বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ৬৬

বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ৬৬
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

আজ রিক-স্নিগ্ধার বিয়ে। সারা বাড়িতে সকলের আনন্দ, হৈচৈ আর কাজের মধ্য দিয়ে কাটছে। কিন্তু অনিমা এখনো ঘুম থেকে উঠতে পারেনি। কেউ ওকে ডাকতেও আসেনি কারণ আদ্রিয়ান সবাইকে বারণ করে দিয়েছে। শরীরে জ্বর না থাকলেও অনিমার একটু রেস্ট দরকার। সময় হলে আদ্রিয়ান নিজেই ডাকতে যাবে।

জানালা দিয়ে রোদের আলো সরাসরি চোখে এসে পড়তেই এতো আলোতে অনিমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে বসতে গিয়ে বুঝতে পারল বেশ দুর্বল, মাথা ভার ভার লাগছে। কোনরকমে বসে, পিটপিটে চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল সাড়ে এগারোটা বাজে। বেশ চমকে উঠল ও। এতো কখন বেজে গেলো? তারপর মনে পড়ল আজতো রিক আর স্নিগ্ধার বিয়ে। আর ও এখনো ঘুমাচ্ছে?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কিন্তু কাল রাতে রুমে এসে ঘুমালো কখন? নাহ, ওকে উঠে এখন নিচে যেতে হবে। সকলে কী ভাবছে কে জানে? অনিমা উঠে দাঁড়িয়ে শাড়িটা ভালোভাবে পরে নিল। এরপর বের হতে নেবে তখনই খাবারের ট্রে নিয়ে আদ্রিয়ান রুমে ঢুকল। ট্রে টা টি-টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,
” উঠে পড়েছো? কেমন লাগছে এখন?”
অনিমা ভ্রু কুঁচকে বলল,
” উঠে পড়েছো মানে? কত বেলা হয়েছে দেখেছেন? কেউ ডাকতেও আসেনি আমায়।”
” আমি বারণ করেছি।”
” বারণ করেছেন মানে? আজ বাড়িতে বিয়ে আর আমি? বাড়ির বউ হয়ে এতক্ষণ অবধি ঘুমাচ্ছি? কী বলবে সবাই?”
আদ্রিয়ান পকেটে হাত রেখে অনিমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

” কে কী বলবে সেই চিন্তা তোমার করার প্রয়োজন নেই। কাল রাতে কত জ্বর ছিল খেয়াল আছে তোমার? সারারাত জেগে ছিলাম তোমার জন্যে। বারবার বলেছি নিজের খেয়াল রাখো একটু কিন্তু আমার বকা না শোনা অবধি তুমিতো কথা শোনার মানুষ-ই নও।”
অনিমা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান সারারাত জেগে ছিল ওর জন্যে? আর ও কি-না পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল? আদ্রিয়ান বলল,

” এভাবে তাকিয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। কাল রাতেতো তেমন কিছুই খাওনি। দুধটাই যা খাওয়া হয়েছে। শরীর এমনিতেই দুর্বল হয়ে আছে। যাও।”
অনিমা ভাবল এমনিই দেরী হয়ে গেছে উঠতে। খেতে গেলে আরও সময় নষ্ট হবে। তাই ইতস্তত করে বলল,
” কিন্তু_”
অনিমা কথা শেষ করার আগেই আদ্রিয়ান বেশ রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। কারণ ও জানে অনিমা কী বলবে। অনিমা আর কথা বাড়ানোর সাহস পেলো না। ভদ্র মেয়ের মতো মাথা নেড়ে চলে গেলো ওয়াশরুমে। লোকটাকে অকারণেই ভয় পায়। যেখানে এটা ও জানে যে ওকে সামান্য আঘাত করতেও আদ্রিয়ানের হাত কাঁপবে। তাহলে এই ভয় কীসের? এটাকে কী ভয় বলা যায়? নাকি এটা অনিমার আদ্রিয়ানের প্রতি শ্রদ্ধা? যার কারণে আদ্রিয়ানের কোন কথা অমান্য করতে পারেনা ও।

কিছুক্ষণ আগেই রিক আর স্নিগ্ধার বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হলো। এখন অতিথিদের খাওয়াদাওয়া চলছে। অনিমা দেরী করে নিচে নামাতে কয়েকজন একটু কানাঘুষা করা শুরু করেছিল ঠিকই কিন্তু মিসেস রিমাও হাসি মুখে সঙ্গে সঙ্গে তাদের জবাব দিয়ে দিয়েছে। অনিমা শুধু মুচকি হেসে সরে এসেছিল ওখান থেকে। ওনারাও আর কিছু বলার মত মুখ পান নি। আসলে নিজের পরিবার যদি ঠিক থাকে তাহলে বাইরের মানুষ সুযোগ পায়না। হাসান কোতয়াল খানিকটা দেরী করেই পৌঁছেছেন আজ।

অনিমা ওনাকে দেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়েছিল। কারণ এবার বেশ লম্বা সময় পর নিজের বাবার সাথে দেখা হয়েছে ওর। ওর মামা-মামি এলেও অর্ককে কোথাও দেখতে পেলোনা অনিমা। তাই হাসান কোতয়ালকে অর্কর বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে উনি বললেন কয়েকদিন আগেই অর্কর বেশ বাজেভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে। হাত পায়ের অনেক জায়গাতে ফ্র্যাকচার হয়েছে। সুস্থ হতে বেশ সময় লাগবে। কখনও পুরোপুরি স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারবে কি-না সেটাও জানা নেই। অনিমা ভীষন অবাক হলো কথাটা শুনে। এতো বড় একটা ঘটনা আর ওকে কেউ জানায়নি? হাসান কোতয়ালকে কথাটা জিজ্ঞেস করতেই উনি একপ্রকার এড়িয়ে গেলেন। তাই অনিমাও আর জিজ্ঞেস করেনি।

আদ্রিয়ান সহ বাড়ির সকল ছেলেরা গেস্টদের খাওয়ানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে প্রচন্ড ব্যস্ত আছে তাই অনিমা, অরুমিতা, স্নেহা, তনয়া, রাইমা সবাই মিলে স্নিগ্ধার কাছে চলে গেল। বিকেলের দিকে সব কাজকর্ম সেড়ে সব রিল্যাক্স হওয়ার পর বসার ঘরে এসে বসল সবাই। সবাই মিলে কথাবার্তা বলে ডিনার শেষ করে ফ্রেশ হতে হতে অনেকটা রাত হয়ে গেলো।

সময়মতো রিক-স্নিগ্ধাকে বাসর ঘরে পৌঁছে দিয়ে নিজেরা নিজেদের মতো বিশ্রাম করতে চলে গেল। এবার বিচ্ছুবাহিনীর সেই চির পরিচিত দুষ্টুমি আবার শুরু হল। এবারও রিক-স্নিগ্ধার বাসর ঘরে ওদেরকে বিরক্ত করার ফন্দি এঁটেছে। আদিব, নাহিদ, আশিস, তীব্র, অরুমিতা, স্নেহা, তনয়া আর জাবিনতো আছেই সাথে আজ অনিমাও যোগ দিয়েছে। আদিব বলল,

” আজকের প্লানটা ফ্লপ হলে মোটাও চলবে না। গতবার ডাহা লস হয়েছে। কী খিচুড়ি পাকিয়েছিলো এরা কে জানে?”
বলে অনিমার দিকে তাকিয়ে একটা হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ করল আদিব। অনিমা ঠোঁট চেপে হালকা হাসল। এই রহস্যের সমাধান ওরা এখনো করতে পারেনি। এবারের প্লানটা হচ্ছে দরজার নিচে ফোন রেখে একটু পরপর লাউড স্পিকারে গান চালিয়ে দেওয়া।

তো প্লান মতো অনিমা ফোনটা দরজার নিচে রাখতে যাবে তখনই সামনে আদ্রিয়ান হাত ভাঁজ করে এসে দাঁড়ালো। অনিমা আদ্রিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে ও চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। অনিমা ফোনটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জোরপূর্বক একটা মেকি হাসি দিল। বাকিরা একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। এরপর যা হওয়ার তাই হলো। আদ্রিয়ানের এক ধমকে উপস্থিত সবাই একপ্রকার দৌড়ে পালালো।

শুধু অনিমা পড়ে রইল। অবস্থা বেগতিক দেখে নিজেও জাবিনের রুমের দিকে ছুট লাগাতে যাবে তার আগেই আদ্রিয়ান শক্ত করে হাত ধরে ফেলল। তারপর সাথেসাথেই অনিমাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
” মানুষ দিন দিন বড় হয় কিন্তু আপনি বাচ্চা হচ্ছেন। রুমে চলো বাচ্চামো বের করছি আমি।”
অনিমা মুখ কাঁচুমাচু করে তাকিয়ে রইল আদ্রিয়ানের দিকে। না জানি এখন আবার কোন নতুন এঙ্গেলে টর্চার করবে।

রাত সাড়ে তিনটা বাজে। স্নিগ্ধা আর রিক পাশাপাশি শুয়ে আছে। দুজনে দুজনের দিকে ফিরে শুয়ে আছে। দুজনের দৃষ্টি দুজনের চোখের দিকে। বলা, না বলা সমস্ত কথা যেনো চোখেচোখেই সেড়ে নিচ্ছে ওরা। বেশ অনেকটা সময় পর রিক মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে স্নিগ্ধার সামনে আসা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলল,

” এভাবে আর কতক্ষণ দেখবে? এতক্ষণ দেখে শান্তি হয়নি?”
স্নিগ্ধা হেসে বলল,
” তোমাকে একপলক দেখেই আমার শান্তি। কিন্তু সারাজীবন দেখলেও তৃষ্ণা মেটেনা।”
রিক স্নিগ্ধার দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলল,
” সারাজীবন আপনারই থাকব ম্যাডাম। যতখুশি দেখে নিতে পারবেন। এখন আপাতত ঘুমিয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে।”

