ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩৯

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩৯
সাইয়্যারা খান

সকাল সকাল ঘুম ভাঙতেই রোদ দেখলো আদ্রিয়ান পাশে নেই। কোনমতে উঠে ঢুলু ঢুলু পায়ে ব্যালকনিতে তাকাতেই দেখলো রোদের সুদর্শন জামাই পুশ আপ করছে। দরদর করে ঘাম ঝরছে তার। কিছু অবাধ্য চুলের বিচরণ আদ্রিয়ানের কপাল জুড়ে। পরণের পাতলা হাতাকাটা টিশার্টাও গায়ে সেটে আছে। ইশ! কত সুন্দর দৃশ্য। রোদের জামাইকে কতটাই না হ্যান্ডসাম লাগছে। এই লোক জিম করে করে বডি টাইট করে রেখেছে। জিম মিস হলে তার বাসায় ই শুরু হয়ে যায়। রোদ এখন রোম্যান্টিক মুডে আছে। ঘুম জড়ানো চোখে মুখেই আস্তে করে যেয়ে আদ্রিয়ানের কোমড়ের উপর বসে পরলো। ওমনিই ধাম করে শুয়ে পরলো আদ্রিয়ান। বেকায়দায় পরলো রোদ। আদ্রিয়ান চমকানো কন্ঠ বলে উঠলো,

— তুমি কখন এলা?
রোদের বাকি থাকা ঘুম তখন পালিয়েছে। কটমট করে বললো,
— আপনি এমন ভাবে পরলেন কেন? মনে হচ্ছে আমার পাঁচ মুন ওজন।
— যতটুকু আছে তাই যথেষ্ট বউ।
— এখন ভদ্র ভাবে পুশ আপ দিন। আমি এভাবেই বসে থাকব। মুডটা রোম্যানটিক ছিলো আপনার জন্য বারোটা বাজলো।
আদ্রিয়ান বেচারা ওভাবেই পুশআপ দিলো। রোদ বেজায় খুশি হলো চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। শক্তিশালী জামাই ওর। সাবাসী দেয়ার ন্যায় রাজকীয় ভঙ্গিতে আদ্রিয়ানের কাঁধ চাপড়ে গর্বের সহিত বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— সাবাস মে’রে শের!
আদ্রিয়ান মুখ লটকে রেখেছে। ব্যাকে বেচারা সর্বোচ্চ ৩০/৩৫ কেজি উঠিয়ে পুশ আপ দিতে পারে সেখানে আজ পুরো আলাম বউ পিঠে তুলে পিশ আপ দিয়েছে। তাও আলহামদুলিল্লাহ। যদি এটা না পারতো তাহলে রোদ আজ আদ্রিয়ানের বারোটা বাজিয়ে দিত। রোদ উঠে যেতে যেতে বললো,

— আমি যাচ্ছি। আপনি কন্টিনিউ করুন।
মুখ চোখা করে আদ্রিয়ানকে চুমু দেখিয়ে রোদ চলে গেল। আদ্রিয়ান হেসে ফেললো। এই ছোট্ট ছোট্ট রোদের বাচ্চামো গুলো ওর ভীষণ ভালোলাগে। যেখানে সবার জামাই রোম্যান্টিক মুডে থাকে সবসময় সেখানে আদ্রিয়ানের বউ অলওয়েজ মুডে থাকে। এখন যদি আদ্রিয়ান ও তেমন হয়ে যায় তাহলে তো পরিস্থিতি সামলাতে বেগ পেতে হবে। ভাবতে ভাবতে ডাম্বেলগুলো হাতে তুলে সব গুছাতে লাগলো আদ্রিয়ান। আজ আর কিছু করলে সোজা হয়ে হাটা দায় হয়ে পরবে।

ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে সবাই। রোদ এদিক ওদিক ঘুরঘুর করছে। মিশানের টিফিন ব্যাগে ভরে আরেকটা এক্সট্রা বক্স দিয়ে বললো,
— এটা রুদ্র’কে দিও তো মিশান। ওর অনেক পছন্দের টিফিন এটা।
মিশান মুখে খাবার ভরে সায় দিলো। রোদ দুধ হাতে ফিরত এলো। মন খারাপ ভীষণ ভাবে ওর। আগে এই ফ্লাটে আসবে না বলে মন খারাপ ছিলো। কতদিন ঝগরা বেঁধেছে আদ্রিয়ানের সাথে অথচ কাল রাত থেকে মন পুড়ছে এটা ভেবে এই ফ্লাট ছেড়ে চলে যেতে হবে।

অল্প সময়ে বেশ কিছু স্মৃতি জমিয়েছে রোদ আদ্রিয়ান এখানে তাদের বাচ্চাদের নিয়ে। জীবনের বড় একটা দিক পরিবর্তন হয় বিয়ের মাধ্যমে। নতুন শশুর বাড়ীতে কিন্তু রোদের জীবনের মোর ঘুরেছিলো এখানে। ইট পাথরের এই ফ্লাটে। জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া রোদ পেয়েছে এখানে। আদ্রিয়ানের বুকে মাথা গুজে নিজেকে সমর্পণ করেছে এখানে। সবটুকু সুখ খুঁজেছে এখানেই তো। এখন যখন যেতে হবে তখন যেন বুকে চাপ অনুভব করলো রোদ। আদ্রিয়ানের যে মন খারাপ হয় না সেটা না। দুইজনের ই মনের অবস্থা ভালো না।

আবার থেকে যেতেও পারছে না। সেটা সম্ভব নয়। পরিবারের সাথে থাকার যে সুখ যে শান্তি সেটা অন্য কোথাও সম্ভব নয়। টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েই চলছে সব। আজ বাদে কাল যাওয়ার ই ছিলো। এটা রোদ আদ্রিয়ান দুই জন ই জানে। তবে এটতা পীড়াদায়ক হবে তা হয়তো জানা ছিলো না। আজ থেকে সব গুছিয়ে কালই চলে যাবে ওরা। সব কিছু আজ পাঠিয়ে দেয়া হবে। কাল সকালে হয়তো চলে যাবে। সে অনুযায়ী কাজে লেগে পরলো রোদ। হঠাৎ পরিচিত ছোঁয়া পেয়ে ঘুরে তাকালো। আদ্রিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। একদম কাছাকাছি। রোদ একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,

— কিছু লাগবে?
আদ্রিয়ান কিছু না বলে একটু পাশাপাশি দাঁড়ালো। রোদ তখন কিচেনে। ওপেন কিচেন হওয়াতে সবাই দেখা যায় বাইরে থেকে। সরে যেতে নিলেই আদ্রিয়ান ধরে কাছে আনলো। রোদ নিচু স্বরে বললো,

— কেউ দেখবে। সরুন।
— দেখবে না। কেউ নেই।
— মিশি?
— টিভি দেখছে।
রোদ কিছু বললো না আর। আদ্রিয়ান ওর কোমড় জড়িয়ে নিজের কাছে এনে আগাছালো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজতে গুঁজতে নরম কন্ঠে বললো,

— মন খারাপ? আরো কিছু দিন থাকবে?
— না। পরে যেতে বেশি খারাপ লাগবে।
— এটা তো হওয়ার ই ছিলো জান। মন খারাপ করো না। আমার দুষ্ট, পাজি রোদটাকেই ভালোলাগে এমন বিষন্ন রোদ না।
রোদ মুখটা উঁচু করে আদ্রিয়ানের গলায় দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। আদ্রিয়ান সন্তপর্ণে দেয়ালে মিশিয়ে নিলো রোদকে। একহাত রোদের পৃষ্ঠদেশে জড়িয়ে অন্য হাত রোদের চুলের ভাজে গলিয়ে দিলো। গলায় ভেজা অনুভব করলো আদ্রিয়ান। তার রোদের চোখের পানি এটা।

চুলে থাকা আঙুলগুলো চেপে রোদের মুখ সরালো গলা থেকে। মাথা নিচু করে আছে রোদ। আদ্রিয়ান নিজের বড় হাতের থাবায় আটকে নিলো রোদের কান সহ গাল। শক্ত হাতে মুছে দিলো গালের পানি। লাভ হলো কই? আবার ভিজে উঠলো গালদ্বয়। সেই ভেজা গালেই নিজের দাঁড়ি ভর্তি গাল মিলিয়ে দিলো আদ্রিয়ান। হালকা দাঁড়ির খোঁচায় ঈষৎ কেঁপে উঠল রোদ। ছুটার জন্য তাগাদা দিলো।

মোচড় দিয়ে সরতে চাইলো কিন্তু লাভ হলো না। রোদের নড়চড় আদ্রিয়ানের পৌরুষ সত্তা হঠাৎ জাগিয়ে তুললো। বেসামাল হয়ে উঠলো আদ্রিয়ান। রোদের ওষ্ঠাধরে নিজের পুরু ঠোঁটের গভীর থেকে গভীর ছোঁয়া দিতে ব্যাস্ত হলো। রোদ যেন শক্তিহারা হলো। এই একমাত্র ব্যাক্তির কাছে একান্ত দূর্বল ও। আবার এই ব্যাক্তির বুকেই একান্ত দূর্দান্ত হয়ে উঠে।

দিশা মনমরা হয়ে আকাশপানে তাকিয়ে আছে। পেছনে কারো উপস্থিত টের পেয়েও কিছু বললো না। জানে কে এসেছে। এই ব্যাক্তির অস্তিত্ব, ঘ্রাণ, পদচারণ যে পইপই মুখস্থ দিশার। ওহ্ মুখস্থ না ঠোঁটস্থ। দূর থেকে বুঝতে পারে দিশা কে আসছে। ব্যাক্তিটি দিশার পাশে দাঁড়ায়। গলা খেঁকানি দেয়। হেলদুল হয় না দিশার। রাদ এবার মুখে বলে উঠলো,

— বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?
— আমার জীবনে বুঝার বাকি নেই কিছু। মরি ও তো না। দেখুন। এত মানুষ ম’রে অথচ আমি দিব্যি বেঁচে আছি।
রাদের বুকে হালাক কাঁপলো বুঝি। ধমকে উঠলো,
— থাপ্পড় চিনিস? ফালতু কথা বললে কানের নিচে পরবে একদম।
দিশা নিশ্চুপ হয়ে গেল। রাদ কিছু সময় নীরব থেকে বললো,

— তুই যা চাইবি তাই বলে। রাতুল ভালো ছেলে। ওর মা’য়ের জন্যই ছেলেটা ঐ দিন…। আচ্ছা বাদ দে। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই…
দিশা ফুঁসে উঠলো। কিছুটা জোরেই বলে উঠলো,
— ভালো লাগবে না আমার। খারাপটাই লাগবে। এনে দিন খারাপ কাউকে। খারাপকেই বিয়ে করে গলায় দড়ি দিব আমি। পাগল হয়ে যাবো আমি। যান এখান থেকে। আপনাকে দেখতে চাই না।

কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পরলো দিশা। কষ্টগুলো হাজার চেয়েও গিলতে পারছে না ও। বারবার যেন কাটার ন্যায় গলায় বিঁধে যাচ্ছে। না পারছে গিলতে না পারছে ফেলতে। হাটু মুড়ে বসে চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে মেয়েটা। রাদের ঠোঁট অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কাঁপতে লাগলো। কোন মতে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলো সেটা। নিজেকে চেয়েও শক্ত রাখতে পারছে না রাদ। এই বুঝি গাল গড়িয়ে পানিগুলো ছিটকে আসে। হঠাৎ দিশা দেয়ালে জোরে নিজের মাথা বারি মারলো। আওয়াজে রাদ তারাতাড়ি বসে ধরতে নিলেই দিশা তেঁতে উঠে বলে উঠলো,

— যেতে বলেছিনা? চলে যান এখান থেকে। আমার কাছে আসবেন না আপনি। কখনো না।
রাদ নিজেকে সামলাতে ব্যার্থ হলো। ওপাশে দরজায় কড়াঘাত করছে ইশান, ওর বউ আর তিশা। চাচা চাচি বাসায় নেই। দিশার বিয়ের শপিং এ গিয়েছে। রাতুল সেদিন দিশার প্রশ্নের জাবাবে বলেছিলো,” তুমি চাইলে এখনই বিয়ে হোক দিশা। আমি জানি আমি বিশ্বাসের যোগ্য না। যা করলে বিশ্বাস করবে তাই করব। বলো তুমি”। রাতুলের এই কথার পাল্টা কথা দিশা বলতে পারে নি। বিয়েতে সে রাজি এটা বলেই প্রস্থান করেছে ও।

রাতুলের মা মোটা দুটো চুড়ি পড়িয়ে দিয়েছিলেন আর রাতুলের বাবা হাতে হাজার বিশএক টাকা দিয়েছিলেন। এককথায় ঐদিন সব ধার্য হয়ে গিয়েছিলো বিয়ের। এখন যখন বিয়ের তোরজোর চলছে তখন দিশা বেসামাল হয়ে উঠেছে। সারাদিন কান্না করে। ওর বাবা এসে যখন জিজ্ঞেস করলো, বিয়ে ভেঙে দিবে কি না তখন দিশা দৃঢ় কন্ঠে বলেছে,” আমি রাতুল ভাইকেই বিয়ে করব আব্বু।”

মেয়ের একথার বীপরিতে আর কিছুই বলেন নি তিনি। মেয়েটা এবার একটু সুখী হোক এটাই চাওয়া।
দরজা অবদি রাদ যেতেই হঠাৎ পায়ে টান অনুভব করলো। মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলো দিশা পা ঝাপটে ধরে আছে। এলোমেলো দিশার বিষন্ন মুখাবয়ব। পাগল পাগল ভাব যেন একেই বলে। দিশা রাদের পা জড়িয়েই কাঁন্নায় মাখামাখি গলায় অনুরোধ করে উঠলো,

— প্লিজ যাবেন না। রাদ ভাই? আমার কষ্ট কমিয়ে দিয়ে যান। আপনিই পারবেন কমাতে। এই রাদ ভাই? কমিয়ে দিন না।
রাদের এবার চোখ বাঁধ ভাঙা হলো। কেউ কি না ওকে এমন পাগলকরা ভালোবাসে। মৃত্যু যন্ত্রণা হয় না বুঝি দিশার? কি আছে রাদের মাঝে যে তাকে এমন করে ভালোবাসতে হবে? এতমাস তো দিশা ঠিকই ছিলো তাহলে আজ কি হলো? উত্তর রাদের মনই দিলো। দিশা রাদকে ভুলতে পারে নি কখনো।

এতদিন অনুভূতিগুলো লুকিয়ে রেখে নতুন সম্পর্কে জড়ানোর ব্যার্থ চেষ্টা করেছে। রাদকে ভুলে থাকার ব্যার্থ চেষ্টা করেছে। এখন যখন সবসময়ের জন্য রাদকে হারিয়ে অন্য ঘরে যেতে হবে তাও অন্য পুরুষের বউ হয়ে সেটাই নিজেকে মানাতে ব্যার্থ হচ্ছে দিশা।
রাদ দিশার বাহু ধরে অনেক কষ্টে ধরে উঠালো। বিছানায় বসিয়ে নিজে হাটু গেড়ে পাশে বসলো। দিশা ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে তখনও। রাদ দিশার হাতটা চেপে ধরে বললো,

— আমাকে বিয়ে করতে চাইছিস?
চমকে তাকালো দিশা। সময় অপচয় না করে তড়িৎ গতিতে উত্তর দিলো,
— না না। আমি এখন চাই না। বিশ্বাস করুন আমাকে। আমি খারাপ হতে পারি। জঘন্য হতে পারি তাই বলে নিষ্পাপ শিশুর বাবা’কে, জাইফার মতো মেয়ের স্বামী লোভী না আমি। আ…আমি নিজেকে মানাতে পারছি না। কিছুতেই না।
রাদ তপ্ত শ্বাস ফেলে দিশার দিকে তাকিয়ে বললো,

— তুই খারাপ না। জঘণ্য না। আমার দিশা তো সদ্য ভেজা নাদান ফুল। সে শুধু ভালোবাসতে জানে। বিষ ছড়াতে না।
দিশা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। যেন নিজেকে বুঝাচ্ছে। রাদ আবারও বলে উঠলো,
— তুই বিয়েটা কর। ভালো থাকবি।
— সত্যি?
অবুঝ প্রশ্ন। রাদ চোখ দিয়ে আশ্বাস দিলো। দিশা মাথা দুলালো। রাদ জিজ্ঞেস করলো,

— আর পাগলামি করবি?
— উহু।
— কাঁদবি?
— উহু।
— সত্যি তো?
— হু।
রাদ অল্প হাসলো। উঠে দিশার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যেতে নিলেই দিশা বলে উঠলো,
— রাদ ভাই।
রাদ তাকাতেই দিশা বলে উঠলো,
— “আমি ম’রে গেলে আমার লাশের হলেও বিয়ে দিবেন। আমি ভালো থাকতে চাই”।
দিশার এহেন ঠান্ডা স্বরে ভয়ংকর কথায় রাদের হৃদপিণ্ড যেন খাঁমচে উঠলো।

রোদরা যেহেতু চলে আসবে তার আগেই ফুপি ভাইয়ের বাসা ত্যাগ করতে চান। একথা জানাতেই আদ্রিয়ান ফুপিকে থাকতে বলে কিন্তু ফুপি রাজি নয়। শেষ মেষ কথা হলো শেষ দিনটা তারা সবাই আসবে আদ্রিয়ানের বাসায় ডিনার করতে। রোদও খুশি মনে রাজি হলো। ঐ দিক থেকে রাদ, রুদ্র সহ চাচাতো ভাই ইশান সহ তার বউ আর দিশা, তিশাও আসবে। রাতুলের কথা উঠতেই রোদ চুপসে যায়। আদ্রিয়ান একবার রোদের দিকে তাকালো।

রোদ মাথা নিচু করে মিশি’র খেলনাটা হাতে নিয়ে অহেতুক নাড়ছে। রাতুলের কথা শুনলে আগে হয়তো নিজের জীবনের অগোছালো একবছরের কথা মনে পরতো কিন্তু এখন শুনলেই ভয়ে কেন জানি বুক কেঁপে উঠে। আদ্রিয়ানের সেদিনের ভয়ংকর বাজে রুপের সাক্ষী রোদ। এখনও হুট হাট মনে পরলে চোখের কোণে পানি জমে উঠে। মিশান এসে ধাম করে রোদের পাশে বসলো। রোদ চোখ তুলে তাকাতেই মিশান একচামচ আইসক্রিম রোদের মুখের সামনে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— মন খারাপ?
রোদ মুখ খুলে খেয়ে বললো,
— না তো।
তখনই মিশি মিশানের ঘাড়ে চড়ে উঠে বসে বলতে লাগলো,
— ভাই মিশিও খাবে। মিশিকে দাও।
রোদ মিশানকে চোখ রাঙায়। মিশির জন্য ও নিজে আইসক্রিম খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না মিশি। মিশান মুখ কাচুমাচু করে তাকালো মা’য়ের দিকে। রোদ মিশিকে মিশান থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,
— মা এখানে আসো। মাম্মা মিশি’কে মজা দিবে।
মিশি মিশানের চুল টেনে ধরে জেদ করে উঠলো,

— মিশি আইসক্রিম খাবে। ভাই দাও।
আদ্রিয়ান এতক্ষণ দেখছিলো। রোদ পরেছে মহাঝামেলায়। এদিকে মিশান ভয়ে ভয়ে। মা তো বলেছিলো যাতে আইসক্রিম মিশির সামনে না খায়। এখন বকা খাওয়া নিশ্চিত। মিশিও আজ নাছোরবান্দা। আদ্রিয়ান পরিস্থিতি খারাপ দেখে মিশানের ঘাড় থেকে মিশিকে কোলে তুলে নিলো। জীবন্ত পুতুল এটা আদ্রিয়ানের। বাবা’কে পেয়ে মিশি আদর কন্ঠে বললো,
— বাবাই মিশি আইসক্রিম খাবে।
আদ্রিয়ান হেসে মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। রোদের দিকে তাকিয়ে বললো,

— বোরকা পড়ে নাও। নীচে যাব।
অবাক হয়ে রোদ জিজ্ঞেস করলো,
— কোথায়?
— আইসক্রিম পার্লার। ঐ দিন রোহান দেখালো। এখানেই সোসাইটির ভেতরেই আছে।
রোদ কিছুটা রাগী কন্ঠেই বললো,
— মাথা খারাপ? মিশিকে ঠান্ডা খাওয়ানো যাবে না।
— আহ্হা আগে চলোই না।
বলে চোখ দিয়ে ইশারা করতেই রোদ উঠে দাঁড়ালো। মিশি খুশিতে বাবার কোলেই লাফিয়ে ঠোঁটে চুমু খেয়ে গলা জড়িয়ে রাখলো। মিশান শর্ট প্যান্টটা প্লাটে এসে বললো,

— বাবা রোহান ভাইয়াকেও ডাকি?
রোদ না করার আগেই আদ্রিয়ান অনুমতি দিয়ে দিলো। চারজন একসাথে নীচে নামলো। এই এরিয়টা বেশ বড়। রোহান আগেই নীচে ছিলো। রোদকে দেখেই মিষ্টি করে হাসলো। রোদ ঠ্যালায় পড়ে নিজেও একটু হাসলো। রোহন যেন লাই পেয়ে বসলো। বললো,

— যাওয়ার আগে কফি খেতে আসব।
— দাওয়াত রইলো কাল রাতে।
— আচ্ছা।
পাঁচজন সামনের দিকে হাটা দিলো। মিশান রোদের হাত ধরে আর মিশি বাবার কোলে। রোহান সামনের দিকে ফোনে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। মৃদু বাতাসে রাতে হাটতে বেশ ভালোই লাগলো। সময়টা উপভোগ করলো চারজন। আইসক্রিম পার্লারে আদ্রিয়ান মিশির কোণে অল্প আইসক্রিম দিয়েছে। রোদ আর মিশান রীতিমতো কমপিটিশন শুরু করে দিয়েছে। আদ্রিয়ান না পেরে শেষে ধমকে থামালো ওদের। নাহলে কাল দেখা যাবে ঠান্ডায় পড়ে আছে।

রোহানের সাথে ওদের রেখে আদ্রিয়ান রোদকে নিয়ে একটু হাটতে সামনে গেলো। নীরব এলাকা। কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফুলের বাহার। আদ্রিয়ান সাইডে পড়া একটা কুঁড়িয়ে আনলো। রোদের মাথায় তো হিজাব তাই হাতে দিয়েই নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় রোদের হাতটা চেপে ধরলো। পাশাপাশি দুইজন হাটছে। রোদের মনটা যেন হঠাৎ করেই ভালোলাগায় ছেঁয়ে গেলো। কুঁড়ানো ফুলটা যেন পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান এবং প্রিয় মনে হচ্ছে ওর কাছে। দিনভর বিরতিহীন সূর্যের আলোর তীব্র গরমে পর রাতে যেন আজ ঠান্ডা বাতাস ভেসে এসেছে। বাতসে হঠাৎ কদম ফুলের ঘ্রাণ পেলো রোদ। জোরে শ্বাস টেনে নিজের ভিতর টেনে নিলো তার সুবাস। আদ্রিয়ান হঠাৎ চমৎকার কন্ঠে গান ধরলো,

” চিরদিন পাশে থেকো, সুখে দুখে জড়িয়ে
অভিমানে আবদারে মায়া দিও ছড়িয়ে,
চিরদিন পাশে থেকো, সুখে দুখে জড়িয়ে
অভিমানে আবদারে মায়া দিও ছড়িয়ে,
তুমি, তুমি, তুমি শুধু তোমারই উপমা
তুমি, তুমি, তুমি শুধু তোমারই উপমা,
তোমাকে জানিয়ে দিলাম, ও প্রিয়তমা
তোমাকে জানিয়ে দিলাম, ও প্রিয়তমা।”
রোদ চমকে আছে তখনও। আদ্রিয়ান এই ভিন্ন রং টা ওর সম্পূর্ণ আজানা৷ একদম অচেনা। রোদ আদ্রিয়ানের বাহুটা যতটুকু পারলো বুকে চেপে নিলো। এই অনুভূতি,এই ভালোবাসা,এই মুহূর্ত, এই আদ্রিয়ান সবই রোদের কল্পনা সম। না পাওয়া ভালোবাসা সম। এত সুখ বুঝি লুকিয়ে ছিলো?

রোদ একহাতে যতটুকু পারছে এগিয়ে রাখছে। বুয়া এসেও সাহায্য করছে। আদ্রিয়ান ও আজ বউকে সাহায্য করছে। রাতে সবাই আসবে তাই রোদ সকাল থেকেই সব গুছাতে ব্যাস্ত। মিশান এসে হেল্প করতে চাইলেই রোদ পেস্তা বাতাম দিয়ে বলেছে যাতে ছিলে দেয়। ঘন্টা হয়ে এলো মিশান তাই করে যাচ্ছে । একা বেশি কিছু করা সম্ভব না তাই রোদ কাচ্চি, কাবাব,একটা ভেজিটেবল, রায়তা আর মিষ্টি একটা আইটেম করছে। সন্ধ্যার খাবার আদ্রিয়ান বাইরে থেকে আনবে। তারপরও একা এসব করা রোদের জন্য অনেক ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে। আদ্রিয়ান বলেছিলো যাতে কিনে আনবে কিন্তু রোদই না করেছে। তখনই সাহায্যর জন্য রোহান আর ওর মা আসে। এতে অবশ্য রোদের কাজ অনেকটাই এগিয়ে যায়।

সন্ধ্যা হতেই সবাই আসে। পুরো ফ্লাট যেন রমরমা হয়ে উঠে। খাবার বাড়া সহ বাকি কাজেও রোহান আর ওর মা অনেক সাহায্য করলো। বেশ ভালো সময় কাটালো সবাই কাটালো একসাথে। রাতুলকে আসার জন্য বললেও আসে নি। মূলত এখনও ঐ রকম স্বাভাবিক না সবাই। কিছু একটা তো রয়েই যায়। সবাই বিদায় নিতে নিতে রাত প্রায় ১২ টা। গোছাতে গোছাতে রাত ১ টা। ক্লান্ত রোদ।আদ্রিয়ান ও কম কাজ করে নি।

রোদ সাওয়ার নিয়ে বের হলো। আদ্রিয়ান ডুকলো পরপরই। ক্লান্ত রোদ ঘরটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। জড় পদার্থের প্রতি অনুভূতি হয় সেটা জানা যায় যখন তাদের থেকে দূরে যাওয়া হয়। ছোট্ট সংসার এটা রোদের। কতশত মিষ্টি স্মৃতি জড়িয়ে এখানে। চোখ ভিজে উঠতেই রোদ মুছে নিলো। আদ্রিয়ান বের হলো একটু পরই। কালই চলে যাবে ওরা। ঘরের শুকনো সব খাবার সহ ফ্রিজের সব দারোয়ান আর বুয়াকে বাট করে দেয়া হয়েছে। সবকিছু গুছিয়ে রাখা হয়েছে। আদ্রিয়ান বলেছে ওরা মাঝে মধ্যে আসবে এখানে। রোদের জানা নেই এই মাঝেমধ্যে টা আদৌও কোনদিন আসবে?

আদ্রিয়ান পেছন থেকে কোলে তুলে নিলো রোদকে। মুহুর্তেই দুঃখী রোদ সুখের রাজ্যে পারি জমালো আদ্রিয়ানের সাথে। সুখের অশ্রুতে সিক্ত হলো গালদ্বয়।

শেষ রাতে আদ্রিয়ান ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই দেখলো রোদ নেই। মাত্রই তো এখানে রেখে গেলো। মিশানের রুমে যেতেই দেখলো রোদ সেখানে বসা। আদ্রিয়ান গিয়ে ওর মাথায় পেঁচানো টাওয়ালটা খুলে ভেজা চুল গুলো ছড়িয়ে দিলো। গালে হাত বুলিয়ে বললো,
— চলো ঘুমাবে।
— এখানেই ঘুমাই?
— আচ্ছা।

বলে আদ্রিয়ান রোদকে নিয়ে বাচ্চাদের পাশে শুয়ে পরলো। এত এত সুখ গুলো এই বাসাতে। এসব কি আদৌও টিকে থাকবে? রোদের সুখ গুলো কি এই একার সংসারটা জুড়েই থেকে যাবে? নাকি বাড়বে? আদ্রিয়ান কি এভাবেই ওকে ভালোবাসবে? নাকি ভালোবাসার রং বদলাবে?

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩৮

মানুষতো বলে দুঃখের পরই সুখ আসে। তাহলে কি রোদ আদ্রিয়ানের সুখের পর দুঃখ আসবে? সেই দুঃখ কি আদৌও দুজন সামলাতে পারবে? এসব চিন্তায় জর্জরিত রোদ। আদ্রিয়ানের বুকে মাথা দিয়ে সব কিছু বাদ দিতে চাইছে তবুও যেন ওর বলছে ওর এই সুখগুলো থাকবে না। এই আদ্রিয়ান নামক ভালোবাসা থাকবে না। রোদ তখন কি করবে? আদ্রিয়ান ছাড়া তো দম বন্ধ হয়ে ম’রে যাবে। ভালোবাসার ভিন্ন রং কি সামলে উঠতে পারবে রোদ নাকি খেই হারিয়ে ডুবে যাবে?

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪০