বসন্ত এসেছে পর্ব ৩

বসন্ত এসেছে পর্ব ৩
মাহিমা রেহমান

-“এতো ব্যগপ্যাক নিয়ে যাচ্ছিস কোথায়?”
কাঁচুমাচু করে বেলা কিছু বলবে তার পূর্বেই অর্পিতা বলল,
-“কেনো তুই জানিস না আজকে আমার মেহেন্দি অনুষ্ঠান।সবাই পার্লারে সাজতে যাচ্ছি।”
কপাল কুঁচকে নিল রায়ায।বলল,

-“পার্লারে যাওয়ার দরকার কী? আমাকে বলতি, মেকআপ আর্টিস্টদের ফোন করে দিতাম।তারা বাড়িতে এসেই সাজিয়ে দিত।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“জি না।পার্লারে গিয়ে সাজা আর বাড়িতে বসে সাজা অনেক পার্থক্য বুঝেছিস।পার্লার থেকে সাজার পর আমি যখন বাড়ির পথে আসবো।তখন মানুষ আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখবে আর বললে এই এটা বউ না।তখন কী যে মজা হবে!”
আপনা-আপনি ভ্রু কুঁচকে গেল রায়াযের।মহিলা মানুষ মানেই ভেজাল।তাই আর মাথা ঘামালো না সে।নিজের কাজে মনোনিবেশ করল।পরমুহুর্তে বেলার কথা মাথায় আসতেই পাশ ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-“কিন্তু তুই কোথায় যাচ্ছিস?”
পুনরায় বেলার পূর্বে অর্পিতা বলল,
-“বারে ও বুঝি সাজবে না।”
ভারী কণ্ঠে রায়াযের উত্তর,
-“না।”

অবাক হলো সবাই।অর্পিতা জিজ্ঞেস করল,
-“কিন্তু কেনো?আমরা সবাই তো সাজছি।”
-“সবাই যা খুশি কর।ও করতে পারবে না।”
ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিল অর্পিতা।বলে উঠল,
-“কেন করতে পারবে না।”
চোখমুখ শক্ত করে রায়ায উত্তর দিল,
-“আমি বলেছি তাই।তোরা চলে যা। ও যাবে না।”

কথাটা বলেই বেলাকে হিরহিরিয়ে টানতে টানতে ভিতরে নিয়ে যেতে লাগল রায়ায।অবাক চিত্তে সেদিক তাকিয়ে সকলে।অর্পিতা লম্বা করে শ্বাস ত্যাগ করল।তার ভাই একবার যখন না করেছে তখন সূর্য পর্শিম দিকে উঠলেও তার কথার কোনো পরিবর্তন হবে না।তাই সে কাল বিলম্ব না করে বাকিদেরকে নিয়ে ছুটল পার্লারে উদ্দেশ্যে।বেলা যেন এবার কেঁদেই দিবে।নিজের ক্রন্দন বহু কষ্টে আঁটকে রায়াযকে জিজ্ঞেস করল,

-“আমাকে কেন যেতে দিলেন না রায়ায ভাই? সবাই কত সুন্দর করে পার্লার থেকে সেজে আসবে।সবাইকে খুব সুন্দর লাগবে।আমি কেন সাজতে পারব না।এখন আমাকে আর সুন্দর লাগবে না।”
থমকে গেল রায়াযের কদম।পিছন ঘুরে বেলার দুগাল আলতো করে স্পর্শ করল।চোখ বুঁজে নিল বেলা।রায়ায ভাই তাকে স্পর্শ করলে তার গা কেমন শিরশির করে।তবে খারাপ লাগে না।বেশ লাগে।অকস্মাৎ পুরুষালি গম্ভীর কণ্ঠে সম্বিত ফিরল বেলার।

-“তুই কী জানিস আমার চোখে দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারীর দ্বিতীয়টি তুই?”
কথাটা শুনে বেশ খুশী হলো বেলা।পরমুহূর্তে আবার অস্থির হয়ে পরল সে।ব্যস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-“তাহলে প্রথম নারীটি কে রায়ায ভাই?”
বিরক্ত হলো রায়ায।এই মেয়ের খালি উল্টা পাল্টা চিন্তা ভাবনা আর অহেতুক প্রশ্ন! রায়াযকে চুপ থাকতে দেখে আরো বেশি অস্থির হয় বেলা।বারংবার জিজ্ঞেস করতে লাগে,
-“বলুন না কে সে প্রথম নারী?আমি কী তাকে চিনি? আপনি কী কাউকে ভালোবাসেন রায়ায ভাই? আপনার প্রেমিকা আছে?”

আর বলতে পারল না।নিমিষেই গলা ভেঙে আসছে বেলার।আপনা আপনি গাল বেয়ে গড়িয়ে পরল একফোঁটা অশ্রু।সেদিক কয়েক পল তাকিয়ে বেলাকে নিজের কাছে টেনে নিল রায়ায। বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে উঠল,
-“তুই এখনও অনেক ছোট বেলা।এতো বেশি আবেগ অনুভূতি তোর জন্য ভালো না।”
বেলাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে পুনরায় বলল,

-“আমার সাথে চল।”
অবাক হলো বেলা।জিজ্ঞেস করল,
-“কোথায়?”
জবাব দিল না রায়ায।বেলার একহাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে এগিয়ে যেতে লাগল নিজের রুমের দিকে।রুমে প্রবেশ করে হাত ছেড়ে দিল।এগিয়ে গেল আলমারির দিকে।বিশাল আকারের একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল বেলার হাতে।অবাক চিত্তে বেলা জিজ্ঞেস করল,

-“এটা কী রায়ায ভাই?”
রায়াযের গম্ভীর কণ্ঠ,
-“নিজে গিয়ে দেখে নে।আর যা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে।আর ভুলেও সাজার চেষ্টা করবি না।”
-“সাজলে সমস্যা কোথায়? সবাই কী সুন্দর পার্লার থেকে সেজে আসবে।আর আমি পুটি মাছের মত ফ্যাকাসে হয়ে থাকবো?”
গম্ভীর কণ্ঠে রায়াযের জবার,

-“সাজলে তোকে ভূতের মত লাগবে।তাই তো না করছি।সাজ ছাড়াই তোকে বেশি ভালো লাগে।”
এবার যেন খুশি হলো বেলা।চপলা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-“সত্যি?”
রায়ায মাথা নাড়ল।পরপুহূর্তে পটেক থেকে একটা বক্স বের করলো রায়ায।হাঁটু গেড়ে বসে পরল বেলার সম্মুখে।বক্সের ভেতর থেকে বের করল এক জোড়া নূপুর।

বেলার এক পা নিজের পায়ের উপর রেখে নূপুর জোড়া এক-এক করে দুপায়ে পরিয়ে দিল।
অতি সন্তর্পনে বেলার বা পায়ে নিজের ওষ্ঠের সিক্ত স্পর্শ এঁকে দিল রায়ায।চকিতে রায়াযের দিকে তাকাল বেলা।সত্বর উঠে দাঁড়ালো সে।পিছুমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে ভারী কণ্ঠে বলল,
-“নিজের রুমে যা এবার।”
বেলা আর কিছু না বলে নিজের রুমের দিকে ছুটল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন রায়ায। এই অবুঝ মেয়েটা যে আর কবে বুঝাবে তাকে কে জানে?

এমনিতেই এই মেয়েকে দেখলে চোখ ঝলসে যায় তার।বেসামাল হয়ে পড়ে সে।তার উপর এই মেয়ে যদি সেজেগুজে তার চারপাশে ঘুরঘুর করে,তাহলে আর নিজেকে কোনোভাবেই কন্ট্রোল করতে পারবে না সে। এছাড়া নিজেকে নিয়েই কত টেনশন তার।তার উপর যদি অন্য কারো নজর পড়ে বেলার উপর।তাহলে তার নিজের কপালই পুড়বে।নিজের ভালো পাগলেও বুঝে।চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে নিজের কাজের দিকে ছুটল রায়ায।বোনের বিয়ের সকল কাজ তাকেই দেখতে হবে।বাড়ির একমাত্র ছেলে সে।

নিজের রুমে বসে প্যাকেটের ভিতরের সকল জিনিস এক এক করে বের করে দেখছে বেলা। প্রথমেই লাল রঙের বেশ সুন্দর একটা শাড়ি বের করল সে। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে রয়েছে দুমুঠো কাঁচের চুড়ি।চোখ চকচক করে উঠল বেলার।রায়ায ভাই কত্ত সুন্দর সুন্দর জিনিস উপহার দিয়েছে তাকে!আজকে মেহেন্দিতে সে এই শাড়িটাই পারবে।
তাৎক্ষণিক তার রুমে প্রবেশ করল রুমি রওশন।মেয়েকে আগের ন্যায় অগুছালো দেখে ঝাঁকিয়ে উঠল,

-“কী ব্যাপার এখনো তৈরি হসনি কেন?”
-“তুমি তৈরি করে দাও মা।”
-“কীরে সবাই তো মনে হয় পার্লারে গেল।তুই গেলি না কেন?”
নিচু কণ্ঠে বেলার জবাব,
-“এমনি যাইনি মা। তোমার হাতে তৈরি হতে ইচ্ছা করছিল তাই।”
যেন খুশি হলেন রুমি রওশন! এগিয়ে এলেন মেয়ের দিকে।বলে উঠলেন,
-“চল তাহলে তোকে তৈরি করে দিচ্ছি।ওই দেখ সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে এরই মধ্যে।”

রুমি রওশন নিজের সাথে নিয়ে আসা ব্যাগ থেকে এক-এক করে সকল জিনিসপত্র বের করতে লাগলেন।সেদিক তাকিয়ে বেলার মনে পড়ে গেল, আজকেই থিম*তো গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি।সকলে তাই পরবে।মন খারাপ হলো বেলার।রায়ায ভাইয়ের দেওয়া শাড়িটা পরতে পারবে না এই ভেবে।সকলে গ্রাম্য স্টাইলে শাড়ি পরবে।তাই সেও মাকে বলল সেভাবে শাড়ি পরিয়ে দিতে।রুমি রওশন মেয়ের কথা মত তাকে শাড়ি পরিয়ে দিল।শাড়ি পরা শেষে ভেনিটির সমীপে নিয়ে বসলো।বেলা জিজ্ঞেস করল,

-“এখানে আনলে যে.. কী করবে মা?”
-“তোকে একটু সাজিয়ে দিই।”
আঁতকে উঠে বেলা বলল,
-“না মা আমি সাজবো না।”
ভ্রুকুটি করে রুমি রওশন জিজ্ঞেস করলেন,
-“কেন সাজবি না শুনি?”
নখের সাহায্যে মেঝে খুঁটতে খুঁটতে বেলা জবাব দিল,
-“এমনি মা।ইচ্ছা করছে না।”
রেগে গেলেন রুমি রওশন।বলে উঠলেন ,
-“একদম বুড়া মহিলাদের মত কথা বলবি না।না সাজলে কেমন পোনা মাছের মত দেখতে লাগবে বল তো? এদিকে আয় আমি যতটুকু পারি সাজিয়ে দিচ্ছি তোকে।”

আয়নায় নিজেকে দেখে চমকালো বেলা।দেখতে তাকে বেশ লাগছে।মা তাকে কেবল হালকা মেকআপ করে ঠোঁটে লাল লিপিস্টিক আর আইনেইনার দিয়ে দিয়েছে।আর কানে টানা ঝুমকো যা সবাই পরবে।গলা খালি।হাতে রেশমি চুরি।
মেয়েকে সাজিয়ে দিয়ে নিজের কাজে ছুটলেন রুমি রওশন।মন খারাপ করে খাটের এক কোণে বসে পড়ল বেলা।রায়ায ভাইয়ের দেওয়া কিছুই পরতে পারল না সে।কেবল নূপুর জোড়া ছাড়া।

হইহুল্লোড় পরে গেছে রওশন বাড়িতে। একটু পরেই মেহেন্দির অনুষ্ঠান শুরু হবে।পার্লার থেকে সেজেগুজে বাড়ির সকল মেয়েরা এসে পরেছে।ঘরেই মেহেন্দির অনুষ্ঠান। হৈ হৈ করে উঠছে মেয়েরা।মেহেদী পরা শুরু হলো বলে।অনুষ্ঠানটা কেবল মেয়েদের।এখানে ছেলেদের কোনো কাজ নেই।তাই ছেলেগুলো নিজেদের মত করে অন্যথায় এনজয় করছে।অর্পিতার পাশে বসে খেজুরে আলাপে মেতে বেলা।অকস্মাৎ বাড়ির কাজের মেয়ে যুথী এসে বলল,
-“বেলা আপা আপনারে ছাদে যাইতে কইসে।”
-“কে?”

উত্তর আর দিতে পারল না যুথী।তার পূর্বেই ডাক পরল তার।সেদিকে ছুটলো সে।ললাট কুঁচকে ছাদের দিকে এগুতে লাগল বেলা।সিড়ি বেয়ে ছাদের দিক উঠতেই অকস্মাৎ কোনো ছায়ামূর্টি বেলাকে নিজের সঙ্গে চেপে ধরল। আঁতকে উঠে যেই চিৎকার দিতে যাবে তৎক্ষণাৎ কর্ণগোচর হলো মাদক মিশ্রিত পুরুষালী হাস্কি স্বর,
-“আর কত পোড়াবি আমার?প্রণয় দহনে পুড়তে পুড়তে আমি শেষ!আর কতো মারবি আমার।”
বুঝলো এটা রায়ায।কেঁপে উঠল তার সর্বাঙ্গ।কম্পনরত স্বরে বেলা সুধালো,

-“আমি আবার কী করলাম?”
-“অনেক কিছুই! সাজতে মানা করেছিলাম না? তারপর ও সেজেছিস কেনো?আর ঠোঁটে লাল রঙ্গা লিপস্টিক পরার সাহস পেলি কোথায়?”

বলেই নিজের বৃদ্ধা আঙ্গুলের সাহায্যে বেলার ওষ্ঠ হতে লিপস্টিকটুকু মুছে দিল রায়ায।কম্পন যেন বেড়ে গেল আরো কয়েকগুণ।রায়াযের নজর এখনো বেলার ওষ্ঠের দিকে।সেদিক দৃষ্টি স্থির রেখে উন্মোক্ত কোমরে হাত রেখে নিজের খুব সন্ন্যিকটে নিয়ে এলো বেলাকে।নিজের মুখ নামিয়ে আনলো বেলার ওষ্ঠের খুব কাছাকাছি।আবেশে চোখ বুঁজে নিল বেলা।
বেলার ললাটে নিজের ওষ্ঠের সিক্ত স্পর্শ এঁকে দিল রায়ায।তখনও চোখ বন্ধ বেলার।বেশ খানিক সময় আবেহিত হওয়ার পরও যখন নিজের ওষ্ঠ কোণে কোনো স্পর্শ পেল না তখন আলগোছে চোখ মেলল বেলা।দেখতে পেল তার থেকে ঠিক কয়েক ইঞ্চ দূরে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে পাঞ্জাবির পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে রায়ায।দৃষ্টি তার বেলাতে স্থির।চোখ খুলতেই বেলার উদ্দেশ্যে রায়ায বলল,

-“এই ছোট বয়সে এসব উল্টো পাল্টা চিন্তা ভাবনা নিয়ে ঘুরিস কীভাবে? এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।এখনো অনেক ছোট তুই!”
অতঃপর বেলার খুব সান্নিধ্যে এসে কিঞ্চিৎ ঝুঁকলো বেলার দিকে।পুনরায় উন্মোক্ত কোমরে নিজের শক্তপোক্ত হাত চেপে ধরে,, টেনে নিল নিজের আরো কাছে।বলে উঠল,

বসন্ত এসেছে পর্ব ২

-“তুই যেটার কথা ভেবেছিলি তার সময় এখন নয়।আরো পরে।”
কথাটা বলেই বেলার ডান গালে স্বশব্দে একটা চুমু এঁকে দিল। আপনা-আপনি দুচোখ বড় হয়ে গেল বেলার।

বসন্ত এসেছে পর্ব ৪