স্নিগ্ধা রিকের বুকে মুখ গুঁজে বলল,
” তোমার মুখে ‘তুমি’ শুনতে কিন্তু বেশ লাগছে।”
রিক হালকা আওয়াজ করেই হেসে দিয়ে বলল,
” বকবক থামিয়ে ঘুমিয়ে পড়।”
স্নিগ্ধা আলতো করে রিককে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। রিকও স্নিগ্ধাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় একটা চুমু দিল। স্নিগ্ধার উন্মুক্ত শরীর চাদর দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিল। এরপর স্নিগ্ধার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আপনাআপনি ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ওর।

সময় নিজের গতিতে এগিয়ে চলেছে। দেখতে দেখতে আরও ছয়টা মাস পার হয়ে গেছে। এই ছ’টা মাস যেন একটু বেশি-ই দ্রুত পার হয়ে গেলো। সকলের জীবন এখনো একই ধারায় চলছে। কারো সম্পর্কেরই কোনরকম পরিবর্তন ঘটেনি। সবকিছুই আগের মতই আছে।
আদ্রিয়ান স্টুডিওতে বসে বসে ফোন স্ক্রোল করছে। আজ ওর সাথে রিকও এসেছে। অভ্রতো সবসময়ই থাকে। আদিব আর আশিস দুজনকেই আদ্রিয়ান কাজে পাঠিয়েছে। হঠাৎ করেই আদ্রিয়ানের ফোন বেজে উঠল। আননোন নাম্বার দেখে আদ্রিয়ান একবার রিকের দিকে তাকাল তারপর ফোনটা রিসিভ করে

‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে কবির শেখ বলল,
” আদ্রিয়ান, তোমাকে এখনো বলছি আমার পেছনে লাগা ছেড়ে দাও। নিজে নিজের মত থাকো আমায় আমার মত থাকতে দাও। তুমি আমার ভাগ্নে হও। আমি আগের সব ভুলে যাব। শুধুশুধু শত্রুতা বাড়িয়ে লাভ কী?”
আদ্রিয়ান হাতের নখ দেখতে দেখতে মুচকি হেসে বলল,
” ভয় পেলে মামা?”
” না, সাবধান করছি। তোমার খালুর বের হতে আর মাত্র কয়েকটা মাস। এখনো বলছি আমাদের পেছনে না লাগাটাই ভালো হবে।”
আদ্রিয়ান হালকা আওয়াজ করে হেসে বলল,

” তোমাদের পেছনে লাগাটাই আমার কাজ মামা। আমি তোমাকে এরচেয়ে বেটার সল্যুউশন দিচ্ছি। এসব ছেড়ে দাও। আমিও তোমার পেছন ছেড়ে দেব। আর সেটা না পারলে এরকম ফোন-টোন করে নিজের মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ না করাই বেটার।”
কথাটা বলে আদ্রিয়ান ফোনটা রেখে দিল। লাউড স্পিকারে থাকায় রিক সবটাই শুনতে পেয়েছে। রিক একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
” মামা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার মানুষ নয়। নিশ্চয়ই কিছু করছে।”
আদ্রিয়ান গম্ভীর কন্ঠে বলল,

বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ৬৫

” জানি। আমি চাইছিই সেটা। আগেরবার প্রমাণের অভাবে ওনার কিচ্ছু করতে পারিনি। আমি চাইছি এবার উনি নিজেই সব করুক। কিন্তু সমস্যা একটাই। ওনার ফার্স্ট টার্গেট অনি-ই হবে। আই নো দ্যাট। কারণ উনি জানেন ওকে আঘাত করলেই আমায় দুর্বল করা সম্ভব। কিন্তু এটাই বুঝতে পারছিনা যে অ‍্যাটাকটা করবে কোন দিক দিয়ে।”

রিক কিছু বলবে তার আগেই ওদের জন্যে খাবার নিয়ে চলে এলো সার্ভেন্ট। অভ্র এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। আদ্রিয়ান বলাতে ওও বসে পড়ল খেতে। খাওয়ার মাঝে হঠাৎই আদ্রিয়ান বলে উঠল,
” আমার বোনকে রিজেক্ট করার কারণটা কী অভ্র?”
অভ্র বিষম খেয়ে গেল আদ্রিয়ানের আচমকা এমন প্রশ্নে। রিকও অবাক হয়ে তাকাল। অভ্র কোনরকমে পানি খেয়ে নিজেকে সামলে একটা ঢোক গিলে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,

” জি স্যার?”
আদ্রিয়ান এবার অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,
” জাবিনকে ফিরিয়ে দেওয়ার রিজন কী? আর হ্যাঁ এটা বলোনা যে তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে বা তুমি কমিটেড। কারণ ঐ গাধিটা তোমাকে না চিনলেও আমি তোমাকে খুব ভালোভাবে চিনি। গার্লফ্রেন্ড অনেক দূরের কথা তোমার যেয়ে কোন স্বাভাবিক মেয়ে বন্ধুও নেই সেটা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানেনা। আসল কারণটা বলো।”

বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ৬৭