শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫১

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫১
তানিয়া মাহি

ডাক্তারের চেম্বার থেকে শুভ্রতাকে কাঁদতে কাঁদতে বের হতে দেখে আয়েশা বেগম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। শুভ্রতা এসে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। আশেপাশের মানুষ আড়চোখে তাদের দেখছে। আয়েশা বেগম বেশ শক্ত মনের মানুষ।

তিনি শক্ত হাতে সবকিছু সামলে নিতে জানেন। মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন এমন সময় শুভ্রতা মাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতে থাকা রিপোর্ট মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে চোখ মুছে নেয়। মুখে তার হাসির রেখা স্পষ্ট। কান্না আর হাসিতে জর্জরিত মুখ দেখে দোটানায় পড়ে যান। হাতের রিপোর্টটা বের করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন তিনি৷ শেষের দিকে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, “পজিটিভ “। আয়েশা বেগমের মুখে হাসি ফুটে যায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” শুভ্রতা! শুভ্রতা তুই মা হতে চলেছিস!”
শুভ্রতা চোখে পানি থাকা সত্ত্বেও মুখে হাসি নিয়ে উপর নীচ মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়। আয়েশা বেগম শুভ্রতার চোখের পানি মুছে দেন। মেয়েকে ধরে নিয়ে সাবধানে সেখান থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়। রিকশায় বসেও শুভ্রতার চোখ টলমল করছে৷ কতদিনের ইচ্ছে পূরণ হলো তার। সে মা হতে চলেছে। নিহান শুনলে কতই না খুশি হবে! শুভ্রতা বারবার রাস্তায় সামনের দিকে তাকাচ্ছে। আজ যেন রাস্তাই শেষ হচ্ছে না। শুভ্রতা ধৈর্য্য ধরতে না পেরে বলেই ওঠে, ” মামা তাড়াতাড়ি চলুন না, এত আস্তে কেন যাচ্ছেন?”

স্নিগ্ধা অফিসের একপাশে মন খারাপ করে বসে আছে। যা ঘটছে বা ঘটতে যাচ্ছে সেটা কেমন হবে? স্নিগ্ধাকে বসে থাকতে দেখে মাহতিম এগিয়ে আসে। লাঞ্চের সময় হয়ে যাওয়ায় তাকে বলে, ” এখানে বসে আছেন কেন? খাবার খাবেন না?”
স্নিগ্ধা তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে চেয়ারের কোণায় লেগে পায়ে ব্যথা পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। মাহতিম ফোনটা টেবিলের ওপর রেখে স্নিগ্ধার পায়ে হাত দিতে যাবে ঠিক তখনই স্নিগ্ধা একপা উঁচু করেই পিছিয়ে যায়।

” কি হলো?”
স্নিগ্ধা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ” কিছু না স্যার। আপনি আমার পায়ে স্পর্শ করবেন বিষয়টা ভালো দেখায় না।”
” ঠিক আছে পা ঝেঁড়ে ফেলুন ঠিক হয়ে যাবে। অফিসের সবাই পাশের রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে আপনিও চলুন।”
” স্যার আমার মা খাবার দিয়ে দিয়েছে। ”
” ঠিক আছে, ওটা সবাই মিলে খেয়ে নেবে। চলুন সবাই একসাথে যাওয়া যাক।”
” ঠিক আছে।”

অফিসের সবাই অফিস থেকে বের হয়ে অফিসের দুটো গাড়ি নিয়েই বেরিয়ে পড়ে। গাড়িতে পিছনে সিট না থাকায় স্নিগ্ধাকে মাহতিমের পাশেই বসতে হয়। গাড়িতে বসার পর থেকে মাকে আর বোনকে কল করেই যাচ্ছে স্নিগ্ধা। কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন কিছু হলো না তখন ফোনটা রেখে চুপচাপ বসে রইল সে। স্নিগ্ধার অস্থিরতা দেখে পাশে থেকে রাইমা বলে উঠলো, ” কিছু হয়েছে তোমার?”

স্নিগ্ধা চকিতে বলল, ” না গো, তেমন কিছু না। মা আর আপুকে ফোনে পাচ্ছি না।”
” কোন দরকার বাসায়? জরুরি হলে ছুটি নিয়ে চলে যাও।”
” না সেটার প্রয়োজন হবে না, তুমি ভেবো না।”
রেস্টুরেন্টে গাড়ি এসে থামলে একে একে সবাই গাড়ি থেকে নেমে যায়। স্নিগ্ধা গাড়ি থেকে নামবে ঠিক তখনই শুভ্রতার কল আসে। স্নিগ্ধা থেমে যায়। তাড়াতাড়ি করে কলটা রিসিভ করে।

” হ্যালো আপু! কী রে তোরা? কখন থেকে তোদের দুজনকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি রিসিভ করিস না কেন?”
” রিকশাতে ছিলাম রে। মাত্র এসে বাড়ির সামনে থামলো।”
” রিকশা কেন? গাড়ি নিয়ে যাস নি?”
” হ্যাঁ নিয়ে গিয়েছিলাম। মাঝরাস্তায় কী যেন সমস্যা হয়েছিল তাই ম্যাকানিক ডেকে ঠিক করতে বলে এসেছি।”
” এসব ছাড়, ডাক্তার কী বলল সেটা বল তো।”

শুভ্রতা গম্ভীরগলায় বলে, ” তুমি খালামনি হতে চলেছ স্নিগ্ধা, তাড়াতাড়ি রেডি হও।”
স্নিগ্ধা আনন্দের চিৎকার দিয়ে ওঠে, ” সত্যি! আমি খালামনি হচ্ছি? আমার কেমন বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমি তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে বাসায় আসছি দাঁড়া। নাম কিন্তু আমি রাখব বলে দিলাম।”
শুভ্রতা হেসে বলে, ” আচ্ছা রাখিস সময় আগে হোক। আচ্ছা শোন সাবধানে বাসায় আসিস। দেখি যাই সবাইকে খবরটা দিই।”

শুভ্রতা কল কেটে দেয়। স্নিগ্ধার মুখে হাসি স্পষ্ট। সে গাড়িতে খেয়াল করে দেখে সবাই রেস্টুরেন্টের ভেতরে চলে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে সেও সেদিকে চলে যায়।

অফিসকক্ষে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে কলেজের প্রথম বর্ষের মেয়েদের নিয়ে শিক্ষাসফরে যাওয়া বিষয়ে। কলেজের প্রধান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যেহেতু দেশের অবস্থা ভালো নয় তাই বেশি দূর তিনি যাবেন না মেয়েদের নিয়ে। পার্শ্ববর্তী জেলার একটা এলাকায় নতুন একটা পর্যটককেন্দ্র হয়েছে এবং সেখানেই আশেপাশে কিছু পুরোনো মসজিদ, মন্দির আছে যেখানে মুসলমান এবং হিন্দুরা একসাথেই মিলেমিশে থাকতো।

ছাত্রছাত্রীদের থেকে চাঁদা তোলা শুরু হয়েছে বেশ কয়েকদিন আগেই। কয়েকজন বাকি আছে তারা দুই একদিনের মাঝেই দিয়ে দিবে। কলেজ প্রধানের কথানুযায়ী সবাই রাজি হয়ে যায়। টিচারদের কোন অসুবিধা আছে কি না সেটা জিজ্ঞেস করতেই ফাউজিয়া বলে, ” স্যার সময়টা উল্লেখ করলেন না তো? মানে কখন যাওয়া এবং ফিরে আসা?”

” হ্যাঁ, ভোর সাড়ে ছয়টায় গাড়ি ছাড়া হবে। ফজরের নামাজ শেষ করে ওমনি তৈরি হয়ে সবাই চলে আসবেন। আপনাদের তো আগে আগেই আসতে হবে। ওখানে পৌঁছতে এক থেকে দেড়ঘণ্টা সময় লাগবে। সারাদিন ওখানে থেকে সন্ধ্যা বা সন্ধ্যার আগেই রওয়ানা দেব। রাত আটটার মধ্যেই সবাই বাড়ি পৌঁছে যাবে।”

” ঠিক আছে স্যার।”
” কারো কোন সমস্যা থাকলে জানাতে পারেন৷ শেষ মুহুর্তে গিয়ে বলবেন স্যার যেতে পারব না, তখন কিন্তু আমি কোন কথা শুনব না।”
সামনে বসা সবাই জানায় তাদের কোন সমস্যা নেই। গতবছরের মেয়েরা যেতে পারেনি তাই তাদেরও যাওয়ার সুযোগ এবার আছে বলে জানান প্রধান। স্টুডেন্টদের সেটা জানিয়ে দিতে বলেন তিনি। কথাবার্তা শেষে সবাই রুম থেকে বেড়িয়ে যান। ফাউজিয়া বারান্দায় এসে মাকে কল দেয়। দুই একবার রিং হতেই কল রিসিভ হয়ে যায়।

” মা।”
” হ্যাঁ বল।”
” তোমার ওষুধ কী সবগুলো আছে নাকি কোনটা লাগবে? লাগলে বলো আমি ফেরার সময় নিয়ে আসব। ”
” না সব আছে। তুই সাবধানে বাড়ি চলে আসিস। ছুটি কখন?”
” এইতো কিছুক্ষণ পর।”
” ঠিক আছে। ”
ফাউজিয়া ফোন রেখে টিচার্সরুম থেকে ক্লাসের বইটা নিয়ে রওয়ানা দেয় শেষ ক্লাসটা নিতে।

শুভ্রতা মায়ের সাথে নিজেদের বাড়িতেই যায়। শাহাদাত সাহেব বাহিরে বসে কিছু অফিসিয়াল কাজ করছিলেন। আয়েশা বেগম আর শুভ্রতাকে দেখে কলম রেখে দিলেন। বাহিরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ” খবর কী?”
আয়েশা বেগম একগাল হেসে বললেন, ” তুমি তো নানু হতে চলেছো গো।”

শাহাদাত সাহেবের মুখেও হাসি ফুটে যায়। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বুকে টেনে নেন।
” দোয়া করি আল্লাহ যেন পৃথিবীর সব সুখ আমার মেয়েকে দেয়। আমার মেয়েটাকে আল্লাহ ভালো রাখুক সবসময়। ”
শুভ্রতা চুপচাপ বাবাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। বাবার বুকে এক অন্যরকম শান্তি, বুকে মাথা রাখলেই হৃদয় প্রশান্ত হয়ে যায়। শাহাদাত সাহেব খবরটা ও বাড়িতে দিতে বললে শুভ্রতা বলে, ” হ্যাঁ যাব। একটু বিশ্রাম নিয়ে নিই বাহিরে অনেক রোদ ছিল। খারাপ লাগছে বাবা।”

” ঠিক আছে। বাহিরে না দাঁড়িয়ে থেকে যাও রুমে যাও তাহলে৷ ”
” আচ্ছা।”
শুভ্রতা মায়ের সাথে রুমে চলে যায়। শুভ্রতাকে রুমে রেখে আয়েশা বেগম এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে শুভ্রতাকে দেন। শুভ্রতার পানি খাওয়া শেষ হলে গ্লাসটা যথাস্থানে রেখে পাশে বসেন। রাস্তায় তেমন কোন কথা না হওয়ায় তিনি একটা বিষয় খোলাসা হতে পারেন নি। শুভ্রতাকে জিজ্ঞেস করেন, ” মা, তুই তো বললি গতমাসে তোর পি…….”
মাকে থামিয়ে দিয়ে শুভ্রতা বলে, ” ডাক্তার বললেন, এরকম নাকি অনেকের হয়। এটাকে মিড-সাইকেল বা ওভিউ*লেটরি ব্লি*ডিং বলে।”

” ওহ আচ্ছা বুঝেছি এবার। কিছু খাবি? বানিয়ে দেব?”
” না, মা। এখন কিছু খাব না। বাসায় যাই, দেখি গিয়ে উনি এখনো ঘুমাচ্ছেন নাকি?”
” আচ্ছা ঠিক আছে যা। সিড়ি দিয়ে সাবধানে উঠবি। এখন থেকে কিন্তু খুব সাবধানে থাকবি। আমি নিহানের সাথে কথা বলব, এবার যেন তোকে এখানেই রেখে যায়। ওখানে তুই একা একা থাকতে পারবি না।”

” হ্যাঁ, আমি এখানেই থাকেব এবার সবার সাথে। ”
” এগিয়ে দিয়ে আসব তোকে?”
” আমি একদম ঠিক আছি মা। আমি একাই যেতে পারব। থাকো আসছি আমি।”
” ঠিক আছে সাবধানে যাবি। ”

শুভ্রতা নিজ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে শ্বশুরবাড়ির দিকে পা বাড়ায়। সদর দরজা তখনও খোলা। ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখে আমির সাহেব ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে চা নিয়ে বসে বসে টিভি দেখছেন।
শুভ্রতাকে দেখেই বলেন, ” কী রে মা, কোথায় গিয়েছিলি?
দুপুরবেলায় চা নিয়ে বসে দেখে শুভ্রতা বলে ওঠে, ” দুপুর বেলা কেউ চা খায় সেটা আগে আমাকে বলা হোক।”

” বস এখানে, খাবার খাওয়ার পর এক কাপ খাওয়া যেতেই পারে অসম্ভব কিছু না।”
” বড়আম্মু কোথায়? আবিরা আপু কোথায়? নেহা এসেছে কি?”
” হ্যাঁ এসেছে। সবাই তোদের রুমেই আছে গল্প করছে বসে বসে। তুই নাকি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলি রে মা? কিছু হয়েছে?”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫০

” এমনিই চেকআপ করাতে গেছিলাম বড়আব্বু। তেমন কিছু না।” শুভ্রতা ভেবেছিল খুশির খবরটা দিয়েই দিবে কিন্তু বলার আগ মুহুর্তে কেমন লজ্জা লাগছিল তার। আমির সাহেব তাকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য বলেন৷ দুই একটা কথা বলেই শুভ্রতা সেখান থেকে চলে যায়। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে নিজের রুমের দিকে যেতে থাকে। মনে আনন্দ আর লজ্জা দুটোই কাজ করছে। এতগুলো বছর পর একটা খুশির খবর সবাইকে দিতে পারবে।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫২