ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৫

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৫
তাজরীন ফাতিহা

মাহাবুব আলমের সাথে ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার কি কথা হলো জানা নেই তবে মাহাবুব আলম বিয়েতে মত দিয়েছেন এটা সকলের জানা। মাহদী, মাহফুজ বোনের বিয়ে দিতে সম্মত ছিল না। বাবার রাজি হয়ে যাওয়ায় অনেক ক্ষেপে গেছে তারা। বড় ভাইয়ের নম্বরে বারংবার চেষ্টা করেও কল ঢোকেনি। ফোন দিলেই বলছে,
“আপনি যে নম্বরে কল দিয়েছেন তা এই মুহূর্তে বন্ধ আছে। অনুগ্রহ পূর্বক কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন। The number is currently unreachable. Please try again.”
রাগে মাহদী কথা বলতে ভুলে গেলো। মাহাবুব আলম মেয়ের রুমে গিয়ে আস্তে করে বললো,
“বাবা তোমার খারাপ চাইবো না মামণি। বাবাকে বিশ্বাস আছে?”
মানহা বাবার দিকে ছলছল নেত্রে তাকিয়ে থাকলো। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে মানহা চুপ মেরে গেলো। মাহাবুব আলম মেয়ের মাথা বুকে টেনে বললেন,

“বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসি। এই বিয়েটা হলে তুমি ভালো থাকবে। তুমি কি বিয়েতে মত দিবে?”
মানহা বাবার কোলে আদুরে বিড়াল ছানার মতো পড়ে রইলো। কিচ্ছু বললো না। তার চোখ থেকে বর্ষণ হচ্ছে। বাবার মুখের উপর আজ পর্যন্ত কোনো কথা বলেনি কিন্তু এবার চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,
“বাবা আমি বিয়ে করবো না।”
মাহাবুব আলম মেয়ের মনের কথা বুঝলেন যেন। মেয়েকে নিজের বুক থেকে তুলে চোখ মুছে বললেন,
“বাবাকে বিশ্বাস করলে বিয়েতে মত দিও আর যদি বিশ্বাস না করো তাহলে মত না দিলেও সমস্যা নেই। আমি তাদেরকে না করে দিবো।”
মানহা দ্বিধাদ্বন্দ্বে বাবার মুখের দিকে চাইলো। বাবাকে অবিশ্বাস সে কোনো কালেই করেনা কিন্তু এবার সে দোটানায় ভুগছে। বেশ অনেক্ষণ পর মেয়ের ঘর থেকে বের হলেন মাহাবুব আলম। মাহদী, মাহফুজ বাবার দিকে চেয়ে আছে। মাহাবুব আলম ধীর পায়ে হেঁটে উঠোনে বসা ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
“মেয়ে বিয়েতে রাজি।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার মুখ উজ্জ্বল হলো। ইহাবের ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি। মাহদী বাবাকে পাশে টেনে চাপা স্বরে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কিসব বলছেন আব্বা? আপনার মাথা ঠিক আছে? ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের কাছে বিয়ে দিলেন না মেয়েকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবেন না বলে অথচ আজ বিয়েতে মত দিচ্ছেন কেন?
মাহাবুব আলম শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“কারণ এর থেকে যোগ্য পাত্র আমার মানহার জন্য একটিও নেই।”
মাহদী ভীষণ অবাক হলো। সে বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“এসব কি বলছেন আব্বা? আপনি কি পুরোনো দিনের কথা ভুলে গেছেন? ওই পরিবারের সাথে দ্বন্দ্বের কথা ভুলে গেছেন? এতকাল মানহার জন্য যেমন আল্লাহ ভীরু পাত্রের সন্ধান আপনি করেছেন ইহাব ভুঁইয়া কি সেরকম ছেলে? আপনি কি তাদের টাকা পয়সা দেখে মানহাকে কুরবানী করছেন আব্বা?”
মাহবুব আলম ছেলেকে ধমকে উঠে বললেন,
“মাহদী মুখে লাগাম টানো। আমি যা জানি বা আমার অভিজ্ঞতার এক পার্সেন্টও এখন পর্যন্ত অর্জন করতে পারোনি তোমরা? তাই অহেতুক ফালতু কথা বলে আমাকে রাগিয়ে দিবে না।”
মাহদী এই প্রথম বাবার সাথে এতো অবাধ্য হয়ে কথা বলেছে। তাই ‘দুঃখিত’ বলে অন্যপাশে সরে গেলো। মাহাবুব আলম ধীর পায়ে হেঁটে ফাঁকা চেয়ারে বসলেন। তারপর বললেন,

“বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেলুন তাহলে।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া গলা খাকারি দিয়ে বললেন,
“জ্বি আজকেই আকদটা সেরে ফেলতে চাচ্ছিলাম।”
“কিন্তু আমার বড় ছেলের অনুপস্থিতে বিয়েটা দেই কিভাবে? বিয়েটা দুই একদিন পরে হলে ভালো হয়না?”
ইহাব চট করে বলে বসলো,
“এখন তো শুধু কাবিন করে রাখবো। উঠিয়ে তো নিবো না। যেদিন উঠিয়ে নিবো সেদিন নাহয় আপনাদের বড় ছেলেকে ইনফর্ম করবেন।”
ইহাবের শেষের কথাটা কিছুটা গম্ভীর শোনালো। মাহাবুব আলম কিছুটা বিভ্রান্ত হলেন। মাহদী, মাহফুজ বাবার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। মাহফুজ কিছুটা উচ্চস্বরে বললো,
“আমাদের বড় ভাইয়া না আসা অবধি বিয়েটা হচ্ছে না। বিয়েতে তো মত দেয়াই হয়েছে। আপনারা বলেছেন মত শুনেই চলে যাবেন কিন্তু এখন আবার আকদ সেরে ফেলতে চাওয়ার কারণ কি?”
কথাটা শুনে ইহাব হাতের মুঠো শক্ত করে ফেললো। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া মাহফুজের দিকে চেয়ে মুচকি হাসলেন। বললেন,

“এতো রেগে যাওয়ার কিছু নেই। তোমাদের ভাইয়াকে আজকেই ইনফর্ম করো। সে আসলে নাহয় আমরা বিয়েটা পড়াবো।”
মাহফুজ কথার খেই হারালো যেন। বড় ভাইকে তো ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ইভেন নিশাত ভাবির ফোনও সুইচড অফ। কিভাবে যোগাযোগ করবে তাদের সাথে? মাহাবুব আলম শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“ঠিক আছে। আকদ সেরে ফেলুন।”
মাহদী, মাহফুজ উভয়ই চমকে গেলো। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া এবং ইহাব ভুঁইয়ার ঠোঁটে রহস্যময় মুচকি হাসি। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে একটি মিষ্টি মুখে পুড়লেন
খুবই সাদামাটা ভাবে দুই লক্ষ টাকা কাবিন ধরে ইহাব ভুঁইয়া এবং মানহা আফরিনের বিবাহ সম্পন্ন হলো। বিয়ে সম্পন্ন করে ভুঁইয়া পরিবার চলে গেলেন। মাহদী, মাহফুজ বাবার সাথে একটা কথাও বললো না। ভীষণ রেগে আছে তারা। মায়মুনা বেগম মেয়ের ঘরে মেয়ের কান্না থামাচ্ছেন। মাহাবুব আলম উঠোনে বসে রইলেন। তার চোখেমুখে অজস্র রহস্য খেলা করছে।

মারওয়ান খুব সকালে কোথায় যেন বের হয়েছে। নিশাতের ফোনটা নষ্ট হয়ে গেছে। ফোনটা ঠিক করাতে হবে। গত পরশু স্কুলের সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে হাত ফসকে ফোনটা পড়ে গিয়ে বারোটা বেজে গেছে। কারো সাথে যোগাযোগও করতে পারছে না। ফজর পড়ে নিত্যদিনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো নিশাত। মারওয়ানকে এতো সকালে তাদের বিয়ের পর থেকে আজ অবধি বের হতে দেখেনি। বেশ কিছুদিন মারওয়ান প্রচণ্ড অস্বাভাবিক আচরণ করছে। গত কয়েকদিন মারওয়ানকে তার কাছে রহস্যময় মানব মনে হচ্ছে। নিশাতের মন খারাপ। কিছু ভাবতে চাচ্ছে না তবুও মনে উদয় হচ্ছে,
“লোকটা খারাপ কিছুর সাথে জড়িয়ে গেলো না তো?”
এই চিন্তা তাকে ভিতর থেকে অস্থির করে তুলছে। ইদানীং বেশিরভাগ সময় বাইরে কাটাচ্ছে। স্বভাবেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। পায়ে কারো ছোঁয়া পেয়ে নিশাতের ভাবনার ছেদ ঘটলো। নিশাত তাকিয়ে দেখলো নাহওয়ান ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে। নিশাত তা দেখে বললো,
“আরে আব্বা চোখে পানি কেন?”
“বাবা কুই?”

“হায় আল্লাহ বাবার জন্য কাদঁছেন? বাবা তো বাইরে গেছে। এসে পড়বে কিছুক্ষণ পর।”
নাহওয়ান মায়ের জামা টেনে বললো,
“বাবার কাচে যাব।”
“আচ্ছা যাবে। এখন মুখ ধুয়ে দেই চলো।”
বলেই ছেলেকে মুখ ধুইয়ে খাবার খাইয়ে দিতে লাগলো। নাহওয়ান খাবার মুখে ঢুকিয়ে না চিবিয়ে বসে আছে। নিশাত প্রথমে অতটা পাত্তা দেয়নি কিন্তু ছেলেকে আজকে খাবার নিয়ে ঝামেলা করতে দেখে বললো,
“খাবার খাচ্ছো না কেন নাহওয়ান?”
নাহওয়ান চোখ ছলছল করে বললো,
“বাবা নাই। বাবা ককোন আচবে?”
নিশাত ছেলেকে কাছে টেনে আদর করতে করতে বললো,
“বাবা এসে পড়বে। আপনি খেলেই চলে আসবে। শান্ত বাচ্চার মতো খাবার খেয়ে নিন।”

নাহওয়ান অল্প খেয়ে আর খেলো না। নিশাত হিমশিম খেলো বাচ্চাটাকে খাওয়াতে। এতদিন মারওয়ান খাওয়াতো, দেখাশোনা করতো। আজকে সে না থাকায় তার অভাববোধ করছে নিশাত। লোকটা কাছে থাকলে আর যাইহোক বাচ্চাটার দেখভাল নিয়ে নিশাতের টেনশন করতে হয়নি। বাচ্চাটাও বাবার ন্যাওটা। বাবাকে দেখেনি দেখে খাবারের প্রতি অনিহা দেখাচ্ছে। চঞ্চলতা, উচ্ছ্বলতা নেই। কেমন যেন ম্লান ও মনমরা ভাব নিয়ে বসে আছে মায়ের কাছে। নিশাতের স্কুলে যেতে হবে একটু পর। লোকটা না আসলে বাচ্চাটার দেখভাল করবে কে? নিশাত ঘড়ির দিকে চাইলো। এখনো আসছে না কেন? চিন্তায় অস্থির অস্থির লাগছে তার। ফোনটাও নষ্ট যে কল দিয়ে জানবে কোথায় আছে।
দরজায় টোকার আওয়াজে নিশাতের ধ্যান ভঙ্গ হলো। ছেলেকে কোলে নিয়েই দরজার এপাশ থেকে বললো,
“কে?”
“আমি।”

নাহওয়ান বাবার গলার আওয়াজ পেয়ে মায়ের কোলে বসেই লাফিয়ে উঠলো। নিশাতের দরজা খুলে দিতে দেরি কিন্তু নাহওয়ানের বাবার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেরি নেই। বাবার গলা ঝাপটে ধরে ‘বাবা বাবা’ বলে কাঁদতে লাগলো। মারওয়ান অবাক হয়ে ছেলেকে কোলে চেপে ধরলো। আচমকা ছেলেকে এভাবে কোলে আসতে দেখে অবাক হয়েছে সে। নিশাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো নিশাত তার দিকে কেমন যেন চোখে তাকিয়ে আছে। মারওয়ান তা দেখে বললো,
“ছেলেকে কাঁদিয়েছিস কেন?”
“আমি কাঁদাই নি। আপনাকে না দেখে কেঁদেছে। কিছু খায়নি ঠিক করে। এখন ছেলেকে সামলান আমি স্কুলে গেলাম।”
বলেই নিশাত রেডি হতে চলে গেলো। মারওয়ান ছেলেকে কোল থেকে উঠিয়ে বললো,
“ওই তুই কাঁদিস কেন? একদম চটকে ভর্তা করে খেয়ে ফেলবো।”
নাহওয়ান নাক টানতে টানতে বললো,
“ইননা, বত্তা কাই না।”
“তোকে খেতে বললো কে? আমি খাবো তোকে।”

“না।”
“হ্যাঁ।”
“মা মাইল দিবে।”
“তোর মাকে মাইর দিবো। তাকে সুদ্ধ খেয়ে ফেলবো। লিলিপুট, লিলিপুটের ছাও কেউ বাদ যাবে না। দুটোই আমার পেটে যাবে, হা হা!”
নিশাত ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে হেঁটে আসতে আসতে বললো,
“ছেলেকে এসব কি শিখাচ্ছেন? একদিন নিষেধ করেছি না? বাচ্চাদের সামনে যা বলা হয় তা তারা দ্রুত আয়ত্ত করে ফেলে। কিসব ছাতার মাথা শিখান? ধামড়া পুরুষ হয়েছেন কোথায় কি বলতে হয় সেটাও শিখিয়ে দিতে হবে আপনাকে এখন?”
“ওরে বাপ্রে লিলিপুট ম্যাডাম ফৌজিয়া নিশাতের কাছ থেকে আমাকে এখন শিখতে হবে কোথায় কি বলতে হবে? এসব জ্ঞান আমাকে না দিয়ে স্কুলের চ্যাংড়া পোলাপানদের দিয়েন লিলিপুট ম্যাডাম।”
নিশাত রাগে গজগজ করতে লাগলো। মারওয়ান ছেলেকে নিয়ে রুমে চলে গেলো। নিশাতও নিজের গন্তব্যে চলে গেলো।

ইমতিয়াজ ভুঁইয়া নিজেদের রুমে ঘুরঘুর করছেন। উর্মি ভুঁইয়া বই পড়ছেন। সময় পেলেই তিনি বই পড়েন। আজকেও অবসরে বই নিয়ে বসেছেন। সাথে নোটবুকও আছে। বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ কিছু লাইন আন্ডারলাইন করে নোটবুকে টুকে রাখছেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার ঘুরাঘুরি তার নজরে পড়ছে না। সে নিজের ভাবনায় গভীরভাবে মগ্ন। হঠাৎ করে পাশে কারো গা ঘেষে বসায় ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলেন। উর্মি ভুঁইয়া বই থেকে মুখ তুলে পাশে চাইলেন। ছেলেকে দেখে বললেন,
“What happend?”
“আসলে আম্মু গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল।”
উর্মি ভুঁইয়া ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“বলে ফেলো। ভনিতা করছো কেন?”
“ইয়ে মানে..”
“ইয়ে মানে কি?”
“আসলে আম্মু, আমার বিয়ে হয়ে গেছে। দোয়া কোরো।”

কথাটা এক নিঃশ্বাসে বলে ইহাব পগারপার। উর্মি ভুঁইয়া কথা বলতে ভুলে গেলেন। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন ছেলের যাওয়ার পানে। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া অদূরে দাঁড়িয়ে কপালের ঘাম মুছছেন। উর্মি ভুঁইয়া তার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে চাইলেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার মনে হলো তার শরীর প্যারালাইজড হয়ে গেছে। উর্মি ভুঁইয়াকে কোনো কথা না বলে তার দিকে ঠান্ডা দৃষ্টি মেলে চাইতে দেখে তিনি কি বলবেন কথা খুঁজে পেলেন না। উর্মি ভুঁইয়া কোনো কথা না বলে আবারও বইয়ে মনোযোগ দিলেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার ভয় আরও বেড়ে গেলো। চিল্লাচিল্লি করে যদি রাগটা মেটাতো তাহলে তো একটু বুক থেকে পাথরটা নামতো। এমন শান্ত হয়ে আছে মানে এটা ঝড় আসার পূর্বাভাস। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া ধীরে ধীরে হেঁটে স্ত্রীর পাশে বসলেন। উর্মি ভুঁইয়া তবুও কিচ্ছু বললেন না। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া চট করে স্ত্রীর হাত ধরে বললেন,

“I’m sorry.”
“Why?” উর্মি ভুঁইয়ার শান্ত কণ্ঠ।
“সেদিনের বিহেভিয়রের জন্য এক্সট্রিমলি সরি।”
উর্মি ভুঁইয়া কিছু বললেন না। স্বামীর হাতের ফাঁক থেকে নিজের হাত টেনে সরিয়ে বই বন্ধ করলেন। উঠে বারান্দায় গিয়ে বসলেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়াও স্ত্রীর পিছু পিছু গেলেন। তার হঠাৎ করে যৌবনের কথা মনে পড়ে গেলো। উর্মির পিছনে এভাবে এককালে ঘুরতেন তিনি। ভেবে কিছুটা মুচকি হাসলেন। বারান্দার গ্রীল ধরে বাইরে তাকিয়ে আছেন উর্মি ভুঁইয়া। পাশে স্বামীর উপস্থিতি পেয়ে বললেন,
“আপনার মধ্যে এখনো অহংকার এবং ক্ষমতার দাপট আছে, এটা কি আপনি বিশ্বাস করেন?”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া কেঁপে উঠে স্ত্রীর দিকে চাইলেন। উর্মি ভুঁইয়া আগের মতোই বলতে লাগলেন,
“আপনি সবার সামনে দেখান যে আপনি আমাকে ভীষণ ভয় পান, আদতে কিন্তু এটা না। আপনি আমাকে সম্মানটুকুও করেন না।”
“কি বলছো উর্মি?”

উর্মি ভুঁইয়া বাইরে থেকে নজর ফিরিয়ে স্বামীর দিকে চাইলেন। তার চোখ দুটো ভয়ংকর দেখাচ্ছে। স্বামীর পাঞ্জাবির কলার দু হাতের মুঠোয় পাকিয়ে বললেন,
“আমাকে আপনার বোকা মনে হয়?”
“শান্ত হও উর্মি। তোমাকে আমার মোটেও বোকা মনে হয়না। বোমা মনে হয়, বোমা।”
“আপনি আমার সাথে ইয়ার্কি করছেন?”
“না, বহু বছর আগের উর্মিকে দেখছি তো তাই আগের মতো কথা বেরিয়ে গেছে।”
উর্মি ভুঁইয়া কথাটা শুনে হাসতে হাসতে মাটিতে বসে গেলেন। বললেন,
“বহু বছর আগের উর্মি কবেই মারা গেছে। আগের উর্মি এলো কোত্থেকে?”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া স্ত্রীর পাশে বসে মাথাটা বুকে টেনে বললেন,
“আমার উর্মি আছে। আমার উর্মি আমার উপর সাময়িক রাগ করেছে কিন্তু আমি জানি আমার উর্মি এখনো জীবিত।”
উর্মি ভুঁইয়া বললেন,

“নাহ, ওই উর্মির কোনো ঠাঁই আমি আমার জীবনে রাখিনি। এখন যে উর্মি আছে সে সম্পুর্ণ নতুন উর্মি। আগের উর্মিকে মাড়িয়ে যার সৃষ্টি।”
বলেই উন্মাদের মতো হাসতে লাগলেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া স্ত্রীকে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলেন। উর্মি ভুঁইয়া হাসি থামিয়ে বললেন,
“ছেলে মেয়েকে খুব সূক্ষ্মভাবে আমার থেকে কেড়ে নিচ্ছেন তাইনা? আজ ছেলে মাকে ছাড়াই বিয়ে করে ফেললো। অনুমতি পর্যন্ত নিলো না। কালকে মেয়ে করবে। বাহ্ তাদের জীবনে আমার দরকার কি? তাদের বাবাই তাদের সব, মায়ের কোনো ভ্যালু নেই। ”
“শুধু কাবিন করিয়ে রেখেছি উর্মি। তাছাড়া তুমি রেগে ছিলে দেখে তোমার পারমিশন নেয়ার সাহস আমাদের কারো হয়নি।”
উর্মি ভুঁইয়া আবারও হেঁসে দিলেন। বললেন,
“আমার সাথে কথা বলতে সাহসও লাগে আপনাদের?”
বলে কিছুক্ষণ হেঁসে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া স্ত্রীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
“তুমি আগের বাচ্চা উর্মিই আছো। আমি ভেবেছিলাম বড় হয়ে গেছো। এই বয়সেও সামান্য বিষয় নিয়ে এতো অভিমান? হা হা”
উর্মি ভুঁইয়ার চোখ থৈ থৈ করছে জলে।

রাতে প্রবল বর্ষণ মাথায় নিয়ে মারওয়ান ঘরে ফিরলো। রাত বাজে তখন আড়াইটা। নিশাত খাটের উপর শক্ত হয়ে বসে আছে। মারওয়ান মাথা মুছে জামা পাল্টিয়ে নিশাতকে ভাত দিতে বললো। কিন্তু নিশাতের কোনো নড়চড় নেই। মারওয়ান বললো,
“সমস্যা কি? কখন থেকে ভাত চাচ্ছি দিচ্ছিস না কেন?”
“এগুলো কি?”
হাতের বস্তুগুলো মারওয়ানের দিকে ধরে বললো। মারওয়ান ভিতরে ভিতরে চমকে উঠলো। কিন্তু উপরে স্বাভাবিক থাকলো। নিশাত উঠে দাড়িয়ে মারওয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো,
“ইয়ারপিস, হিডেন ক্যামেরা, ট্র্যাকার এসব আমাদের ঘরে কি করে?”
মারওয়ান চুপ করেই আছে। নিশাতের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। কিছুটা উচ্চশব্দে বললো,
“আমাদের ঘরের বাল্বের ভিতরে হিডেন ক্যামেরা কি করছে? আলমারির ভিতর ট্র্যাকার কিভাবে এলো? কি করছেন আপনি? সত্যি করে বলুন।”

“এগুলো রেখে দাও।”
“আজকে না জেনে আমি কিছুতেই এসব রাখবো না? কি করে বেড়াচ্ছেন আপনি? স্ট্রেটকাট বলুন। এসব নিশ্চয়ই ঘরে হেঁটে হেঁটে আসেনি?”
“এক বড় ভাই এসব দিয়েছেন। তিনি পুলিশে চাকরি করেন। কয়েকদিন আমার কাছে এসব রাখতে বলেছেন। উনি সময় হলে চেয়ে নিবেন। ব্যাস এইটুকুই। ভাত কি দিবি নাকি ঘুমিয়ে পড়বো?”

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৪

নিশাতের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না। সে আজকে একটা নামও দেখেছে। একটা ব্যাজ ছিল সেটা। খাটের নিচের ময়লার স্তূপে এসব ইয়ারপিস, ব্যাজ সে পেয়েছে কয়েকদিন আগে। আজকে বাল্ব নষ্ট হওয়ায় সেটার ঠিক সাথে সূক্ষ্ম ছোট্ট হিডেন ক্যামেরা পেয়েছে। তাই তার যথেষ্ট সন্দেহ হয়েছে আজ। ব্যাজে নাম ছিল ‘মুনতাজির জায়েদ’। কে এই মুনতাজির জায়েদ? পরিচয় কি তার? মারওয়ানের সেই বড় ভাইয়ের ব্যাজ কি এটা? তার ব্যাজ মারওয়ানকে দিবে কেন তিনি? এসবের সাথে মারওয়ানের কানেকশন কি? ইশ আর ভাবতে পারলো না সে। সবকিছু মাথায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৬