শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৮

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৮
তানিয়া মাহি

” এই কয়েকটা মাস তোকে আমি কতটা মিস করেছি তুই ভাবতেও পারবি না শুভ্রা। মনে হয়েছে ছুটে এখানে চলে আসি, তোকে জড়িয়ে ধরি৷”
রাতে শুভ্রতা আর নিহান ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। বলতে গেল মাঝরাত, চারপাশ স্তব্ধ, নিরবতা বিরাজ করছে। মাঝেমাঝে ঝোঁপঝাঁড় থেকে পোকা ডেকে উঠছে শুধু। নিহান শুভ্রতাকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে শুভ্রতার কাধে থুতনি রেখে কথা বলছে।

” মিস করেছেন, চলে আসতে ইচ্ছে করেছে তাহলে আসেন নি কেন শুনি? আপনার তো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই।”
” অনেক কাজ ছিল। কিছু কাজ এসেছে হাতে। তোকে আমার কাছে নিয়ে যাওয়ার দুই একমাস পর আবার আসতে হবে। গ্রামের শেষ মাথায় একটা স্কুল হবে। প্রজেক্টটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর আমি ওখানে ভার্সিটিতে তোর জন্য কথা বলে রেখেছি৷ সব একদম ঠিকঠাক, শুধু রেজাল্ট দিক তারপরই কার্যক্রম শুরু হয়ে যাবে। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” আমার সবাইকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে।”
নিহান শুভ্রতাকে ছেড়ে এবার দুই বাহু শক্ত করে ধরে জিজ্ঞেস করে, ” আমার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে না? আমার থেকে দূরে থাকতে কষ্ট হয় না তোর? ”

” সবাইকে নিয়ে একসাথে থাকার ভাগ্য কেন যে হলো না!”
” আমাকে মনে পড়ে নি এই কয়েকটা মাস? মনে হয়নি আমাকে ছাড়া তোর দিন কাটানো মুশকিল?”
” হয়েছে, খুব করে মনে হয়েছে। প্রতিটা মিনিট আমাকে আপনার অনুপস্থিতি টের পাইয়েছে। ”
” আমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে নি? একটাবার ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে করে নি?”

নিহানের কথায় এবার মিইয়ে যায় শুভ্রতা। মাথা নিচু করে নেয়। লজ্জা লাগছে তার। কোন নারীর তার ব্যক্তিগত পুরুষকে কাছে পেতে ইচ্ছে করেছে কি না, স্পর্শ করতে ইচ্ছে করেছে কি না এসব কথা সেই পুরুষের সামনে যে নারীর লাজলজ্জার বালাই নেই সেই নারীই শুধু নির্দ্বিধায় বলতে পারে। শুভ্রতার মতো মেয়ে যে কি না কথাই বলতে লজ্জা পায় নিহানের সাথে আর সে কীনা এসবের কথা বলবে! লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায় শুভ্রতার। নিহান আবার বলে ওঠে, ” চুপ হয়ে গেলে কেন বলো?”

শুভ্রতা কথাটা এড়িয়ে যেতে বলে, ” আর কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন, রাত দুটো বাজতে চলল ঘুমাবেন না?”
” আমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করেনি? মনে হয়নি এতগুলো মাস পর আসলেই কাছে পেয়ে আবেগী হয়ে গাল,চোখ,নাক,ঠোঁট চুমুতে ভরিয়ে দিবি?”
হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ার মতো নিহান বলল, ” এই তুই আমাকে চুমু খাস নি কেন?”
শুভ্রতা ভ্রু কুচকে নিহানের দিকে তাকিয়ে আছে। নিহানকে আগাগোড়া একবার পর্যবেক্ষণ করে নিল। এই লোকটা উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করল কেন? তাকে লুকিয়ে নে* শা করেনি তো?

” আপনি ঠিক আছেন?”
” কেন? ঠিক নেই মনে হচ্ছে?”
শুভ্রতা মুখে কিছু না বলে হ্যাঁসূচক মাথা ঝাঁকালো।
নিহান এতক্ষণে শুভ্রতার হাত ছেড়ে বেলকনির গ্রিলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে শুভ্রতার সাথে কথা বলছিল। শুভ্রতার নিরবতা কাটাতে বাম হাত দিয়ে শুভ্রতাকে টেনে সামনে দাঁড় করিয়ে আবার বাম হাত দিয়ে গ্রিল ধরল। নিহান শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে আছে আর শুভ্রতা অন্যদিকে। নিহানের আচরণ এবার তাকে লজ্জা পাইয়ে দিচ্ছে।

” বউ!”
নিহানের ডাকে তার দিকে তাকায়। নিহান ঠোঁট প্রসস্থ করে, নিহানের হাসিমাখা মুখ শুভ্রতা একপলকে দেখতে থাকে।
” এই বউ।”
” এসব কি ডাক?”
” বউ একটা চুমু খাই?”
” কি অসভ্য আপনি!”

শুভ্রতার কথার প্রত্তুত্তোরে কিছু না বলে শুভ্রতার গালে ঠোঁট ছুইয়ে দেয় নিহান। শুভ্রতা নিঃশ্বাস আটকে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। নিহান গাল থেকে ঠোঁট উঠাতেই ভারী একটা নিঃশ্বাসের শুব্দ হয়। শুভ্রতার এহেন কর্মকান্ডে তাকে আরেকবার ভড়কে দিতে শুভ্রতার কোমর দুইহাতে চেপে ধরে। শুভ্রতা টাল সামলাতে না পেরে নিহানের বুকে হাত রাখে। সামনের ছোট চুলগুলো চোখে মুখে আটকে যায়। শুভ্রতা মুখে হাত দেওয়ার আগেই নিহান হাত দিয়ে চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দেয়। শুভ্রতা এবার নিহানের দিকে তাকিয়ে আছে। নিহান বুঝতে পারছে না শুভ্রতা এখন মনে মনে কি ভাবছে? তাকে কি গা*লম*ন্দ করছে? করতেও পারে আবার না করতেও পারে।

নিহান এবার শুভ্রতার গালের পাশে হাত রেখে শুভ্রতার চোখে চোখ রেখে বলে, ” আরেকটু অস*ভ্যতামি করতে ইচ্ছে করছে। তোমার ঠোঁট দুটো আমাকে আহ্বান করছে শুভ্রা। আজকে যদি আরেকটু অশ্লী*ল প্রেমিকের মতো আচরণ করি তাহলে কি খুব অন্যা*য় হবে? এই অ*ন্যায়ের শা*স্তিস্বরূপ তোমাকেই চাইব আমি। ”

শুভ্রতার ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর প্রশ্বাস ফেলছে। মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছে না তার, এই মুহুর্তে হয়তো কোন নারীর কথা বের হওয়াটাই অসম্ভব কিছু। অতঃপর নিহানের সম্মোহনী ডাকে সাড়া দিয়েই ফেলল শুভ্রতা। দুজন দুজনকে নতুন করে পাওয়ায় মেতে উঠলো। প্রকৃতিও সাক্ষী হলো নতুন এক যুগলের পূর্ণতায়।

তিনটা দিন কেটে গিয়েছে। আবিরা আর অভীক এসে আবার বাড়ি ফিরেও গিয়েছে। নেহা আর সিয়ামের ব্যাপারটা কচ্ছপের গতিতে এগোচ্ছে। অসম্ভব ছটফটানিতে দিনগুলো কাটছে ফাউজিয়ার। একটাবারের জন্য সাহিল শেখ-এর সাথে যোগাযোগ করে উঠতে পারে নি সে। সবাই সবার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ব্যস্ত। সকালেই ফাউজিয়ার সাথে দেখা করে এসেছে শুভ্রতা। ফাউজিয়ার মুখে সবটা শুনে সে কী রাগ তার! এত ভালো একটা মানুষকে পেয়েও কেউ এভাবে হারায়!

নিহান বাহিরে গাড়ি ডেকে এনে, ব্যাগপত্র হাতে হাতে গাড়িতে তুলছে। অন্যদিকে শুভ্রতা বাবার বাড়িতে একবার বাবাকে আর একবার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। শুভ্রতার সাথে সাথে বাড়ির তিনটা মানুষের মনেও কালো মেঘ নেমে এসেছে। পাশেই দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নাকাটি করছে। শাহাদাত সাহেব মেয়েকে বারবার বোঝাচ্ছেন কয়েকমাস পরপরই আসা হবে, সে যেন কষ্ট না পায় আর ফোন তো আছেই। শুভ্রতার একটাই কথা সে যখন চাইবে বাবা-মা, বোনকে ছুয়ে তো দেখতে পারবে না, মন খারাপ হলে সেই মন খারাপের গল্প তো বাবা রাতের বেলায় ছাদে বসে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করবে না। বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে শুভ্রতা। এমন করছে যেন ছেড়ে দিলেই কিছু হয়ে যাবে৷

নিহান শুভ্রতাদের বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে দেখে শুভ্রতা কেঁদেই যাচ্ছে। কিছুটা সময় সেখানে ব্যয় করে শেষ মুহুর্তে শুভ্রতাকে নিয়ে বের হয়। অতিরিক্ত সময় ব্যয় করলে ট্রেন তাদের ছেড়ে চলে যাবে।
রাবেয়া বেগমও টলমল চোখে শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরে আছেন। গাড়িতে উঠার পূর্বমুহুর্তে শুভ্রতাকে ছাড়লেন। সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠবে এমন সময় শাকিরা দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরে।
” সাবধানে থাকিস ওখানে শুভ্রতা, আমাকে ভুলে যাস না প্লিজ। মাঝেমধ্যে কল করবি কিন্তু। ”

” আচ্ছা করব। তুইও সাবধানে থাকিস। ভাইয়া আসে নি?”
” ওই তো আসছে, আমি তো গাড়ি থেকে নেমেই দৌঁড়ে চলে এসেছি।”
রায়হানও এগিয়ে আসে। অতঃপর শেষ মুহুর্তে সবার কাছে থেকে শেষবারের মতো বিদায় নিয়ে রওয়ানা দেয় শুভ্রতা আর নিহান। গাড়ি যতদূর দেখা যায় বাড়ির সবার চোখ ততদূর দেখতে থাকে। শুভ্রতাও কারো মায়া ত্যাগ করতে না পেরে বার-বার ফিরে তাকাচ্ছিল৷

দুজনের জন্য ছোট একটা কেবিনরুম নিয়েছে নিহান। শুভ্রতা সেখানেই জানালার পাশে বসে আছে। নিহান ফোনে কারও সাথে কথা বলছে আর মাঝেমাঝে হোল্ড করে শুভ্রতাকে বলছে, ” মাথা বা হাত বাহিরে যেন বের করিস না শুভ্রা। অঘটন ঘটে যেতে পারে, চুপচাপ বসে থাক একটু আমি আসছি এখনই।”

শুভ্রতা নিহানের কথাটা শুনে আবার বাহিরে মনোযোগ দিচ্ছে শুভ্রতা। এবার প্রথম না এই একই কথা নিহান তাকে পাঁচবার বলেছে। এক কথা নিশ্চয়ই কারও পাঁচবার শুনতে ভালো লাগবে না। শুভ্রতারও ভালো লাগে নি৷ রাগ হয়েছে, খুব রাগ হয়েছে। সে তো বাচ্চা না, তাকে এত বুঝানোরও কিছু নেই। কিছুক্ষণ পর নিহান এসে তার পাশে বসে। শুভ্রতা দেখেও না দেখার মতো বসেই থাকে। নিহান শুভ্রতার কাধে হাত দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসে। নিজের বুকের একপাশে জড়িয়ে নেয়৷ মাথা তুলতে চাইলেই আবার দাবিয়ে রাখে। শুভ্রতা বিরক্তিস্বরে বলে ওঠে, ” ছাড়ুন।”

নিহান বুঝতে পারে এতক্ষণ ওখানে বসে কথা বলায় শুভ্রতা রেগে গিয়েছে। নিহান বলে ওঠে,” আমি দূরে থাকায় আমার প্রিয়তমার মনে কি মেঘ করেছে? কালো মেঘ? বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা আছে নাকি গর্জনেই মেঘ কেটে সাফ হয়ে যাবে?”
শুভ্রতা অভিমানী গলায় বলে, ” কিচ্ছু হবে না সরুন। যান গিয়ে আরও কয়েকজনের সাথে কথা বলুন। আমি কে, আমাকে কেন সময় দিতে হবে?”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৭

” চুমু দিলে কি বউয়ের রাগ কমে যাবে?”
বড় বড় চোখে তাকায় শুভ্রতা। স্বামী হিসেবে কি এবার নিহানের ভয়ে চুপসে যাওয়া উচিৎ? হয়তো। কিন্তু নিহান উল্টো কাজ করে বসলো। শুভ্রতার কপালে চুমু দিয়ে দিল। শুভ্রতা লজ্জায় নিহানের বুকেই মুখ লুকায়।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৯