বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ২৪

বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ২৪
ফাতেমা তুজ নৌশি

মেঘলা বিকেলেই উষশীকে নিয়ে বের হলো অভিরাজ। মেয়েটি এখন ওর প্রেমিকা। এই পরিচয়টা অদ্ভুত রকমের আনন্দ দেয় তাকে। তাকিয়ে থাকার ইচ্ছেটা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মনে হচ্ছে দিনকে দিন আরো বেশি আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে চলছে ওরা। সামনেই বকুল তলা। মাটিতে বকুল ফুলে ছেঁয়ে আছে। ফুল গুলো তুলতে তুলতে একটা গানের লাইন শুনতে পেল।

“বকুল ফুল, বকুল ফুল
সোনা দিয়া হাত কেনও বান্ধাইলি।”
ছোট ছোট কিছু বাচ্চা গানটি গাইছে। তারা একটু দূরের মাচায় বসে আছে। ময়লা ঢিলেঢালা গায়ের পোশাক।
“ওরা ওখানে শুয়ে কি করছে?”
“আড্ডা দিচ্ছে।”
“চলেন না আমরা ও যাই।”
“না,না যাওয়া যাবে না।”
“আসেন না প্লিজ। এমন করেন কেন।”
“ওরা তো শুয়ে আছে।”
“একটু যাই চলেন।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

উষশী’র বায়নার কারণে যেতে হলো। বাচ্চা গুলো এখনো গান গাইছে। তাদের গানের তাল শুনছে দুটো কুকুর।
“তোরা এখানে কি করিস?”
“আড্ডা মা রি।”
“এখন আড্ডা মা রা র সময়? যা,যা বাড়ি যা।”
“এহনি তো আড্ডার সময়।”
বাচ্চা গুলো উঠতে নারাজ। কিছুতেই কিছু বোঝাতে সক্ষম হলো না অভি। উষশীর মুখে মেঘ জমেছে। সে এখানে শুয়ে আকাশ দেখতে চায়। অভি পকেট থেকে পাঁচশত টাকার নোট বের করে বলল,”শোন সবাই।”
বাচ্চা গুলো একটু মাথা তুলল। অভি টাকাটা এগিয়ে বলল,”যা, আইসক্রিম কিনে নিস।”

টাকাটা পেয়ে বাচ্চা গুলোর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারা হৈ হৈ করে চলে যাচ্ছে। হাফ ছেড়ে বাঁচে অভিরাজ। উষশী ভীষণ আগ্রহে তাকিয়ে আছে। মেয়েটিকে উঁচু করে ধরে মাচায় বসিয়ে নিজেও উঠে বসেছে। এখান থেকে চারপাশের সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যাচ্ছে। চারপাশে সোনালী ধান মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই ঘরে ধান তোলা হবে। ধানের একটা সুন্দর গন্ধ আছে। সেই গন্ধটাই এখন উষশী’র নাকে ধরা দিল। সে মুগ্ধতা নিয়ে অনুভব করছে সব। আর অভিরাজ দেখে চলেছে তাকে। মেয়েটির সরু নাকের ডগাটা কিছুটা লাল। ঠোঁট রাঙা থাকে সর্বদা। মনে হয় পদ্ম ফুল। তাকে এভাবে তাকাতে দেখে উষশী বলল,”কি দেখেন?”

“তোমায়।”
“রোজ ই তো দেখেন।”
“হুম। তবে প্রতিবারই ভিন্ন রকম মনে হয়।”
মিটিমিটি হাসছে উষশী। অভিরাজের কথার জাদুতেই ম রে যাবে সে। উষশী হুট করেই মাচায় গা এলিয়ে দিল। একই ভাবে অভিরাজ ও শুয়ে পড়ল। কিশোরীর দৃষ্টি আকাশে থাকলেও অভি’র দৃষ্টি রইল মেয়েটির উপর। সে যত দেখছে তার তৃষ্ণা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সন্ধ্যার কিছু পূর্বে বাড়ি ফিরল ওরা। চুলোয় গরম গরম ছিটা রুটি তৈরি হচ্ছে। তার সাথে রয়েছে দেশি মুরগির রসালো ঝোল। লোভনীয় খাবারের গন্ধে ‘ম’ ‘ম’ করছে চারপাশ। জাবেদ বাজার থেকে রসগোল্লা এনেছেন। এখানকার বিখ্যাত মিষ্টির দোকান থেকে। সেই রসগোল্লার হাড়ি থেকে ইতোমধ্যেই চার খানা রসগোল্লা পেটে চালান হয়ে গেছে ইফতি আর মুস্তফার। তাদেল ঠোঁটের কোণ বেয়ে রস গড়িয়ে পড়ছে। এই অবস্থায় হাতে নাতে ধরেছে রত্না। দুটির কান ধরে বাইরে আনল সে। তারপর হুংকার তুলে সকলকে ডেকে নিল। দুই চোর ছটফট করছে। কিন্তু রত্নার শক্তির সাথে পারছে না ঠিক।

