রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ২৯

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ২৯
লেখনীতে: সালসাবিল সারা

–“তাহুরা, দাঁড়াও।তুমি দূর্বল।কথা শুনতে বললাম!”
মৃদু চিৎকার ভেসে আসে উমাইরের।ক্রোধে উন্মত্ত মানব।তাদের সুন্দর মুহূর্তের মাঝে হুট করেই তাহুরা তাকে ধাক্কা দেয়। উমাইর কিছু ঠাহর করার পূর্বে তাহুরা ধীর পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নামতে শুরু করে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

এর মানে এটা বুঝায়,খানিক আগে তাহুরা হুঁশ খুইয়ে ভুল করে, এর দরুণ লজ্জিত সে।সরল মেয়ে তাহুরা।বিবাহ ছাড়া উমাইরের নিকট ঘনিষ্ট হওয়াতে নিজেকে বিশাল দোষ দেয়।অতঃপর মস্তিষ্কে যা আসে,তাই পদক্ষেপ নেয় মেয়েটা।বড়রা এমন ঘটনা জানলে তাহুরাকে নিশ্চয় খারাপ,বাজে মেয়ে বলবে। উমাইরকে দেখা করার কথা সেই বলে আজ।তাই তাহুরা ভয় বেশি পায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাহুরা দুজনের অনুভূতি বুঝে এবং সম্মান করে।তাদের এই সম্পর্ককে নোংরা ভাবুক,এমনটা ইহকালে চায় না তাহুরা।সরল মেয়েটা দুজনের সম্মান নিয়ে চিন্তিত,হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কাবু।
উমারের কথায় তাহুরার সত্তা কুঁকড়ে উঠে।ততক্ষণে উমাইরের লম্বা হাতের আড়ালে চলে আসে তাহুরা।মেয়েটার আঁখিতে অনুশোচনা।মেজাজের তিক্ততা বৃদ্ধি পায় উমাইরের।তাহুরা তখনো ছটফট করা অবস্থায় জবাব দেয়,

–“ছাড়ুন প্লিজ।এইসব ঠিক না।বড়রা জানলে আমাকে খারাপ মেয়ে ভাববে।”
ফোঁপায় মেয়েটা।তার এহেন ভেঙে পড়া কান্না উমাইর কখনো দেখেনি।বা হাত অনবরত কাঁপছে তাহুরার।মুহূর্তেই তাহুরার গাল চেপে ধরে উমাইর,
–“বড়রা কখনো বাজে বলবে না।আমি তোমার….”
–“নাহ,আমি কিছু শুন…শুনতে চাই না।প্লিজ,আমাকে ছাড়ুন।কাছে আসবেন না এতো।আমাকে ন…ষ্ট মেয়ে বলতেও ভাব…বে…”
বাকি কথা আওড়ায়নি তাহুরা।উমাইর তার দানবীয় হাত শূন্যে তুলে।কর্কশ ভাষায় আওড়ায়,
–“তাহুরা!”

পলক ঝাপটিয়ে তাহুরা মুখ চেপে ধরে নিজের।নিঃশ্বাস আটকে আসার জোগাড়।ভুল বলেছি কি সে?না।ভুল।নয়।লোকটাকে দেখতে চাইলেও,এমন কাছাকাছি এসে যাবে তারা তাহুরা আয়ত্বে আনেনি।পূর্বেও উমাইরের কড়া যত্ন সাদরে গ্রহণ করলেও,আজ সীমা পার হয়।সম্পূর্ণ দোষ নিজ কাঁধে তুলে মেয়েটা।সেদিনের ঘটনার জের এবং আজকের এহেন ঘটনায় তাহুরা বড্ড বিচলিত,বারংবার ভাবে বিরাট পাপ!
উমাইর তাহুরার গলায় হাত রাখে।অনেকটা চাপ দেয়,

–“আগে কখনো কাছাকাছি এসেছি আমি?হ্যাঁ?এসেছি এতটা কাছে?এখন কাছে আসার কারণ নিশ্চয় ছিলো!আমার ভেতরের উত্তেজনা তোমাকেই সামলাতে হবে,তাই আগে থেকে তোমাকে আমি সহজ হওয়ার জন্যে কাছে এসেছি।কারণ,আমার অধিকার আছে।”
পরক্ষণে উমাইর তার পাঁচ আঙুল এক করে তাহুরার কপালের কিনারায় মৃদু টোকা দেয়,

