বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু সিজন ২ শেষ পর্ব 

বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু সিজন ২ শেষ পর্ব 
নুরুন্নাহার তিথী

রুহানীকে ডাক্তার দেখিয়ে ও নিজের ক্ষত পরীক্ষণ করিয়ে করিডোরের ওয়েটিং চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসল আরহান। রুহানীর চাচা-চাচি ও ফুফাতো ভাই রিফাত হসপিটালে এসেছে রুহানীকে নিয়ে যেতে। উনারা পাশেই কিছুটা দূরে রুহানীর বাকশক্তি ফিরে আসা নিয়ে ওকে ঘিরে আবেগময় পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। আরহান বসে বসে কিছু একটা ভেবে কাউকে কল করল।

“আমার জন্য এখনই ঢাকার ফ্লাইট টিকিট বুক করো। ইমিডিয়েট যেই ফ্লাইট আছে আমি সেটাতেই যাব। ইটস আর্জেন্ট। দেন ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুরের ফ্লাইট বুক করো। এন্ড হ্যাঁ সাথে আরও তিনটা টিকিট।”
ফোন রেখে এবার কনফারেন্সে সাদমান, তন্নি, রাইদাকে কল করে। রিসিভ হওয়ার পর সাদমান বলে,
“কী ব্যাপার আরহান? তোমরা হসপিটাল থেকে বাড়ি পৌঁছেছ?”
“ভাই, আমরা এখন ঢাকা যাব ইমিডিয়েট ফ্লাইটে। তারপর সেখান থেকে সিঙ্গাপুর যাব।”
আরহানের কথা শুনে রাইদা বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“সাফার জন্য? কিন্তু তুই তো সুস্থ না।”
“টাইম নেই রাইদা। আমি সুস্থ। কাল সকালেই সাফার দা*ফনকার্য হয়ে যাবে। রাত হওয়াতে আঙ্কেল-আন্টি দা*ফন করাবেন না। আমরা ভোরেই পৌঁছাতে পারব। এখন তো সবে সন্ধ্যা।”
সাদমানও বিষয়টা ভাবে। অতঃপর বলে,

“তুমি ঠিক বলেছ। তাহলে আমরা জলদি বেরিয়ে পরি। কারণ নেক্সট ফ্লাইট আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। হাতে আর হাফ এন আওয়ার আছে। বাই দ্যা ওয়ে, রুহানী জানে? ও আবার যেতে চাইবে না তো? ওর মে*ন্টাল কন্ডিশন আমি যা বুঝলাম, ও খুব বিষন্নতায় আছে। ও নিজেকেই দায়ী করে চলেছে। এখন এই মুহূর্তে যদি ও সাফার ব*ডি দেখে তাহলে ও আরো কন্ট্রোললেস হয়ে পরবে। আই থিঙ্ক ওকে না জানানো বেটার।”

“জানাব না। ওর রেস্ট দরকার। একাকিত্ব দরকার। তারপরেও যদি নিজেকে সামলে নিতে না পারে তাহলে তো আমি আছিই। ডাক্তার ওকে মেডিসিন প্রেসক্রাইব করেছে ও কথা কম বলতে বলেছে। সি নিড রেস্ট। আমি আমাদের চারজনের টিকেট বুক করিয়ে নিয়েছি।”
“আচ্ছা। দ্রুত বেরিয়ে পরো সবাই।”
আরহান ফোন রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে রুহানীদের কাছে যায়। তারপর বলে,
“আঙ্কেল, আন্টি, আমাকে একটু বেরোতে হবে। আপনারাও এবার বাড়ি ফিরে যান। রুহানীর রেস্ট দরকার। বেশ ধকল গেছে ওর উপর দিয়ে।”

রহমত শেখ হাস্যজ্জ্বল কণ্ঠে বললেন,
“কতো বছর পর মেয়েটার কণ্ঠস্বরটা শুনতে পেলাম। সেই খুশিতে বিকেলের ঘটনা প্রায় মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছিল। তুমিও বাড়ি যাও আরহান। আজ তোমার উপরও বেশ ধকল গেল।”
“জি আঙ্কেল।”
আরহান রুহানীর সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর বলে,

“তোমার কথা ফুটেছে এখন। সেই খুশিতে সব জমানো কথা আজকেই বলতে শুরু করো না। রেস্ট করো। ডাক্তার রেস্ট করতে বলেছেন তোমায়। বাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে পরবে। অতিরিক্ত কিছু চিন্তা করার কথা ভাববেও না। মানুষ তার নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল নিয়ে জন্মায়। সবার মৃত্যুর তারিখ, ক্ষণ ও স্থান পূর্ব নির্ধারিত। তাও কিন্তু আমরা প্রতিটা মুহূর্ত পরের মুহূর্তের জন্য বাঁচি। কিন্তু দেখো, আমরা কিন্তু জানিও না যে পরের মুহূর্তটা আমার জীবনে আসবে কী-না। প্রত্যেক প্রা*ণীকে মৃত্যুর স্বাদ ভোগ করতেই হবে। তাই কারও মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করা বোকামি। ইট ওয়াজ এন অ্যা*কসিডে-ন্ট। তুমি তো আর খু*ন করোনি। বি স্ট্রং মাই উডবি ওয়াইফ!”

আরহান রুহানীর এক গালে আলতো হাতের স্পর্শ করে মুচকি হাসল। বিপরীতে রুহানীও হাসল। তারপর আরহান সবাইকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেল। সে হসপিটাল থেকে সরাসরি এয়ারপোর্টে যাবে।

সিঙ্গাপুরের সময় ভোর সাড়ে পাঁচটায় ওরা সিঙ্গাপুরের মাটিতে ল্যান্ড করে। তারপর ওরা হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা করে। রাইদা আগের থেকেই মিসেস শাহানার কাছ থেকে সাফাকে কোন হসপিটালে রাখা হয়েছে। সব জেনে নিয়েছিল। সকাল সাতটায় সাফার জানাযার নামাজ হবে। রাইদা ও তন্নি গিয়ে সাফার মুখটা শেষ বারের মতো দেখে আসে। আরহান ও সাদমান যায় না। ওরা জানাজার জন্য অপেক্ষা করছে। আজকেই আবার রিটার্ন টিকেটে সন্ধ্যার ফ্লাইটে ফিরে যাবে। সাদমান ও আরহান সাফার বাবা মিস্টার ফয়সালের কাছে যায়। সাদমান বলে,

“আঙ্কেল, আপনাকে শক্ত থাকতে হবে। নয়তো আন্টি আরও ভেঙে পরবেন। একটা প্লেনের পাইলট যদি ঠিক না থাকে তবে প্লেনের বাকি যাত্রীদের কী অবস্থা হবে বলেন তো? আপনি নিজে একজন পাইলট হয়ে নিশ্চয়ই জানেন। আপনি আরেকজন পাইলটকে সম্মানের সাথে বিদায় দিবেন।”

মিস্টার ফয়সাল কেঁদে ওঠলেন। এতক্ষণ তিনি খুব কষ্টে কান্না দমন করে রেখেছিলেন। স্ত্রীর সামনে নিজেকে স্ট্রং প্রমান করছিলেন। কিন্তু চেপে রাখা কান্না এবার জয়ী হয়ে ঠিক প্রকাশ্যে এলো। তিনি কিছুক্ষণ পর নিজেকে ধাতস্থ করে বললেন,
“আমাদের জীবনে সাফার আগমনে যেন মরুভূমিতে সজীবতা এনেছিল। নিঃসন্তান দম্পতির কাছে সন্তান কী সেটা ভাষায় প্রকাশ করা দুষ্কর। ছোটো সাফাকে বুকের সাথে আগলে বড়ো করেছি। আজ তারই বিদায়বেলা তাও আমার আগে। একজন বাবার জন্য এর থেকে কষ্ট আর কী হতে পারে?”

সাদমান ও আরহান জবাব দিতে পারল না। সত্যি তো, পিতা-মাতার কাছে সন্তানের লা*শ সহস্র বোজার সমান। মিসেস শাহানাকে তার ছোটোবোন সামলে রেখেছেন। কিছুক্ষণ পর জানাজার নামাজ শুরু হয়। আরহান ও সাদমান জানাজার নামাজ পড়ে দা*ফনকার্য শেষ করে সেখান থেকে চলে আসে। রঞ্জু খন্দকার আজ নিরব। তিনি যাদের বাঁচাতে এতোকিছু করলেন, তাদের একজনকে আজ দাফন করলেন আর আরেকজন মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। তিনি হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজ গন্তব্যে চলে গেলেন।