“চাচ্চু রসগোল্লা আনতে না আনতে চারটে শেষ করে দিয়েছে ওরা। এত কষ্ট করে ছোট চাচি লুকিয়ে রাখল তারপরও খুঁজে নিয়েছে!”
জাবেদের স্ত্রী মিফতি দুই ছেলের কান টেনে ধরলেন। বরাবরই এমন করে ওরা। মিষ্টা দেখলে হুস থাকে না। ওদের কান্ডে বেশ আমোদ হলো। মাগরিবের আজান পড়ে যাওয়ায় মুক্ত করে দেওয়া হলো দুজনকে। সন্ধ্যার ঠিক পরেই বাড়ির সব মানুষ এক সাথে হলো। ছিটা রুটি খেতে দেওয়া হলো সবাইকে। তার সাথে দেওয়া হলো মুরগির ঝোল আর আম দুধ। উষশী তাকিয়ে দেখছে কেমন করে খায় এটা। সে ঠিক বুঝতে পারছিল না। অভিরাজ নিজের প্লেট থেকেই ছিটা রুটির সাথে আম দুধ মাখিয়ে উষশী’র মুখে তুলে দিল। সবাই ব্যস্ত থাকায় বিষয়টা কারো নজরে এল না।

মশার কয়েলে উষশী’র অসুবিধা হয়। ধানের সময় হওয়াতে মশা মাছি বেড়ে গেছে। কয়েল এর ধোঁয়ায় ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মেয়েটির। খবরটা ইরা দিতেই রাতের আধাঁরে বেরিয়ে পড়েছে অভিরাজ। প্রায় তিন ঘন্টার পথ পেরিয়ে ওডোমস নিয়ে এসেছে। উষশী এতে একটু রাগ করল। ছেলেটির বুকের কাছটা খামচে ধরে বলল,”এখানকার রাস্তাঘাট কতটা ভয়ঙ্কর দেখেছেন? এই রাতে কেউ এমন পাগলামি করে?”

এমন কথায় অভিরাজ গা দুলিয়ে হাসল। মেয়েটির চুল গুলো মুঠোয় নিয়ে ঘ্রাণ নিল বুক ভরে।
“এত অদ্ভুত কেন আপনি?”
“তোমার এই ব্রাউন চুলে নিশ্চয়ই মাদক রয়েছে উষশী। যখনি দেখি তখনি আমায় ঘোরে ফেলে দেয়।”
“আপনি পাগল অভিরাজ।”

এই তো প্রথমবারের মতো অভি’র নাম উচ্চারণ করেছে উষশী। কিশোরীর এমন বাক্যে অবাক হয়ে রইল সে। উষশীও যেন একটু অন্যমনস্ক ছিল। তখন খেয়াল হয়েছে তখন ভীষণ অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে। একটু পরই অনুভব হলো ছেলেটার শক্ত শীতল হাত ওর কোমর ছুয়েছে। হাল্কা চাপে কাছে টানছে সে।
“এভাবেই পাগল করে দিবে রেইন?”
“পাগল তো আপনি করে দিচ্ছেন আমায়।”
“দুজনেই পাগল হলে সংসার হবে কেমন করে?”
“পাগলরা বুঝি সংসার করতে পারে না?”
“কে জানে।”

ছেলেটির খোঁচা দাড়ির আন্দোলন অনুভব হচ্ছে ঘাড়ে। ক্রমশ তা নিচের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। একটা শির শির অনুভূতি বয়ে চলেছে সর্বাঙ্গে।
“শুরুর দিকে তোমার সাথে আমার বনিবনা হচ্ছিল না। তোমাকে আনতেই চাচ্ছিলাম না। অথচ সেই ঝড়ের রাতেই তোমার জন্য ঔষধ আনতে বের হয়েছিলাম। তখন কি পরিমাণে ঝড় ছিল তবু পিছিয়ে যাই নি। আর এখন তো তুমি আমার ভালোবাসা উষশী। তোমায় এক বিন্দু কষ্ট পেতে দিব না।”

এত সুখে উষশী ভেসে যাচ্ছে। তার জীবনের সব না পাওয়ার মাঝে অভি যেন অনন্য। সে কিছুতেই মানুষটাকে ছাড়তে চায় না। একটা লম্বা জীবনের স্বপ্নে তার ভেতরটা ক্রমশই আন্দোলিত হয়ে উঠছে।
চা দিতে এসে রত্না দেখল ফোনে কিছু দেখছে ঈশান। সে খুব লুকিয়ে দেখতে গিয়েও পারল না। চট জলদি উঠে পড়ল ছেলেটা। শরীরে তার শার্ট নেই। গরমের কারণে খুলে ঘুমিয়েছিল। সেটা পরতে পরতে শুধাল,”চা দিতে এসেছ?”

“হু। আম্মু পাঠাল। গত রাতে আপনার নাকি কাশি হচ্ছিল।”
“অল্প।”
“আদা চা এনেছি। খেলে ভালো লাগবে।”
চা নেওয়ার পর ও কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইল রত্না। তারপর প্রশ্ন করল,”ফোনে কার ছবি দেখছিলেন? গার্লফ্রেন্ড বুঝি?”
“উহু। একটা চাঁদ দেখছিলাম।”
“চাঁদ!”

“হুম। চাঁদ দেখছিলাম আর ভাবছিলাম আমি গরীব বামন বিধায় চাঁদটা আমার নয়।”
শক্ত কথা গুলো একটুও বুঝল না রত্না। সে বারান্দার দরজা খুলে দিয়ে গাছ গুলোকে পানি দিল। ভেজা তোয়ালেটা সরিয়ে বলল,
“বিকেলে মেলা আছে। বছরের সব থেকে বড়ো মেলা। মিস করিয়েন না।”

একটা প্ল্যান করেছে অভিরাজ। সবাই মেলা দেখতে গেলে সে উষশীকে নিয়ে অন্য কোথাও ঘুরতে যাবে। এখানে এত বেশি সীমাবদ্ধতা যে মেয়েটির সাথে কথা বলার ও তেমন সুযোগ নেই। গ্রামের পথে তো হাত ধরলেও ঝামেলা। দুপুরে খাবার সবাই একসাথে খেল না। মেলার জন্য সকলেই বেশ তাড়ায় আছে। উষশী’র কাছে মেলা মানে অনেক গুলো ছোট ছোট স্টল। গ্রাম্য মেলা তার নিকট একটা কৌতূহলের বিষয়। রত্নার থেকে মেলা সম্পর্কেই শুনছিল সে।
“জানো তো উষশী। আমাদের গ্রামে এই মেলাটার জন্য খুব অপেক্ষা করে সবাই। পুরো মাঠ জুড়ে ছোট ছোট দোকান বসে। নাগরদোলা,গরু দৌড়,নৌকা বাইচ আরও কত কি হয়। রাতের বেলা আবার যাত্রাপালা। কি যে মজা।”

আগ্রহ নিয়ে শুনছে উষশী। রত্না আসলেই মিশুক প্রকৃতির মেয়ে।
“তুমি গ্রামের মেলা দেখেছ?”
“না। কখনোই দেখি নি।”
“যাত্রাপালা?”
“সেটাও না।”

বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ২৩

“আহারে। তুমি তো তাহলে এসব খুব মিস করে গেছ। এবার দেখে নিবে। খুব মজা হয়।”
“লাবণ্য আপু বলছিল তোমরা সবাই নাকি শাড়ি পরবে।”
“হ্যাঁ। প্রায় সব মেয়েরাই শাড়ি পরে যায়। এই দিনটা অনেক স্পেশাল বুঝলে।”
রত্নার কথা গুলো বেশ ভালো লাগছে উষশী’র। সব কেমন কল্পনা মনে হচ্ছে। আসলেই সব সত্যি তো?

বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ২৫