–“কারণ আমি তোমার ফিয়োন্সি।দুই পরিবার কথাটা জানে।ফ্যামিলি গত আমরা এনগেজড।”
উমাইরের মুখশ্রী ক্রোধে রক্তিম। ধীম আলোয় সেই চেহারা আরো করুণ দেখায়।তার একেকটা বুলি তাহুরার হৃদযন্ত্রে হানা দেয়।উমাইর পরোয়া করে না।মেয়েটার ভীত,চমকিত রূপে আরো উন্মাদ হয়।তাহুরার হাত টেনে উঁচু করে,
–“রিংটা আমার নামে পড়ানো হয়েছে।”
–“আমি…আমি কিছু জানিনা কেনো?আমার ভুল…”

–“আমাকে চরিত্রহীন মনে হয়?হ্যাঁ?আমি ক্যারেক্টারলেস?তোমার ফায়দা নিতে চাই?এগুলো বলতে চাচ্ছো তাই তো?(জানিনা,তোমার ভুল) এইসব কথা বলা বন্ধ করো।যা ভুল হয়েছে আমি করছি।”
তাহুরাকে থামিয়ে বলে উমাইর।

ভয়ে আরো গুটিয়ে যায় আদুরে মেয়েটা।দুইহাত এক করে ক্ষমার ভঙ্গিমা করলে উমাইর উল্টো দিকে মুখ করে।কান্ড জ্ঞান হারাচ্ছে সে।তাহুরার বুলি ফুরিয়েছে।আপাতত উমাইর তার বাগদত্তা,তাদের পারিবারিকভাবে বিয়ে ঠিক আছে ব্যাপারগুলো হজম হলেও,উমাইর তার সহিত বিরাট ভুল বুঝে,মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না।
অন্তরের গহীনে তার হাহাকার।কি বিষাদ অনুভূতি!ত্রস্ত পায়ে হেঁটে উমাইরের নিকট যায় তাহুরা। আঁকড়ে ধরে তার টিশার্ট এর অংশ।আহত সুরে বলে,

–“এই যে!”
উমাইর পেছন ফিরে।এলোমেলো অবয়বের কান্নারত রমণীতে আহত হয়।
–“হিসাবটা অনেক বড় অংকের।বিয়ের জন্যে তৈরী থাকো।সকালে,আমার সব স্পর্শ হালালের খাতায় উঠে যাবে।”
তাহুরার সুন্দর আঁখিদ্বয় বিস্ফোরিত। মোটা অশ্রু বহমান।গাল দুটো নড়ে উঠলো আতংকে।দৃষ্টি বিভোর সম্মুখে দাঁড়ানো বিশালদেহী প্রিয়তমের অবয়বে।

ক্লান্ত হয়ে উঠে তাহুরার সত্তা।কেঁদে মেয়েটা জর্জরিত।কিছু ভাবার জন্যে মস্তিষ্ক আর সায় দিচ্ছে না।
হুট করে অনুভব করে উমাইর বেশ কঠোর ভঙ্গিতে এগোয়।তাকে তুলে নেয় কাঁধে। পেটের মধ্যখানে পীড়া।তোয়াক্কা করলো না উমাইর।তার আত্মসম্মানে আঘাত পেয়েছে।জখম সারবে জিদ মিটিয়ে।
মায়ের কক্ষের সম্মুখে নামালে তাহুরা ভেজা গলায় শুধায়,

–“বিয়ে!কেমনে কি?বাবা, মা কেউ তো নেই দেশে।আমি দুঃখিত সবকিছুর জন্যে।”
–“চুপচাপ ভেতরে যাও।আমার ভেতরকার আগুন সহজে নিভে না।তোমার দুঃখিত,তোমার কাছে রাখো।”
উমাইর দরজার হাতল চেপে সটান ভঙ্গিতে দরজা খুলে।ফের তাহুরার বাহু টেনে কক্ষের ভেতরে ডিঙিয়ে প্রবেশ করায় তাকে,

–“শেষ ঘুম দিয়ে নাও সিঙ্গেল মাথামোটা হিসেবে।”
এক অন্যরকম ঝটকা অনুভব করে তাহুরা।শিরশির করে তার সর্বাঙ্গ। এই উমাইরকে চিনে না তাহুরা।অধর তার থমথমে।এক মিনিট ব্যয় না করে উমাইর প্রস্থান ঘটায়।

তাহুরা মেনে নিতে পারছে না কিছু।কি থেকে কি হলো?লোকটা হাসিখুশি ছিলো,চিন্তিত ছিলো শেষে তাহুরার জন্যে আবার বিরাট সিদ্ধান্ত নিলো।গলা পাকিয়ে কান্নার দল উপচে আসছে।মেঘলা শুনবে বলে ফের নিজেকে সামলাতে চায় সে।কিন্তু পারে না।দ্রুত ওয়াশরুমের পানে ছুটে।দরজা বন্ধ করে মেঝেতে বসে পা গুটিয়ে।নিঃশব্দে বিসর্জন দেয় দুঃখিত অশ্রুর।নিজেকে অপরাধী মনে হয় তার। উমাইরের সেই করুণ কথা, করুণ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ভাবলে অন্তরে প্রদাহ সৃষ্টি হয়।কেশে উঠে তাহুরা বারংবার।বুঝতে পারে মনের উত্তাপের সহিত বাড়ছে গায়ের উত্তাপ।
অস্ফুট সুরে মেয়েটা আওড়ায়,

–“আপনি কি আমাকে কখনো ক্ষমা করবেন না,এই যে?”
কক্ষে ফিরে সর্ব প্রথম উমাইর ফোন করে রনিকে।তাহুরা তার মস্তিষ্ক নড়বড় করার অন্যতম কারণ।রাগ উন্মোচনের জন্যে দুবার দেওয়ালে আঘাত করতে গিয়েও ফিরে আসে সে। কাল তার ট্রেনিং।প্রফেশনের দিকে কোনো এক্সকিউজ উমাইর দেয় না।
গজগজ করা অবস্থায় উমাইর নিজের ঘাড়ে হাত ঘষে। ঘাড়ের উপরিভাগের চুল টানে।রনি ফোন ধরে মিনিট পাঁচেক পর।সাথে সাথে ফোঁসে উঠে উমাইর,

–“তোর কাজিনকে বল সকালে আমার বাসায় আসতে।আমি আমার আর তাহুরার ইনফরমেশন হোয়াটস অ্যাপ করছি।তুইও সাথে আসবি। আই ওয়ান্না ম্যারি হার।”(আমি তাকে বিয়ে করতে চাই)।
–“কিইই দোস্ত?কি করছোস তুই ভাবীর সাথে? হঠাৎ বিয়ে?কাগজ কেমনে রেডি হবে জলদি?”
রনি যতস‌ই অবাক।
–“আমি ডাবল পেমেন্ট করবো।জাস্ট সকালে আমার বাসায় আসবি।”
গম্ভীরতা উমাইরের সত্তায়।

–“তা বুঝলাম।কিন্তু হয়েছে কি?তুই কন্ট্রোল করতে…”
–“রনি!মেজাজ খারাপ আছে,আর খারাপ করবি না।”
তার চিৎকারে রনি দমে যায়।বন্ধুকে আশ্বাস দেয় কাজ হয়ে যাবে।
ব্যস, উমাইরের রুহতে পানি আসে।

ট্রাভেল ওয়েবসাইটে ঢুকে ঢাকার উদ্দেশ্যে টিকিট কনফার্ম করে।কলেজের গ্রুপে ঢুকে ব্যক্তিগত জরুরী তলবে কলেজ কর্তৃপক্ষের সহিত যেতে পারবে না,কিন্তু বিকালে ঢাকায় উপস্থিত থাকবে বলে জানায় সে।
সকল নীতি কার্য শেষে উমাইর মোবাইল ছুঁড়ে বিছানায়।পড়নে টিশার্ট খুলে বিছানায় ফেলে। উবুত হয়ে সময় গড়ানোর অপেক্ষা করে।খানিক বাদে মাকে ফোন করবে।তাহুরার মায়ের সাথে জরুরী আলাপ করা দরকার মেঘলার।
উমাইর হাত মুঠ করে।পলক ঝাপটিয়ে বলে উঠে,
–“সরল মেয়ে হয়ে আমাকে কঠোর হতে বাধ্য করেছো তুমি,তাহু।”

