শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫০

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫০
তানিয়া মাহি

” ছয় বছর জে*লে ছিলি, ছাড়া পাচ্ছিস তবু এখানেও ত্যাড়ামি করলে ছুড়ে ফেলে দেব আবার যেখানে ছিলি।”
জেলারের মুখে হুমকি শুনে চুপসে যাওয়ার পরিবর্তে আরও তেজ দেখিয়ে ইমতিয়াজ বলে ওঠে, ” তোরা এক একটা জানো**য়া*রের বাচ্চা বুঝেছি? কেউ টাকার গরমে মিথ্যা কে*সে জেলবন্দি করে আবার কেউ বের না হতেই আবার ভেতরে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত থাকে। তোরা কোনদিন মানুষ হবি না।”

ইমতিয়াজের কথা শুনে পিছন থেকে এক কনস্টেবল এসে লা*ঠিপে*টা করতে শুরু করে। ইমতিয়াজ হাত দিয়ে ঠেকানোর প্রচেষ্টায় বাধা প্রদান করে যাচ্ছে। এসআই এর হুংকারে একসময় পরিবেশ স্থির হয়ে যায়। ইমতিয়াজকে ডেকে চেয়ারে বসায়। এসআই নতুন এসেছেন থানায়। একগ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন ইমতিয়াজের দিকে। ইমতিয়াজ সাথে সাথে একগ্লাস পানি শেষ করে ফেলে। হাতের কনুইটা বেশ জ্বা*লা*পো*ড়া করছে। ভালো করে খেয়াল করতেই দেখে র*ক্ত ঝড়ছে। এসআই কাউকে ডেকে সেখানে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিতে বলল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” এবার বলুন তো তখন কী যেন বলছিলেন? কে টাকার গরমে আপনাকে মিথ্যা কে*সে ফাঁসিয়েছে?”
ইমতিয়াজ নিম্নস্বরে বলে ওঠে, ” আমার মা। মা না স্যার ওটা বা*ঘিনী আমার বাপের ছোটবউ।”
এসআই ফের প্রশ্ন করেন, ” আপনার সৎমা?”
” হ্যাঁ স্যার।”
” কী করেছেন উনি?”

” আমি বললেই কেন আপনি বিশ্বাস করবেন? পাঁচ বছর আগে কেউ বিশ্বাস করেনি। পাঁচ বছর পর সেটা শুনে আপনি আর কিই-বা করবেন বলুন তো?”
” হয়তো আসল অপরা*ধী শা*স্তি পাবে।”
” সবাই সবার মতো ভালো থাকুক। আমি নিজেই নিজের খারাপ থাকা বেছে নিয়েছি স্যার। ”

হাতে ব্যান্ডেজ করা শেষ হতেই ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়ায়। এসআইকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে থানা থেকে বেরিয়ে আসে৷ পকেটে টাকা নেই, নির্দিষ্ট কোন ঠিকানা নেই। কোথায় ফিরবে সে? থানায় আগে যা যা জমা নিয়েছিল সেখানে কী কী আছে সেটাও দেখা হয়নি৷ ব্যাগ থেকে সেগুলো বের করে কিছু টাকা দেখেই মুখে হাসি ফুটে যায় তার। এটা দিয়ে অন্তত দুই থেকে তিনদিন চলে যাবে।

থানার পাশেই রেলস্টেশন, ইমতিয়াজ গিয়ে প্লাটফর্মের একপাশে এক কাপ চা আর একটা রুটি নিয়ে স্থির হয়ে বসল। চায়ের কাপে রুটি ডুবিয়ে ডুবিয়ে খেতে শুরু করল। সামনের দিকে এক পলকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে সে। সামনের দিক থেকে একটা ট্রেন আসছে, গতি ধীরে ধীরে কমছে। ট্রেনটা বোধ হয় এখানে থামবে। ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়ায়, ট্রেন থেকে কারো জিনিসপত্র নামিয়ে দিলে কিছু টাকা পাওয়া যাবে ভেবে সামনের দিকে এসে দাঁড়ায়।

শুভ্রতা বাড়িতে ঢুকেই খেয়াল করেছিল বাড়ির পরিবেশ ভিন্নরকম। সাতমাস আগে যখন বাড়ি এসেছিল নেহার বিয়ের সময় পরিবেশ যেমন ছিল আজও ঠিক তেমন। বাড়িতে কেউ আসবে কি না বুঝতে পারছে না। আসলেও কে আসবে? অভীক নাকি সিয়াম? আবিরা আর নেহা দুজনই তো এখানে। আবিরার ছেলে হয়েছে বিয়ের তিনবছর পরই। ছেলের বয়স দুই বছর। কী সুন্দর করে মামিমা মামিমা করে ডাকে! বাচ্চাটার ডাক শুনে যেমন শান্তি লাগে তেমনই বুকটা কষ্টে ভারী হয়ে আসে।

শুভ্রতা নিজেদের রুমে ঢুকে দেখে রুমটা বেশ পরিপাটি, কেউ হয়তো পরিষ্কার করে রেখেছে। রুমে ঢুকে ব্যাগটা রেখে বিছানায় বসতেই মা আয়েশা বেগমও রুমে প্রবেশ করলেন৷ মেয়ে আসার খবরে তিনি নিজ বাড়িতে স্থির থাকতে পারেন নি। মাকে দেখেই মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে শুভ্রতা। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যায়। রাবেয়া বেগম শুভ্রতার জন্য চিনি,লেবুর শরবত নিয়ে রুমে প্রবেশ করে মা-মেয়ের এমন অবস্থা দেখে বলে ওঠেন, ” কই কে তো আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরল না? মা হয়ে উঠতে পারলাম না নাকি?”

রাবেয়া বেগমের কথায় দুজন দুজনকে ছেড়ে দাঁড়ায়। শুভ্রতা গিয়ে রাবেয়া বেগমকেও জড়িয়ে ধরে বলে, ” আমার তো দুটোই মা, দুজনই আমার। এসো দুজনই বসবে এসো।”
বেশ খানিকটা সময় তিনজনের কথাবার্তা এগোয়। রাবেয়া বেগম ঘড়ি দেখেই বলে ওঠেন, “কত বেজে গেছে দেখেছিস! তোরা মা-মেয়ে গল্প কর। আমি যাই রান্না করতে হবে।”
শুভ্রতা বলে, ” আমিও আসছি বড়মা।”

” না, অনেকদিন পর এসেছ এখন একটু বিশ্রাম নাও।”
রাবেয়া বেগম প্রস্থান করেন। শুভ্রতার মা দরজা ভেজিয়ে দিয়ে আবার এসে শুভ্রতার পাশে বসে। মেয়েটাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সামনের চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ” বিয়ের পাঁচ বছর হয়ে গেল, বাচ্চা নিচ্ছিস না কেন? অনেক তো সময় গেল এবার একটা বাচ্চা নে। মেয়েদের বয়স বাড়লে বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবন কমে যায়।”
মায়ের কথায় কোন জবাব দিতে পারে না শুভ্রতা। শুভ্রতার মৌনতায় কিছু একটা আঁচ করতে পারেন তিনি। তিনি যা মনে করছেন সেটা সত্যি নয়তো? অন্যসময় বাচ্চা নেওয়ার কথা বললে শুভ্রতা বলত আরো কিছুদিন যাক, সময় তো চলে যাচ্ছে না তাহলে আজ সেটা না বলে চুপচাপ আছে কেন?

” কিছু বলছিস না যে?”
” কি বলব মা? এই প্রশ্নটা আমাকে ক্ষ*ত*বি*ক্ষ*ত করে ফেলে। মুখ দিয়ে কোন কথা আসে না আমার।”
” তার মানে আমি যা ভাবছি তাই?”

শুভ্রতা ওপর নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়। আয়েশা বেগমের মাথায় যেন বা*জ পড়ে যায়। মেয়েটার ভাগ্য কি তবে এমনই হওয়ার ছিল! যখনই একটু সুখ মিলল তখনই আরেক বিপদ এসে হাজির।
আয়েশা বেগম গলার স্বর নিম্ন করে বললেন, ” কার সমস্যা? তোর নাকি নিহানের? ডাক্তার দেখিয়েছিস? ডাক্তার কী বলেছে? ”

” ডাক্তার দেখানো হয়নি। আমার ভয় করছে মা। ডাক্তার দেখালে যদি ডাক্তার বলে সমস্যাটা আমার তাহলে আমি কী করব বলো তো? আমি আমার এই শেষ ভালোবাসার মানুষটাকে অন্যকারো সাথে কীভাবে দেখব বলো তো মা? সবাই যখন জানবে আমরা একটা সন্তানের মুখ দেখতে পারছি না আর সমস্যাটা আমার তাহলে কী হবে? বড়মা, বড়আব্বু তো নিজেরা নাতি-নাতনি দেখতে ছেলেকে আরেক জায়গায় বিয়ে দিতে চাইতেই পারে।”
” তুই কেন ভাবছিস যে সমস্যাটা তোর? নিহানেরও তো হতে পারে। সমস্যাটা যদি নিহানের হয় তাহলে কি তুই ওকে ছেড়ে দিবি? পারবি তুই বাচ্চার জন্য আরেকটা বিয়ে করতে? ”

” কখনো না। আমি ওকে ভালোবাসি খবু ভালোবাসি।”
” তোর থেকে বেশি দিন যাবৎ ছেলেটা তোকে ভালোবাসে। তোকে পেতে কত কিছু করেছে ও। আর তুই কী না ভাবছিস নিহান আবার বিয়ে করবে? তুই কাল বের হবি আমার সাথে। আমার পরিচিত একটা ভালো ডাক্তার আছে। ওই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।”
” কী দরকার বলো তো মা এসবের?”

দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হতেই শুভ্রতা গলা ছেড়ে বলে, ” দরজা খোলা আছে।”
ভেতরে প্রবেশ করে নিহান৷ নিহানকে দেখে বেশ অবাক হয়ে যায় শুভ্রতা। নিহানের তো আসার কথা ছিল না! ও এখানে কেন তাহলে এখন?
নিহানকে দেখে আয়েশা বেগম কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। কথা শেষ করে শুভ্রতাকে বলে, ” বাসায় আসিস। তোর বাবা তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”

” হ্যাঁ মা আমি আসছি।”
” ঠিক আছে আমি আসছি তবে।”
আয়েশা বেগম চলে গেলে নিহান এসে শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরে। শুভ্রতাও নিশ্চিন্তে নিহানের বুকে মাথা রেখে দাঁড়ায়। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখে দুজন দুজনকে।

অরু আজ সকাল সকাল লালশাড়ি পড়েছে। চুলটা ছেড়ে বারবার আয়নার সামনে যাচ্ছে আর আসছে। এপাশ ওপাশ ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখছে। লালশাড়িতে বেশ মানিয়েছে তাকে। নিজেই নিজের ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। আচ্ছা নিজের ওপর কি নিজের নজর লাগে? লাগতেও পারে বলা তো যায় না। ঠোঁট নাড়িয়ে কতক্ষণ কিছু বিড়বিড় করে পড়ে হাতে ফু দিয়ে সারা শরীরে হাত বুলিয়ে নেয়। একটা জোরে শ্বাস ছাড়ে। যেন নিজেকে নজর লাগা থেকে বাঁচিয়ে নিল সে।

সামনের চুলগুলো কানে গুজে লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গি করতেই অরুর মা ফিক করে হেসে ফেলে। মায়ের হাসির শব্দে লজ্জা পেয়ে যায় অরু। মায়ের সাথে যদিও সে ফ্রি, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তবুও আয়নার সামনে রংঢং করার সময় কারো সামনে পড়লে কেমন লজ্জা লাগে, যে এই লজ্জায় পড়েছে সে জানে। অরু মাথা নিচু করে পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখে তার মা দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তখনো হাসছে।

মেয়েকে আর লজ্জায় না ফেলে অরুর মা নিজেই বলে ওঠেন, ” সাহিল এসেছে। এত কষ্ট করে রান্না করেছিস খেতে দিবি না? নাকি আমারই খেতে দিতে হবে?”
” তুমিই খেতে দাও। আমার লজ্জা করছে শাড়ি পরে সামনে যেতে।”
অরুর মা হেসে ওখান থেকে প্রস্থান ঘটান। অরু বিছানায় বসে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে করে জিহ্বায় কামড় দিয়ে ভাবে, ” ইশ কী যে একটা অবস্থা! মাকে কেন তখনই আসতে হলো!”

অরুর মা সাহিলকে খেতে দিয়েছেন। সামনে তিন-চার ধরণের খাবার রাখা। সাহিল খাবার খেতে খেতে সামনে দরজার দিকে তাকাতেই কিছু একটা সরে যায়। দরজার পর্দার ওপাশে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। সাহিল নজর সরিয়ে আবার খাওয়ায় মন দেয়। অরুর মা মাংসের পিস তুলে দিতে দিতে বলে, ” রান্না কেমন হয়েছে সাহিল?”
সাহিল খেতে খেতেই জবাব দেয়, ” বেশ হয়েছে। দেখছেন না খেয়েই যাচ্ছি!”
” অরু রান্না করেছে। বলল তোমাকে দাওয়াত করে খাওয়াতে। ”

কথাটা শুনে যেন খাবার গলায় ঠেকে গেল। অরুর মা পানি এগিয়ে দিতে গিয়ে দেখলেন গ্লাস রাখা হয়েছে ঠিকই কিন্তু পানি নেই। অরুকে বলতেই অরু তাড়াহুড়ো করে গ্লাসভর্তি পানি এনে সাহিলের দিকে এগিয়ে দিল। সাহিল গ্লাসটা না নিয়েই অরুর ওপর চোখ বুলিয়ে নিল। লাল শাড়িতে অরু! কিছুক্ষণ আগেই পর্দার ওপাশে অরু দাঁড়িয়ে ছিল?
” গ্লাসটা নিন। ”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৯

অরুর কথায় চোখ নামিয়ে নিয়ে গ্লাসটা নিল সাহিল। লালশাড়িতে অরুকে দেখে বছর কয়েক আগের লাল শাড়িতে আবেদনময়ী একটা নারীর কথা মনে পড়ল তার। কী অসম্ভব সুন্দর, স্নিগ্ধ ছিল মেয়েটি। তাদের প্রেম কখনো হয়নি, হয়েছিল একপাক্ষিক ভালোবাসা আর সেই ভালোবাসার প্রত্যাখ্যান। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাহিল।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫১