শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৯

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৯
তানিয়া মাহি

” পড়তে এসেছো, পড়ায় মন দাও। লুকিয়ে চুরিয়ে আমাকে এতবার দেখার কিছু নেই অরু।”
সাহিলের কথায় চুপসে যায় অরু। ওরনার আঁচল আঙুলে পেচাতে পেচাতে বইয়ের দিকে তাকায়। সাহিলের গলা শুনে সাহিলের মা দরজায় এসে দাঁড়ায়।

” কিছু হয়েছে?”
” না মা, তুমি রুমে গিয়ে বসো। পড়ানোর মাঝে আসবে না তো।”
” মেয়েটাকে বকছিস কেন? ও তোর কত ছোট!”
” কেন বকেছি সেটা ও নিজে বুঝেছে, তোমার বুঝতে হবে না মা।”
” তুই যে এই কয়েক বছরে ঠিক কতটা বদমেজাজি হয়েছিস খেয়াল আছে? একটু ঠিক করে নে নিজেকে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” বড়মা, তোমার ছেলেকে বলো প্রাক্তনের ওপরের রাগ যেন আমাকে না দেখায়। ওই মেয়ের কথা মনে করে তোমার ছেলে সবসময় আমাকে বকে। একটু না তাকানোও যাবে না, মগের মুল্লুক নাকি? আমার চোখ দিয়ে যাকে ইচ্ছে আমি তাকে দেখব।”

কথাগুলো বলেই অরু টেবিলে রাখা বই আর খাতাগুলো নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালে সাহিল বলে ওঠে, ” বেশি পেকে গেছিস তুই, হাটুর বয়সী মেয়ে এত পাকা পাকা কথা বলবি আর আমি মেনে নেব ভেবেছিস? ঠাটিয়ে দাঁতকপাটি খুলে দেব একদম। চুপচাপ যেটা লিখতে দিয়েছি সেটা লিখবি।”
সাহিলের কথায় আবার চুপচাপ বসে যায় অরু। চুপচাপ লিখতে শুরু করে আবার। সাহিলের মা ও এবার সেখান থেকে চলে যান। সাহিল বসে বসে নিজের কাজ করতে থাকে ল্যাপটপে।

এক,দুই করে গোটা পাঁচটা বছর কেটে গিয়েছে। বয়সও সাতাশ থেকে বত্রিশে গড়িয়েছে। মেজাজটাও সময় এবং বয়সের সাথে খিটখিটে হয়ে গিয়েছে যার দরুন অরুকে প্রতিদিনই কড়া কথা শুনিয়ে দেয় সাহিল৷ সাহিল যখন মাকে নিয়ে আবার গ্রামে ফিরে আসে তখন অরু ক্লাস নাইনে পড়ে। প্রথমদিকে সাহিলের সামনাসামনি না হলেও দুবছর যাবৎ বেশিরভাগ সময়ই সাহিলের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে। অপ্রয়োজনীয় কথা তেমন মুখ থেকে বেরোয় না কিন্তু প্রয়োজনে কথা ঝুড়ি থেকে বের করতেই থাকে। সাহিল বুঝতে পারে মেয়েটা তাকে পছন্দ করে।

স্নিগ্ধা রেল স্টেশনে বসে আছে। বারবার হাতঘড়িটায় চোখ রাখছে আর রেললাইনের দিকে তাকাচ্ছে। তাকে দেখে যে কেউ বুঝবে, সে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। প্লাটফর্মে বসে বসে কারো জন্য অপেক্ষারত রমনীকে দেখে সাতাশ /আটাশ বছরের একটা ছেলে স্নিগ্ধার পাশে এসে বসে। এদিক ওদিক তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ” কারো জন্য অপেক্ষা করছেন বুঝি? দূর থেকে দেখছিলাম অনেকক্ষণ যাবৎ বসে আছেন তাই ভাবলাম আমার সঙ্গ হয়তো আপনার খারাপ লাগবে না।”

স্নিগ্ধা পায়ের থেকে জুতো খুলে ছেলেটার সামনে উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বলে, ” এটা আপনার পিঠে পড়লেও মন্দ লাগবে না বোধ হয়, তাই না?”
ছেলেটা আস্তে করে পাশে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আমতা আমতা করে বলতে শুরু করে, আ আসলে আমি ভাবলাম…..”
” তোর ভাবাভাবির টুট টুট টুট শা*লা গেলি এখান থেকে?”

স্নিগ্ধা হুঙ্কার দিতেই ছেলেটা দৌঁড় দেয়। ঘণ্টাখানেক ধরে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে ছিল স্নিগ্ধা। ট্রেনে তার নতুন বস আসার কথা রংপুর থেকে। দুই বছর আগে সে বাবা আর নিহানের সাহায্যে তার স্বপ্নের প্রফেশনে যেতে পেরেছে। দুবছর ধরে সে একটা টিমের সাথে ট্রেইনিংয়ে থেকে দেড় বছর হলো চাকরিতে জয়েন করেছে। সেই টিমের বড় অফিসার বদলি হয়েছে আজ নতুন একজনের আসার কথা। তাকেই রিসিভ করতে এসে ফেঁসে গেছে সে।

স্নিগ্ধা বসতে গিয়েই খেয়াল করে পাশে রাখা ছোট্ট পার্সব্যাগটা নেই। সামনে, এদিক ওদিক তাকাতেই খেয়াল হয় ছেলেটা এখানে বসেছিল তাহলে চুরি করার জন্যই! স্নিগ্ধা আবারও সামনের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলে ওঠে, ” ওই দাঁড়া বলছি…” জোরে ছুট লাগায় স্নিগ্ধাও।

শুভ্রতা বাড়ি ফিরছে। এই পাঁচটা বছরে হাতেগোনা কয়েকটা বার বাড়ি যাওয়া হয়েছে তার। পড়াশোর জন্য বেশিদিন বাড়ির মানুষের সাথে থাকতে পারেনি সে। দুদিন আগেই বিসিএস পরিক্ষা শেষ করেছে। আপাতত কোনকিছুর জন্য পড়াশোনা নেই তাই নিহানকে জানানোর পর নিহান না আসতে পারলেও গাড়ি আর সাথে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিয়েছে।

গাড়ি চলছে আপন গতিতে। শুভ্রতা বসে নতুন পুরাতন অনেক কথা ভাবছে। একটা কারণ নিয়ে সে বেশ চিন্তিত। সেই কথে ভেবে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শুভ্রতা। কিছুদিন হলো বেশিরভাগ সময় অন্যমনস্ক থাকে সে। কেন যেন কোন আনন্দ তাকে ছুঁতে পারছে না। স্বামী বিষয়ক কোন সমস্যা নেই তার। নিহান হয়তো কখনোই স্বামী হিসেবে খারাপ হবে না। দিনকে দিন তার ভালোবাসা বেড়েই চলেছে। সে ভালো স্বামী হিসেবে নিজেকে ধরে রেখেছে। উন্নতিও তাকে দূরে রাখে নি। এই পাঁচ বছরের একবছর সময় হলো সে জেনারেল হয়েছে। সফলতা তাকে চারদিক দিয়ে ছুয়ে গেলেও কোন একদিকে সে শূন্য আর সেটা শুভ্রতার কারণেই।

” ম্যাম, আর কতদূর? কিছু বলছেন না যে?”
শুভ্রতার ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটে ড্রাইভারের ডাকে। সে সোজা হয়ে বসে। ড্রাইভার কী বলল সেটা সে স্পষ্ট বোঝে নি। শুধু এটুকু বুঝেছে যে তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলা হয়েছে।
” কিছু বললে মামা?”
” কইলাম আর কতদূর যাইতে হইব? ম্যালাদূরই তো চইলা আইলাম আমরা।”

” না মামা, আমরা মাত্র কিছুক্ষণ হলো পাবনা জেলাতে ঢুকেছি। এখনো প্রায় আধাঘন্টা লাগবে। আমাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে আপনি যাবেন গাড়িটা ধুতে। নোংরা হয়ে গেছে দেখলাম আসার সময়। আমাদের বাড়ির পাশেই গাড়ি ধোয়ার ব্যবস্থা আছে আমি টাকা দিয়ে দেব আপনার অসুবিধা হবে না। বাড়িও চিনিয়ে দিয়ে রাখব আপনাকে।”
” আচ্ছা মেমসাহেব। ”
” তোমাকে কতবার বলেছি মামা যে ম্যাম, মেমসাহেব বলে আমাকে ডাকবে না? আমাকে শুভ্রতা বলেই ডেকো।”
” না মানে…”

” নিহানের ভয় পাচ্ছো? ওর বিষয়টা আমি দেখে নেব। ও বুঝতেই চায় না অতিরিক্ত সম্মানে সবসময় ভালোবাসাটা থাকে না। তুমি মনোযোগ দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করো।”
বাড়িতে না জানিয়েই রওয়ানা দিয়েছে সে। না জানিয়ে হয়তো খুব একটা ভুল সে করে নি। হঠাৎ প্রিয় মানুষকে দেখলে মানুষ বেশি আবেগী হয়ে যায়। সেই আনন্দটা অন্য সব আনন্দ থেকে ভিন্ন। সিটে ফেলে রাখা ফোনটা হাতে নেয় সে। ফোনের কললিস্টে একটা নাম জ্বলজ্বল করছে, ” ফাউজু”। নম্বরে কল লাগায় সে। কয়েকবার রিং হয়ে কেটে যায়। সাথে সাথে আবার কলব্যাক আসে। শুভ্রতা কলটা রিসিভ করে কানে নেয়।

” শুভ্রতা?”
” হ্যাঁ রে কেমন আছিস?”
” এইতো ভালোই আছি, খুব একটা খারাপ না। তোর কি অবস্থা বল তো?”
” এই তো বাড়ি ফিরছি, প্রায় পেয়ে গেছি।”
” সত্যি?কোন রাস্তা ধরে আসছিস বল তো?”
” ভার্সিটির এই রাস্তায়।”
” পার করে গেছিস?”

” না। মিনিট দুই লাগবে।”
” সামনে এসে নামবি তুই পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও। ”
” তুই কি কলেজে?”
” হ্যাঁ আমি ক্লাস থেকে বের হচ্ছি। এখনই শেষ করে দিচ্ছি ক্লাস। ”
” আচ্ছা ঠিক আছে আসছি।”

কলটা কাটে ফাউজিয়া। তাড়াতাড়ি করে ক্লাস শেষ করে গেইটের উদ্দেশ্যে বের হয়। কয়েকমাস হলো সে কলেজের টিচার হয়ে এসেছে। কড়া টিচার হয়েও কেমন আজ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে আসতে হলো তার!
শুভ্রতা গাড়ি থামিয়ে রেখে পাশেই দাঁড়িয়ে ফাউজিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। কিচ্ছুক্ষণ পরই ফাউজিয়াকে দেখতে পায় সে। যদিও বোরখা পরা তবুও বান্ধবী চলনে চেনা খুব একটা অসম্ভবের ব্যাপার না। এত পুরোনো বান্ধবীকে আবার দেখে দুজনের মুখেই হাসি ফুটে যায়।

স্নিগ্ধা নিজের পার্সব্যাগটা উদ্ধার করে উঠতে পারে নি। তবুও সে এটা ভেবে সন্তুষ্ট যে সেখানে শুধুমাত্র টাকা ছাড়া আর কিছু ছিল না। ডিটেকটিভ টিমের সদস্য নিজের পার্সব্যাগ উদ্ধার করতে পারেনি এটা বড্ড লজ্জার বিষয়। ছোট একটা জিনিসের জন্য তো আর রিভালবার ব্যবহার করা যায় না!

স্নিগ্ধা ঠিক আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। পাশে কয়েকজন কথা বলাবলি করছে সেখান থেকেই বুঝতে পারল ট্রেন চলে গেছে। মাথায় যেন আকাশ ভে*ঙে পড়ে স্নিগ্ধার। আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে থাকে। ফোনের গ্যালারি থেকে ছবি বের করে ভালো করে দেখে নেয়। প্রথম দেখায় মানুষকে ছবির সাথে খুব একটা মেলানো যায় না। স্নিগ্ধা ছবিটা বের করেই সামনের দিকে এগুতে থাকে। শেষপ্রান্তে গাছের নিচে কালো একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছে একজন। স্নিগ্ধা আরেকটু কাছাকাছি গিয়ে ছবির সাথে মেলাতে থাকে। হ্যাঁ এটাই, ইনিই এনএসআই অফিসার মাহতিম তন্ময়। স্নিগ্ধা পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে সালাম দিতেই লোকটা মুখ থেকে ধোঁয়া ছেড়ে স্নিগ্ধার দিকে তাকায়।

” জি?”
” আপনি মাহতিম তন্ময়? ”
” হুম। ”
” স্যার আমি স্নিগ্ধা শাহাদাত। আপনাকে রিসিভ করার জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছে।”
” ইউ আ’র ফাইভ মিনিটস লেইট। ”
” স্যার আমি দেরি করি নি। আমি প্রায় দেড় ঘণ্টা যাবৎ অপেক্ষা করছি। আপনার ট্রেন অনেক দেরি করে এসেছে। আমি সামনেই ওখানে বসেছিলাম…..”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৮

” চলুন। গাড়ি এনেছেন নাকি অন্য কোন গাড়িতে যেতে হবে?”
” স্যার গাড়ি এসেছে। আপনি চলুন।”
” গাড়িতেই আপনি পুরো কে*স আমাকে এক্সপ্লেইন করবেন মিস.. ”
” স্নিগ্ধা।”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫০