বাবুইপাখির অনুভূতি পর্ব ৪৮

বাবুইপাখির অনুভূতি পর্ব ৪৮
লেখিকা: তানজিল মীম

কিছুটা বিষন্নমাখা মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে অথৈ, রিনি আর আহির মুখের দিকে। সে কল্পনাও করতে পারে নি এই মুহূর্তে রিনি আর আহিকে দেখবে। অথৈ এতটাই বিষন্ন যে, সে যে আহিদের বাড়ির ভিতরে ঢুকতে বলবে সেটাই যেন মাথা দিয়ে বেরিয়ে গেছে তাঁর। অথৈকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে উঠল আহি,
‘ এভাবে তাকিয়ে থাকবি নাকি আমাদের ভিতরেও যেতে বলবি?’
আহির কথা শুনতেই হুস আসলো অথৈর কিছুটা হতভম্ব হয়ে বললো সে,
‘ দেখছো আমি ভুলেই গেছিলাম তাড়াতাড়ি আয় ভিতরে আসলে তোদের যে আমি এই মুহূর্তে দেখবো এটাই ভাবি নি তাই একটু শকটে আছি।’
এমন সময় অথৈর পিছনে দাঁড়িয়ে থেকে বলে উঠল ওর মা,

‘ কি হলো অথৈ তুই এখনো ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন কে এসেছে বাহিরে?’
অথৈ তাঁর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আমার ভার্সিটির এক বন্ধু আর রিনি এসেছে মা।’
সাথে সাথে অথৈর মা এগিয়ে গেল সামনে। রিনি আর আহি অথৈর মাকে দেখে খুশি মনে বলে উঠল,
‘ আসসালামু আলাইকুম আন্টি, কেমন আছেন?’
‘ ওলাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো তোমরা?’
‘ জ্বী ভালো।’
‘ তোমরা বাহিরে দাঁড়িয়ে আছো কেন ভিতরে আসো?’
‘ দেখো না আন্টি অথৈ আমাদের দেখে এতটাই চমকে গেছে যে আমাদের ভিতরে নিয়ে যাবে এটাই বলতে ভুলে গেছে।’ (রিনি)
রিনির কথা শুনে রিনির মা বলে উঠল,
‘ ও তো ওমনই তোমরা আসো?’
বলেই রিনি আর আহিকে ভিতরে নিয়ে গেল অথৈর মা। আর অথৈ সেও আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ওদের পিছুপিছু।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দোতলার রুমে জানালার পাশ দিয়ে খাটের ওপর বসে আছে আহি আর রিনি। আর ওদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে অথৈ। কিছুক্ষন আগেই অথৈর মায়ের দেওয়া হাল্কা পাতলা নাস্তা সেরে অথৈর রুমে এসে বসলো তাঁরা। অথৈ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে উঠল,
‘ তারপর বল,তোরা এখানে কেন এসেছিস?’
অথৈর কথা শুনে আহি সোজাসাপ্টা বলে উঠল,
‘ তোকে নিতে এসেছি।’
‘তোকে নিতে এসেছি’ কথাটা শুনতেই যেন নীরবের ফেসটা ভেসে আসলো অথৈর সামনে। চিনচিনে ব্যাথা শুরু হয়ে গেল বুকে। যেটা রোজই হয় তাঁর। অথৈ মুখটা ঘুরিয়ে বলে উঠল,
‘ কিন্তু আমি তো যাবো না আহি।’
অথৈর কথা শুনে আহি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো তারপর অথৈর দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধে হাত দিয়ে বললো,
‘ কেন যাবি না তুই? আমার হয়তো আরো আগেই আসা উচিত ছিল কিন্তু সময় করে উঠতে পারি নি।
দেখ যা হয়েছিল সেদিন তাতে তোর কোনো দোষ ছিল না। তাহলে শুধু শুধু আমার জন্য নিজের ক্যারিয়ার কেন নষ্ট করবি তুই? আর তাঁর থেকেও বড় কথা তুই চলে আসলেই কি নীরব ভাইয়া আমায় ভালোবাসতে শুরু করবে নাকি?’
আহির কথার উওরে কি বলবে অথৈ জানে না। অথৈকে চুপ থাকতে দেখে আবারো বললো আহি,

‘ প্লিজ চল আমাদের সাথে।’
আহি কথা শুনে আহির দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো অথৈ,
‘ বিষয়টা তেমন নয় আহি?’
‘ ওতোশতো জানি না আমি সামনে এক্সাম তোকে আমার খুব প্রয়োজন। কিছু পারি না তুই না গেলে আমায় পড়াবে কে? তোকে ছাড়া ভালো লাগে না চল না ফিরে।’
‘ কিন্তু আহি?’
এবার রিনিও এগিয়ে গেল অথৈর দিকে তারপর বললো,
‘ কোনো কিন্তু নেই অথৈ, আমরা যখন এসেছি তখন তোকে নিয়েই যাবো বুঝতে পেরেছিস।’
‘ তোরা বুঝতে পারছিস না।’
‘ কি বুঝতে পারছি না আমরা?’ (আহি)
এখন অথৈই কি বলবে বুঝতে পারছে না। এমন সময় অথৈর ডাক পড়লো নিচে, অথৈ ‘আমি একটু আসছি’ বলে চলে যায় নিচে। আর আহি রিনি দুজনেই কিছুটা হতাশ হয়ে তাকিয়ে রয় অথৈর যাওয়ার পানে।’
রিনি নিশ্চুপেই গিয়ে বসে বিছানায়, আর আহি হতাশ হয়ে বসে সামনে থাকা টেবিলের পাশের চেয়ারটায়। হঠাৎই অথৈর ফোনটা বেজে উঠল উপরে শুভর নাম দেখে মুচকি হেঁসে বললো সে,
‘ তুই দু’মিনিট বস আমি এক্ষুনি আসছি।’
‘ কি শুভ ফোন করেছে বুঝি?’
উওরে মুচকি হাসলো রিনি। আর রিনির হাসি দেখেই আহি তাঁর প্রশ্নের উওর পেয়ে গেছে। আহি নিজেও হেঁসে বললো,
‘ যা তাড়াতাড়ি আসিস।’
‘ হুম।’

বলেই ফোনটা তুলে ‘হ্যালো’ বলে বেরিয়ে যায় রিনি রুমে থেকে। আর আহি নিশ্চুপে বসে রয় চেয়ারে। সময়টা তখন প্রায় দুপুর বারোটার কাছাকাছি বেজে গেছে। দুপুরের কড়া রোদ্দুর এসে পড়ছে অথৈর রুমে যেটা সরাসরি আহির দিকে বিদ্যমান বর্তমানে। রুমে রোদ আসায় আহি হাত দিয়ে জানালার পাশে থাকা একদিকের জানালাটা একটু ঠেলে দিলো। এরই মধ্যে হঠাৎই এক ধমকা হাওয়া এসে অথৈর টেবিলে থাকা সেই লাল ডাইরিটার কিছু পৃষ্ঠা উল্টে দিতে লাগলো। আহির চোখটা যায় সেদিকেই আহি আনমনেই ডাইরিটা হাতে নিলো কারন কিছু পেইন্টিং জাতীয় জিনিসের দিকে চোখ আঁটকে যায় তাঁর।’
শুরুতেই আহির যে ছবিটার দিকে চোখ যায় সেটা হলো একটা চশমা পড়া ছেলে সাইকেল চড়ে এদিকেই আসছে। এঁকে এঁকে ডাইরির প্রতিটা পৃষ্ঠা উল্টে দেখতে লাগলো আহি। ডাইরির প্রতিটা ভাঁজে ভাঁজে লেখা ছিল অথৈর ছোট বেলার ভালোবাসার মানুষের অনুভূতির কথা। কি করে একটা মেয়ে একটা মানুষকে না দেখেই এতটা ভালোবাসতে পারে সেটা হয়তো এই ডাইরিটা না পেলে জানতেই পারতো না আহি। অবশেষে আহির চোখ গেল এই ডাইরির লেখা শেষ পৃষ্ঠার কাছে, শেষের দু’পৃষ্ঠা পড়ে আহির চোখ যেন ভেসে আসছিল। কারন সেখানে লেখা ছিল,

জীবনটা যেন আজ দোটানার মুখে পড়ে গেছে। একদিকে প্রান প্রিয় বন্ধু আর আরেকদিকে ছোট বেলার ভালোবাসা। আমি কখনো কল্পনাও করিনি যাকে আমি না দেখেই সেই ছোট বেলা থেকে ভালোবাসতাম সেই মানুষটাই নীরব হবে। আমার ভালোবাসাগুলো হয়তো ভালোবাসা হয়েই থেকে যাবে। কারন আমি কখনোই আমার ভালোবাসা প্রকাশ করে আমার প্রান প্রিয় বন্ধুকে ঠকাতে পারবো না। এই রকম হাজারো বাক্য লেখাছিল সেই ডাইরিতে, শেষে অথৈর চোখের পানির ছাপটাও দেখতে পেলো আহি। আহি বুঝতে পেরেছে অথৈ লেখাগুলো যখন লিখেছিল তখন কাঁদছিল। আহি পুরো লেখাটা পড়ে ডাইরিটা বন্ধ করে রেখে দেয় টেবিলের এক কোনে। সে ভাবতেই পারে নি তাঁর জন্য দুজন ভালোবাসার মানুষ শুধু শুধু কষ্ট পেল। সবার ভালোবাসাই যে সবসময় অসম্পূর্ণ থাকবে এমনটা তো নয়। যেখানে অথৈ নীরব এঁকে অপরকে খুব ভালোবাসে। আহি তাঁর চোখ মুছে ফেললো চটজলদি। আর ভাবলো তাঁর এখন অনেক কাজ যেগুলো খুব দ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে।’

অফিসের চার দেয়ালের মাঝে বসে আছে আদ্রিয়ান। দৃষ্টি তাঁর সামনে থাকা ল্যাপটপের দিকে। আদ্রিয়ান আজ থেকে আবারো ব্যস্ত হয়ে পড়বে তাঁর নিজের জীবনের অতীতে চলাকালীন সময়ের দিকে। যেটা কিছুদিনের জন্য স্থগিত ছিল। আজ আদ্রিয়ানের মনটা খুবই খারাপ, আদ্রিয়ান বুঝতে পেরেছে ভালোবাসা জিনিসটা মানুষের জন্য সত্যি খুব বাজে একটা জিনিস। ভালোবাসা জিনিসটা তখনই খুব খারাপ যখন ভালোবাসার মানুষটা আপনাকে রিজেক্ট করে দিবে বা আপনি কাউকে ভালোবাসবেন কিন্তু অপর প্রান্তের মানুষটি আপনায় মেনে নিবে না।’

আদ্রিয়ান যখন কাউকে ভালোবাসতো না তখনই ভালো ছিল। এক অন্যরকম এটিটিউড ছিল, অন্যরকম চিন্তা ধারা ছিল। কিন্তু এখন আহিকে নিয়ে ভাবা ছাড়া আর কোনো কিছুই ভালো লাগে না আদ্রিয়ানের। কিন্তু সে তো আর আহিকে নিজ ইচ্ছে ভালোবাসতে চায় নি। পরিস্থিতি তাঁকে আহিকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছে। হুট করে কাছে আসা, হুট করে অনুভূতিতে জড়ানো, হুট করে জড়িয়ে ধরা, ছোট বেলার স্মৃতি জাগ্রত হওয়া, না চাইতেও একসাথে সময় কাটানো, হুটহাট মুখোমুখি হওয়া এগুলোর একটাও কি আদ্রিয়ান নিজ ইচ্ছে করেছে নাকি। তাহলে, যদি ভালোবাসার পূর্ণতা নাই হওয়ার ছিল তাহলে এগুলো কেন হলো না হলেই তো হতো। ভালোবাসার ওপর বড্ড অভিমান হচ্ছে আদ্রিয়ানের। যে অভিমান তাঁকে ভিতর থেকে ধীরে ধীরে ভেঙে দিচ্ছে।’
এমন সময় ওর রুমে ঢুকলো নিলয়। আদ্রিয়ানের দিকে এগিয়ে এসে বললো সে,

‘ আদ্রিয়ান আমাদের বিদেশি ক্লাইন্ট ভিডিও কনফারেন্স মিটিং এর জন্য অপেক্ষা করছে সব তৈরি এখন শুধু তুই গেলেই হয়।’
নিলয়ের কথা শুনে আদ্রিয়ানও বেশি না ভেবে বলে উঠল,
‘ ঠিক আছে তুই যা আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।’
‘ ওঁকে তাড়াতাড়ি আসিস।’
‘ হুম।’
উওরে নিলয় আর কিছু না বলে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। নিলয় যেতেই নিজের মাথা থেকে কিছুক্ষনের জন্য আহিকে দূরে রেখে সামনের ল্যাপটপটা বন্ধ করে বেরিয়ে যায় আদ্রিয়ান মিটিং রুমের উদ্দেশ্যে।’

‘দুপুর ৩ঃ৩০টা’
অথৈদের বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে রিনি আর আহি। অপেক্ষা করছে তাঁরা অথৈর জন্য। অবশেষে অনেক জোরাজোরি করে অথৈকে ঢাকা বেক করাসে সক্ষম হয়েছে আহি আর রিনি। অথৈ শুরুতে রাজি না হলেও শেষে দুই বান্ধবীর জোরাজোরিতে তাঁকে হার মানতেই হলো। অথৈ জানে না সামনে তাঁর জন্য কি অপেক্ষা করছে তবে অথৈ এতটুকু ভেবে নিয়েছে নীরবের থেকে দুরত্ব বজায় রাখতে হবে। যতই নীরব আহিকে ভালোবাসুক বা না বাসুক। কারন একটাই আহিকে সে কিছুতেই ঠকাতে পারবে না। অন্যদিকে রিনি অথৈর কাছে অনেক আগেই সরি বলেছে। অথৈও তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে অনেক আগেই। কারন রিনি জায়গায় যদি অথৈ থাকতো তাহলে সেইম রিয়েকশন সেও করতো। আর সবশেষে আহি, আহির মাথায় এই মুহূর্তে কি চলছে সেটা একমাত্র সেই জানে। এঁকেক ভাবনায় মগ্ন এঁকেকজন।’
অতঃপর অথৈদের বাড়িকে গুড বাই টাটা জানিয়ে তিন বান্ধবী গাড়ি করে চললো একসাথে ঢাকার উদ্দেশ্যে। যেখানে কিছু পূর্ণতা আর অপূর্ণতার গল্প লুকিয়ে আছে।’

রাত তখন আটটা বেজে বারো মিনিট। নীরব চুপচাপ তাঁর পড়ার টেবিলে মুখ মাঝে মুখ লুকিয়ে বসে ছিল। যদিও বইটা জাস্ট সো অফ, সে তো বর্তমানল অথৈর চিন্তায় মগ্ন। এই যুগে নীরব অথৈকে ভুলতে পারবে কি না এটা সন্দেহ আছে নীরবের। এমন সময় নীরবের ভাবনার মাঝে তাঁর দরজায় নক করলো আহি বললো সে,
‘ আসবো ভাইয়া?’
হুট করেই আহির কন্ঠ কানে আসতেই কিছুটা চমকে উঠলো নীরব। আজ অনেকদিন পর যেন নীরব আহির ভয়েস শুনতে পেল। কিছুটা অবাক হয়েই তাকালো সে সামনে সত্যি সত্যি আহিকে এমন সময় নিজের রুমের দরজার সামনে দেখে বেশ খানিকটা বিস্ময় নিয়েই বললো নীরব,

বাবুইপাখির অনুভূতি পর্ব ৪৭

‘ হুম আয় কিন্তু এই সময় তুই আমার রুমে?’
নীরবের কথা শুনে আহি বেশি কিছু না ভেবেই গিয়ে বসলো নীরবের সোজাসুজি থাকা চেয়ারে তারপর বললো,
‘ তোমার সাথে কিছু কথা ছিল ভাইয়া?’
আহির কথা শুনে বিষন্নমাখা মুখ নিয়েই বললো নীরব,
‘ এখন।’

বাবুইপাখির অনুভূতি পর্ব ৪৯