বুকের বা পাশে পর্ব ১৯

বুকের বা পাশে পর্ব ১৯
written Nurzahan akter Allo

সেদিন রাতে প্রিয়মের আর কোনো সমস্যা হয়নি। তাই পরেদিন সকালে প্রিয়মকে আরেকবার চেক আপ করে রিলিজ করে দিলো। প্রিয়মের সাথে তুয়া আর ওর বন্ধুরা প্রিয়মের ফ্ল্যাটে ফিরলো। রিমন সহ দুইজন এখন এখানেই থাকবে।‌ তুয়া সব কিছু ঠিকঠাক করে দিলো।তারপর প্রিয়মকে সাবধানে থাকতে বলে তুয়া চলে গেলো।
এভাবে আরো চারটা দিন কেটে গেলো। প্রিয়ম এখন হাঁটতে পারে, তাও একটু খোঁড়ায়। এই চারদিনে তুয়া দুইবার করে প্রিয়মের ফ্ল্যাটে আসতো খাবার নিয়ে। রিমন আর প্রিয়ম বেশিভাগ সময়ই ফ্ল্যাটেই থাকতো। আগের তুলনায় প্রিয়ম মোটামুটি এখন সুস্থই আছে। মাথার, হাতের, পায়ের ব্যান্ডেজও খুলে দিয়েছে। তুয়ার আব্বু আম্মু এসেও প্রিয়মকে দেখে গেছে।
প্রত্যয় রাত সাড়ে দশটায় বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিলো।তারপর ডিনার করতে করতে প্রত্যয়ের আম্মু প্রত্যয়কে বললো,

— “প্রত্যয় তুয়ার সাথে তোমার দেখা হয়েছিলো? তুয়া তোমাকে কিছু বলেছে?” (আম্মু)
— “না, আর কি বলবে?” (জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে)
— “শুক্রবারে তুয়া আর প্রিয়মের আকদ হবে। আপাতত পারিবারিকভাবে করছে, পরে অনুষ্ঠান করবে। তোমার আন্টি আংকেল এসে আমাদের ইনভাইট করে গেলো।” (প্রত্যয়ের বাবা)
— “ওহ্!” (প্রত্যয়)
— “সেদিন কোন কাজ রেখো না। কারণ তুমি না গেলে তোমার আন্টি আংকেল কষ্ট পাবে।” (আম্মু)
— “হুম, আমি যাওয়ার চেষ্টা করব।” (প্রত্যয়)
— “প্রত্যয় তোমার জন্যও আমরা মেয়ে দেখছি। আর পালাই পালাই করলে হবে না। তোমাকে এবার বিয়ের করতেই হবে। এবার খুব জলদি লাল টুকটাকে শাড়ি পড়া একটা বউ নিয়ে এসো। আর একা বাসায় থাকতে ইচ্ছে করে না।” (আম্মু মুচকি হেসে)
— (প্রত্যয় নিশ্চুপ)

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

প্রত্যয় ওর আম্মুর কথায় টু শব্দ করেনি। কিন্তু প্রত্যয় বাহানা দেখিয়ে না খেয়ে চলে গেল। কারণ গলা দিয়ে খাবার নামছে না। মনে হচ্ছে কেউ গলা চেপে ধরে আছে!প্রত্যয় ওয়াশরুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি দিলো। তারপর আয়নাতে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে বললো,
— “লাল টুকটাকে শাড়ি পড়া বউ তো আনতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার সব স্বপ্ন আর ইচ্ছে গুলোকে কেউ একজন ভেঙ্গে চুড়ে চূর্ন-বিচূর্ন করে দিয়েছে। আচ্ছা জোর করে ওকে পেতে চাইলে কি পাপ হবে? আমি যে এই কষ্টটা আর সহ্য করতে পারছি না। প্রতিটা সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা আমাকে প্রতিনিয়ত এই কষ্টে দগ্ধ করেই যাচ্ছে।” (প্রত্যয়)
প্রিয়মের আব্বু-আম্মু প্রিয়মকে অনেক বুঝিয়েছে। কিন্তু প্রিয়ম তাদের কথা শুনেনি। প্রিয়মের আম্মু প্রিয়মকে একটা মেয়ের ছবি দেখাতে চেয়েছে। উনার বিজনেস পাটনারের মেয়ে, নাম রশ্নি। কিন্তু প্রিয়ম সেদিকে ফিরেও তাকায় নি। প্রিয়ম ওর দরকারী জিনিসপত্র নিয়ে আবার ওর ফ্ল্যাটে চলে গেছে। ওর ফ্ল্যাটটা গুছানোই ছিলো, কিন্তু প্রিয়ম আবার নতুন করে সব কিছু সাজিয়েছে। ওর যত গান আর মডেলিং এর শো ছিলো, আপাতত সব ক্যানসেল করে দিয়েছে। প্রিয়মের আম্মু আর আব্বু অনেক চেষ্টা করেছে এই বিয়ে আটকানোর, কিন্তু তারা ব্যর্থ!
তুরাগ বাসায় এসে তুয়ার আর প্রিয়মের বিয়ে শুনে কিছু বলেনি। কারণ তুরাগ সব জানতো। প্রিয়ম আর তুয়া শপিং করতে এসেছে। কিন্তু আশ্চর্য্য জনক ঘটনা, আবার কেউ প্রিয়মের গাড়ির ব্রেক ফেল করে দিয়েছিলো। আল্লাহর রহমতে ওদের কিছু হয়নি। কোনো এক রকম ভাবে বিপদটা কেটে গেছে। তুয়া খুব কেঁদেছে এই ঘটনার পর। প্রিয়মও বুঝতে পারছে না, ওকে মেরে ফেললে কার কি এমন লাভ? ও কার কি বা ক্ষতি করেছে? যে ওকেই মারতে চায়?

তুয়া ভিডিও কলে প্রিয়মের হাস্যজ্জ্বল মুখটাকে দুচোখ ভরে দেখে নিলো। আর একটা দিন পরেই ওদের আকদ।তাই প্রিয়ম এত খুশি। ওর হাসি মুখে দেখে মনে হচ্ছে প্রিয়ম যেন নতুন করে বাঁচার চাবিকাঠি পেয়েছে। প্রিয়মের খুশি মুখটা দেখলেই তুয়া আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায়। তুয়া প্রিয়মের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবে, ঠিক কতটা ভালবাসলে কাউকে পাওয়ার আনন্দটা এভাবে উপভোগ করা যায়।
কালকে শুক্রবার, এজন্য প্রিয়ম সারারাত তুয়ার সাথে ফোনে কথা বলেছে। ওর নাকি খুশিতে ঘুম আসছে না, তাই সে তুয়াকেও ঘুমাতে দেয়নি। তুয়া প্রিয়মের কান্ডগুলো দেখে না হেসে পারে না। দুজনেই সারারাত কথা বলে ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে। তুয়া সকাল নয়টায় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো। ওর আব্বু-আম্মু প্রিয়মের ফ্ল্যাটে গেছে। ওখানে প্রিয়ম একা তাই সবকিছু দেখে আসতে। প্রিয়ম সব সামলে নিয়েছে, কিন্তু তাও ওনাদেরও তো একটা দায়িত্ব আছে। একটু পর কলিংবেল বেজে উঠলো। তুয়া দরজা খুলে দেখে কেউ নেই, শুধু একটা খাম পড়ে আছে। তুয়া খামটা খুলে ওর রুমে চলে গেল। একটু পর ওর ফোনে একটা মেসেজ আসলো।আর মেসেজ টা ছিলো এমন,

“যুদ্ধে আর ভালবাসায় নাকি সব কিছুই জায়েজ। তাই আমিও মাঠে নেমে গেলাম। তোমাকেও আহ্বান জানাচ্ছি, যুদ্ধ/ভালবাসার জন্য মাঠে নামতে! আমিও এবার দেখি, তুমি সবকিছু কিভাবে সামলাও। আমার চাওয়া আমি এবার পূরণ করেই ছাড়বো। কারণ আমিও হেরে যাওয়া মোটেও পছন্দ করিনা। আমি এত বোকা নই যে, যা হবে সব মুখ বুজে সহ্য করবো। অনেক তো হলো, আর না! এতদিন ভালো রুপটা তো দেখলে, এবার না হয় খারাপ রুপটাও দেখে নাও। তুমি এবার রেডি হও ডালিং, আমার প্ল্যানটা সাকসেসফুল করার জন্য।”
মেসেজটা দেখে তুয়া ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। ওর পুরো শরীল থরথর করে কাঁপছে। তুয়া শব্দ করে কেঁদে দিলো। এখন কি করবে বুঝতে পারছে না। তবে
তুয়া এটা খুব ভালো করে বুঝতে পারছে, এটা কোন বিপদের, আগাম সংকেত।

আজকে তুয়া আর প্রিয়মের বিয়ে। তুয়া একটু বাইরে গিয়েছিলো, কেবল ফিরলো। প্রিয়মের ওখান থেকে তুয়ার আব্বু আম্মুও অনেক আগেই ফিরে এসেছে। আর ওদের আকদ হবে প্রিয়মের ফ্ল্যাটে, তাই সবাই রেডি হয়ে বের হয়ে গেলো। তিন্নি তো তুয়াকে খোঁচাতেই আছে। কারণ ছেলেরা আকদ এর দিন মেয়ের বাড়িতে আসে, কিন্তু এখানে হচ্ছে তার উল্টোটা। তুয়া যাচ্ছে ছেলের বাসায়। অর্থাৎ মেয়ে যাচ্ছে ছেলেকে বিয়ে করতে। এটা নিয়েই তিন্নি বকবক করছে আর তুয়া চুপ করে আছে।
একটু পর তুরাগরা প্রিয়মের ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এসে কলিংবেল চাপ দিলো। প্রিয়ম এসে দরজা খুলে দিলো।সবাই প্রিয়মের অবস্থা দেখে থ! সবাই চোখ বড় বড় করে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ প্রিয়ম সাদা সেন্ডো গেন্জী, মেরুন থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট আর গলায় লাল গামছা ঝুলিয়ে পুরো মুখে হলুদ দিয়ে ভুত সেজে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়মের বন্ধুরা প্রিয়মের এই অবস্থা করেছে। আর ওরা ইচ্ছে করেই প্রিয়মকে দিয়ে দরজা খুলিয়েছে।প্রিয়ম ওর মুখটা কাচুমাচু করে সবার দিকে তাকিয়ে উল্টো ঘুরে দৌড় দিলো! তারপর মাঝপথে আবার থেমে গিয়ে বললো,
— “আংকেল আন্টি, আপনারা সবাই বসুন। আমি এক্ষুনি আসছি।” (প্রিয়ম)
কথাটা বলে প্রিয়ম দ্রুত গতিতে হেঁটে চলে গেল। আর প্রিয়মের বন্ধুরা হো হো করে হেসে দিলো। কারণ ওরা ইচ্ছে করেই প্রিয়মকে এমন প্যাচে ফেলেছে। এর মধ্যে
তুয়ার আব্বু প্রিয়মের কান্ড দেখে বলে উঠলো,

— “জামাই আমার নিজের বিয়ের খুশির ঠেলায় পাগল হয়ে গেছে।” (তুয়ার আব্বু)
এই কথা শুনে ওখানে আরেকদফা হাসির রোল পড়লো!
একটু পর আরো কয়েকজন গেস্ট আসলো। তিন্নি তুয়াকে অন্য রুমে নিয়ে গেছে শাড়ি পড়ানোর জন্য।‌ কারণ তুয়া থ্রিপিস পড়ে এসেছে বাসা থেকে। প্রিয়ম খুব সুন্দর সিঁদুরে লাল কালারের একটা সিল্কের শাড়ি কিনেছে; সোনালি পাড়ের। শাড়িটা সিম্পল হলেও অসম্ভব সুন্দর। আর প্রিয়ম বলেছে এই শাড়িটাই তুয়াকে পড়তে হবে। এটা পড়েই সে বিয়ে করবে। এটাই প্রিয়মের আবদার। তিন্নি একদম হালকা সাজেই তুয়াকে সাজিয়ে দিলো।‌ কারণ তুয়া ভারী মেকাব পছন্দ করে না। আর তুয়ার স্কিনটাও খুব সেনসেটিভ ,ভারী মেকাব সুট করে না। তিন্নি তুয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
— “কি হয়েছে তুয়া? এমন চুপ করে আছিস কেন?”
— “না, আমি ঠিক আছি।” (তুয়া)
— “কিছু কি হয়েছে?” (তিন্নি)
— “না।” (জোর করে মুখে হাসির রেখা টেনে)
বাসায় গেস্টরা চলে এসেছে। প্রিয়ম রেডি হয়ে সবার সাথে টুকটাক কথা বলছে। একটু পর প্রত্যয়ের বাবা-মা আর প্রত্যয়ও চলে আসলো। প্রিয়ম ওদের সাদরে গ্রহন করলো। প্রত্যয়রা সবাই বসলো। প্রত্যয় আশে পাশে তাকালো। চেনা মুখটাকে না দেখতে পেয়ে চুপ করে বসে থাকলো।
তুয়ার বাবা প্রিয়মকে ডাকলো আর বললো কাজী এসে গেছে। প্রিয়ম তুয়ার বাবার কাছে এসে দাঁড়ালো। তুয়ার আম্মু আর তিন্নি তুয়াকে নিয়ে আসলো। সবার দৃষ্টি এখন তুয়ার দিকে।

তুয়া প্রিয়মের পাশে বসতেই দেখে প্রত্যয় ওর সামনে বসে আছে। তুয়া আর প্রত্যয়ের চোখাচোখি হয়ে গেল। প্রত্যয়ের চোখ লাল হয়ে আছে। মুখটাও গম্ভীর হয়ে আছে। প্রত্যয় চোখ সরিয়ে নিলো আর মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। কাজী লেখালেখি করছে আর তুয়ার বাবা প্রয়োজনীয় তথ্য কাজীকে বলছে।
প্রিয়ম আড়চোখে তুয়াকে দেখছে। একটুপর প্রিয়ম ফিসফিস করে বললো,
— “এই টুপা এতো সেজেছিস কেন? তোকে তো আমার এখনই টুপ করে গিলে ফেলতে ইচ্ছে করছে।”
— “(তুয়া নিশ্চুপ)
— “লাল শাড়িতে আমার বউটাকে পুরো পুতুলের মতো লাগছে। আর আমার এই পুতুলটাকে আমি খুব খুব ভালবাসবো! আর অনেক যত্নে রাখবো।” (ফিসফিস করে)
— (তুয়া নিশ্চুপ)
— “কি ব্যাপার রে? এই টুপা কথা বলছিস না কেন? তোর সাথে কথা বলার জন্য আমার জান বের হয়ে যাচ্ছে ।আর তুই চুপ করে আছিস। এই টুপা!” (গুঁতো মেরে)
— (তুয়া নিশ্চুপ)
— “আমি কিন্তু বোবা মেয়েকে বিয়ে করবো না, আগেই বলে দিলাম।” (মুচকি হেসে)
তুয়া চুপ করেই থাকলো। আড়চোখে তুয়া প্রিয়মকে দেখে নিলো। আজকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে প্রিয়মকে।গোল্ডেন কালার পাঞ্জাবিতে দারুন মানিয়েছে।
একটু পর প্রত্যয় ওখান থেকে উঠে ওর আম্মুকে ডাকে বললো,

বুকের বা পাশে পর্ব ১৮

— “আম্মু আমার যেতে হবে, আমি গেলাম।”
— “কেন, যাবে কেন?” (ওর আম্মু)
— “জরুরী কাজ পড়ে গেছে আমার। বাবাই এর সাথে তুমি এসো, আমি গেলাম।” (প্রত্যয়)
— “বিয়ে পড়ানো হোক, তারপর না হয় যেও। এটা কেমন দেখায় বলো?” (ওর আম্মু)
— “সম্ভব না আম্মু, আমি গেলাম।” (প্রত্যয়)
— “প্রত্যয় আব্বু কি হয়েছে?” (তুয়ার আম্মু)
— “আন্টি আমার যেতে হব। একটু কাজ পড়ে গেছে তাই আর কি!” (মুচকি হেসে)
— “ডক্টর মানুষ জরুরি কাজ থাকতেই পারে, দাঁড়াও আব্বু খেয়ে তারপর যাও।” (তুয়ার আম্মু)
–‌ “না না অান্টি এতো সময় নেই! আমি গেলাম।”

প্রত্যয় না দাঁড়িয়ে তুয়ার দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেল। তুয়াকে সবাই ঘিরে ধরেছে, তাই তুয়ার সাথে প্রত্যয়ের দেখা হলো না। প্রত্যয় যাওয়ার পর পরই তুয়ার ফোনে আরো দুইটা মেসেজ আসলো। তুয়া মেসেজ দুইটা পড়ে নিয়ে ঢোক গিললো। ওর শরীর কাঁপছে থরথর করে। তুয়ার এখন একটু পানির খুব বেশিই প্রয়োজন!ওর গলা শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে! তাই তুয়া তিন্নিকে ডাকার জন্য মাথা উপরের দিকে তুলতেই দেখে প্রিয়মের আব্বু আর আম্মু ওদের সামনে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়মের আব্বু-আম্মু তুয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। আর কাজীর দিকে তাকিয়ে বললো অতি শীঘ্রই বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ করতে।কারণ শুভ কাজে বিলম্ব করাটা উচিত নয়।

বুকের বা পাশে পর্ব ২০