মেঘলা উমাইরের বক্তব্যে অবাক।সে হাত বাড়িয়ে তাহুরার জ্বরের গভীরতা মাপে।মেয়েটা জ্বরে কাঁপছে।ছেলে নিজ মনের খবর জানিয়েছে। অর্থাৎ, বিয়ের কথা।তাহুরার কপালে জ্বর পট্টি দেওয়া শেষে কামরা হতে বেরোয় মেঘলা।ছোট ছেলের কক্ষে প্রবেশ করে স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞাসা করে,

–“আব্বা,মেয়েটার জ্বর।এছাড়া তুমি কাল ঢাকায় যাবে। কিভাবে কি সম্ভব?হয়েছে টা কি?”
–“আমি ওকে বিয়ে করবো ব্যস। এক্সপ্লেনেশন দেওয়া যাবে না।ওর মাকে ফোন করো।মা,আমি জানিনা আমি কি করবো যদি কাল তাহুরা আমার হালাল না হয়!”
ছেলের এহেন ক্রোধ মেঘলা বহু বছর পর লক্ষ্য করেছে।তার শান্ত,গম্ভীর ছেলেটার হঠাৎ ক্রোধ বাড়ার কারণ কি?নিশ্চয় কিছু বিরাট ঘটেছে?মেঘলা কিছু বলতে গেলে উমাইর তার মোবাইলের কন্ট্যাক্ট লিস্টে জয়ের ইন্ডিয়ান নাম্বার বের করে। শিউলির সাথে কথা বলার উদ্দেশ্যে জানায়,

–“কথা বলো।উনার মেয়েকে আমার জীবনে চাই হালালভাবে। মুন্সী আংকেলকে জানানোর দরকার নেই। এইভাবেও বিয়েটা ডিসেম্বরে হবে।”
–“কিভাবে কি করবে,উমাইর?”
মেঘলা চিন্তিত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে।
–“রনি ম্যানেজ করবে। শুধু তাহুরার মাকে জানিয়ে রাখো।”
উমাইর কথাখানা হলে ব্যালকনিতে যায়।তার জানা আছে,মা ঠিক ম্যানেজ করবে শিউলিকে।
সকাল নয়টায় পুরো ঘরে ছড়িয়ে পরে উমাইরের সিদ্ধান্তের কথা।সুনেরা অবাকের পর্যায়ে।সে দ্রুত ছুটে তাহুরার পানে।মেয়েটা জ্বরে নুয়ে।মায়া হয় সুনেরার।বোনকে জড়িয়ে ধরে সযত্নে,

–“তাহু,উমাইর ভাইয়া রাতারাতি এমন সিদ্ধান্ত কেনো নিলো?তুই জানিস কিছু?বল আপুকে?”
জ্বরের মাঝেও তাহুরা গত রাতের কান্ড মনে করে ফুঁপিয়ে উঠে। এও বুঝে আজ বিয়েতে মানা করলে,উমাইর তাকে দুমড়ে মুচড়ে নদীতে ভাসাবে।লোকটাকে হারাতে চায় না তাহুরা।আবার এমন অনুভূতিতে বিয়ের কথাটাও হজম হচ্ছে না।তাহুরা কেঁপে উঠে।বোনের হাত শক্ত করে ধরে,

–“আপু,আমি কিছু বুঝছি না।”
–“তুই এখন রাজি না হলে, পরে বিয়ের কথাটা বলি?”
বড় বোনের কথায় আঁতকে উঠে তাহুরা।আজ বিয়েটা আটকানো সম্ভব না।এত দুশ্চিন্তার মাঝে বিয়ের বন্ধনে লোকটা তার হউক,কেনো জানি মন এটা চাচ্ছে।তাহুরা মিনমিন সুরে বোনকে জানায়,
–“উনি যেটা চাচ্ছে সেটা হোক আপু।”

সুনেরা মলিন হাসে।বোনকে বুকে জড়ায়।মায়ের সাথে কথা হয়, মা রাজি।তবে, কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তারা ব্যতীত কেউ যেনো বিয়ের কথা না জানে।মুন্সী শুনলে ভদ্রলোক বিরাট কষ্ট পাবে।
সকলের ধারণা নিশ্চয় উমাইর,তাহুরার মাঝে কিছু হয়েছে,যায় দরুণ উমাইরের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া।উমাইর ম্যাচিউর ছেলে,জেনেশুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে অবশ্যই।মেঘলা এও জানায়,ইমনের বাড়ি বা জাফরানের বাড়ি,কাউকে ব্যাপারটা না জানাতে।যা হবে এখন,দুই পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।

তাহুরাকে মাথায় হাত বুলিয়ে খানিকটা তৈরি করে সুনেরা।মেঘলা জানিয়েছিলো খাটে রাখা তার শাড়ি তাহুরাকে পড়াতে।
সুনেরা বোনকে আদর করে,ধীরে উত্তাপে জ্বলন্ত শরীরে লাল শাড়িটা জড়িয়ে দেয়।তাজা ফুটন্ত গোলাপ। নেতিয়ে থাকা আঁখি, ফুলো নাক,জ্বরের কারণে অদৃশ্য আলাদা প্রসাধনী মুখশ্রীতে লেপ্টে থাকলো যেনো।তাহুরা বোনকে খাটে বসায়।কপালে চুমু দেয়,

–“আমার দেবরের আদরের বউ।”
তাহুরা লজ্জা পেয়ে,চোখ মুছে।লোকটা তার সাথে কথা বলুক মনে মনে এটা দোয়া করে।
সময়ের পাল্লার ভারী হয়।ঘড়ির কাঁটা দশটায় এলে রুমে প্রবেশ করে একে একে কাঙ্ক্ষিত মানুষজন।বুকের গভীরে ঢিপঢিপ শব্দ তাহুরার।উমাইর আসে সবার শেষে।তাহুরা তার পা দেখে কেবল।চোখ তুলে লোকটার অবয়ব দেখার সাহস হয়নি।
খাটের কিনারায় উমাইরের সরল লাজুক পরী।আর কিছু সময় পর তার অর্ধাঙ্গিনী হবে।

সকল রাগ,ক্রোধ কই উবে যাচ্ছে কি?কেনো এখন গতরাতের মতো ক্রোধের উত্তেজনা ভর করছে না?তাহুরার মাথা নত।লম্বা চুল ছড়ানো।মাথায় ঘোমটা টানা।মায়ের নির্দেশে পাশে বসে সে তাহুরার।ধীরে পড়ানো শুরু হয় বিয়ে।দুই মানব মানবী তাদের প্রেমময় জীবনের পূর্ণতা দান করে কবুল বলার পর।

তাহুরার কণ্ঠস্বর ছিলো ভঙ্গুর। উমাইরের মায়া হয় প্রচুর।যেহুতু গোপনের বিয়ে তাই উমারদের বাড়ির নির্দেশনা অনুযায়ী,তাহুরার গলায় চেইন এবং হাতে চুড়ি পড়ানো হয়নি।কেবল মেঘলার দেওয়া পাথরের নতুন নাকফুল পড়ায় মেঘলা। উমাইরের অবশ্য কিছু যায় আসে না তাতে।সে মেয়েটাকে নিজের করেছে,ইহা তার কাছে স্বস্থি।ঘড়িতে সময় মাপে উমাইর।

রনি,মেঘলা,নিবরাস মিষ্টি দেওয়া নেওয়া করে।সকলে মিষ্টিমুখ সাড়ে। নিবরাস ছবি তুলে ক্লান্ত নব দম্পতির। আফিয়া আসেনি কক্ষে।সে কেঁদে খুন হচ্ছে নিজ কামরায়।তার তোয়াক্কা করলো না কেউ।অহেতুক কান্না করার কোনো শান্তনা হয় না।
মেঘলা তাহুরাকে আলতো আগলে নেয়।মিষ্টি ভাষায় বলে,
–“খারাপ লাগছে?”

তাহুরা মাথা নাড়ায়।উত্তর দেয়নি।কি বা উত্তর দিবে।সে অনুভূতি শূণ্য।জ্বরের উত্তাপ উমাইর অনুভব করছে।যেখানে তাহুরার কোনো খবর নেই।তার মাথায় একটা কথা ঘুরছে,সে সারাজীবনের জন্যে উমাইরের হয়ে গেলো।উমাইর তাকে নিশ্চয় গত রাতে করা বেয়াদবির জন্যে শাস্তি দিবে!গলা শুকিয়ে আসে তাহুরার।নিঃশ্বাসের পাল্লা ভারী হয়।
–“উমাইর ভাইয়া বেরুবে একটু পর।উনার ফ্লাইট আছে।আপনারা নিচে আসুন নাস্তা করতে।তাহুরা তুই উমাইর ভাইয়ার সাথে কথা বল।”
সুনেরা বলে উঠে মেঘলার ইশারায়।
জুবায়ের কিছু বলতে নিলে চোখ রাঙায় সুনেরা,

–“তোমার জরুরী মিটিং আছে না?খেয়ে অফিসে যাবে।আসো।”
হুরমুড়িয়ে সকলের প্রস্থান ঘটে।
–“উমাইর,ছোট বউকে তোমার রুমে নিয়ে যাও।”
মেঘলা শেষে উপদেশ দেয়।

তাহুরা নাজুক।মাথা উঠিয়ে দেখবে কিনা তার জো নেই।অজানা অনুভূতিরা চারিদিকে হানা দিচ্ছে। চক্ষুদ্বয়ের সম্মুখে উমাইরের শুভ্র হাতখানা অনুমান করে টনক নড়ে তাহুরার।তার উমাইর স্যার,অন্য দিকের সম্পর্কের উমাইর ভাইয়া এখন কেবল উমাইর।তার হালাল প্রিয়তম।
তাহুরা মাথা তুলে তাকায় এইবার।দৃষ্টি মিলে।লোকটার মুখশ্রী ঠিক গত রাতের লাগান। থমথমে। উমাইর ভ্রু কুচঁকায়।লোকের বুলি ফুটে এখন,

–“আমার চওড়া হাতটা কি দেখা যায় না?”
–“জ.. জ্বী।”
তাহুরা ধীরে নিজ হাত উমাইরের হাতের সপে।তাহুরার হাত বেশ ছোটখাটো। উমাইরের চওড়া হাতের মাঝে কেমন হারিয়ে গেলো।
উমাইর তাকে ধীরে উঠায়। হাঁটিয়ে রুমে নেয়।বিছানায় বসায়,পিঠের নিচে বালিশের আবরণ রেখে।
পরক্ষণে মুখোমুখি বসে সে তাহুরার।হাতের উল্টো পিঠে গলা ছুঁয়ে জ্বর পরখ করে,
–“তোমার বাসায় ফেরার আগ পর্যন্ত এই রুমে থাকবে আম্মির সাথে। একটা কাপড় আমার কাবার্ডে রেখে যাবা। চাবি আম্মির কাছে থাকবে।”

তাহুরার মন নরম। সে বেশ বুঝে উমাইর রেগে আছে এখনো।কিঞ্চিৎ উবু হয়ে দুখানা হাত উমাইরের গালে স্পর্শ করে।মানবের কুঁচকানো ভ্রু সমান্তরাল হয় মুহূর্তে।প্রেয়সীর উত্তপ্ত হাতের তালু অগ্নিকুন্ড।
তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জানান হলে উমাইর জিজ্ঞাসা করে,
–“কি?আমি গত রাতের কিছু ভুলিনি।”
–“সরি। সরি উম..মাইর।উমাইর।”
থেমে জবাব দেয় তাহুরা।
নিজ নাম প্রেয়সীর সুরে বেশ সুমধুর। উমাইরের সকল ক্রোধ পানি হতে শুরু করে।

তাও ছেলেটা বললো না এক অক্ষর।বরংচ উমাইর তাহুরার মাথার ঘোমটা সরায়। ঘাড়ে তার দেওয়া চিহ্ন পরখ করে।কালসিটে হয়ে আছে।মন বললো একখান চুমু বসাতে।পাষাণ লোক দমায় নিজের অনুভূতি।
–“সরি দিয়ে কি হবে?যা বলেছো সেটা ভুলতে আমার অন্যকিছু দরকার।যেটা আমি আজ পাবো না।”
উমাইর জানায়।
মেয়েটার শাড়ির আঁচলের কিনারা মেঝে হতে তুলে কোলে ফেলে উমাইর।ব্লাউজ ঢোলা বেশ।গলার নিচের মেয়েলী হাড় বড্ড আকর্ষণীয়।

–“কি চাই আপনার?আমি সত্যি অনেক সরি,উমাইর।”
তাহুরা ফের আওড়ায়।এক হাত এগিয়ে লোকটার বাহু ধরে।
–“যা চায়, তা হাসিল করতে বেশিক্ষণ লাগবে না যদি এইভাবে ডাকো আমাকে।তুমি সরল,আমার মাথামোটা।সময় লাগবে তোমার আমি জানি।”
–“ঠিকভাবে চলবে,থাকবে।তুমি এখন বিবাহিত,আমার বউ।আসছি আমি।”
উমাইর নিজ বক্তব্য শেষ করে।উঠে দাঁড়ায়।চলে যেতে নিলে তাহুরা বসা থেকে সোজা হয়।দ্রুত পায়ে এগিয়ে পেছন হতে জড়িয়ে ধরে উমাইরকে।

শক্তদেহী উমাইর পিঠে নরম আবরণের প্রেয়সীর সংস্পর্শে অনুভব করে পুরুষালি আদিম অনুভূতি।বুকের উপর তাহুরার দু হাত।মেয়েটা শব্দ করে কাঁদছে।মাথা লেপ্টে রাখে তার সুঠাম পিঠের মাঝে।
–“প্লিজ,রাগ করবেন না।আমি আপনাকে ভালোবাসি,উমাইর।”
দুইটা বাক্য।খতম করে উমাইরকে।তার বোকা প্রেয়সী তাকে “ভালোবাসি” বলেছে!মুহূর্তটা উমাইরের সকল ধৈর্য্য ভাঙার জন্যে যথেষ্ট।তাহুরার হাত সরিয়ে পেছন ফিরে উমাইর।লাল টুকটুকে বউটা নাক টেনে অশ্রু ঝরাচ্ছে।উফফ, দিলে হরতাল চলে।দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দ্বারা অশ্রু মুছে।জড়িয়ে ধরে মনেপ্রাণে।এহেন আলিঙ্গনের জন্যে কতো বছর অপেক্ষা করেছে সে, জানে মেয়েটা?বুঝে মেয়েটা?

উমাইরের বক্ষ মাঝারে মুখ গুঁজে সুখের সাগরে ভাসে প্রিয়তমা। ক্ষণে উমাইর তার বক্ষদেশ হতে মুখ তুলে তাহুরার।বেশ খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়ায়।ঘনিষ্ঠ হয় দুজনে।কপালে কপাল ঠেকায়।
–“বোকা মেয়ে,তুমি আমার জন্যে কি, তুমি বুঝো?এই মাথামোটা,আমাকে বুঝো তুমি?শেষ করলে আমাকে এখন? সামলাতে পারবে আমাকে?”

তাহুরা মাথা নাড়ে।
উমাইর হাসে।আজকের সিদ্ধান্তটা তার জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত।মেয়েটার ললাটের মধ্যখানে অধর স্পর্শ করে উমাইর।পরপর তার পুরুষালি অধর ঝাঁপিয়ে পড়ে সদ্য বিবাহিতা বউয়ের নরম তুলতুলে অধরে।তাহুরা নড়ে উঠে। চেপে ধরে উমাইরের শার্ট। অপর পক্ষে উমাইরের এক হাত বিচরণ করে তাহুরার উন্মুক্ত কোমরে,আরেক হাত গলায়,বক্ষদেশে, মেয়েলী কাঠামোয়।
অনুভূতির শীর্ষে তাহুরার শ্বাস আটকে গেলে উমাইর থামে।জড়িয়ে ধরে ফের মনের রাণীকে,

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ২৮

–“তুমি আমার কাছে অনুভূতির জ্বলন্ত এক আগ্নেয়গিরি।যেথায় আমি পুড়তে চাই বারংবার,শতবার।”
তাহুরা তখনো লেপ্টে রইলো উমাইরের আবরণে। ঠোঁটের জ্বলনে অস্থির।কেটেছি কি?লোকটার স্পর্শ সুখ হতে সুখকর।তাহুরা মাথা তুলে তাকালে উমাইর আবারো প্রশান্তির হাসি হাসে। অধর ছুঁয়ে দেয় গালে,
–“যত্ন নিবা নিজের।অকারণে অন্য কারো কথায় কাঁদলে কান টেনে ছিঁড়বো তোমার।আসি,বউ।আমার বউ।”

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ৩০