৩৭

বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ৩৭
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

কথাগুলো বলতে বলতে অনিমার চোখ ভিজে উঠেছে। রিক চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। এরকম অদ্ভুত অভিযোগের মানে কী? অনিমাকে খুঁজে খুঁজে ও পাগল হয়ে যাচ্ছে আর এই মেয়ে উল্টে ওকেই দোষারোপ করছে? রিক অবাক কন্ঠে বলল,
” কী বলছ এসব? কী করেছি আমি? দেখো নীলপরী আ__”
অনিমা রিককে থামিয়ে দিয়ে বলল,

” একদম নীলপরী বলে ডাকবেন না আমাকে। আপনার মুখে এই ডাকটা অসহ্য লাগছে আমার। আমি ভালো আছি এখন। এতগুলো বছর পর এখন একটু ভালো আছি আমি। আমার জীবনটাকে নতুন করে আর দুর্বিষহ করবেন না। ছেড়ে দিন আমাকে আমার মত। প্লিজ!”
রিকের এবার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে অনিমার ওপর। ছেড়ে দিন মানে কী? ওর এতোদিনের ভালোবাসা এই মেয়ের কাছে কিচ্ছু না? রিক আবার অনিমার বাহু চেপে ধরে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” এতোটা স্বার্থপর কীকরে হলে তুমি? যা ইচ্ছা করবে? আমাকে বিয়ে করা নিয়ে তো তোমার মধ্যে অনেক কনফিউশন ছিল। তাহলে আমারই ভাইকে হুট করে বিয়ে করে ফেললে কীকরে? বল?”
” কারণ ভালোবাসি ওনাকে আমি। হ্যাঁ আমি আপনার ভাইকে ভালোবাসি।”

রিক সাথেসাথে অনিমার হাত ছেড়ে দিল। শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনিমার দিকে। প্রায় দুই বছর যাবত ভালোবেসেও না অনিমাকে ভালোবাসি বলতে পেরেছে, আর না অনিমার মুখ থেকে শুনতে পেরেছে। অথচ সেই ভালোবাসার কথাই অনিমা আজ বলছে। কিন্তু সেটা ওকে না ওরই ভাইকে। অনিমার মাথা ভার লাগছে তাই মাথা ধরে বিছানায় বসে পরল।

রিকের রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। এখানে থাকলে হয়তো অনিমার সাথে খারাপ কিছু করে ফেলবে। আর অনিমাকে দেখেও অসুস্থ মনে হচ্ছে। তাই রিক আর না দাঁড়িয়ে দরজা খুলে হনহনে পায়ে বেড়িয়ে গেল। অনিমা নিঃশব্দে কাঁদছে। ওর জীবনে অন্যতম ভালো বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিল রিক। কিন্তু রিকও ওর বিশ্বাস ভেঙ্গে দিয়েছে বাকি সবার মতই। সবাই এতো স্বার্থপর কেন হয়?

সকালবেলা আদ্রিয়ান আর নাহিদ সোফায় বসে নিউস দেখছে। আজ আর বেড় হবেনা আদ্রিয়ান। রিক আজকে দিনটা এখানে থাকবে তাই। অনিমাকে কাল রাতেই বলে দিয়েছে আজ ভার্সিটি না যেতে। অনিমা এখন কিচেনে কফি বানাচ্ছে। জাবিন আর রিক নামেনি এখন ও। অভ্র এসে পাশের সিঙ্গেল সোফাতে বসে আদ্রিয়ানের উদ্দেশ্যে বলল,

” গুড মর্নিং স্যার!”
আদ্রিয়ান টিভিতে মনোযোগ রেখেই বলল,
” মর্নিং।”
অভ্র নাহিদকেও সকালের শুভেচ্ছা জানালো। এরমধ্যে রিকও টি-শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে নিচে চলে এলো। অপরপাশের সিঙ্গেল সোফায় বসল। কিন্তু কিছু বলল না। আদ্রিয়ান আর অভ্র সকালের শুভেচ্ছা জানালে সেটারই উত্তর দিল শুধু। আদ্রিয়ান রিকের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
” কী ব্যাপার? চোখ আবার লাল হয়ে আছে? রাতে ঘুমাস নি?”
রিক চোখ কচলে কোনরকম হাসার চেষ্টা করে বলল,

” আরে না, সেরকম কিছুই না। বললাম না ঠান্ডা লেগেছিল? সেইজন্যই হয়তো।”
নাহিদ রিকের হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” ব্যান্ডেজে আবার রক্ত এলো কথা থেকে?”
রিক হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
” ঘুমের মধ্যে লেগে গেছে হয়ত। ও কিছুনা সেড়ে যাবে।”
এরমধ্যেই অনিমা ট্রে তে করে সবার জন্যে কফি নিয়ে চলে এলো। প্রথমে অভ্র, নাহিদ পরে আদ্রিয়ানকে দিল। আদ্রিয়ান বলল,

” সব ক্ষত সেড়ে যাবে বললেই সাড়েনা। একটু কেয়ারফুল থাকবি তো।”
ততক্ষণে অনিমা রিকের সামনে চলে গেছে। রিকের দিকে কফির মগটা এগিয়ে দিতেই রিক অনিমার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেটা নিতে নিতে বলল,
” ঠিকই বলেছিস, সব ক্ষত সাড়েনা। বরং সময়ের সাথে সাথে আরও গভীর হয়।”
অনিমা চুপচাপ ওখান থেকে চলে যেতে নিলে আদ্রিয়ান বলল,
” কোথায় যাচ্ছো?”
” ব্রেকফাস্ট বানাতে।”
আদ্রিয়ান অনেকটা আদেশের সুরে বলল,

” চুপচাপ এখানে বস। আজ ব্রেকফাস্ট সার্ভেন্টরাই বানাতে পারবে। এই শরীর নিয়ে আর কিচ্ছু করতে হবেনা। জেদ করছিলে তাই কফি করতে দিয়েছি। এখন আর কিচ্ছু না।”
আদ্রিয়ানের কথা শুনে অনিমা ভদ্র মেয়ের মত বসে পরল। রিক কফির মগে চুমুক দিতে দিতে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখছে ওদের। তবে এতোদিন পর অনিমার হাতের কফির স্বাদ পেয়ে মনটা তৃপ্ত হয়েছে। নাহিদ উচ্ছসিত কন্ঠে বলল,

” একটা জিনিস ভালো হয়েছে। ভাবিকে এতোদিন লাইসেন্স ছাড়া ভাবি ডাকতে হতো। এখন লাইসেন্স পেয়ে গেছি। মন খুলে ভাবি ডাকব।”
নাহিদের কথায় অভ্র আর আদ্রিয়ান দুজনেই হাসল। অনিমা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ভয় লাগছে অনেকটা ওর। এরমধ্যেই জাবিনও নেমে এল। অভ্রর দিকে চোখ পরতেই ও মোটামুটি বড়সর একটা ক্রাশ খেলো। এলোমেলো চুল, হাফ হাতা টিশার্ট, থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট সব মিলিয়ে দারুণ লাগছে। অভ্রর সাথে চোখাচোখি হতেই ও দ্রুত চোখ সরিয়ে বসে পরল সোফায়। অনিমা ওর দিকে কফির মগ এগিয়ে দিল। কফিতে চুমুক দিয়ে জাবিন বলল,

” উম ভাবি, তুমি কফিটা যা বানাও না। আমি কফি তেমন পছন্দ করিনা। কিন্তু তোমার কফি মিস করতে মন চায়না। অসাধারণ।”
হঠাৎ রিক বলে উঠল,
” বরাবরই অসাধারণ হয়।”
রিকের কথা শুনে সবাই রিকের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। অনিমা ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিকের দিকে। আদ্রিয়ান চোখ ছোট ছোট করে বলল,
” তুই ওর বানানো কফি এর আগে খেয়েছিস?”
রিক মুচকি হেসে কফির মগটা রেখে বলল,

” কফিটা খেয়ে মনে হল বরাবরই ভালো বানায় সেটাই বললাম।”
সবাই আবার নিজের কাজে মন দিল। অনিমা একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল। আদ্রিয়ান বলল,
” আজকেই চলে যাবি কেন? আর কয়েকটা দিন থেকে যা এখানে?”
আদ্রিয়ানের কথা শুনে রিক আবারও একটু হাসল। নিজের তীক্ষ্ম দৃষ্টি অনিমার ওপরেই রেখে বলল,

” চাইলেও থাকতে পারব না। জামাকাপড় আনিনি। তবে ভাবছি যে পোশাক নিয়ে আবার চলে আসব এখানে। কয়েকটা দিন থেকে গেলে মন্দ হয়না। ভাবির সাথেও ভালো করে আলাপ হয়ে যাবে।”
অনিমার বুক কেঁপে উঠল। রিক এখনও অনিমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আদ্রিয়ান হেসে বলল,
” একদম! চলে আয়। সবাই মিলে কয়েকটা দিন মজা করা যাবে।”
জাবিনও খুব এক্সাইটেড হয়ে উঠল রিকের থাকার কথা শুনে। ওরা সবাই বেশ খুশি। শুধু অনিমাই খুশি হতে পারছেনা। রিক কেন থাকতে চায় এখানে? কী দরকার এখানে ওনার? আবার কী করতে চায়? এই লোকটার কী ওর শান্তি সহ্য হয়না? কবে ছাড়বে ওকে? ও মরে গেলে?

রুমের ব্যালকনির রেলিং ধরে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অনিমা। আজ সারাদিন ও রুমেই ছিল। খুব দরকার ছাড়া বেড় হয়নি। রিকের মুখোমুখি হতে চায়না ও। ওর ভয় করছে খুব। আদ্রিয়ান যখন সব জানবে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে? সেটা ভাবলে আরও বেশি ভয় হচ্ছে ওর। খুব বেশি জড়িয়ে গেছে আদ্রিয়ান নামক মানুষটার সাথে। ওই মানুষটাকে ছেড়ে বাঁচতে পারবেনা ও। কখনও না। সম্ভব না আদ্রিয়ানকে ভুলে যাওয়া। হঠাৎ কেউ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই অনিমা কেঁপে উঠল। অনিমা নড়তে গেলেই আরো শক্ত করে ধরে বলল,

” আমি, এতো নড়াচড়া করোনাতো।”
আদ্রিয়ানের গলা পেয়ে অনিমা শান্ত হল। নড়াচড়া থামিয়ে দিল। আদ্রিয়ান অনিমার কাঁধে থুতনি রেখে বলল,
” কী এতো ভাবছ? সারাদিন রুমেই আছো। দুপুরে খেলেনা ঠিক করে। শরীর খারাপ?”
অনিমা কোন জবাব দিলোনা। আদ্রিয়ান ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কোমরে হাত রেখে বলল,
” কী হয়েছে?”
অনিমা মাথা নেড়ে ‘কিছুনা’ বোঝালো। আদ্রিয়ান ওর কপালে কপাল লাগিয়ে বলল,
” মন খারাপ?”
” আব্বুর কথা খুব মনে পরছে।”

অত্যন্ত অসহায় গলায় কথাটা বলল অনিমা। চোখ ছলছল করছে ওর। আদ্রিয়ানের বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল। ওর মায়াবিনীর এরকম অসহায়ত্ব ওকে তীব্র যন্ত্রণা দেয়। ও আর কিছু না বলে অনিমাকে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” এখন একটু ঘুমিয়ে রেস্ট করো। ভালো লাগবে।”
অনিমা চোখ বন্ধ করে ফেলল। বন্ধ চোখ দিয়েও জল পরছে। আদ্রিয়ান শান্ত কন্ঠে বলল,

” আব্বুর কথা খুব মনে পরে?”
অনিমা চোখ বন্ধ করেই মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। আদ্রিয়ান আর কিছু বলল না। ওরও চোখ লালচে হয়ে উঠছে। এই মেয়েটার সামান্য কষ্টও ওর সহ্য হয়না। এতোটা ভালো কবে বেসে ফেলল ও নিজেও জানেনা। কিন্তু অনিমার চোখের একেক ফোটা জল ওর হৃদয় থেকে ফোটায় ফোটায় রক্ত ঝড়ায়। অনিমা ঘুমিয়ে পরার পর অনিমার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” যখন থেকে ভালোবেসেছি, তোমার সব কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার দায়িত্ব আমার জানপাখি। আমি থাকতে এভাবে কাঁদতে পারোনা তুমি।”

বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ৩৬

আদ্রিয়ান আর রিক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। চা টা খেয়েই বেড়িয়ে পরবে বাড়ির উদ্দেশ্যে। যদিও রিক বলেছে আবার আসবে। এটা নিয়ে আদ্রিয়ানের তেমন মাথাব্যাথা নেই। বরং এবিষয়ে ও আরও উৎসাহি। আদ্রিয়ান বলল,
” তাড়াতাড়ি চলে আসিস কিন্তু। তোর হিটলার বাপ যাই বলুক।”
রিক হাসল খানিকটা। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে রিক বলল,
” তোর বউ কই?”
” ঘুমোচ্ছে একটু। শরীর ভালো নেই।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে রিক আবার বলল,

” আচ্ছা নী_ আই মিন ভাবির সাথে কোথায় দেখা হয়েছিল তোর? আই মিন কোথায় পেয়েছিলি ওকে? আর ও এখানে থাকত কেন? ওর ফ্যামিলি সব ___
আদ্রিয়ান কিছক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” ওকে একটা নারীপাচার চক্রের লোকেদের হাত থেকে বাঁচিয়ে এনেছিলাম। ওকে বেঁচে দিচ্ছিল ওরা।”
রিক বিস্ফোরিত চোখে তাকাল। নারীপাচার চক্র? কী বলছে কী এসব আদ্রিয়ান? রিক অনেকটা অবাক হয়েই বলল,
” মানে?”

এরপর আদ্রিয়ান রিককে অনিমাকে কোথায়, কীভাবে পেয়েছে। এরপর থানায় কী কী ঘটেছে। কেন ওকে বাড়ি নিয়ে এসছে সবটা খুলে বলল। সবটা শুনে রিক হতভম্ব হয়ে গেল। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে ওর। ওর মামা বলেছিল যে অনিমা পালিয়ে গেছে। পালিয়ে গেলে এরকম একটা গ্যাং এর হাতে কীকরে পরল ও? ও উল্টে ভেবে বসেছিল অনিমা ওকে ঠকিয়েছে। কিন্তু অনিমার সাথেই তো সবচেয়ে খারাপ কিছু হতে যাচ্ছিল। কী হয়েছিল ও যাওয়ার পর? সেদিন আদ্রিয়ান অনিমাকে না পেলে আজ কোথায় থাকত ওর নীলপরী? কী অবস্থায় থাকত? কল্পনা করলেও গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ওর।

বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ৩৮