ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩৭

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩৭
সাইয়্যারা খান

বেশ সকালেই ঘুম ভেঙে গেল রোদের। অতি ক্লান্ত শরীর কাল একটু বিছানার ছোঁয়া পেতেই ছেড়ে দিয়েছিলো। ঘুমটা বেশ হয়েছে তার প্রমাণ সরুপ গালে, হাতে ঘুমের দাগ পড়েছে। রোজকার মতোই শক্ত হাতের বন্ধনীতেই আবদ্ধ ছিলো। নিজেকে ছাড়িয়ে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে কিচেনে ডুকে পড়লো রোদ। এখনও পুরোপুরি আলো ফুটে নি।

এমনি সময় তো বুয়াই নাস্তা তৈরী করে ওটাই খাওয়া হয়। আজ যেহেতু রোদ বাসায় আছে তাই নিজে বাচ্চাদের জন্য রান্না করবে। যেই ভাবা সেই কাজ। পানি বসিয়ে কফিটা করে ফ্লাক্সে ডেলে আলুর পরটা বানাতে ব্যাস্ত রোদ। লাস্ট দুটো বাকি এমন সময় কেউ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। রোদ অল্প ঝটলা খেলেও নিজেকে সামলে নিলো। আদ্রিয়ান ওর কাঁধে মাথা দিয়ে পেট জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। রোদ কোন কথা না বলে নিজের মতো কাজে ব্যাস্ত। আদ্রিয়ান বউ থেকে পাত্তা না পেয়ে মুখটা উঁচু করে গলায় চুমু খেয়ে আদুরে গলায় ডাকলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— বউ?
উত্তর না দিয়ে পরটা উল্টালো রোদ। আদ্রিয়ান হতাশ হলো কিন্তু দমলো না। আবারও গালে চুমু খেয়ে বললো,
— এই বউ, রাগ কমেনি? আমি অনেক সরি তো। আচ্ছা, কি করলে রাগ কমবে?

রোদ হাতের গোলাটায় আটা ছিটিয়ে বেলতে নিবে এমন সময় আদ্রিয়ান রোদের হাতের উপর নিজের হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রোদের তবুও কোন সাড়া না পেয়ে আদ্রিয়ানের এবার মন খারাপ হলো। কি দরকার ছিলো রাগের মাথায় ঐসব বলা? এখন কে সাফার করছে? আদ্রিয়ান ই তো। আদ্রিয়ান তবুও প্রচেষ্টা চালালো রোদকে মানানোর। অথচ রোদ তো মেনেই আছে। কি আর মানবে? আদ্রিয়ানকে সরতে না দেখে হাতে থাকা আটা ওর গালে লাগিয়ে দিলো। আদ্রিয়ান বুঝলো দুষ্ট বউ আগেই রাগ ভুলেছে এতক্ষণ ওকে হেনস্তা করছিলো। আদ্রিয়ান ও হাতে অল্প আটা নিয়ে রোদের গলায় মাখিয়ে দিতেই চেঁচিয়ে উঠলো রোদ,

— এই কি করেছেন? সরুন। আজাইরা। কাজ করছি না আমি।
আদ্রিয়ান বউয়ের ঝাঁড়ি খেয়েও থামলো না। গলায় আদর করতে ব্যাস্ত সে। রোদ তখন শেষ পরটা টা নামালো। ভেজিটেবল রান্না করবে এখন তখনই গ্যাসটা অফ করে দিলো আদ্রিয়ান। রোদ ছাড়াতে চাইলেও পারলো না। আদ্রিয়ান ফিসফিস করে বললো,

— বউ বাচ্চাদের উঠতে এখনও অনেক দেড়ী।
রোদ কিছুটা রাগী কন্ঠে বললো,
— তো কি? ছাড়ুন।কাজ করছি না আমি?
— উহুম। এখনও অনেক সকাল।
কথাটা বলতে বলতে দুষ্ট আদ্রিয়ান দুষ্টমিতে ব্যাস্ত হলো। রোদ নিজেও তখন কিছুটা বেপরোয়া হলো। তবুও মুখে বললো,
— তাতে কি?
আদ্রিয়ান ফট করে রোদকে কোলে তুলে নিয়ে বললো,
— না বলে দেখাচ্ছি চলো।

সকাল সকাল ভালোবাসার মুহূর্ত কাটলো দুজন। রোদ গুটিয়ে শুয়ে আদ্রিয়ানের উন্মুক্ত বক্ষে। আদ্রিয়ান ব্যাস্ত রোদের মাথায় বিলি কাটতে। এতসব সুখ লুকিয়ে এই রোদের মাঝে। সবটুকু সুখ শুধু আদ্রিয়ানের জন্য। ভোরের আলোর ন্যায় সিগ্ধ এই সুখ। দিনের সাথে সাথে এর উষ্ণতা শুধু বাড়েই বৈ কমে না। যতটা কাছাকাছি থাকা যায় ততটাই গভীরতা অনুভব করা যায়। একদম যেন একটা সুখ পানি যে কি সুদূর থেকে এসেছে শুধু মাত্র আদ্রিয়ানের জন্য।

আদ্রিয়ানের বেরং জীবনটাকে রঙিন আঁচড়ে রাঙিয়ে দিবে বলে। ভিন্ন রং এর দেখা দিবে বলে। এই যে আদ্রিয়ান পাগল পাগল হয়, কখন হয়? এই রোদকে অতি কাছে পেলেই তো হয়। যখন রোদ নিজেকে আদ্রিয়ানের জন্য বিলীন করে দেয় তখন আদ্রিয়ানের সুখটা যেন আকাশচুম্বী হয়ে উঠে। এত এত সুখ রাখার যোগার হ’য়ে উঠে না। উত্তাল ঢেউয়ে যেন ভেসে যায় আদ্রিয়ান। ভাটার পর জোয়ার আসার অনুভূতির ন্যায় এই ভালোবাসা। একদম ভেজা ভেজা। কখনো কাঁচা তো কখনো মিঠা। যেমন এখন মিঠা মিঠা অনুভূতি হচ্ছে।

আদ্রিয়ান ঘড়ির দিকে তাকালো। সকাল ৭ টা এখন। রোদের উঠার নামও নেই। অতি ভালোবাসায় দিক হারা এই মেয়ে। অল্পতেই যেন গলে যায়। কোথায় যাবে আদ্রিয়ান একে নিয়ে। মোমের পুতুল এটা আদ্রিয়ানের। যার সানিধ্য পেয়ে আদ্রিয়ান নিজেও গলে যায়।
রোদকে উঠানো প্রয়োজন এখন। আদ্রিয়ান ওর কপালে চুমু খেয়ে বললো,
— সোনা উঠবে না?
রোদ নিজেও একটু মাথাটা উঁচু করে আদ্রিয়ানের গালে চুমু খেয়ে বললো,
— উহুম।

আদ্রিয়ান হাসলো। এতক্ষণ আনা যাচ্ছিলো না এখন উঠবে না। কি আর করার? টেনে নিজের উপর তুলে নিয়ে বললো,
— এই দুষ্টু পাখি, তোমার এতসব দুষ্টামী আর পাজি পানা শুধু আমার সাথেই কেন?
রোদ মুখটা আদ্রিয়ানের দিকে এগিয়ে নিয়ে বললো,
— তো কার সাথে করবো?
আদ্রিয়ান তাকালো রোদের দিকে। নিজেও মুখটা এগিয়ে নিলো। অল্প সল্প ভালোবাসা বিনিময় করে রোদকে নিয়ে উঠে গেলো। নাহলে এই মেয়ে সারাদিনেও উঠবে না। যেই দুষ্ট হয়েছে ইদানীং। ভাবতে ভাবতে আদ্রিয়ান নিজেই হেসে দিলো।

দুজন ফ্রেশ হয়ে আসার পর পরই বাচ্চারা উঠে গেল। আদ্রিয়ান নিজেই সবজি আর ডিম করে নিলো। রোদকে এখন কাজ করানো মানেই দূর্বলতা বাড়া। খাওয়ার টেবিলে মিশি মিশান বায়না ধরলো ঘুরতে যাবে। দুই দিন পর পরই এদের এসব বায়না। আদ্রিয়ান হেসে রাজি হয়ে’ছে বাকিটা এখন রোদের উপর। মিশান জানে মা’য়ের সামনে অসহায় চেহারা করলেই মা রাজি হবে। তাই এসব নিয়ে টেনশন নেই।

জারবার সাথে ধুমসে লেগেছে ইয়াজের। ইয়াজ বুঝে না এতবড় ডক্টরও সেখানে এতটুকু মেয়ে ওকে ঝাঁড়ি মা’রে। সবটুকু দোষ ঐ রোদের। আজ যদি রোদ ওকে সম্মান দিতো তাহলে নিশ্চিত জারবাও দিতো। রোদ থেকে সম্মান পাওয়া কল্পনা বৈ কিছুই না। হাজার ভিক্ষা চেয়েও ইয়াজ রোদ থেকে কোন দিন চুল্লু পরিমাণ সম্মান টুকু পায় নি।
ইয়াজ অবাক হয় এটা ভেবে এমনি সময় বলদা হবু বউ ইয়াজকে কোন মেয়ের সাথে দেখলেই ফুঁসে ওঠে। এক কথায় যাকে বলে, “জাতে মতাল,তালে ঠিক”।

দোষটা অবশ্য ইয়াজেরই। কথায় কথায় জরবাকে বলেছিলো হাসবা নামের মেয়েটা ওর পেছনে ঘুরঘুর করে কিন্তু ইয়াজ পত্তা দেয় না। জরবা তখন কিছুই বলে নি কিন্তু যখন শুনলো কাল রাতে ইয়াজ ঐ হাসবার হোস্টেলে গিয়েছিল এটা শুনার পরই ভেজা বিড়ালের ন্যায় মিউ মিউ করা জারবা বাঘিনীর ন্যায় গর্জে উঠেছে। ইয়াজ শত চেষ্টা করেও বুঝাতে অক্ষম। না পেরে রোদকে কল দিয়ে একদফা ঝেঁরেছে, কেন ও ইয়াজকে সম্মান দেয় না? ও দিলে ওর ননদ ও দিতো। রোদ তখন কিছু বলে নি কিন্তু ইয়াজের ঝাঁড়ি দেয়ার সোঁধ তুলেছে জারবার কাছে বলে ইয়াজ নাকি নিজেই হাসবার পেছনে ঘুরে। এবার বুঝবে ইয়াজ রোদকে ঝাঁড়ি মারলে কি হয়?

দিশাদের ড্রয়িং রুমে বসে আছে রাতুল তার মা-বাবাকে নিয়ে। এদিকে দিশার মা-বাবা অক্কার মা চক্কা হয়ে বসে আছে। রাতুল দিশার হাত চাইতে এসেছে। তিশাকে ওর মা পাঠিয়ে রোদের বাসায় যাতে চাচা,চাচি আর রাদকে ডেকে আনে। এমনি সময় হলে মেয়ে দিতে তারা দ্বিতীয় বার ভাবতো না কিন্তু এখন কিভাবে কি? যেখানে রাতুলকে ঘিরেই রোদ নামক সবার ছোট্ট ভালোবাসাটা এতটা ভোগান্তির শিকার হয়েছিলো। কাবিন পর্যন্ত এসে ভেঙেছিলো সেখানে দিশার সাথে এখন রাতুলের বিয়ে দেয়াটা উচিত কি না কেউ বুঝতে পারছে না। রাতুলের বাবা বন্ধুর হাত ধরে বিনিনয়ের সুরে বললেন,

— দেখ আমরা দিশাকে নিজের মেয়ের মতো রাখব। শেষ বার ভরসা কর। তোর হত দুটো ধরি।
দিশার বাবা নির্বাক। কি বলবেন৷ রাদরা তখন হাজির। রাদ সবার সামনেই বলে উঠলো,
— তিশা দিশা’কে ডাক। ও যেটা বলবে সেটাই হবে।
তিশা দিশাকে ডেকে আনতেই রাদ তাকালো। দিশা রাতুলের দিকে তাকিয়েই আচমকাই বলে উঠলো,
— আমিও যদি কোন দিন মা হতে না পারি তখন কি বিয়ের আসরে আমিও রোদের মতো একা বসে বসে সবার কটু কথা শুনবো?আমিও কি রোদের মতো ঘর কোণা হয়ে থাকবো?
দিশার এহেন প্রশ্নের জন্য হয়তো কেউ ই প্রস্তুত ছিলো না যা তাদের চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।

ঘুরতে বের হয়েছে আদ্রিয়ান বউ, বাচ্চাদের নিয়ে। কথা ঘুরার থাকলেও ওরা এসেছে শপিং মলে। মলে একটু হাটার পরই মিশি ক্লান্ত। বাবার কোলে উঠে সে এখন আরামসে ঘুরে ঘুরে দেখছে। রোদ প্রথমেই দুই বাচ্চার জন্য গরমের শপিং করলো। যেই গরম সেই হিসেবেই উজ্জল রং এর পাতলা পোশক নিয়েছে। গাঢ় রং সূর্যের আলো শোষণ করে তাই গরমে হালকা রং এর পাতলা পোশাক পড়া উচিত। আদ্রিয়ানের জন্য ও রোদ কিনলো কিন্তু নিজের জন্য কেনাকাটায় অনাগ্রহী রোদ। না চাইতেও আদ্রিয়ান রোদের জন্য ও কিনেছে। মিশান আর রোদ হাত ধরে হাটছে পাশেই মিশিকে কোলে নিয়ে আদ্রিয়ান হাটছে। হঠাৎ মিশান রোদের হাতটা শক্ত করে ধরতেই রোদ ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

— কি হয়েছে? কিছু বলবে আব্বু?
মিশান কথা বললো না। সামনের দিকে হাটতে লাগলো রোদকে নিয়ে। রোদ আবারও জিজ্ঞেস করতেই আদ্রিয়ান ও ফিরে তাকালো। মিশান হালকা হেসে বললো,
— ফুড কোর্টে চলো। খাবো।
আদ্রিয়ান এদিক ওদিক তাকালো। রোদও বুঝলো মিশান এখান থেকে চলে যেতে চাইছে। হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বললো,
— মা’কে বলবে না কি হয়েছে?

মিশান রোদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রোদ চোখের ইশারায় ভরসা দিতেই মিশান বললো,
— পেছনেই মিসেস মাইশা আছেন। আমরা অন্য দিকে যাই। দেখলেই কথা বলতে আসবে। ভালোলাগে না আমার।
রোদ তাকালো। বিয়ের দিনই দেখেছিলো একবার। আর দেখা হয়নি। মিশানের টানে রোদ সামনে এগিয়ে গেলো। হঠাৎ পেছন থেকে নারী কন্ঠে কেউ ডেকেই উঠলো,

— মিশান?
মিশান পেছনে তাকালো না। রোদের হাতটা শক্ত করে ধরে আদ্রিয়ানকে বললো,
— বাবা চলো।
আদ্রিয়ান শান্ত কন্ঠেই বললো,
— ডাকছে। কথা বলে এসো।
— আমার ভালোলাগে না।
— ডাকছে না? একবার দেখা করে এসো।

রোদ ঢোক গিললো। ওর বাচ্চা মিশান। কেন অন্য জানের সাথে কথা বলতে বলছে আদ্রিয়ান? রোদ ও মিশানের হাতটা শক্ত করে ধরলো। কাউকে দিবে না রোদ। ওর বাচ্চা এগুলো। মিশান তাকাতেই রোদ বললো,
— চাইলে বলে আসো।
— চাইনা।
রোদ মিশানকে নিয়ে হাটা দিলো৷ আদ্রিয়ান জোর করলো না আর। পেছন থেকে অবশ্য আরো দুই একবার ডাক শুনা গিয়েছিলো কিন্তু মিশান ই যায় নি।

বাসায় ফিরতে মোটামুটি রাত ই হলো। সবাই ফ্রেশ হয়ে তখন ড্রয়িং রুমে আড্ডা দিচ্ছে। এমন সময় কলিং বেল বাজতেই আদ্রিয়ান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
— এতো রাতে কে এলো?

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩৬ শেষ অংশ

বলে নিজেই উঠে দরজা খুলে দিলো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীকে দেখেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। কঠিন কিছু বলতে গিয়েও বললো না। আশে পাশে অন্য ফ্ল্যাট আছে।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩৮