বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ২৪

বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ২৪
জাওয়াদ জামী

কুহু নিচে এসে দিদুনের কাছে যায়। দিদুন জায়নামাজে বসে আছেন। কুহু ওয়াশরুমে ঢুকে, অজু করে এসে আরেকটা জায়নামাজ নিয়ে দিদুনের পাশে দাঁড়িয়ে যায়।
নামায শেষ করে জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে, বিছানায় শুয়ে পরে।

” কুহুমনি, তুমি শুয়ে পরলে যে! এখনই ঘুমিওনা কিন্তু। রাতে খেয়েই তবে ঘুমাবে। ”
” না দিদুন, আমার খুব ঘুম পেয়েছে। আজ রাতে আর খাবনা। আমি ঘুমালাম, আমাকে ডেকোনা কেমন? ” কুহু দিদুনের কথা না শুনেই ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়। ছোটমা চুল ধরার পর থেকেই মাথাটা ভিষণ ব্যথা করছে। চুলের গোড়া ব্যথায় টনটন করছে। একটু না ঘুমালেই নয়।
” কুহু মা, ও কুহু মা। একটু ওঠ দেখি। খাবারটুকু খেয়ে নে। তারপর আবার ঘুমাবি। ” তাহমিনা আক্তার ক্রমাগত ডাকতে থাকে কুহুকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ঘুমে বিভোর কুহু তাহমিনা আক্তারের ডাক শুনে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠে।
” কি হয়েছে, আন্টি! আমাকে ডাকছেন যে! ” কুহু জিজ্ঞেস করে তাহমিনা আক্তারকে।
” কিছুই হয়নি পাগলি। এখন যা চোখমুখ ধুয়ে আয়। আমি তোকে খাইয়ে দিব। ”
” আমার ক্ষুধা নেই আন্টি। এখন কিছুই খেতে ইচ্ছে করছেনা। ”
” এই মেয়ে, একদম বেশি কথা বলবিনা। যা চোখমুখে পানি দিয়ে আয়। তোর খাওয়া হলেই তবে আমি খাব। ”

তাহমিনা আক্তারের ধমকে কুহু কথা না বাড়িয়ে, বিছানা থেকে নেমে, চোখমুখে পানি দিয়ে আসে।
তাহমিনা আক্তার একটা প্লেটে গরম ভাত আর মুরগির মাংস নিয়ে এসেছেন। কুহুকে খাইয়ে দিয়ে, একটা পেইন কিলার কুহুর হাতে ধরিয়ে দেন। কুহু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে তিনি জানান, শ্বাশুড়ির কাছে মাথা ব্যথার কথা শুনে তিনি পেইন কিলার এনেছেন। কুহু জানতেও পারলনা তাহমিদ ওর মা’কে ঔষধ দিয়ে কুহুর কাছে পাঠিয়েছে।
কুহু ঔষধ খেয়ে পুনরায় শুয়ে পরে। ওর শরীর খারাপ থাকায় অল্প সময়েই ঘুমিয়ে পরে।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গলে কুহু আবিষ্কার করে ওর আর মাথা ব্যথা নেই। খুশিমনে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে বড় ফুপুর কাছে আসে। তিনি নিজ রুমে শুয়েছিলেন। তার প্রেশার এখনও কম। তাই কেউই তাকে কোন কাজ করতে দিচ্ছেনা।
” ফুপু, তোমার শরীর এখন কেমন আছে? কিছু খেয়েছ? আমার আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল। ” কুহু মুখ কাঁচুমাচু করে ফুপুর সাথে কথা বলে।
” আমি আগের থেকে এখন অনেকটাই ভালো আছি। সকালে খেয়ে ঔষধও খেয়েছি। আমাকে নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবেনা। তুই ডাইনিং রুমে যেয়ে কিছু খেয়ে নে। “। কুহু মাথা নেড়ে রুম থেকে বেরোতেই, আফরোজা নাজনীনের কথা শুনে দাঁড়িয়ে যায়।

” হ্যাঁ রে সোনা মা, তুই এই বাসায় এসেছিস বলে, তাহমিদ কি তোকে কিছু বলেছে? কিংবা ওর কোন বিরক্তি বুঝতে পারছিস? ”
” না ফুপু। তিনি তো আমার সামনে খুব একটা আসছেননা। তবে যে দুই-একবার সামনে পরেছে, মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে৷ ” কুহু মৃদুস্বরে জবাব দেয়।
আফরোজা নাজনীন হাঁফ ছাড়েন। হাত বাড়িয়ে কুহুকে কাছে ডাকেন। কুহু তার কাছে আসলে তিনি, কুহুকে পাশে বসান।

” সেদিন ও চরম অন্যায় করেছিল মানছি, কিন্তু তারপর থেকেই অনুশোচনায় ভুগেছে। আমি এটাও লক্ষ্য করেছি, ও চায় তুই আগেরমতই এই বাসায় আসিস। তাই সেদিনের কথা মনে রাখিসনা মা। ও যেমন আমার ছেলে, তুইও তেমনই আমার আরেকটা মেয়ে। তোরা দুজনেই আমার কাছে সমান। আমি মা হয়ে বলছি, তুই ওকে ক্ষমা করে দে। তবে আমাকে স্বার্থপর মনে করিসনা তুই। আমি চাই তুই পূর্বেরমতই এখানে এসে থাক। কয়েকমাস পর এইচএসসি দিবি। তারপর কোচিং করতে হবে। এরপর ভার্সিটিতে ভর্তি হবি। আমি চাইনা, শুধু হোস্টেলেই তোর জীবন কাটুক। তুই হোস্টেলে থাকিস, আমি থাকি টেনশনে। তোকে বোঝাতে পারবনা, কত চিন্তার মধ্যে আমার দিনরাতগুলো কাটে। ”

” ফুপু, তাহমিদ ভাইয়ার ওপর আমার কোন রা’গ নেই। কিন্তু তুমি যেটা বলছ, সেটা সম্ভব নয়। এই বাসায় থাকলে ছোটমা যদি রা’গ করে? ছোটমা চায়না, আমি এখানে থাকি। আমি এখানে এসেছি, ছোটমা এতে রা’গ করেছে। ”
” শিউলির, রাগ দেখতে তোকে কে বলেছে! তোর ভালোমন্দের বিষয় দেখার জন্য আমরা তিন বোন আছি। তোকে নিয়ে ওর ভেবে কোন কাজ নেই। ”
” তবুও তার কথা মানতেই হবে, ফুপু। হোস্টেলে তো আর সারা বছর থাকতে পারবনা। ছুটিতে আমাকে গ্রামে যেতেই হবে।

” তুই গ্রামে যাবি, তোর বাবার বাড়িতে। তুই কি ওর বাবার বাড়িতে যাবি! এত ভয় করিস জন্যই ও তোকে পেয়ে বসে। একটা কথা শুনে রাখ, ওর কোন কথার জবাব তুই দিবিনা, শুধু কাজে দেখিয়ে দিবি। তুই ওর শত বাঁধা স্বর্তেও জীবনে বড় হয়েছিস। শুধু ভয়কে জয় কর, দেখবি শিউলি তোকে সমঝে চলবে। ”

” ভয়কে জয় করতে হলে খুঁটির জোর থাকতে হয়, ফুপু। কিন্তু সেই খুঁটিই যদি নড়বড়ে হয়, তবে ভয়কে জয় করব কিভাবে! আমার খুঁটির জোরই হলো বাবা। কিন্তু সেই বাবাও অনেক দূরে সরে গেছে। আজকাল আমাকে দেবার জন্য ভালোবাসা তার কম পরেছে। কিন্তু আমাকে যে ফুলতলা যেতেই হবে ফুপু। আমার মা আছে সেখানে। আমার দাদু, দাদিমা সবাই আছে। আমার মায়ের স্মৃতি আছে ঐ বাড়িতে। আমি ছোটমাকে খুঁচিয়ে, ঐ বাড়িতে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করতে চাইনা। ” ফুঁপিয়ে কাঁদছে কুহু।
আফরোজা নাজনীন কুহুকে বুকে টেনে নেন। মেয়েটার যুক্তিও যে হেলা করার নয়।

” তুই কাঁদিসনা, সোনা মা। আমরা তোর পাশে আছি তো। তুই এখানে থাকতে না চাইলে থাকবিনা। কিন্তু মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসতে পারবি তো। শুধু শিউলিকে জানাবিনা এখানে এসেছিস। তুই এখানে আসায় সবাই খুব খুশি হয়েছে। তোর ফুপা পারলে আনন্দে কেঁদে দেয়। আমি শুধু চাইব, তুই এই মানুষগুলোকে এই আনন্দটুকুই দিস। এখন যা খেয়ে নে। এরপর গোসল সেরে, তৈরি হয়ে নিবি। সুপ্তির শ্বশুর বাড়িতে যেতে হবে। ”
কুহু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বেরিয়ে আসে।

” ও আমার কলিজার বইন, তুই তৈরি হবি কখন! আমরা সবাই তৈরি হয়েছি, কিন্তু তোর কোন খবর নেই! ” আনান বারবার তাড়া দিচ্ছে কুহুকে।
ঐদিকে তনয়া, আরোশি, সিক্তা, দৃষ্টি সবাই তৈরি হয়েছে। শুধু কুহুই বাকি আছে। দিদুনের শরীর খারাপ লাগায়, কুহু তার কাছে ছিল এতক্ষণ। এজন্য ও তৈরি হতে পারেনি।

” ভাইয়া, তুমি আমার সাথে কিছুদিন থেকে এভাবে কথা বলছ কেন! আগে তো এভাবে বলতেনা? ”
” আগের হিসেব আর এখনকার হিসেবের মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। আগেরগুলোর জন্য এখন আমাকে নিয়ম করে তওবা করতে হয়। তাই ভবিষ্যতে সারাজীবন তওবা করতে চাইনা বলে, এখন থেকে প্র্যাকটিস করছি এভাবে ডেকে। ”
কুহু আনানের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝেনা। তাই কোন প্রত্যুত্তর না করে তৈরি হতে যায়।

শিউলি আক্তার তার ছেলে-মেয়েকে দামী কাপড়চোপড় কিনে দিয়েছে, বিয়ে উপলক্ষে। নিজেও দামী শাড়ি, গহনা কিনেছে। যাতে বিয়ে বাড়িতে কেউ কিছু বলতে না পারে। ছেলে-মেয়েকে তৈরি করিয়ে, নিজেও তৈরি হয়ে নেয়। আয়নায় বারবার ঘুরেফিরে নিজেকে দেখছে, আন তৃপ্ত হচ্ছে। কায়েসকে যখন বলছে, সুপ্তির বিয়ের জন্য কেনাকাটা করবে, কায়েস সাথে সাথেই রাজি হয়েছে। স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে গিয়ে, ওদের পছন্দমত কেনাকাটা করেছে।

কেনাকাটার সময় কেউ ভুল করেও কুহুর নাম উচ্চারণ করেনি। কিন্তু শিহাব যখন দেখল, বাবা ওদের জন্যই সবকিছু কিনছে, কুহুর জন্য কিছুই নেয়নি। তখন ও বাবাকে কুহুর জন্যও কিনতে বলে। সাথে সাথে রে’গে উঠে শিউলি। কায়েসকে জানায় কুহুর অনেকগুলো নতুন জামাকাপড় আছে। তাই ওর জন্য কিছু না কিনলেও চলবে। কায়েসও স্ত্রীর কথামত কুহুর জন্য কিছুই নেয়না। সেদিন মনে মনে খুব হেসেছিল শিউলি। কুহু হোস্টেলে থাকায়, তার জন্য ভালোই হয়েছে। কুহুর বিরুদ্ধে নানান কথা বলে কায়েসকে নিজের দিকে টানতে পেরেছে। অবশ্য এর জন্য তাকে কম কসরত করতে হয়নি।

অবশেষে অনেক সাধনার পর সে সফল হতে পেরেছে। তবে চিন্তা একটা থেকেই যায়, স্বামী, মেয়ে তার হাতের মুঠোয় এসেছে ঠিকই, শুধু শিহাবটাই দিনরাত কুহুর নাম জপে। ছেলেকে কুহুর কাছ থেকে কিভাবে সরাবে, সেই চিন্তাই এখন তার মাথা ঘুরে। একবার ছেলেকে নিজের দিকে আনতে পারলে, রইল তিন ননদ। আস্তেধীরে তাদেরকেও নিজের দিকে টানবে। তার আগে কুহুকে নিজেদের জীবন থেকে সরাতে হবে।

কুহু যতদিন ফুপুদের সাথে যোগাযোগ রাখবে, ততদিন কুহুর কিছুই করতে পারবেনা। তাই সর্বপ্রথম কুহুকে সরাতে হবে। অবশ্য সব প্ল্যান তার ঠিক করাই আছে। যেহেতু স্বামীকে হাতের মুঠোয় আনা গেছে, তাই সেই প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করতে কোন বাধাই নেই। নিজের বুদ্ধির বহর দেখে কিটকিটিয়ে হেসে উঠে শিউলি। ঐ কুহুর জন্য তাকে অনেক অপমানিত হতে হয়েছে। এবার সে সব শোধ একবারে নিবে।

তাহমিনা আক্তার কুহুকে সাজিয়ে দিয়েছেন। যদিও কুহু বেশ আঁইগুই করছিল, কিন্তু তিনি কুহুর কথা কানেই নেননি। মনের মত করে কুহুকে সাজিয়েছেন। তারা সবাই সুপ্তির রিসিপশন যাচ্ছেন। শুধু আফরোজা নাজনীন শরীর খারাপ থাকায় যেতে পারছেননা। আফরোজা নাজনীনকে দেখাশোনার জন্য তাহমিনা আক্তার থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বড় জায়ের মতামতের কাছে হার মেনে তাকেও যেতে হচ্ছে। তবে আফরোজা নাজনীনকে দেখে রাখার জন্য তিনি এ বাড়ির পুরোনো কাজের খালা, জাহেদাকে রেখে যাচ্ছেন।

তাহমিদ ড্রয়িংরুমে বসে আনান আর নিহানের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। মা, দিদুন আর কুহু আসলেই ওরা রওনা দিবে। আড্ডার মাঝেই ওর চোখ যায় সিঁড়ির দিকে। কুহু ডিপ পার্পল কালারের একটা লেহেঙ্গা একটু উঁচিয়ে ধরে নিচে নামছে। তাহমিদের হার্টবিট এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়।
ফ্রন্ট পাফ করা ঘন কালো চুল পিঠে লুটাচ্ছে। চোখে কাজল, ঠোঁট রাঙ্গিয়েছে হালকা কালারের লিপস্টিক দিয়ে। কানে পাথরের বড় ঝুমকা, হাতে পাথরের ব্রেসলেট। এতেই বেশ লজ্জা লাগছিল কুহুর। এমনভাবে আগে কখনোই সাজুগুজু করেনি ও।
তাহমিদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কুহুর দিকে। আনান সেটা লক্ষ্য করে জোরে শিষ বাজায়।

” সুপার বইন, সুপার। তোরে তো হিরোইন লাগছে। মানুষের হার্ট অ্যাটাক করানোর জন্যই কি এই লুকে হাজির হয়েছিস! আজ আমাকে হার্ট অ্যাটাকের রুগীর আশেপাশেই থাকতে হবে দেখছি। ” আনানের দিল খোলা কথায় বেশ লজ্জা পায় কুহু।
আনানের কথার জবাব না দিয়ে বড় ফুপুর কাছে যায় বিদায় নিতে।

আয়েশা সালেহা গাড়িতে উঠে তারপাশে কুহুকে বসতে বললেন। কুহুও দিদুনের কথামত তার পাশে বসে। এবার দিদুন তাদের কাছে তাহমিদকে ডেকে নেয়। এবার কুহু মহাফ্যাসাদে পরে যায়। তাহমিদ ভাইয়ার এখানে বসা মানেই, কুহুর পাশে তাকে বসতে হবে। আয়েশা সালেহা বুদ্ধি করেই নিজের কাছে কুহুকে বসিয়েছেন, আবার বুদ্ধি করেই তাহমিদকে একই গাড়িতে ডেকেছেন। এতে যদি দুজন একটু হলেও কাছে আসে।
ড্রাইভারের পাশে বসেছে আনান, পেছনে দিদুন, কুহু, তাহমিদ আর শিহাব। তাহমিদ কুহুর পাশে বসে মুচকি হাসে। চিপসের প্যাকেট বাড়িয়ে দেয় কুহুর দিকে।

বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ২৩

” নাও, চিপস খাও। ”
কুহু চিন্তায় অস্থির। ছোটমা এ নিয়ে আবার কোন কান্ড ঘটায়।
কুহু তাহমিদের কাছ থেকে চিপস নেয়।

বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ২৫