ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩৮

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩৮
সাইয়্যারা খান

ড্রয়িং রুম জুড়ে নিস্তব্ধতা। কেউ কোন প্রকার বাক্য ব্যায় করছে না। ফোঁস করে দম ছাড়লো আদ্রিয়ান। উঠে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিলো। এভাবে সং সেজে বসে থাকার কোন মানে নেই। আদ্রিয়ান উঠতে নিলেই ফুপি মুখ খুললেন,
— আদ্রিয়ান বাবা আমার কথাটা শুন।
আদ্রিয়ান বসলো। পাশেই রোদ বসা। তার পাশে মিশি, মিশান। ফুপি উঠে মিশি’কে আদর করার জন্য হাত বাড়াতেই রোদ বলে উঠলো,

— মিশান, বোনকে নিয়ে রুমে যাও। মা আসছি।
মায়ের বাধ্যগত সন্তান মিশান। কথা শুনেই উঠে বোনকে কোলে তুলে রুমে হাটা দিলো। ফুপি মুখটা নিচু করে তাকালেন। রোদের চোখে মুখে তখনও শক্ত একটা ভাব। মা হয়তো একেই বলে। নিজের সাথে করা অন্যায় ভুলে গেলেও ভুলে না সন্তানের সাথে করা অন্যায়। রোদের ও তাই। ফুপি ওর সাথে যা ই করুক না কেন কোন অফসোস নেই কিন্তু তাই বলে ওর ছোট্ট মেয়ে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ঐ দিন কি উচিত ছিলো না উনার নিজের স্বামী’র বিপক্ষে যাওয়া? কয়েক বছর আগে যদি স্বামী’র নোংরা মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে যেতেন তাহলে হয়তো মিশির দিকে নজর দেয়ার সাহস হতো না ওনার। আদ্রিয়ানের মা-বাবা আর আরিয়ান ও সাথেই আছেন। রোদ উঠে দাঁড়িয়ে রুমে চলে গেল। মিশানকে নিয়ে আবার কিচেনে ডুকলো।

ঐ দিকের কথা শুনার ইচ্ছে আপাতত নেই। শশুর শাশুড়ী আর ভাই সম ভাসুর এসেছে নাস্তার আয়োজন তো করতেই হয় কিন্তু এত রাতে কি ই বা দিবে? রোদ চুলায় পানি বসিয়ে মিশানকে বললো যাতে ডিনার অর্ডার করা হয়। মিশান মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে তাই করলো। রোদ আপাতত কফি করে মিশানের হাতে ড্রয়িং রুমে পাঠাতেই আরিয়ান সবার আগে এক মগ নিয়ে হাসি দিয়ে বললো,

— ধন্যবাদ আব্বু। দরকার ছিলো।
মিশান ঘাড় দুলিয়ে হেসে বললো,
— মা বানিয়েছে। ধন্যবাদটা তার পাওয়া।
আরিয়ান হাসলো। বললো,

— আচ্ছা আচ্ছা এই ধন্যবাদ তুমি রাখ। তোমার মা’কে ধন্যবাদ জানিয়ে দিব নে।
আদ্রিয়ানের মা-বাবা ও কফি হাতে তুললো বাদ রইলো ফুপি। আদ্রিয়ান তপ্ত শ্বাস ফেললো। নিজে উঠে একমগ ফুপির হাতে দিয়ে আরেক মগ নিজে তুললো। ফুপি কিছু বললেন না। এক চুমুক বসিয়ে মিশানের দিকে তাকিয়েই বললেন,
— কফিটা ভালো হয়েছে।

মিশান ভদ্র ভাবে “ধন্যবাদ” শব্দটা বলে চলে যেতে নিলেই ফুপি বলে উঠলেন,
— মিশান রোদকে একটু ডেকে দাও।
— মা এখানে আসবে না। মিশি’কে ঘুম পারাচ্ছে।
বলেই পা বাড়ালো মিশান। ফুপি মুখ জুড়ে অপরাধ বোধ।
মিশান মায়ের কাছে গিয়েই শুয়ে পরলো। রোদ মিশিকে বুকে নিয়ে মাথায় হাত বুলাচ্ছে তখন। মিশান ঘেঁষতে ঘেঁষতে রোদের কাছে আসলো। রোদ আস্তে করে বললো,

— ঘুমাবে?
— উহু।
— মন খারাপ?
— হু।
— কারণটা কি ফুপি?
— জানি না।
— মন খারাপ করে না আব্বু। বাবা ইউল হ্যান্ডেল অল ইনশাআল্লাহ।
— ইনশাআল্লাহ।

মিশি ঘুমাতেই রোদ ওকে পাশে শুয়ে দিলো। উঠতে নিলেই মিশান আটকে দিলো কোলে মাথা দিয়ে। রোদ জানে মিশানের জান মিশি। এই বয়স তো মিশানের হয়েছে বোনের সাথে কি ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছিলো সেটা বুঝবে। রোদ কিছু সময় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। একটু হেসে বললো,
— কাল গোসলের সময় ভালো করে শ্যাম্পু করে দিব নে তোমাকে। চুল আঠা হয়ে আছে।
মিশান ফট করে উঠে বসে নিজের মাথায় হাতিয়ে দেখতে লাগলো। রোদ ফিক করে হেসে দিয়ে বললো,

— আরে বোকা আমি তো দুষ্টামী করছিলাম।
মিশান থামলো। রোদ হেসেই বললো,
— বাবার ছেলে একদম বাবার মতো হয়েছে। অলওয়েজ ফিটফাট থাকতে হবে। তোমার বাবা তো নিজের ছেলের বউ দেখতে ব্যাস্ত। ঐ দিন রাস্তায় এক মেয়েকে দেখিয়ে আমাকে বলে, দেখোতো রোদ সুন্দর না। আমি তো চোখ রাঙিয়ে তাকালাম। বললাম, হ্যাঁ সুন্দর, বিয়ে করবেন নাকি আপনি? তোমার বাবা পরপর তিনবার তওবা করে বললো, আমি তো এই মেয়েকে ছেলের বউ করতে চাই। দেখো কত ভালো। চেহারা দেখেই বুঝা যায়।

মিশান হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এতদিন বাবা নাহয় ওর সাথে এসব বলেছে এখন কি না মায়ের কাছে এসব বলে বেড়ায়? রোদ তখনও হাসছে। মিশান মুখ ভোঁতা করে বললো,
— বাবা কে কিছু বলো না কেন তুমি? এসব বলে আমাকে ক্ষ্যাপায়। তুমি কিছু বলে দিও।
রোদ হাসি থামিয়ে বললো,
— কেন কেন আমি শাশুড়ী হব। তোমার বউকে জ্বালাবো। সব কাজ করাবো। মাঝে মধ্যে তোমার কাছে বদনাম করব।
মিশান আরেক দফা অবাক হয়ে বললো,

— তুমি সত্যি সত্যি এমন করবে?
রোদের হাসি এবার থামছেই না। মিশানের হাত ধরে বললো,
— আব্বাজান এখন ই বউয়ের জন্য এত দরদ? বউ পেলে তো আমাকে চিনবেন ই না।
মিশান রোদের হাত ধরে বললো,
— সত্যি আমি এমন ভাবি না মা। তুমি আগে। প্রমিস।
রোদ হাসি থামালো। ছেলের চুল নেড়ে হেসে বললো,

— জানি তো আব্বু।
মিশান যেন একথায় সস্তি পেলো তখনই কলিং বেল বাজলো। রোদ বললো,
— হয়তো ডেলিভারি ম্যান এসেছে। সব কিচেনে নাও। মা আসছি।
মিশান চলে যেতেই দেখলো আদ্রিয়ান বিল পে করে সব নিচ্ছে। মিশান এগিয়ে সব নিতেই রোদ হাজির হলো। কিচেন ওপেন হওয়ায় সব দেখাই যায়। আরিয়ান বলে উঠলো,

— রোদ বোন তারাতাড়ি দে। ক্ষুধায় পেট চু চু করছে।
রোদ “আচ্ছা” বলে টেবিল গুছাতে লাগলো। সব গুছিয়ে ডাক দিতেই আরিয়ান উঠে এলো। ফুপি একবার নিজের ভাইয়ের দিকে তাকালেন। যার জন্য তা ই এখনো বলা হলো না। আরিয়ানের বাবা ইশারা করতেই আরিয়ান ধুপ করে বসে পরলো। আসলে প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে ওর। আর কতক্ষণ না খেয়ে থাকবে? আদ্রিয়ানের বাবা রোদকে ডেকে উঠলেন,
— রোদ মামনি এখানে আসো তো।

রোদ মিশানকে রুমে পাঠিয়ে দিলো। সেন্স করতে পারছে রোদ এখানে এখন কিসের কথা হবে। এগিয়ে এসে আদ্রিয়ানের পাশে বসতেই ফুপি মুখ খুললেন,
— বউ মা, আমাকে মাফ করে দাও। আমার জন্যই আজ তোমরা আলাদা। আমার ভাইয়ের পরিবার ভাঙুক তা কখনো চাই না আমি। প্লিজ ফিরে চলো৷ বাড়ীটা নির্জীব হয়ে আছে৷ মিশান, মিশি তো ঐ বাড়ীর সন্তান। নিজের বাসা থাকতে কেন ফ্ল্যাটে থাকবে? ফিরে চলো।

রোদ থম মে’রে সবটা শুনলো। তাচ্ছিল্যের হাসি আসছে ওর। হাত দিয়ে জামার কোণা মুঠ করে ধরলো। আদ্রিয়ান রোদের হাতের উপর নিজের হাতটা রাখতেই রোদ মাথা তুলে বলে উঠলো,
— কিসের মাফ চাইছেন? বুঝলাম না। আর পরিবার কেন ভাঙবে? তার চেয়ে বড় কথা এটা মিশান,মিশানের বাবার করা ফ্ল্যাট।
রোদ এমন চ্যাটাং চ্যাটাং উত্তর দিবে ভাবে নি ফুপি। রোদ বিরক্ত হলো। যেটা বলার সেটা না বলে উনি আগে পিছের কথা বলছে। রোদ আবার বললো,

— আপনার স্বামী হাইপারসেক্সুয়াল ডিজিজে আক্রান্ত। কথাটা জেনেও এতবছর লুকিয়েছেন আপনি। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে যুবতি মেয়েদের প্রতি এটরাকশন। আমার সাথে যা করেছে তা নাহয় ভুলে গেলাম। আমার কতটুকুন মেয়ে…
আর বলতে পারলো না রোদ। চোখ জ্বলে উঠলো। আদ্রিয়ান শক্ত করে রোদের পোড়া হাতটা ধরলো। সাদা চামড়ায় কালো দাগটা ফুটে আছে এখনও। কতদিনে দাগ মিটবে জানা নেই। ফুপি মাথা নিচু করে নিয়েছেন। এই বয়সে এসে আজ কতকিছু পোহাতে হচ্ছে। ফুপি আচমকা বলে উঠলেন,

— দোষটা আমারই। শুরুর দিকে যদি আমি কঠোর হয়ে ডিভোর্স দিতাম তাহলে আজ এতকিছু হতো না। ওনাকে রিহ্যাবে পাঠানো হয়েছে। ভেবেছিলাম ঠিক হয়েছেন তাই ভাইয়ার বাসায় এসেছিলাম নাহলে আসতাম না। আমি জানতাম না উনি ঠিক হন নি। মিথ্যা বলেছেন। ভয়ে আমি জারাকে হোস্টেলে রেখে পেলেছি। এখন তো বিয়ের বয়স হয়েছে। কিছুদিন পর বিয়ে দিব। জুরাইনকে ও বিয়ে করানোর সাহস পাই না।

যদি কিছু ঘটে যায়। বিয়ের পর ভালোই ছিলো। বছর গড়াতেই রং বদলান তিনি। চাপ দিতেন সম্পদ ভাগ করার জন্য। ভাইয়াকে বলতেই ভাইয়া দিয়ে দেয়। এখন আবার বাড়ীর বাট চায়। আমি তো জানি ঐ বাড়ী শুধু ভাইয়ার টকায় করা। ওটাতে আমার হক নেই।

ওনার কোটি টাকার সম্পদ থাকলেও আমারটা চায়। দিলেই বিক্রি করে কি করেন বলেন না। কিছু করার ছিলো না আমার। ছোট্ট জুরাইন কোলে ছিলো। কি করতাম বলো? আদ্রিয়ান ও ভুল বুঝে আছে। ঐ দিন জারবার হয়ে কিছুই করতে পারি নি আজ নাতীর হয়েও কিছু করতে পারলাম না। শুধু তোমার কাছে অনুরোধ বউ মা।তোমার ভাইকে বলে উনাকে ছাড়ানোর ব্যাবস্থা করে দাও। রিহ্যাবে পাঠানো হোক। উনার এই ডিজিজ রিহ্যাবে ছাড়া ঠিক হবে না। ওখানে হাজার অত্যাচার হলেও না।

একদমে কথাগুলো বলে পানির প্রয়োজন বোধ করলেন তিনি। আদ্রিয়ান ই পানি দিলো৷ ফুপি আদ্রিয়ানের হাত ধরে কেঁদে উঠলো। আদ্রিয়ান জড়িয়ে ধরলো আজ কয়েকবছর পর। এ বিষয়ে পরে কথা বলবে বলে খেতে বসালো। যাওয়ার আগে তাগাদা দিলো সবাই বাড়ী ফিরার। বাবার সাথেও আদ্রিয়ানের মনোমানিল্য কমেছে। সবাই পরিস্থিতির শিকার। সবাই বিদাই নিতেই রোদ মিশানের রুমে ডুকলো। বোনকে আগলে নিয়ে ঘুমাচ্ছে মিশান। রোদের রাদের কথা মনে পরলো। ছেলে মেয়েকে আদর করে রোদ নিজের রুমে ডুকলো৷ ফ্রেশ হয়ে আসতেই দেখলো বেড গুছাচ্ছে আদ্রিয়ান। রোদ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো আদ্রিয়ানকে। আদ্রিয়ান হাতে থাকা বালিশটা ঝেরো রেখে হাত পেছনে দিয়ে রোদকে ধরে সামনে আনলো। ফোলা ফোলা গালে চুমু খেয়ে বললো,

— কি ভাবলে?
— ভাবতে পারছি না।
— আ’ম উইথ ইউ এট এনি ডিসিশন।
রোদের ভালেলাগা কাজ করলো। আদ্রিয়ান ওকে সাপোর্ট করেছে। আর কি চাই? রোদ নিজেও পা উঁচু করে আদ্রিয়ানের গালে চুমু খেল। গলা জড়িয়ে ধরতেই আদ্রিয়ান ওর কোমড় উঁচু করে ধরে নিজের বরাবর করে বললো,

— এখন সব স্ট্রেস দূর করে দাও।
রোদ চোখে চোখে প্রশ্ন করলো। আদ্রিয়ান দুষ্ট হাসলো। রোদ নামার জন্য মোচড়া মোচড়ি করতেই আদ্রিয়ান ওর কানে মুখ লাগিয়ে বললো,
— এতদিন পাগল বানিয়েছো? এখন তোমার ইটিশ পিটিশ তো মানব না।
রোদ অবাক হলো। এই আদ্রিয়ান রোদের ভাষা কবে শিখলো? আদ্রিয়ান ওকে নিয়ে বিছানায় শুতেই রোদ মাথাটা আদ্রিয়ানের বুকে দিয়ে বললো,

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩৬

— আমার কষ্ট লাগবে এই বাসা ছেড়ে যেতে।
— তাহলে থেকে যাই?
— উহু। ফ্যামিলি কামস ফাঁস্ট।
আদ্রিয়ান হাসলো। রোদের উত্তর ওর জানাই ছিলো।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩৯