বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ১৯

বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ১৯
ফাতেমা তুজ নৌশি

দু হাত ভরাট করে মেহেদি লাগাল উষশী। তার হাত এখন রঙিন হয়ে উঠেছে। এত সময় পর অভিরাজের দেখা মিলল। সে কোকো কে চেকাপ করাতে নিয়েছিল। প্রানীটির মাঝে মাঝেই নানান ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বিষয়টা বেশ সিরিয়াস ভাবে নিয়েছে অভি। উষশীকে দেখতে পেয়েই নেমে এল কোকো। মিউ মিউ করছে কোলে উঠার জন্য। অথচ উষশী’র হাত ভরাট করা মেহেদিতে। ইরা এসে কোকো কে তুলে ধরল।

“এমন করে না কোকো। মেহেদি নষ্ট হলে তোমার বন্ধু কষ্ট পাবে।”
মানুষের ভাষা বুঝতে পারলে কোকো নিশ্চয়ই থেমে যেত। তবে অবলা প্রাণীটির সেই ধরনের বিশেষ কোনো ক্ষমতা নেই। ইরার বান্ধবীরা চলে আসায় তাকে যেতে হলো। উষশী মাথাটা ঘুরিয়েছে সবে। ওমনি লাফিয়ে উঠল কোকো। সঙ্গে সঙ্গে মেহেদিতে কোকোর শরীর মেখে গেল। সুন্দর ডিজাইন লেপ্টে যাওয়ায় কান্না পাচ্ছে ওর।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অভি খেয়াল করেছে বিষয়টা। সে সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিকে উপরে নিয়ে এল। হাত ধুয়ে দিতেই সবটা ঠিক দেখতে পেল। উষশীর মন খারাপ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অর্গানিক মেহেদি হওয়ায় রঙ হতে সময় লাগে। তাই ডিজাইনটা নষ্ট হয় নি। কিছু সময় পূর্বে একটা কথা শুনতে পেয়েছে সে। মেহেদির রঙ যত গাঢ় হয় হাসবেন্ড তত ভালোবাসে। ওর হাতের রঙটা একদমই গাঢ় হয় নি। এই নিয়ে ফের মন খারাপ হয়ে গেল। সে চাতক পাখির মতো অভিরাজের দিকে তাকাল। অভি কোকোর গায়ে লেগে থাকা মেহেদি পরিষ্কার করছে।

“কোকো তুই আমার বন্ধু না। দিলি তো সবটা নষ্ট করে।”
রেগে গিয়েছে উষশী। ভীষণ ভালোবাসার প্রাণীটিকে ‘তুই’ বলে সম্মোধন করছে।
“ও কি আর বুঝতে পারে এসব।”
“মেহেদিটা একদমই রঙ হয় নি।”
হাত বাড়িয়ে দেখাল উষশী। খুব একটা রঙ হওয়ার সুযোগ পায় নি। তবু সুন্দর লাগছে হাতে। প্রথমবার হাতে মেহেদি স্পর্শ করিয়েছে কিশোরী মেয়েটি। তাই উত্তেজনা এত বেশি। কিন্তু সবটাই তো ঘেটে গেল। অভিরাজ অবশ্য প্রশংসা করতে ভুলল না।

“সবার থেকে আলাদা হয়েছে। এটাই তো ভালো। তাছাড়া অতিরিক্ত কিছুই ভালো না। তোমার হাতে বেশ সুন্দর মানিয়েছে রঙটা। ঠিক তোমার চুলের মতো।”
উষশী অভিরাজকে একটিবার অবলেকন করে নিল। তারপর ছেলেটার বুকের কাছে হাত রেখে নরম সুরে শুধাল,”সত্যিই সুন্দর লাগছে?”
“হুম। খুব সুন্দর লাগছে।”

লাবণ্য ভিডিও কলে যোগ দিয়েছে। মেয়েটার এমন সময় কাজ পড়ে গেল যে কিছু করার নেই আর। তবে বিয়েতে থাকতে পারবে সে। উষশী লাবণ্যকে পেয়ে বাকি সবাইকে ভুলে বসেছে। বিশ মিনিট কথা বলল ওরা। উষশী’র জন্য লাবণ্য’র খুব বেশি মায়া অনুভব করে। অথচ দিনকে দিন মেয়েটি ওর প্রতিদ্বন্দ্বি রূপে তৈরি হচ্ছে।

শিউলি ফুলের সুবাসে এদিকটা একটু বেশিই মোহময় লাগছে। ছোঁয়া’র প্রিয় ফুল এটি। মিষ্টি একটা ঘ্রাণ মিলে এটা থেকে। সে এখন তার হবু স্বামীকে মেহেদি দেখানোয় ব্যস্ত। দৃশ্যটি যখন থেকে ঈশান দেখতে পেয়েছে তখন থেকে চারপাশ কেমন অন্ধকার অনুভব করছে। ওয়াইন পান করেছে কয়েকবার। সিগার ধরিয়েছে একটার পর একটা। ভেঙে গিয়েছে পুরোপুরি। তার এই কষ্টমাখা অনুভূতি’র কোনো মূল্য নেই। পুরো দৃশ্যটা উষশী দেখতে পেয়েছে। অনুমতি না থাকায় সেদিকটায় যেতে পারে নি সে। একরাশ অনুভূতি হারিয়ে চলে এসেছে ছোঁয়া’র নিকট। মেয়েটা ওকে দেখে হাসল।

“উষশী,তোমার মেহেদিটা খুব সুন্দর হয়েছে।”
“তোমার চাও ভীষণ সুন্দর।”
এইটুকু কথাতেই শেষ হলো ওদের আলাপ। এগিয়ে এসে ইরার সাথে যোগ দিল মেয়েটি। খুব বেশি সময় সেখানে অবস্থান করতে পারে না কিশোরী। তার বুকের ভেতর বন্ধু’র জন্য কষ্ট তৈরি হয়েছে। সে দেয়ালে হেলান দিয়ে নিচের আলোকসজ্জা দেখছিল। তখুনি চুলে টান অনুভব করল। না দেখেও মানুষটির গায়ের সুবাস অনুভব করতে পারল সে। চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিল।

“সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। তুমি জেগে আছ কেন?”
“বড়োরাই ঘুমিয়েছে। বাকি সবাই জেগে আছে।”
“একা কি করছিলে?”
“কিছুই না।”
“আমার কাছে আসলে না কেন?”
“আপনি কি ডেকেছেন আমায়?”
“না ডাকলে আসবে না?”

মেয়েটা এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সোজা ঘুরল। ছেলেটার বুক বরাবর মাথাটা ঠেকিয়ে জোরে শ্বাস নিল। ঈশানের কথা ভাবলেই তার কষ্ট অনুভব হচ্ছে। বিচ্ছেদ এক যন্ত্রণা’র নাম। সেটা হোক দ্বিপাক্ষিক কিংবা একান্ত।

বর্তমান
ইরা আজ ফিরে যাবে। তার ফ্লাইট রাত নয়টায়। তাই বিকেল হতেই সব আয়োজন চলছে। সে জানে নিজ থেকে না গেলে অভি হয়ত আসবে না। অভি একটা ছবির সামনে বসে আছে। দেয়াল জুড়ে উষশী’র বিশাল একটা ছবি টাঙানো। এই ছবি না দেখলে ওর চোখে ঘুম আসে না। মেয়েটিকে সারাক্ষণ বুকের মধ্যে মিশিয়ে ফেলতে চায়। কিন্তু মানুষ যা চায় তা সবসময় পায় না। তেমনি হচ্ছে অভিরাজের সাথে। পৃথিবী’র সব কিছু পেলেও কাক্ষিত চাওয়াটা পূরণ হয় নি তার। একটা উষ্ণ শ্বাস অনুভব হলো ইরার। তার দু চোখে মুক্তোর মতো জল নেমেছে।

“চলে যাবি আজ?”
“হ্যাঁ। না এলে তো একটি বার দেখতেও যেতে না।”
নিরুত্তর রইল অভি। ইরার কথাটা মিথ্যে নয়। বোনকে দেখার প্রয়াসে উঠে দাঁড়াল সে। শরীরে থাকা টি শার্টটা ঠিক করে নিয়ে বলল, “জানিস তো ইরা, আমার প্রতিটা টি শার্ট উষশী পরে দেখত। লম্বায়, বডিতে এত বেশি ঢিলে হতো যে ওকে এলিয়েন মনে হতো। তবু টি শার্ট গুলো না পরা অবধি ওর শান্তি হতো না।”
কথা বলতে বলতে চোখে জল চলে এল অভিরাজের। কনিষ্ঠা আঙুলের সাহায্যে জল মুছে নিয়ে বলল,”বিরক্ত হচ্ছিস নিশ্চয়ই। আর কথা বাড়াব না। সাবধানে যাস।”

এত সময় যাবত ধরে রাখা অশ্রু এবার বৃষ্টির মতো ঝরতে লাগল। ইরা শব্দ করে কেঁদে ফেলল। অভিরাজের প্রাণহীন দেহটা ঈষৎ কম্পন করে উঠেছে। বোনকে আগলে নিল সে।
“তোরা কেন এমন করিস ইরা?”
“কবে আগের মতো হবে তুমি? এভাবে কেন ভেঙে পড়লে ভাইয়া। আমরা ম রা র মতো বেঁচে আছি। স্বাভাবিক হও ভাইয়া। এভাবে কষ্ট পেতে দেখলে আমার যে খুব যন্ত্রণা হয়।”

ভাই বোনের ভালোবাসার আলাদা কোনো সংজ্ঞা হয় না। আশ্চর্যজনকভাবে ইরাকে এয়ারপোর্ট অবধি ছাড়তে এল অভিরাজ। এখানে এসে পুরনো স্মৃতিতে ভেসে যেতে লাগল সে। এই জায়গাতেই স্বীয় প্রিয়তমাকে শেষ বারের মতো দেখেছিল সে। কি সুন্দর ছিল সবটা।

অতীত
সবাই শাড়ি পরলেও উষশী সেই চিরচেনা হলুদ রঙের ফ্রক পরেছে। তার কোমল গোলাপি ঠোঁট আজ রক্তজবার মতো রঙিন হয়ে উঠেছে। চুল গুলো বিনুনি করে ছোট ছোট ফুল দেওয়া হয়েছে। তাকে এত মিষ্টি দেখাল যে অভিরাজ নিজেই চোখ সরাতে ব্যর্থ হচ্ছে। আশে পাশের নারী গুলোও হা হয়ে তাকিয়ে আছে। এতে অবশ্য বেশ অস্বস্তি মিলল কিশোরী। সে এই মুহূর্তে কাক্ষিত ব্যক্তির খোঁজে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। এ ব্যপারে তাকে সাহায্য করল ঈশান। অভিরাজ আগে থেকেই বাইরে অপেক্ষা করছিল। উষশী আসতেই মেয়েটির হাত ধরে গাড়িতে উঠিয়ে নিল। গাড়ি চলছে। উষশী বাইরের পরিবেশ দেখায় মগ্ন। তাকে কোথায় নেওয়া হচ্ছে এ ব্যপারে একটুও আগ্রহবোধ করছে না। খানিক চলার পর গাড়িটা থেমে গেল। খুব বেশি পথ অতিক্রম করে নি ওরা।

“নেমে এসো।”
শক্তপোক্ত বিশাল হাতের থাবায় নিজের নরম তুলতুলে হাত গছিয়ে দিল উষশী। আকাশের চাঁদ আজ মেঘের বুকে ঘুমিয়ে পড়েছে। মৃদুমন্দ হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে উষশী’র বাদামি রঙা চুল। অভিরাজ এক দৃষ্টিতে মেয়েটির সৌন্দর্য দেখে যাচ্ছে। উষশী আজ ভীষণ লজ্জায় ডুবে গেল। একরোখা জেদি, স্পষ্টভাষী উষশী যেন মুহূর্তেই পুরো বদলে গেছে। তার ভয়ংকর লজ্জামাখা মুখটা উঁচু করল অভিরাজ। এত নিখুঁত সৌন্দর্যে সে সত্যিই অভিভূত হয়ে পড়ল। তার শরীরের প্রতিটা লোম জেগে উঠেছে। শীতল হাওয়ার সাথে ভেসে আসছে সিক্ত মাটির সোঁদা গন্ধ।

অন্যরকম মনরোম হয়ে উঠেছে পরিবেশটি। নিজের সমস্ত অনুভূতি ব্যক্ত করার প্রস্তুতি নিতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। এ যেন প্রকৃতির আর্শীবাদ। কয়েক সেকেন্ডেই বৃষ্টিতে ভিজে গেল যুবক আর কিশোরী। পাতলা ফিনফিনে শরীরে লেপ্টে রইল হলুদ রঙের পোশাকটি। এখন উষশীকে বৃষ্টিভেজা সূর্যমুখীর মতো দেখাচ্ছে। তার বাদামি রঙের চুল যেন চকলেটে ডুবানো পিনাট বাটার। যার মাদকতায় ভস্ম হয়ে গেছে অভিরাজের অন্তঃকরণের সবটা।

মেয়েটি একটু সরতে চাইলেই অভি নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। আঙুলের সাহায্য ঠোঁটের উপরে আসা বৃষ্টির জল মুছে দিচ্ছে। পুরুষালি স্পর্শ পেয়ে উষশী’র সর্বাঙ্গ বিদ্যুৎ লাগার মতো কম্পিত হলো। অন্য হাত লুটপাট চালাচ্ছে কিশোরীর বাদামি রঙা চুলে। ধীরে ধীরে দুজনের মাঝের দূরত্ব কমে যেতে লাগল।

বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ১৮

উষ্ণ নিশ্বাস গুলো একে অপরের মুখে এসে পড়ছে। বুকের ভেতর হওয়া ধীম ধীম শব্দটা গতি হারিয়েছে। একটু বাদেই নরম তুলতুলে উষশী’র গোলাপি বর্ণের ঠোঁটের সমস্ত মিষ্টতা অভিরাজের ওষ্ঠের দখলে চলে এল। প্রবল বর্ষণে বেগতিক ভাবে চলতে লাগল নব্য প্রেমিক প্রেমিকা যুগলের বৃষ্টিভেজা আলাপন।

বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ২০