দেখতে দেখতে আজ আরহান ও রুহানীর গায়ে হলুদের দিন। সকালে গায়ে হলুদ ও রাতে মেহেন্দির ফাংশন হবে। গায়ে হলুদের পর্ব দুই পরিবারে নিজ নিজ ভাবে হয়েছে কিন্তু মেহেন্দির অনুষ্ঠান একসাথে হচ্ছে। অনুষ্ঠানটা খোলা জায়গায় করা হয়েছে যাতে প্রকৃতির অনুভব করা যায়। আরহান গেইটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কখন রুহানীরা আসবে। সে নিজে রুহানীকে রিসিভ করতে গেইটে দাঁড়িয়ে আছে। আহান এদিকে ফটোগ্রাফির কাজ করছে। এই সুযোগে তন্নির কিছু ছবিও তুলে নিচ্ছে। সাদমান রাইদার সাথে সাথে ঘুরছে। কবির সেরিনার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টায় আছে। জাওয়াদ ও অভীকই আরহানের সাথে গেইটে দাঁড়ানো। অভীক বলে,

“কাজলকে কল করেছিলাম, বলল চলে আসছে। দশ মিনিট হলো এখনও এলো না। এই মেয়ে মানুষের সাজগোজ শেষ হয় না। কখন যে আসবে! কখন যে দেখব!”
জাওয়াদ ওকে খোঁ*চা মে*রে বলে,
“বিয়েটা কি তোর নাকি আরহানের? তুই এত উতলা হচ্ছিস কেন? নাকি তোর উতলা অন্যকারও জন্যে?”
অভীক ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
“চুপ থাক। আমি তো আরহানের জন্যই বলছি। এতক্ষণ লাগে নাকি আসতে! কত সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছি।”
আরহান হেসে বলে,

“যদি বল অপেক্ষা, যুগ যুগ আমি তাতে অপেক্ষমান। শুধু ফেরার প্রতিশ্রুতি চাই।”
“দেখলি, দেখলি? বন্ধু আমার অপেক্ষা করতে করতে কবি হয়ে গেছে।”
তখনি হর্নের শব্দ শুনে জাওয়াদ, অভীকের মাথায় একটা চা*টা মে*রে বলে,
“নে তোর অপেক্ষার প্রহর এবার শেষ হলো। আর দুঃখ করতে হবে না।”

আরহান গাড়ির কাছে এগিয়ে গিয়ে, রুহানী যেই গাড়িতে আছে সেটার পেছনের দরজা খুলে রুহানীর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। রুহানী এক পলক আরহানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সেই হাতে নিজের হাত দেয়। দুজনের চোখে যেন অনেক কথা জমা। এখন শুধু প্রতীক্ষা নতুন দিনের। আরহান রুহানীকে নিয়ে স্টেজের দিকে যায়। অভীক কাজলের সাথে কথা বলতে বলতে হাঁটতে থাকে। বেচারা জাওয়াদ, বন্ধুদের প্রেম দেখে পা চালিয়ে নিজেই আগে চলে যায়।
স্টেজে বসে আছে বর ও কনে। কনের হাতে আর্টিস্ট মেহেদী পড়াচ্ছে। বরবেশী আরহান সেটা দেখছে। রুহানী বিষয়টা লক্ষ্য করে আরহানের দিকে মুখ এগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“মেহেদীতে কি নিজের নাম খুঁজছেন?”
“উহুম। প্রেয়সীর হাতে মেহেদী পড়তে দেখাটাও এক ধরনের ভালোবাসা কাজ করে। তাই করছি।”
আরহানের জবাবে রুহানী মুচকি হাসলো। অতঃপর বলল,
“আমি হাতে আপনার নাম লিখাব না। মেহেদীর রং দিন বাদে বিবর্ণ হবে। তাহলে কি আপনিও আমার জীবনে বিবর্ণ হয়ে যাবেন? আপনি তো আমার বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু হয়ে এসেছেন।”
“উুহুম শুধু আমি না। তুমিও আমার জীবনে ভালোবাসার রংধনু হয়ে এসেছ।”
দুজন দুজনের চোখে অপলক চেয়ে থেকে হেসে ফেলে।

নানান ঝল্পনা-কল্পনার পর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কাজি সাহেব রুহানীকে কবুল বলতে বলছেন। রুহানী চোখ বন্ধ করে সেদিনটা কল্পনা করল। যেদিন একই রকম পরিবেশে সে মৌন ছিল নিজের অপরাগতায়। সেদিনও কাজি তাকে কবুল বলতে বলছিল। অক্ষিপটে ভেসে উঠল সেই রাত। একাকী কন্যা নিজের জীবনে আরও একটা দাগ গ্রহণ করে নির্জন, অন্ধকার চা বাগান দিয়ে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে হঠাৎ এক যুবকের সাক্ষাৎ। প্রথম সাক্ষাতে বিরক্তি বয় কিছু হয়নি। তারপর সময়ের ধারাতে বন্ধুত্ব, প্রণয়, নিয়তি ও অবশেষে পরিণয়।

ভাবতে ভাবতে ওষ্ঠকোণে মিষ্টি হাসির রেখা দেখা দেয়।
রুহানীর এই কল্পনা-ঝল্পনারর মাঝেই আশেপাশে মানুষজনে গুঞ্জন তৈরী হচ্ছে। রুহানীর থেকে একটা লাল নেটের পর্দার বিপরীতে বসে আছে আরহান। রুহানীর ঠোঁটে হাসির রেখা দেখে আরহানও হাসল। আরহান বুঝতে পারল রুহানী কোন ভাবনায় মগ্ন। দুইপাশে পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অভিক ও কাজল। অভীক অধৈর্য হয়ে ওঠল।
“কী ভাই রুহানী? কাজি যা বলতে বলে বলো না। তিন অক্ষরের শব্দটা তিনবার বলতে মাত্র নয়টা অক্ষর ব্যয় হয়। তাও কি বলতে কষ্ট হয়?”

অভীকের কথা শুনে রুহানী, আরহান সহ বাকিরা হেসে ওঠল। অতঃপর রুহানী তিনবার কবুল বলে চোখ বন্ধ করে জলধারাকে বইতে দিল। সবাই খুশিতে আলহামদুলিল্লাহ বলছে। এবার আরহানের পালা। কাজী আরহানকে কবুল বলতে বলার সেকেন্ডের মধ্যেই আরহান কবুল বলে দিয়েছে। তাতেও আরেকদফা হাসির রোল। কাজল বলে,
“আমাদের দুলাভাইয়ের যেন ট্রেন ছুটে যাচ্ছে! যেই স্পিডে সে কবুল বলে।”
“ট্রেন না, প্লেন হবে। আফটারঅল, আমার বন্ধু পাইলট বলে কথা!”
অভীকের দুষ্টুমিষ্টি জবাবে কাজল মুখ বাঁকালো। তারপর হুজুর দোয়া পড়লেন। সবাই হাত তুলে দোয়া করলো। পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হলো আরহান ও রুহানী।

পরিশিষ্টঃ বিশ বছর পর। গোধূলির লগ্নে খোলা বেলকনিতে একাকী দাঁড়িয়ে রক্তিম অন্তরীক্ষে অপলক চেয়ে আছে রুহানী। কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি থেমেছে। গাছের পাতায় পাতায় এখনো বৃষ্টির নিদর্শন প্রতিয়মান। আচমকা দুই জোড়া হাত এসে রুহানীকে জড়িয়ে ধরল। ছেলে কণ্ঠে শোনা গেল,
“মাম্মাম, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আজানও পড়ে গেছে। ঘরে চলো।”
মেয়ে কণ্ঠে শোনা গেল,

“চলো মাম্মাম। নানুমনি কিন্তু ব*কা দিবে। ছেলে-মেয়ের সামনে মাম্মাম ব*কা খাবে আমি মানতে পারছি না।”
ওদের কথার মাঝেই জাহানারা শেখ এসে পরেন। তিনি বলেন,
“আমার মেয়েকে আমি ব*কব। তোদের খারাপ লাগার কী আছে? এখন চল ঘরে চল। নামাজ পড় গিয়ে। তোর মাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি।”

ছেলে ও মেয়ে দুটো মুখ ঢেকে হাসতে হাসতে চলে গেল। জাহানারা শেখ ওদের যেতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
“আয় নামাজ পড়। তারপর কথা হবে।”
রুহানী চুপচাপ ঘরে এসে অজু করে আসল। দুইজনে একসাথে নামাজ পড়ল। নামাজ শেষে দুজনে একসাথে বসল। জাহানারা শেখ শুধালেন,
“দশ বছর হলো রুহানী। তোকে এভাবে দেখতে আমার কষ্ট লাগে।”
রুহানী জবাবে বলল,

“কালকের দিনটা আমার জীবনে না আসলে পারত মামনি। আজকের দিনে ওকে আমি বিদায় দিয়েছিলাম। বুঝতেই পারিনি যে পরবর্তী সূর্যদোয় আমার জীবনে বিবর্ণতার রং নিয়ে আসবে। ওকে কেন যেতে হলো মামনি?”
“আরহান বলেছিল মনে আছে, মানুষ তার নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল নিয়ে জন্মায়। সবার মৃত্যুর তারিখ, ক্ষণ ও স্থান পূর্ব নির্ধারিত। ওর সময়টাও ততোটুকুই ছিল।”

রুহানী তার চাচির দিকে তাকায়। তারপর স্রিয়মাণ কন্ঠে বলে,
“এই বৈশাখ মাসেই সে আমার জীবনে এসে বৈশাখেই চলে গেল। আমার বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু হয়ে এসে কিছু সময় বাদে আবারও বিবর্ণ করে চলে গেল।”
তখন আবারও সেই ছেলে কণ্ঠ ভেসে আসলো।
“আমি আর সাফা আছি না? আমরা থাকতে আমাদের মাকে কষ্টে থাকতে দেখতে পারি বলো?”
জাহানারা শেখ বললেন,

“দেখ রুহানী, তোর ছেলে ও মেয়েও তোর চোখে কষ্ট দেখতে চায় না। তাও তুই এভাবে থাকিস। বাচ্চা দুটোর দিকে তাকা।”
সাফা বলে,
“আম্মু, রায়হান ভাইয়া ও আমি মিলে ভাবছি আজ তোমার সাথে রাতে থাকব। বাবাকে একটুও মিস করতে দিব না। আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ, আমি তো বিন্দাস আছি। ভাইয়ারও ফার্স্ট সেমিস্টার ফাইনাল শেষ। তাই তোমার কোনো অজুহাত শুনবই না।”

এতক্ষণে মুখ খোলে রুহানী।
“আচ্ছা থেকো। এখন দুজনে যাও। রায়হান, সাফাকে ইন্টারের পড়া একটু একটু করে পড়াও। অলস সময় বসে থেকো না। আগে দেখো, তোমাদের দাদুভাই ও নানুভাই কোথায়? ফিরেছে? বাহিরে আবারও হুট করে ঝড়ো হাওয়া বইছে।”
সাফা দুরন্তপনা দেখিয়ে বলল,
“দেখছি আমি। তুমি কিন্তু আর মন খারাপ করে থাকবে না।”

সাফা চলে যাওয়ার পর রায়হান এসে তার মায়ের পাশে বসে। তারপর মায়ের হাত ধরে বলে,
“তুমি না বলো, আমি দেখতে একদম বাবার মতো। তাহলে আমি আমার মায়ের বিবর্ণ বৈশাখে রংধনুর জুনিয়র ভার্সন নই?”

ছেলের কথা শুনে রুহানী ছেলেকে মাতৃস্নেহে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। তার মনের পর্দায় ভেসে ওঠল সেই দিনটা।
★দশ বছর আগে আজকের তারিখে রাতে আরহান ফ্লাইটের জন্য বেরিয়েছিল। ঝড়ো হাওয়ার জন্য ফ্লাইট এক ঘণ্টা দেরি করেছিল। তারপর রাত পেরোতেই ভোরে খবর আসে সেই ফ্লাইটের প্লেন ক্রেস করেছে। একটা খবরই রুহানীর পুরো জীবন বদলে দিয়েছিল। নতুন সূর্যদোয় তার জীবনের বৈশাখকে আবারও বিবর্ণ করে দিয়েছিল।

তখন রায়হান নয় বছরের আর সাফা ছয় বছরের। বাচ্চা দুটো ঠিক ভাবে বুঝ হওয়ার আগেই পিতার ছায়া হারিয়েছিল। দেখতে দেখতে দশটা বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু রুহানীর মন থেকে তার জীবনের মতো আরহান বিবর্ণ হয়নি। সে তো সবসময় রংধনুর মতো।★

নিজের রুম থেকে সবাইকে বিদায় করে ঘরটা আঁধারাচ্ছন্ন করে ফের ব্যালকনিতে গেল। ঝোড়ো হাওয়ার চুল ও পড়নের জামার ওড়না সমান তালে উড়ছে। রুহানী আকাশের পানে চেয়ে বলে,
“আমার জীবনে বিবর্ণ বৈশাখে মনের আকাশে সবসময় আপনি রংধনু আরহান। আজীবন ভালোবাসি।”

বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু সিজন ২পর্ব ১৫

আসসালামু আলাইকুম। অবশেষে গল্পটা শেষ হলো। এন্ডিংটা পড়ে প্লিজ আমাকে ব*কবেন না। দুঃখীত আমি ভালোবাসার পাঠকমহল।

সমাপ্ত