বর্ষণ মুখর দিন পর্ব ২

বর্ষণ মুখর দিন পর্ব ২
লেখিকাঃ জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

মায়ের আসার অপেক্ষা করতে করতে প্রবল বেগে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়ায় নিয়াজ একহাত মাথার উপর দিয়ে ছাউনির নিচে এসে দাঁড়ায়।নিজের গাড়িটা সাইডে পার্ক করে রেখেছে।এখন গাড়িতে গিয়ে বসলে মা আবার ওকে না দেখতে পেয়ে কোথায় খুঁজবে?গ্রামে বাবার বাড়িতে কিছুদিন থাকতে গিয়েছে।সকালে গাড়িতে উঠেই নিয়াজকে কল দিয়েছে উনাকে এসে বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসায় নিয়ে যেতে।
হাতঘড়িতে সময় দেখে কাউন্টারে গিয়ে মা যে বাসে আসার কথা ছিলো সেটার কথা জিজ্ঞেস করতেই লোকটা জানালেন দশমিনিট আগেই বাস এসে থেমেছে।

ছাউনিতে বৃষ্টির কারণে লোকজনে ভরপুর।ফোন বের করে মায়ের নাম্বারে কল দিচ্ছে।রিং হয়ে ফোন কেটে যাচ্ছে।নিয়াজ চিন্তিত হয়ে এদিক ওদিক চোখ বুলাতে লাগলো।এতগুলো মানুষকে এখন ঠেলে ঠেলে মাকে খুজতে হবে ফোন ও তুলছেনা।
জারাকে অনেক্ষণ ধরে বৃষ্টির পানি নিয়ে দুষ্টুমি করতে দেখে একজন ভদ্র মহিলা বলে উঠেন,এতক্ষণ পানি ঘাটাঘাটি করলেতো জ্বর আসবে তোমার।কথাটা কে বলেছে কন্ঠ অনুসরণ করে পেছনে তাকাতেই একজন মোটা ফ্রেমের চশমাপড়া মহিলাকে জারার নজরে পড়ে।উনি জারাকে হাতে ইশারা দিয়ে নিজের কাছে ডাকলেন।জারা উনার সামনে গিয়ে একটা মুচকি হাসি দিলো।মহিলাটি কথায় মাধুর্য নিয়ে বলল,এখানে দাঁড়িয়ে থাকো দেখলাম অনেক্ষণ ধরে পানি নিয়ে দুষ্টুমি করছো।জ্বর আসলে তখন কি করবে?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

জারা মুখে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল,ভালো লাগে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দিতে।আমি বাসায় যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু বৃষ্টি আমায় যেতে দিচ্ছে না।তাইতো বৃষ্টির সাথে খেলা করছি।
আপনি এখান থেকে কোথায় যাবেন?
ভদ্রমহিলা উত্তরে ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,আমি বাবার বাড়ি গেছিলাম।আজকে বাসায় ফিরবো আমার ছেলে আসবে আমাকে নিতে।

ওহ!আমিও বাড়ি থেকে এসেছি।এখানে খালার বাসায় থেকে পড়াশোনা করি।চুপচাপ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালোলাগছেনা।হাত দুটো বৃষ্টি কণাগুলোকে ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য নিসপিস করছে।জারা আবারো হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দিচ্ছে।ভদ্রমহিলা শব্দ করে হেসে দিলেন।জারা পেছন একবার তাকিয়ে নিজেও হেসে ফেলে।
নিয়াজ এতক্ষণ মাকে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে মায়ের দেখা পেলো।এক কোনে একটা টুলে বসে আছেন।মায়ের দিকে এগিয়ে যেতেই চোখেমুখে পানির ঝাপটা এসে পড়ে।চোখমুখ কুচকে বামহাতের তালুদিয়ে পানিটুকু মুছে নেয়।সামনের কোত্থেকে পানি এসে মুখে পড়েছে সেটা অনুসরণ করতে গিয়ে দেখলো একটা মেয়ে ওর থেকে ৯-১০ ইঞ্চি দূরে দাঁড়িয়ে অনুতাপের স্বরে সরি বলছে।এমনিতেই মাকে এতক্ষণ খুঁজে না পেয়ে মেজাজ হাই ছিলো এখনতো পুরো ৩৬০ ডিগ্রী এঙ্গেলে ঘুরে গেছে।

