বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ৪২

বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ৪২
ফাতেমা তুজ নৌশি

“আমি খুব বাজে হয়ে গিয়েছি তাই না? কথা বলেন না কেন? আমাকে বাজে দেখাচ্ছে নিশ্চয়ই? খুব বিশ্রি। লাইক বিস্ট? খুব খারাপ দেখাচ্ছে আমায়। আপনি আমাকে আর ভালোবাসবেন না তাই না? একটা বাজে দেখতে মেয়েকে কেন কাছে টানবেন।”

অতীতে বলা উষশী’র কথা গুলো স্মরণ হতেই মৃদু আন্দোলিত হয়ে ঘুম ছুটে গেল অভিরাজের। কিছু সময় ধরে চোখ লেগেছিল তার। সামনেই শুয়ে আছে উষশী। মেয়েটার হাতে ক্যানলা। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। কতটা বাজে সময় যাচ্ছে বলার মতো না। শরীরের বেশ কিছু জায়গায় আ ঘা ত লেগেছে। শ্বেত রঙা শরীরে ফুটে উঠেছে সেসব। অভি’র ভেতরটা চৌচির হয়ে এল। বাদামি রঙা চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শান্ত,ধীর,স্থির কণ্ঠ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

“ইউ আর বিউটিফুল রেইন। ইউ আর এস বিউটিফুল এস আ ফ্লাওয়ার। এস ব্রাইট এস দ্য সান।”
উষশী’র নরম তুলতুলে হাতটা মুঠো বন্দী করল অভিরাজ। সেখানে তার উষ্ণ ঠোঁটের তাপ ছড়িয়ে যাচ্ছে। চারপাশ থেকে মিষ্টি এক সুবাস আসছে। উষশী’র শরীরের মাতাল করা সুবাসটা বরাবরের মতোই উন্মাদ করে তুলে। মৃদু বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর। লাবণ্য বাইরে থেকে দৃশ্যটা দেখতে পেল। গত দিন অভি’র অবস্থা ছিল খেই হারা মাঝির মতো।

মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে উন্মাদের মতো আচরণ করেছিল। লোকজন দেখেছিল এক পাগল প্রেমিকের আর্তনাদ। গতরাত থেকেই উষশী’র পাশে বসে আছে। এখনো জ্ঞান ফিরে নি মেয়েটির। খুব বেশি ক্ষতি না হলেও শরীরের অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। নানান ধরনের নেশা জাতীয় পানীয় আর দীর্ঘ দিন ধরে ড্রাগ নেওয়ার ফলে শরীর দূর্বল হয়ে পড়েছে। সেই জন্যেই জ্ঞান আসতে সময় নিচ্ছে।

লাবণ্য উষ্ণ শ্বাস ফেলে ভেতরে এল। অভি অলসহীন তাকিয়ে। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে যুবতীকে। পাঁচ বছর যেন একটা সংখ্যা মাত্র। এই পাঁচ বছরে মেয়েটির রূপ, জৌলুস কয়েক গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। মনে হচ্ছে মেঘ থেকে নেমে আসা প্রথম জলবিন্দু। কিংবা ফুলের সব থেকে সৌন্দর্য পাপড়ি। খারাপ সময়টাতেও অভি’র ঠোঁটদ্বয় প্রসারিত হলো। শক্ত পোক্ত হাতের থাবাতে উষশী’র ছোট্ট নরম হাতটা আরো বেশি করে জড়িয়ে নিল।

“ফ্রেস হয়ে নে।”
“হুম।”
অভি চলে যেতেই পাশে বসল লাবণ্য। উষশী যেন ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটির রূপ লাবণ্য একটুও কমে নি। এই যে এতটা ঝড় নেমে গেল তারপরও কতটা স্নিগ্ধ লাগছে ওকে। অভি ফ্রেস হয়ে এসেছে। তার শরীরটা মৃদু দুলছে।
“খাবার আনতে দিয়েছি। জানি বাইরে যাবি না।”
এ কথার পৃষ্ঠে কথা বলল না অভিরাজ। সে উষশী’র প্রসঙ্গে চলে গেল।
“ওর জ্ঞান কখন ফিরবে?”

“ডাক্তারের সাথে আলোচনা করেছি। বলেছে আরো কিছুটা সময় লাগবে। অত বড়ো ঘটনার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। শরীরের বিরাম প্রয়োজন।”
“হুম।”
“ছোঁয়া অর ঈশানের ব্যাপারে সবটা জানতি?”
“শুরুতেই জানতাম না। ছোঁয়া’র সাথে অলকের সম্পর্ক হওয়ার পরে জেনেছি। যদিও ঈশানের অনুভূতি ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিল। প্রথমে ধরতে পারতাম। তবে ওর ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম না।”

“তারপর কিভাবে নিশ্চিত হলি?”
“উষশী বলেছিল।”
“উষশী!”
“হুম। কেমন করে যেন বুঝে গিয়েছিল। তবে তখন কিছু করার ছিল না। ভেবেছিলাম ছোঁয়া জীবনে এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওদের সম্পর্কটা যে জোর করে করা সেটা জানা ছিল না। তাছাড়া চাচ্চু আর মেঝো মা চায় নি ছোঁয়া তাদের ছেলের বউ হোক।”

লাবণ্য হতাশার নিশ্বাস ফেলল। ছোঁয়াকে কত আদরে বড়ো করা হয়েছে। সর্বদা মেয়ের মতো আদর দিয়েছে। অথচ ছেলের বউ হিসেবে নাকি মেনে নিতে পারছিল না। সত্যিকার অর্থে মানুষ স্বার্থপর। এর মধ্যেই খাবার এসে গেল। লাবণ্য খাবার বেড়ে এগিয়ে দিল।

“তুই ও খেয়ে নে। আমার জন্য অনেক প্রেসার যাচ্ছে তোর।”
মৃদু হাসল লাবণ্য। অভি’র জন্য তার ভেতরটা সবকিছু করতে প্রস্তুত। খাওয়া শেষে ঈশানের নাম্বারে ডায়াল করল অভিরাজ। ছেলেটা ওর কল ঠিকই রিসিভ করল।
“বাড়ি ফিরছিস না কেন?”
“আমার কেউ নেই ব্রো। আমি একা। কেউ নেই আমার।”
“এসব বলতে নেই। যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। তুই ফিরছিস। আর সেটা ও খুব দ্রুত।”
“সম্ভব না ব্রো।”

“ফিরে এসে বাড়িতে দেখতে চাই। সব শেষে পরিবারটা ঠিক থাকা চাই। ছোঁয়া যেন কখনো না ভাবে তার জন্য পরিবারটা ভেঙে গেল।”
অভি কল কেটে দিল। ঈশান শান্ত সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর হৃদয়ের যন্ত্রণাটা কেউ বুঝে না।

উষশী’র জ্ঞান এল দুপুরে। অভি তখন কাছে ছিল না। মেয়েটার মৃদু গোঙানি শোনা যাচ্ছে। শুরুতেই দেখা মিলল লাবণ্য’র। তার কোটরে যাওয়া দুটি চোখ। উষশী তার ঘোলাটে মনির দৃষ্টি দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। সূর্যের আলো দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ এখন রাত নয়। বারের ঘটনার পর আর কিছুই স্মরণ করতে পারছে না। বেশ চাপ সৃষ্টি হলো মস্তিষ্কে। ওর অবস্থা বুঝতে পারছে লাবণ্য। কাছে এসে আদুরে হাতে গাল স্পর্শ করল। মেয়েটির কোমল ত্বকের উষ্ণতা অনুভব হলো। সেই সাথে মৃদু হাসির উদয় ঘটল অধরে।

“কেমন লাগছে বাবু?”
উষশী ধীর স্থির ভাবে তাকাল। লাবণ্য তাকে বাবু বলে ডেকেছে। তারমানে কি সে কিশোরী বয়সে ফিরে গেছে? এই সেই লাবণ্য যাকে দেখলে মন ভালো হয়ে যেত ওর। আর অভি, সে কোথায়?
“অনেক দিন পর হালকা অনুভব হচ্ছে উষশী। তোমাকে পুনরায় ফিরে পাওয়ার আনন্দ অনুভব হচ্ছে।”

উষশী একটা কথাও বলল না। আসলে তার মুখ থেকে বাক্য উচ্চারণ হচ্ছে না। সে চেয়ে রইল। তারা বাদামি রঙা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। ফ্যাকাশে ঠোঁট। যেন নেতিয়ে যাওয়া গোলাপের শেষ পাপড়িটি। অভি’র প্রবেশ ঘটল কিছু সময় পর। উষশী তখন আধ শোয়া হয়ে। লাবণ্য নেই। সে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গিয়েছে। আয়নায় অভি’র ছবি দেখা যাচ্ছে। শিউরে উঠল উষশী। তাকাল ঝটপট। যতটা সম্ভব। অভি’র ভেঙে পড়া মুখটা নজর কেড়েছে। চোখের দৃষ্টিতে ব্যথা অনুভব হলো। মনে হচ্ছে পাঁচ বছর পূর্বে ফিরে গিয়েছে ওরা। অস্পষ্ট স্বরে ডাকছে মেয়েটি। দূর থেকেই অভি বলল,”চুপ করে বসে থাকো।”

উষশী তাই করল। নড়ল না অবধি। অভি ভেতরে এসেছে। তার চলন বলন যেন শান্ত সমুদ্রের মতো। হাতে ব্যন্ডেজ নিয়েই এগিয়ে এল ছেলেটা। দু হাতের সাহায্যে স্পর্শ করল মেয়েটির মুখ।
“তোমার কিছু হয়ে গেলে অভিরাজ ম রে যাবে রেইন। কোনো কিছুর বিনময়ে তোমাকে হারাতে চাই না। আমি বড়ো ভালোবাসি তোমায়।”

উষশী উত্তর করছে না। তার চোখে জল। লাবণ্য খানিক বাদে এল। ততক্ষণে অভি তার চোখের জলটুকু মুছে নিয়েছে।
“কোকো কে অবজারভেশনে রাখা হবে।”
প্রাণীটার কথা স্মরণ হতেই আতকে উঠল যুবতী। অভি উঠে গিয়েছে। সে দেখল উষশী কিছু বলতে চাইছে। তবে অতিরিক্ত উত্তেজনায় বলতে পারছে না। অভি ওর মুখের ভাষাটা যেন বুঝে নিল। হাত দুটো বাড়িয়ে বলল,”কোকো ঠিক আছে।”
উষশী’র দু নয়নে জল চকচক করছে। স্মরণ হচ্ছে সেই সময়টার কথা। প্রাণীটাকে প্রথমবারের মতো বারে নিয়ে এসেছিল। কে জানত সেদিনই দূর্ঘটনাটা ঘটে যাবে। সব থেকে বড়ো কথা উষশীকে রক্ষা করতে গিয়ে আ ঘা ত পেয়েছে কোকো। প্রাণীটা যদি ছুটে এসে ওর উপরে গিয়ে না পড়ত তবে উষশী’র জীবন বাঁচানো মুশকিল হয়ে যেত।

দুপুরের শেষ সময়ে কথা বলতে পারল উষশী। খুব বেশি নয়। শুধু বলল,”অভিরাজ, একটু এদিকে আসবেন।”
মেয়েটির কণ্ঠ পেয়ে ঝড়ের গতিতে ছুটে এল অভি। তারপর দুটো হাত বাড়িয়ে দিয়ে শুধাল,”কি হয়েছে উষশী?”
“আপনার ফোনটা দেওয়া যাবে?”

বাক্যটি শেষ হতেই নিজের ফোন এগিয়ে দিল উষশী। তারপর অনেকটা সময় নিয়ে কি যেন করল। অভি একটা কথাও বলল না। কি করছে প্রশ্ন ও করছে না। শুধু তাকিয়ে দেখছে মেয়েটির অবস্থা। বেশ কিছু সময় গেলে উষশী’র উষ্ণ শ্বাস নেমে এল। সেই সাথে নেমে এল চোখের জল।

বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ৪১

“মম কে বাঁচানো গেল না। এই পৃথিবীতে এতিম হয়ে গেলাম আমি।”
কথাটা বোধগম্য হলো না অভিরাজের। মেয়েটি সম্পর্কে খুব বেশি জানা নেই। অথচ বুকের ভেতর আকাশসম ভালোবাসা। আর সেই ভালোবাসার অধিকার থেকেই শক্ত হাতে জড়িয়ে নিল বুকে। মেয়েটির শরীর থেকে ভেসে আসা ফুলের সুবাস যেন প্রাণ ভরে মেখে নিচ্ছে। খুব করে মন চাইল যদি সময়টা এভাবেই থমকে যেত।

বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব ৪৩