বিন্দু থেকে বৃত্ত বোনাস পর্ব 

বিন্দু থেকে বৃত্ত বোনাস পর্ব 
জাওয়াদ জামী

দৃষ্টি আগের মত নেই। এখন অনেকটাই বদলে গেছে। যে দৃষ্টি আগে কুহুকে পছন্দ করতনা, এখন সে-ই যেচে কুহুর সাথে কথা বলছে। কুহুর রেজাল্ট শুনে খুশি হয়েছে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে শুনে খুশিতে কেঁদে দেয়। কুহু ছোট বোনের এমন আনন্দ দেখে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তবে কুহু দৃষ্টির সাথে ঠিকমত কথা বললেও, একবারও সবুজের সাথে কথা বলেনি। সবুজকে কেন যেন ওর ভালো লাগেনি।

তিনদিন গ্রামে কাটিয়ে আফরোজা নাজনীন এবং নাজমা পারভিন ঢাকা ফিরে যেতে চাইলে, কুহু আর দুইটা দিন থাকতে চায়। এবার ঢাকা গেলে হয়তো আগামী ছয়মাসে গ্রামে আসতে পারবেনা। ও ফুপুদের আর দুইটা দিন থাকতে বলে। কিন্তু তারা নিরুপায়। তাদের ফিরে যেতেই হবে। আবার কায়েসও এখন কুহুকে কিছুতেই যেতে দিতে চাচ্ছেনা। সে চাইছে মেয়েটা আর কিছুদিন থাকুক। তাই আফরোজা নাজনীন কুহুকে কয়েকটা দিন গ্রামে থাকতে বললেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তিনদিন পর দুপুরে তারা ফুলতলা থেকে রওনা দেন। সবুজ সেদিন দুপুরে খাবার পরই বাড়িতে চলে যায়। তাই আজ সবুজের সাথে তাদের দেখা হয়না। দুই ফুপু দৃষ্টিকে দশ হাজার করে বিশ হাজার টাকা দেন। দৃষ্টি নিতে না চাইলেও জোড় করে দেন।
আফরোজা নাজনীন এবং নাজমা পারভিন সকলের কাছ থেকে বিদায় নেন।
পরদিন দুপুরে সবুজ কুহুদের বাড়ি আসে। আসার পর থেকেই কুহুর সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু কুহু সবুজকে পাত্তা দেয়না।

শিউলি আক্তার এবার আর কুহুর সাথে দূর্ব্যবহার করেনি। সে নিজের মত আছে। কুহুও তাই।
শিহাব সারাদিন কুহুর আশেপাশে ঘুরঘুর করে। দৃষ্টি প্রানখুলে কুহুর সাথে কথা বলছে। কুহুর বেশ ভালো লাগছে দৃষ্টির এই পরিবর্তন।

রাতে খাবার পর যে যার ঘরে চলে আসে। কুহু নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। বিছানায় বসে ফোন হাতে নিতেই দেখল তাহমিদের নম্বর থেকে পাঁজটা মিডস কল। তাহমিদের নম্বর দেখে কুহুর বুকের ভিতর বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস দোলা দেয়। কবে কি মানুষটা ব্লক খুলে দিয়েছে! ও তাহমিদের নম্বরে ফোন দেয়। কিন্তু ফোন সুইচড অফ পায়। আবার মন খারাপ হয়ে যায় কুহুর। ও ভাবল তাহমিদ বোধহয় রা’গ করে ফোন অফ রেখেছে। কিন্তু বোকা মেয়ে একবারও ভাবলনা তাহমিদ স্যারের সাথে মেডিকেলের ওটিতে আছে।

তাহমিদের বাসায় ফিরতে রাত এগারোটা বেজে যায়। ও বাসায় ঢুকেই সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে গোসল সেরে নিচে আসে। সেখানে বড়মা ওর জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
তাহমিদ খেতে খেতে বড়মাকে কুহুর কথা জিজ্ঞেস করে। বড়মা ওকে জানায় কুহু কয়েকদিন পর আসবে।
তাহমিদের মন খারাপ হয়ে যায়। কতদিন মেয়েটাকে দেখেনি। ওকে না দেখে আর থাকতে পারছেনা। মেয়েটাকে দুপুর থেকে কয়েকবার ফোন করেছে, অথচ সে রিসিভ করেনি। তাহমিদ ভাবল রাতে আর ওকে ফোন করবেনা। একবারে সকালেই কথা বলবে ওর শ্যামাঙ্গীনির সাথে। এতদিনের কথা না বলার আক্ষেপ ঘুচাবে সকালেই।

সারাদিন মেডিকেলে ছুটাছুটি করে, ওটিতে কাজ করে ক্লান্ত তাহমিদ এগারোটা পঁয়তাল্লিশে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। শোবার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে যায়। ঘুমানোর আগে একবার ফোন হাতে নিয়ে দেখল এখনও ফোন অন করেনি। সাথে সাথেই ফোন অন করে। একবার ভাবল কুহুকে ফোন করবে কিনা। কিন্তু পরক্ষণেই আবার সিদ্ধান্ত বদলায়। অনেক রাত হয়েছে হয়তো কুহু ঘুমিয়ে পরেছে ভেবে আর ফোন দেয়না তাহমিদ। কিন্তু ও জানলনা কুহু তার ফোনের অপেক্ষায় রয়েছে।
রাত এগারোটা থেকে কুহু কয়েকবার তাহমিদকে ফোন দিয়েছে। কিন্তু বারবার বন্ধ পাচ্ছে।

এগারোটা চল্লিশে কুহু ঘুমানোর প্রস্তুস্তি নেয়।
কেবলমাত্র চোখে ঘুম ভর করেছে, ঠিক সেই সময় ওর ঘরের দরজায় কারও টোকা দেয়ার আওয়াজে কুহুর ঘুম ছুটে যায়। এতরাতে দরজায় কে টোকা দেয়! কুহু দো-মনা করতে করতে বিছানা থেকে নামে। নিয়মিত বিরতিতে কেউ দরজায় টোকা দিচ্ছে! কুহু দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে, দরজার বাইরে কে আছে। আবারও টোকা দেয়ার শব্দ! কুহু বুঝতে পারছে এটা তার বাবা কিংবা শিহাব নয়। এতরাতে বাবা ওর ঘরে আসবেনা। আর আসলেও এভাবে টোকা দিবেনা। সরাসরি ডাক দিবে।

হঠাৎ কুহুর কানে ফোনের রিংটোনের আওয়াজ আসে। যে রিংটোন সে সবুজের ফোনের ছিল। বিকেলে যখন কুহু বারান্দায় বসে শিহাবের সাথে কথা বলছিল, তখন সবুজ বাইরে যাচ্ছিল, সে সময় সবুজের ফোন বেজে ওঠে। আর এই রিংটোনই ছিল।

এবার কুহু ভয় পায়। তবে কি সবুজ ওর দরজায় টোকা দিচ্ছে! কুহুর হাত-পা ভয়ে কাঁপছে। একবার সিদ্ধান্ত নেয় বাবাকে ফোন দিবে। কিন্তু আবার ভাবে এ নিয়ে যদি ছোটমা অশান্তি করে কিংবা সব দোষ কুহুর গায়ে চাপিয়ে দেয়। সমাজে সকলের সামনে কুহুকে দোষী প্রমানিত করে তখন কি হবে! ও খুব ভালো করে জানে ছোটমা কেমন।
বারবার দরজায় টোকা পরছে। কুহু অস্থিরভাবে ঘরে পায়চারি করছে। ও কি করবে ভেবে পায়না।

একসময় চেয়ার, টেবিল আলনা টেনে দরজার দিকে ঠেসে রাখে। যাতে ধাক্কা দিলেও দরজা না খোলে। ঘরের বড় লাইটের সুইচ অন করে। এবার জানালায় টোকার শব্দ। কুহু ভালো করে জানালার ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। একমনে আল্লাহকে ডাকতে থাকে।
রাত একটা। থেমে থেমে একবার দরজা একবার জানালায় টোকা দিচ্ছে সবুজ।