দাঁতে দাঁত চেপে ধরে নিয়াজ বলল,চোখ কোথায় থাকে আপনার?ডিজগাস্টিং!
জারা মুখটা ছোট করে বলে,বললামতো আমি খেয়াল করিনি।আসলে আমি ও আহাম্মকের মতো পানি ছোড়াছুড়ি করছিলাম আর আপনি হঠাৎ সামনে চলে এলেন।আমি সত্যিই দুঃখিত।
নিয়াজ ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে বলে আসলেই একটা আহাম্মক।
ভদ্রমহিলাটি টুল ছেড়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,তোমরা কি নিয়ে ঝগড়া করছো?নিয়াজ তার মায়ের হাত ধরে বলে,তোমাকে কতগুলো কল দিয়েছি সেই খেয়াল আছে তোমার?এদিকে আমি তোমাকে খুজে খুজে হয়রান।ভদ্রমহিলা আঙ্গুলের ডগা দিয়ে চশমাটা উপরের দিকে ঠেলে বললেন,ফোন আমার সাথেই আছে কল কখন বাজলো আমি শুনতে পাইনি।

আচ্ছা এখন বাসায় চলো বলে ভদ্রমহিলার হাত ধরে এগোতে নিলেই উনি বললেন আমার পানির পিপাসা লেগেছে বোতলেও পানি নেই।জারা চটপট উত্তর দিলো আমার কাছে পানি আছে আন্টি।ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করতে গেলেই নিয়াজ তার মাকে বলল তুমি বসো আমি তোমার জন্য পানি নিয়ে আসি।পথেঘাটে কারোকাছ থেকে কিছু খাওয়া ভালোনা সেটা হোক পানি।জারা এবার বিরক্ত হলো লোকটার প্রতি।আড়ালে মুখ বাঁকিয়ে বলল,কি একটা অবস্থা সবকিছু অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি।নিয়াজের মা বললেন পানি খেলে কিছু হবেনা সাথে তুই আছিস না?তাছাড়া তুই এই ভীড় ঠেলে বাইরে গিয়ে আমার জন্য পানি আনতে আনতে আমি শহীদ হয়ে যাবো।
নিয়াজ নাকমুখ কুচকে বলল,মা কি বলছো এগুলা?

জারাকে বলল,দাও মা পানির বোতলটা আমাকে দাও।জারা বোতল এগিয়ে দিতেই পানি খেয়ে জারাকে বোতল ফেরত দিলেন।
নিয়াজের মা বললেন,ওই দেখো তোমার নামটাই জিজ্ঞেস করা হলো না।কি নাম তোমার?
জারা মিষ্টি হেসে বলল,আমার নাম জারা হাসান।

বাহ অনেক সুন্দর নাম।তুমি যেমন মিষ্টি তোমার নামটাও তেমন।নিয়াজ ওর মায়ের হাত চেপে ধরে বলল,এবার চলো যেখানে যাও যারতার সাথে কথা জুড়ে দিতে পারলেই চলে।নিয়াজের মা ওর দিকে বিরস মুখে চেয়ে বলে,তুই তোর বাবার মতো একনম্বরের হিটলার।কোথাও কারো সাথে কথা বলতে দেখলেই টেনে হিঁচড়ে বাসায় নিয়া আসিস।
মায়ের কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ হলোনা নিয়াজের।বৃষ্টি অনেকটা কমে গেছে এখন হালকা একটু গুড়িগুড়ি ফোঁটা এসে মানুষকে ভিজিয়ে দিচ্ছে।নিয়াজ নিজের গায়ের কোর্ট খুলে মায়ের মাথার উপর দিয়ে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যায়।গাড়ির দরজা খুলে পেছনের সিটে মাকে বসিয়ে সামনে বসে ড্রাইভার করে।

বৃষ্টি কমে গেছে মানুষজন ও এক এক করে বেরিয়ে যাচ্ছে।আর দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবেনা ভেবে জারা রাস্তায় বেরিয়ে সিএনজি খুজে নেয়।যেখানে ভাড়া লাগে একশ টাকা বৃষ্টির কারণে দু’শো চেয়ে বসে আছে সিএনজি ড্রাইভার।দামাদামি কষে শেষে একশ পঞ্চাশ টাকায় রাজি হলো।জারা নিজের ব্যাগপত্র নিয়ে সিএনজিতে উঠে পড়ে।
বৃষ্টি হওয়ার কারণে গাছপালা সব সতেজ হয়ে উঠেছে।মনে হচ্ছে গাঢ় সবুজের সমারোহ।চারপাশ এখন অনেকটা স্নিগ্ধ লাগছে।সাথে কাঁচা মাটির ঘ্রাণ মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো পরিবেশ।জারা সিএনজিতে বসে প্রকৃতির এই মনোমুগ্ধকর রূপ দেখে চলেছে।

সিএনজি এসে ওর খালার বাসার সামনে থামতেই ভাড়া মিটিয়ে ভেতর চলে যায় জারা।কলিং বেল চাপ দিতেই জারার খালা এসে দরজা খুলে দিলেন।
কিরে তুই নিজে নিজে আসতে গেলি কেন?তাসিন তোকে নিয়ে আসতো।
জারা ক্লান্ত চোখে চেয়ে বলল,খালা আগে ভেতরে যেতে দাও ক্লান্ত হয়ে গেছি আমি।আমি ফ্রেশ হয়ে আসি তুমি খাবার দাও তারপর তোমার কথা শুনবো সরো বলে খালাকে পাশ কাটিয়ে নিজের জন্য রাখা রুমে চলে যায়।
জারার খালা রাজিয়া বেগম রান্নাঘরে চলে গেলেন জারার জন্য খাবার বাড়তে।
গোসল করে খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় জারা।সারাদিনের জার্নিতে শরীর পুরো ক্লান্ত হয়ে গেছে তাই বিছানায় মাথা রাখার কিছুক্ষণের মাঝেই চোখে ঘুম নেমে আসে।

সন্ধ্যায় সোফায় পা তুলে বসে টিভি দেখছে জারা।কোলের উপর একটা সাফ এসে পড়তেই জারা চিৎকার দিয়ে ওঠে সোফা থেকে নেমে যায়।
পেছন থেকে কারো হাসির আওয়াজে সেদিকে তাকায় জারা।তুহিন হেসে কুটিকুটি।এটা প্লাস্টিকের সাপ ছিলো।জারা নিচ থেকে একটা স্যান্ডেল নিয়ে তুহিনের দিকে ছুঁড়ে মারে।তুহিন সাবধানে পাশ কাটিয়ে যায়।
ভুটকি কখন এলি?
জারা রেগে গিয়ে বলল,বেয়াদব!তুই একি চিকন লাঠি দিন দিন আরো লাঠি হয়ে যাবি আর তোর বউ এত ভুটকি হবে যে তুই খাটেই জায়গা পাবিনা।তখন চোখে হাত দিয়ে কাঁদবি।

তুহিন সোফায় আরাম করে বসে ভাব নিয়ে বলল,জানিস এবারে সাজেক গিয়ে আরো দুটো মেয়েকে পটিয়ে এসেছি।
জারা কোমরে হাত দিয়ে বলল,এত গার্লফ্রেন্ডকে সময় দিস কিভাবে?
তুহিন চোখে চশমা দিয়ে বামহাতে একপাশের চুলগুলো ব্রাশ করে বলে,হিরো তো হিরোই হয় তাইনা।
জারা তুহিনের পেছনে একটা লাথি দিয়ে বলে,এই নে হিরোকে তখন জুতা উপহার দিয়েছিলাম এখন লাথি।
তুহিন কোমর ডলে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,ভুটকি তোর জীবনে বিয়ে হবেনা।
মা কোথায়রে?
খালা মনে হয় ঘরে আছে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে অফিসের জন্য রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে নিয়াজ।একটু তাড়াতাড়িই বের হতে হয়।ঢাকা শহর মানেই জ্যাম।জ্যামে বসে থাকার চেয়ে হেটে যাতায়াত করলে মনে হয় তাড়াতাড়ি আসা যাওয়া করা যায়।কিন্তু হাটার মত মনমানসিকতা এখনকার যুগের মানুষের নেই।
তাসিন পরোটা ছিড়তে ছিড়তে বলল,তোকে আমি ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি।দশটার আগে ঠিকানা অনুযায়ী অফিসে চলে যাবি দশটা থেকেই কিন্তু ইন্টারভিউ শুরু।
জারা মাথা দুলিয়ে বলল,আচ্ছা ঠিকাছে।তুমি এখন যেতে পারো আমার ভাবিজান তো আবার তোমার দেখা পাওয়ার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে।

তাসিন জারার মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল,দিন দিন তুই লজ্জা শরম হারিয়ে ফেলছিস।বড়ভাইয়ের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়ে জানিসনা।জারা দাঁত কেলিয়ে বলে আমাকে জ্ঞান দিতে হবেনা দেখো গিয়ে তোমার না হওয়া বউটা তোমার শোকে জ্ঞান হারিয়ে বসে আছে।জারার কথায় সবাই হেসে দিলো।
তাসিনের বাবা টাক মাথায় হাত বুলিয়ে কন্ঠ খাদে নামি বললেন,আরো এক কাপ চা হবে?

বর্ষণ মুখর দিন পর্ব ১

রাজিয়া বেগম ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,চা তোমার মাথায় ঢালবো।মাথার ছাদেতো চুল নেই আশেপাশে যা আছে সেগুলোও গরম চায়ের উত্তাপে ঝরে যাবে।সারাদিন চা চা করে আমার মাথা খায়।খালার কথা শুনে তুহিন আর জারা দুজনেই মুখ টিপে হেসে ওঠে।রাজিয়া বেগম ধমকে উঠে বললেন,তোরা হাসছিস কেনো যে যার কাজে যা।
একটা লং থ্রিপিস সাথে একটা হিজাব পড়ে খালা খালুর কাছে বলে জারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে।ফুটপাত ধরে হাটতে হাটতেই আজ ইন্টারভিউ দিতে যাবে আসার সময় রিকশা করে চলে আসবে।মানুষ চায় কিভাবে তাড়াতাড়ি যাওয়া যায় জারা তার ঠিক উল্টো।রাস্তার পাশে কতগুলো বাচ্চা কদমফুল নিয়ে খেলছে।জারা ওদের কাছ থেকে দুটো কদমফুল নিয়ে সেগুলো ছিঁড়তে ছিঁড়তে হাটছে।

গাড়ি জ্যামের মধ্যে আটকে যাওয়ায় নিয়াজ বিরক্ত হচ্ছে।বিড়বিড় করে ট্রাফিক পুলিশকে কিছু গালি দিলো।জ্যামে বসে থাকতে কার ভালো লাগে?গাড়ির গ্লাস নামিয়ে চারদিকে চোখ বুলাচ্ছে।হঠাৎ নজর যায় ফুটপাত ধরে হাটতে থাকা রমনির দিকে।মুখে হাসি হাতে কদমফুল।সামনের দিকে নজর নেই একমনে কদমফুল দেখে চলেছে।নিয়াজের মনে হলো মেয়েটাকে কোথাও দেখেছে।দু’সেকেণ্ড মাথা খাটাতেই মনে পড়লো এটাতো কালকের মেয়েটা।জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে বলে নিয়াজ গাড়ির গ্লাস উঠিয়ে চলে যায়।এদিকে জারা হেলেদুলে হেটে যাচ্ছে।যেতে কতক্ষণ সময় লাগবে সেই ধারণাটাও ওর নেই কিন্তু হেটেই চলেছে।অনেক্ষণ হাটার পর মনে হলো বহুত হেটেছি আর হাটা যাবে।একটা রিকশা ডেকে তাতে চড়ে বসে।

বর্ষণ মুখর দিন পর্ব ৩