শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫২

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫২
তানিয়া মাহি

“আজকে আমাকে কেমন লাগছে বললেন না তো ভাইয়া? আপনি আমার দিকে দেখেন না কেন?”
অরুর এমন উদ্ভট প্রশ্নে সাহিল বলে, ” তুই কোন ক্লাসে যেন পড়ছিস?”
” ক্লাস নাইন, কেন?”
” তোর বয়স কত হবে সর্বোচ্চ পনেরো। সেটাও হবে না হয়তো।”
” দুইবার ফেল করেছিলাম বয়স ষোলো। আমি ষোলো পেরিয়ে গেছি। ও আমি ষো…..”
সাহিল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ” আমার বয়স বত্রিশ বছর। তোর বয়সের দ্বিগুণ। আমার সাথে তোর কীভাবে কথা বলা উচিৎ বল?”

” আপনার বয়স বত্রিশ হলেও পঁচিশ বছরের হ্যান্ডসাম যুবকদের মতোই লাগে। আ’ম ইন লাভ উইথ ইউ সাহিল ভাইয়া। ”
অরুর কথা শুনে মেজাজ চরম খারাপ হয়ে যায় সাহিলের। সে ভেবেছিল অরুর ওপর সে আর রাগ করবে না। নিজের কথা সে রক্ষা করতে পারল না। সাহিল এবার হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, ” অরু, আমি কিন্তু তোকে পড়ানো বাদ দিয়ে দিব। তোর বাবাকে এসব কথা আমি আজই জানাবো অপেক্ষা কর। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বাবাকে জানানোর কথা শুনে একটু ভয় পেয়ে যায় অরু৷ তবুও মাথা নিচু করে বলে, ” আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি৷ আমি একবর্ণও মিথ্যে বলছি না বিশ্বাস করুন৷ আমাকে একটু ভালোবাসলে কী হবে? শুধু ভালোবাসাই তো চেয়েছি আর কিছু না।”

সাহিল অরুর খাতা দেখে, সে এখনো কিছুই লেখে নি৷
সাহিল রেগে বলে ওঠে, ” খাতায় এখনো কিছু লেখিস না কেন? আগে ফেল করেছিস পড়াশোনা না করে। এখানেও পড়তে এসে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বেড়াচ্ছিস তাই না? প্রাইভেট পড়েও যখন ফেল করবি তখন আমার মান সম্মান থাকবে? আমি এদিকে খুব স্বার্থপর, আমি আমার সম্মানেও দাগ লাগতে দিই না, কারো কাছে মাথা নিচুও করি না। তাড়াতাড়ি লেখা শেষ কর, নতুন পড়া নিয়ে বাড়ি যা।”

অরু কলম ছুড়ে ফেলে দেয়। খাতা বন্ধ করে বলে, ” আমি লিখব না কী করবেন? আমি ভালোবাসার কথা বললেই আপনার আত্নসম্মান মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আমি তো শুধু ভালোবাসার কথাই বলেছি, অন্যকিছু তো বলি নি। ”
সাহিল এবার নিজেকে আয়ত্ত্বে রাখতে পারে না। টেবিলে রাখা বে*ত দিয়ে অরুর হাতের তালুতে ইচ্ছেমতো কয়েকটা বা*রি দেয়। অরুর চোখে পানি টলমল করছে আর সাহিলের চোখে হিং*স্র*তা। সাহিল থেমে যায়। অরু হাত নিচে নিয়ে নেয়। হাত গরম হয়ে গিয়েছে, খুব জ্ব*ল*ছে তার।

মনে হচ্ছে হাতে মধ্যে লা*ভা সৃষ্টি হয়েছে। অরু নিজের চোখের পানি কিছুতেই আটকে রাখতে পারে না। এক পলকে সাহিলের দিকে তাকিয়ে আছে। সাহিল বইয়ের পৃষ্টা উল্টাচ্ছে। অরু বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ” আপনি আমার জা*ন নিয়ে নেওয়ার আগ অব্ধিও আমি আপনাকেই ভালোবাসব সাহিল ভাই। এইটা তো কিছুই না। হাত শুধু র*ক্তিমবর্ণ ধারণ করেছে বেশি কিছু না।” বলেই বই,খাতা,নিজের ব্যাগ সবকিছু ওভাবেই রেখে দৌঁড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

শুভ্রতা মন খারাপের ভঙ্গিতে রুমে প্রবেশ করে। শুভ্রতাকে দেখে নেহা চেয়ার থেকে উঠে শুভ্রতার দিকে এগিয়ে আসে। ডাক্তার কী বলল সেটা জানতে চায়। শুভ্রতা ঠিক আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। সবাই চুপচাপ বসে আছে। নিহান নিজেও এবার এগিয়ে আসে। শুভ্রতাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” আমার সাথে ডাক্তারের কাছে গেলে হতো না?”
” আপনি তো ঘুমাচ্ছিলেন তাই আর ডাকিনি।”

” ঘুম থেকে ডাকতে কখনো নিষেধ করেছি? প্রয়োজন হলে ডাকবে না? দেখি রিপো*র্ট দাও।”
শুভ্রতা হাসি চেপে রেখে নিহানের হাতে রিপো*র্ট ধরিয়ে দেয়। নিহান সেটা দেখতে থাকে। পেপারের ঠিক নিচে এসে চোখ আটকে যায়। চোখ তুলে শুভ্রতার দিকে তাকায়। শুভ্রতার চোখ টলমল করছে। নিহানের মুখেও কোন ভাষা নেই, সেও চুপচাপ শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কিছু বুঝতে পেরে উঠে তাদের দিকে এসে দাঁড়ায়। রাবেয়া বেগম নিহানের হাত থেকে রিপো*র্টের কাগজটা নিয়ে নেয়। ”

পজেটিভ” দেখে তিনি উচ্চস্বরে হেসে উঠেন। ” আমার ঘরে নতুন মানুষ আসতে চলেছে।” বলে চিৎকার দিয়ে ওঠেন তিনি। সাথে সাথে আবিরা আর নেহার মুখে হাসি ফুটে যায়। দুজনে শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরে। রাবেয়া বেগম উত্তেজনার বশে সোজা বাহিরে চলে যায় মিষ্টির ব্যবস্থা করতে। কিছুক্ষণের মধ্যে আবিরা আর নেহাও বের হয়ে যায়। নিহান ততক্ষণে শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরেছে৷ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে সে। শুভ্রতাও নিহানের বুকে মাথা গুজে দাঁড়িয়ে আছে। নিহান ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই বলতে থাকে, ” তোমাকে ডাক্তারের কাছে পাঠাতে আমার কেমন যেন ভয় লাগছিল। যদি ডাক্তার অন্যরকম কিছু বলে!”

” বলেনি তো, চিন্তা করবেন না।”
নিহান শুভ্রতাকে ছেড়ে হাত ধরে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেয়। গ্লাসে করে পানি এগিয়ে দিয়ে বলে, ” আজ থেকে কোন রকম কাজ করা চলবে না। আমি ওখানে কাউকে ঠিক করে দিব।”
শুভ্রতা ভয়ে ভয়ে বলে, ” মা বলছিল আমাকে এখানে থাকতে। এখানে সবাই আছে, সবার সাথে থাকলে আমার মন ভালো থাকবে। সবাই দেখাশোনা করতে পারবে। ”
নিহান কোন কথা না বলে চুপ করে কিছু ভাবতে থাকে। তারপর বলে, ” তোমার কোন অসুবিধা হবে না তো?”

” তা হবে না। কিন্তু…”
” কিন্তু?”
” তোমাকে ছাড়া থাকতে খারাপ লাগবে। খুব খারাপ লাগবে, খুব খুব খুব।”
” আমার শুভ্রাকে ছেড়ে থাকতে কি আমার ভালো লাগবে নাকি? তাকে ছাড়া কি আমার ভালো থাকার কথা? কী আর করার, আমাকে যে যেতেই হবে। আমার ওপর কত দায়িত্ব! আমি তো শুধু আমার মানুষটার জন্য এতবড় দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি না। আমরা চাইলেও অনেককিছুই পারি না৷ শতকষ্ট বুকে চেপে রেখে দেশ রক্ষার্থে ল*ড়ে যেতে হয়। সেটা যদি দেশের কিছু মানুষ বুঝতো তাহলে দেশে এত অনৈ*তিক কাজ হতো না।”

” আপনি প্রতি সপ্তাহে আসতে পারবে না?”
” প্রতি সপ্তাহে আসা কি সম্ভব হবে? পারলে আসব আর না পারলে দুই সপ্তাহ পরপর চলে আসব ইন শা আল্লাহ। ”
” আমি তোমাকে ভীষণ মিস করব। ”
” ঠিক আছে। এখন বলো বাবু ঠিক আছে তো? কখনো খারাপ লাগলে কিন্তু অবশ্যই অন্তত মাকে আর আমাকে জানাতেই হবে বুঝেছ?”
শুভ্রতা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়। নিহান আবারও শুভ্রতাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। শুভ্রতা নির্দ্বিধায় এবার স্বস্তির শ্বাস ফেলে।

ইমতিয়াজ বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ একটা ব্রিজের ওপর বসে বসে জীবনে পাওয়া- না পাওয়ার হিসেব কষছে। যেভাবেই হিসেব করছে শেষে এসে প্রাপ্তির খাতা শূন্য। ইমতিয়াজ ব্রিজের নিচের বয়ে যাওয়া খরস্রোতা পানির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে মনে ভাবে, ” এখানে লাফ দিলেই হয়তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আশেপাশে সেরকম মানুষও তো দেখা যাচ্ছে না।

আমি তো সাঁতার জানি না, গভীরতা বেশি হলেই আজ সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”
ইমতিয়াজের নিজসত্ত্বা বলে ওঠে, ” তুই পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃ*ষ্ট মানুষ। জন্মের সময় মাকে হারিয়েছিস, যে মেয়েটা তোকে ভালোবেসে আজীবন তোর সাথে থাকতে চেয়েছিল বাহ্যিক আকর্ষণে সে মেয়েটাকেও খুইয়ে ফেললি। তোর বেঁচে থাকার অধিকার নেই।” ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ওঠে ইমতিয়াজের। মা*রা গেলেও আজ তার জন্য কান্না করার একটা মানুষ পর্যন্ত নেই তার জীবনে।

ইমতিয়াজ ব্রিজের ওপর উঠে দাঁড়ায়। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার আজ। চোখ দুটো ছলছল করছে। আর কোন ভাবনাচিন্তা করে না সে। তাকে ব্রিজের ওপর দাঁড়াতে দেখে চারপাশের মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। ইমতিয়াজ আর ভালো কিছুর অপেক্ষা না করে ব্রিজের নিচে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চারপাশের দৌঁড়ে সেখানে এসে জড়ো হয়ে যায়। ইমতিয়াজের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। সে পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫১

কেউ কেউ ফোন বের করে ভিডিয়ো করছে, ন*ষ্ট প্রজ*ন্ম। পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার পর থেকে কী ভেবে বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে অন্যসবাই ও হয়তো এ পথে এগিয়ে কোন একসময়ে বাঁচার চেষ্টা করে কিন্তু, কিন্তু নিজেকে শেষ রক্ষা করতে পারে না। ইমতিয়াজ ও কি এভাবেই বিদায় নেবে!

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৫৩