” কতক্ষণ এভাবে ঘরে সিঁধিয়ে থাকবে টুকটুকি।
তোমাকে আমার মনে ধরছে। আজ রাতে তোমাকে আমার চাই। ” জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে বলল সবুজ। যা কুহুর কানে ঠিক পৌঁছে গেছে। এবার আরও ভয় পায় সে। শিওর হয়ে যায় সবুজই এটা করছে।
কুহু দোয়াদরুদ পাঠ করছে। সেই সাথে আল্লাহকে তো ডাকছেই, এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতেে। একপর্যায়ে ফোনের দিকে চোখ যায়। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন নিয়ে তাহমিদের নম্বরে ফোন দেয়। ওকে এবার আর নিরাশ হতে হয়না।
মনে আশার সঞ্চার করে বেজে ওঠে ফোন।

তিনবার রিং হতেই তাহমিদের ঘুম ভেঙে যায়। বিছানা হাতড়ে ফোন নিয়ে দেখল, কুহুর নম্বর।
” সোনাপাখি, তুমি এখনও ঘুমাওনি! এত রাতে ফোন দিলে যে? আমি সকালেই তোমাকে ফোন দিতাম। ” ঘুম জড়ানো আদুরে গলায় তাহমিদ বলে।
কিন্তু এই মুহুর্তে তাহমিদের কোন কথা কুহুর কানে পৌঁছায়না।

” আপনি কাল এখানে এসে আমাকে নিয়ে যাবেন। আসবেন তো? ” কুহু কাঁদছে।
কুহুর কান্নার আওয়াজ শুনে তাহমিদের ঘুম ছুটে যায়। ঝট করে উঠে বসে।
” কি হয়েছে পাখি? তুমি কাঁদছ কেন? তুমি ঠিক আছো তো? ”
” আপনি কাল আসবেন প্লিজ। আমার ভিষন ভয় করছে। ” কুহুর কন্ঠে অনুনয়।

” আসব। আমি কাল যত তারাতারি পারি আসব। তুমি ভয় পেওনা। বাবাকে ডাক। রাতে তার কাছেই থাক। ”
” নাহ্ বাবাকে ডাকা যাবেনা। কাউকেই ডাকা যাবেনা। আর আমি কিছুতেই ঘর থেকে বেরোতে পারবনা।”
” ঠিক আছে কাউকেই ডাকতে হবেনা। তুমি দরজা জানালা লক করে ঘরেই থাক, আমি আসছি। ভয় পেওনা সোনা। ফোন কাছে রাখ। আমি ফোন দিলেই সাথে সাথে রিসিভ করবে। আমি রাখছি। আবারও বলছি ভয় পেওনা। আমি আছি। ”

” আপনি আসবেন তো? ”
” কথা দিচ্ছি কাল তোমার দিন শুরু হবে আমার মুখ দেখে। এখন একটু শান্ত হও। আমাকে একটু সময় দাও। আল্লাহ হাফেজ। ”

তাহমিদ ফোন কেটে দিলে কুহু আবারও ভয়ে কুঁকড়ে যায়। না জানি এরপর কি হয়!
ভোর চারটা পর্যন্ত থেকে থেকে কুহুর দরজা-জানালায় টোকা দেয় সবুজ। তবে প্রথমদিকের মত ওতটা ভয় কুহু পায়নি। কারন তাহমিদ সারারাত কুহুর সাথে কথা বলেছে। তখন ফোন কাটার দশ মিনিট পরই তাহমিদ কুহুকে পুনরায় ফোন করেছে। এবং সারারাত কুহুর সাথে কথা বলেছে, ওকে শান্তনা দিয়েছে। ফজরের আজান দিলে তাহমিদ ফোন রেখে কুহুকে ঘুমাতে বলে।

কিন্তু কুহুর চোখে ঘুম আসেনা। রাতের বিভীষিকা বারবার ওকে তাড়া করছে।
সকাল ছয়টায় বাড়ির সামনে গাড়ির হর্নের আওয়াজ শুনে কায়েস একটু চমকায়। এত সকালে কে আসল! দুইদিন আগেই আপারা গেছেন। এখনতো কারও আসার কথা নয়! বাড়ির গেইট খোলাই ছিল। তাহমিদ হুরমুড়িয়ে ঢোকে বাড়িতে। এই সাত-সকালে তাহমিদকে দেখে কায়েস তব্দা খেয়ে যায়। তাহমিদ এখন, এখানে! কিছু হয়েছে কি!

” মামা, কুহু কোথায়? ” কায়েসকে জিজ্ঞেস করেই, তার উত্তরের অপেক্ষা না করে তাহমিদ জোড়ে জোড়ে কুহুকে ডাকতে থাকে।
তাহমিদের ডাক শুনে শিউলি, দৃষ্টি, শিহাব তিনজনই উঠানে আসে। তারা সবাই অবাক হয়ে তাহমিদকে দেখছে। তার পড়নে ট্রাউজার আর টি-শার্ট। বাসার পোশাক পড়েই সে এত সকালে, এতদূর পথ পাড়ি দিয়ে কেন এসেছে!
তাদের সকলের বিস্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে তাহমিদ কুহুকে ডাকতেই থাকে।
সারারাত না ঘুমানোয় কুহুর মাথা ব্যথা করছিল।

ও নিস্তেজ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। হঠাৎই তার কানে তাহমিদের ডাক পৌঁছে। ধরফরিয়ে বিছানা থেকে নেমে দরজায় ঠেস দেয়া চেয়ার, টেবিল, আলনা সরিয়ে দরজা খুলে দেয়।
দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে তাহমিদ দৌড়ে সেদিকে যায়।
কুহু দরজা হাট করে খুলে দিতেই ওর সামনে তাহমিদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। আশেপাশের লোকজন কিংবা তাদের বিস্মিত দৃষ্টির তোয়াক্কা না করে কুহু ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহমিদের বুকে।
ঝাঁকুনিতে একটু পিছিয়ে যায় তাহমিদ, তবুও শক্ত করে কুহুকে ধরে রাখে। এই প্রথম মেয়েটা স্বেচ্ছায় ওর এত কাছে এসেছে।

” আপনি আমাকে ব্লক করেছিলেন কেন? জানেন আপনাকে কতবার ফোন করেছি। সেদিনও ঐ বাসায় আপনাকে খুঁজেছি, কিন্তু আপনি ছিলেননা। আপনি খুব খারাপ, খুব খারাপ। ” কুহু হেঁচকি তুলে কাঁদছে।
” রিল্যাক্স পাখি। তুমি এত অস্থির হয়োনা। আমি এসেছি তো। ধীরে ধীরে তোমার সব অভিযোগ শুনব। এবার বল, তোমার কি হয়েছে? ”

কায়েস ওদের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলনা। মাথা নিচু করে নিজের ঘরে চলে যায়। আর ভাবতে থাকে, কি হয়েছে তার মেয়ের। আমার লাজুক মেয়েটা সবার সামনেই তাহমিদকে জড়িয়ে ধরেছে! আশেপাশে কেউ আছে তা লক্ষ্য করছেনা!

দৃষ্টি ওদেরকে দেখে মিটিমিটি হাসছে। ও আগেই বুঝোিল তাহমিদ ভাইয়া আপুকে পছন্দ করে। আজ তার প্রমান পেল।
শিউলি আক্তারের মুখে কোন কথা জোগায়না। মাথা নিচু করে রান্নাঘরে যায়।
শিহাব ভাবছে, আপু এভাবে কাঁদছে কেন!
রাতের ভয় আবারও কুহুকে জেঁকে ধরে।
” আমাকে নিয়ে চলুন এখান থেকে। আমি এক্ষুনি যেতে চাই। ”
তাহমিদ দেখল দৃষ্টি উঠানে দাঁড়িয়ে আছে।

” দৃষ্টি রুমের ভেতরে যা। কুহুর কাপড়চোপড় সব প্যাক করে দে। কুইক। শিহাব তুই মামাকে ডাক। ” কথা বলতে বলতে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাহমিদ একজনকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল।
লম্বাচওড়া, সুঠাম দেহের ফর্সা একটা ছেলে। কুঁতকুঁতে চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
তার তাকানোর ধরন, দাঁড়ানোর ভঙ্গি কোনটাই তাহমিদের ভালো লাগলোনা।
কায়েস ঘর থেকে বেরিয়ে আসলে তাকে জানায়, তারা এখনি চলে যাবে। কায়েস বুঝতে পারে কিছু একটা ঘটেছে। সে কুহুকে জিজ্ঞেস করে কিন্তু কুহু বাবার কথার উত্তর না দিয়ে কেঁদেই চলেছে। ততক্ষণে দৃষ্টি কুহুর ব্যাগ গুছিয়ে তাহমিদের হাতে দিয়েছে।

ওরা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে।
সবুজ ঘরে এসে দেয়ালে মাথা ঠুকছে। কি থেকে কি হয়ে গেল।
” ধ্যাৎ, পাখি হাত ফসকে বেরিয়ে গেল! ওকে দেখে কত সাধ জাগছিল কাছে পাওয়ার, তা আর হলোনা। সকালেই ঐ শা’লা হিরো সেজে আসছে। শা’লা’কে এই বাড়ির বাইরে একবার যদি পাইতাম। সেখানেই পুঁ’তে দিতাম। দেখি কতদিন আমার ময়নাপাখি বাপের বাড়ি ছেড়ে এদিকসেদিক উড়ে বেড়ায়। একদিন না একদিন ওকে এই বাড়িতে আসতেই হবে। আর সেইদিনই ও আমার হবে। ”

সকালে দারোয়ানের কাছ থেকে শুনেই তাহমিনা ছেলের রুমে আসে। ফাঁকা রুম দেখে তার ভয় হয়। ছেলেটা নাকি রাতেই কোথাও গেছে।
প্রায় ছুটেই তিনি আফরোজা নাজনীনের কাছে আসেন। তাকে সব জানান, দারোয়ান কি বলেছে। আফরোজা নাজনীন সব শুনে চিন্তা করতে থাকেন। এরইমধ্যে তাহমিনা ছেলের নম্বরে ফোন দিয়েছেন। কয়েকবার রিং হওয়ার পর তাহমিদ ফোন রিসিভ করে মা’কে জানায় ও দুপুরের মধ্যেই ফিরবে।
ছেলের সাথে যোগাযোগ বলে তাহমিনা চিন্তামুক্ত হন।

‘ কুঞ্জছায়া ‘ র সকলে এই অসময়ে তাহমিদের সাথে কুহুকে দেখে যতটা না অবাক হন, তারচেয়ে বেশী অবাক হন তাহমিদের কথা শুনে।
” তাহমিদ, তুমি কি বলছ দাদু? যা বলছ ভেবেচিন্তে বলছ? ” আয়েশা সালেহা বিস্মিত।
” আমি যা বলছি একদম সজ্ঞানে বলছি। আজ, এক্ষুনি যদি তোমরা আমার সাথে কুহুর বিয়ে না দাও, আর কুহু যদি রাজি না হয়, তবে আমি এ বাড়ি ছেড়ে চিরতরে চলে যাব। ”
” কি এমন হয়েছে বাপ, যার জন্য তুই এই কথা বলছিস? আজকেই বিয়ে কিভাবে সম্ভব! তোর বাবা এখানে নেই, কায়েস নেই। বাবাকে ছাড়া তুই বিয়ে করবি? ”

” বড়মা, আমি আর কোন টেনশন নিতে পারবনা।
তুমি জানো, রাত দেড়টার আগেই আমি বাসা থেকে বেরিয়েছি? সারারাত আমার রাস্তায় কেটেছে। কতটা টেনশনে ছিলাম আমি। এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাব। রাত একটায় ফোনে ওর কান্না শুনলে আমার কি হতে পারে, সে সম্পর্কে কোন ধারনা তোমার আছে? আমি ওকে নিয়ে কোন রিস্ক নিতে চাইনা। যা বলার বলে দিয়েছি। বাকিটা তোমাদের হাতে। ”

আফরোজা নাজনীন এবার কুহুর কাছে আসেন।
” সোনা মা, কি হয়েছে তোর? আমাদের একটিবার বল। দেখছিসনা ছেলেটা কেমন টেনশন করছে। ” কুহু কান্নার দমকে ফুপুর কথার উত্তর দিতে পারেনা।
” কুহু, তাহমিদের প্রস্তাবে তুই কি রাজি? আজকে অন্তত কোন ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিসনা মা। যা বলার খোলাখুলি বল। ” ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তাহমিনা আক্তার কুহুকে প্রশ্ন করেন।
কুহু মাথা তুলে একনজর তাহমিদের দিকে তাকায়। ছেলেটার চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। চুলগুলো উসকোখুসকো। বাসায় পরার ট্রাউজার, টি-শার্ট পরেই সে ফুলতলা ছুটে গেছে!

মাথা নামিয়ে কিছুক্ষণ অনেক কিছু ভাবে কুহু। জীবনের কিছু হিসেব-নিকেশ কষে মনে মনে। সব সময়ই কেন খারাপটাই ওর সাথে ঘটে?
” ফুপু, উনার প্রস্তাবে আমি রাজি। তোমরা যখন বলবে, তখনই এ বিয়ে হবে। ”
কুহুর এতটুকু কথাতেই সবাই হৈহৈ করে উঠে। আফরোজা নাজনীন তার স্বামীকে ফোন করে অফিস থেকে আসতে বললেন। এরপর দেবরকে কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে আসতে বলেন। শাহনাজ সুলতানার বাড়িতে ফোন করেন, নাজমা পারভিনকে জানান। তবে নাজমা পারভিন জানান তিনি আসতে পারবেননা।

এরপর তিনি ফোন করেন কায়েসের কাছে। আজকেই তার ভাইকে শিহাবকে সাথে নিয়ে আসতে বলেন। কায়েস অনেক প্রশ্ন করেছে, কিন্তু তিনি কোন উত্তর দেননি।
সানাউল রাশেদিন এক ঘন্টার মধ্যে বাসায় আসেন। শাহনাজ সুলতানাও ছেলেমেয়ে নিয়ে হাজির হন। তাহমিনা আক্তার সিক্তাকে নিয়ে গেছেন শপিংয়ে। ছেলের বউয়ের জন্য ইচ্ছেমত কেনাকাটা করবেন।
কুহু দিদুনের রুমে শুয়ে আছে। দিদুন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এতে বেশ আরামবোধ করছিল কুহু। এরপর কখন যে ঘুমিয়ে গেছে বলতেই পারেনা।

কুহুর ঘুম ভাঙ্গলো ছোট ফুপুর ডাকে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। ফুপুকে দেখে লজ্জা পায় কুহু। নিশ্চয়ই বড় ফুপু তাকে আসতে বলেছেন। শাহনাজ সুলতানা কুহুকে উঠিয়ে ওয়াশরুমে পাঠান। একবারে গোসল করে আসতে বললেন। ফুপু সালোয়ার- কামিজ নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে।

গোসল সেরে বেরিয়ে এসে দেখল তাহমিনা আক্তার অনেকগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎই হুড়মুড় করে দুইটা মেয়ে রুমে ঢোকে। তাহমিনা আক্তারের নির্দেশে কুহুকে ধরে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসায়।
শফিউল রাশেদিন বড় ভাবির ফোন পেয়েই প্লেনের টিকেট কেটে রাজশাহী থেকে ঢাকায় রওনা দেন। তার টিকেট পেতে দেরি হওয়ায় বাসায় আসতে বিকেল হয়ে যায়।

মাগরিবের আজানের কিছুক্ষণ আগে কুহুকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসেন আফরোজা নাজনীন। ওকে সম্পূর্ণ ব্রাইডাল সাজে সাজানো হয়েছে। তাহমিনা আক্তার শপিং করে ফেরার পথে উনার পরিচিত পার্লার থেকে দুইজন বিউটিশিয়ান এনেছিলেন।
আনান তাহমিদের রুমে এসে দেখল সে এখনো ঘুমাচ্ছে। আনান নির্দয়ের মত তাহমিদকে টেনেহিঁচড়ে তুলে ওয়াশরুম পাঠায়। তাহমিনা ছেলের জন্য শেরওয়ানী এনেছেন। সেটা তিনি আনানকে দিয়ে পাঠিয়েছেন।

বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৪৩

তাহমিদ গোসল সেরে বেরিয়ে আসলে, আনান ওকে জোড় করে শেরওয়ানী পড়ায়। এরপর ওকে নিয়ে নিচে আসে।
দুজনের বিয়ে সম্পন্ন হওয়া মাত্রই মাগরিবের আজান দেয়।
এতক্ষণ নাজমা পারভিন ভিডিও কলে সব দেখছিলেন। বিয়ে সম্পন্ন হতেই তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।
তাহমিদ কবুল বলার পরই কুহুর দিকে তাকিয়ে হা হয়ে যায়। ওর বউকে একদম মায়াবতী লাগছে। চেনাই যাচ্ছেনা সে কুহু।

বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৪৪