ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৯
তাজরীন ফাতিহা
চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে চলন্ত গাড়িটি থেমে গেলো। গাড়ি থেকে প্রথমেই নামলেন ইমতিয়াজ ভুঁইয়া, তারপর ইহাব ভুঁইয়া। গাড়ির পিছনে বসা মানহা, ইহাবের খালা, ফুপি ও আন্ডাবাচ্চারা। পরের আরেকটি গাড়ি থামলো যেটায় বাড়ির পুরুষ সদস্যরা এসেছেন। ধীরে ধীরে তারা সবাই বেরিয়ে গেলেন। মানহা নার্ভাস হয়ে বার বার ঘেমে উঠছে। বোরকা পড়নে তার। বোরকার নিচে শাড়ি। কান্না পাচ্ছে এতো অচেনা, অপরিচিত একটা বাড়িতে এসেছে অথচ সাথে তার পরিচিত কেউ নেই । নিজের পাশ থেকে সবাইকে বেরিয়ে যেতে দেখে সেও আস্তে করে বের হতে নিলে ইহাবের ফুপি ইতি ভুঁইয়া তাকে বেড়োতে সাহায্য করলো। ইহাবকে অদূরে ফোন হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডাক দিলেন,
“ইহাব, বৌমাকে নিয়ে ভেতরে ঢোকো।”
ইহাব বিরক্ত হয়ে বললো,
“পরে ফুপি। তোমরা ঢুকে যাও। আমি একটু পর আসছি।”
“তোমার আম্মু কিন্তু রেগে যাবেন।”
“রাগবে না। আমার জরুরি একটা কাজ আছে। আম্মুকে ম্যানেজ করে নাও প্লিজ।”
ইতি ভুঁইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মানহাকে ধরে ভিতরে ঢুকতে নিচ্ছিলেন পথিমধ্যে ইনাবা দৌঁড়ে এসে মানহাকে ধরলো। মানহা কিছুটা হকচকিয়ে গেল। মানহা বললো,
“আরে ভয় পেও না ভাবি। আমি তোমার ননদিনী। তোমার স্বামীর একমাত্র বোন। আম্মু তোমাকে গেট থেকে নিয়ে আসতে বললো। চলো চলো।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মানহা একটু শিথিল হলো। সে ইনাবাকে সালাম দিলো। ইনাবার তো হেঁসে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। এই প্রথম কেউ তাকে সালাম দিলো বলে হাসতেই থাকলো। মানহার ইনাবাকে দারুন লাগলো। আস্তে আস্তে নকশা খচিত সিঁড়ি বেয়ে উঠে চেয়ারম্যান বাড়ির প্রবেশদ্বারে দাঁড়ালো তারা। মানহা সামনে তাকিয়ে দেখলো বুদ্ধিদীপ্তা, সুন্দর চেহারার মাঝারি গড়নের এক মধ্যবয়সী রমণী দাঁড়িয়ে। মাথায় বড় ওড়না প্যাঁচানো। পড়নে মালবেরি সিল্কের তৈরি বেগুনি রঙের মনোরম কাঞ্জিভরম শাড়ি। মানহার ঘোর লেগে গেলো চোখে। এতো চমৎকার চেহারার একজন মানুষের কাছে আশেপাশের সকল কিছু ফিঁকে লাগছে। আহামরি ফর্সা নন তিনি তবুও এক দেখায় যে কেউ দেখলে মায়াকাড়া এই নারীটির প্রেমে পড়তে বাধ্য।
মানহা মেয়ে হয়েও যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। কে এই নারী? ইহাবকে এখন পর্যন্ত ঠিক করে দেখেনি সে। তাই ওই লোকের সাথে মিল অমিলের কিছু বুঝবে না মানহা। ইনাবার সাথে মিল রয়েছে। তার মানে কি এটাই তার শাশুড়ি?
উর্মি ভুঁইয়া দেখেলেন বোরকা, নিকাবে ঢাকা ইনাবার হাত ধরে এগিয়ে আসা মানহাকে। তিনি হাসলেন না। মানহাকে একবার পরখ করে ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার দিকে চাইলেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া সবাইকে রেখে স্ত্রীর পাশে দাঁড়ালেন। স্ত্রীর কাঁধে হাত দিয়ে বললেন,
“কি হলো উর্মি? ছেলের বউ এনেছি মিষ্টি মুখ করিয়ে বরণ করবে না?”
উর্মি ভুঁইয়া চাপা স্বরে স্বামীর কানে বললেন,
“আপনার পুত্র কোথায়?”
“ওর একটা কাজ পড়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরই এসে পড়বে। তুমি পুত্রবধূকে ঘরে তোলো।”
মানহা ইমতিয়াজ ভুঁইয়াকে সামনে দাঁড়ানো রমণীটির সাথে নিচু কণ্ঠে কথা বলতে দেখে বুঝে গেলো এটাই তার শাশুড়ি। উর্মি ভুঁইয়া মানহাকে ধরে ভিতরে নিয়ে গেলেন। ইনাবা, ইতি ভুঁইয়া, বাড়ির সকল মেয়ে সদস্যের ঢোকার পরে পুরুষ সদস্যরা ঢুকলেন। উর্মি ভুঁইয়া মানহাকে সাথে নিয়ে নিজের রুমে এলেন। নিচে সব পুরুষরা বসা তাই মানহার অস্বস্তি হবে ভেবে নিয়ে এলেন উপরে। মানহাকে দেখে বললেন,
“বোরকা খুলে ফেলো। এখানে কোনো পুরুষ আসবে না।”
মানহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। উর্মি ভুঁইয়া বুঝলেন সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির অস্বস্তি হচ্ছে। তিনি ইনাবাকে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন বোরকা খুলে দিতে। ইনাবা মায়ের ইশারায় মানহার কাছে গিয়ে বললো,
“আরে লজ্জা পাচ্ছো কেন ভাবি? এখানে লজ্জার কিছু নেই। আসো বোরকা খুলে দেই।”
বলেই বোরকা, নিকাব খুলে দিলো ইনাবা। উর্মি ভুঁইয়া দেখলেন, ঘামে তেলতেলে হয়ে যাওয়া মেকআপহীন একটা মায়াবী মুখশ্রী। লাল বেনারসি গায়ে জড়ানো।যে এই মুহূর্তে পুতুলের মতো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ পিটপিট করে এদিক ওদিক তাকিয়ে লজ্জা, অস্বস্তি লুকানোর চেষ্টা করছে। উর্মি ভুঁইয়ার ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি খেলে গেলো। তবে তা বোঝা গেলো না। সালামের মিষ্টি কণ্ঠে তার ভাবনা চিন্তার পরিসমাপ্তি ঘটলো। তিনি বুঝলেন, তার সম্মুখে দাঁড়ানো মায়াবী বদনের মেয়েটির কণ্ঠ হতে তা নিঃসৃত হয়েছে। তিনি সৌম্য স্বরে সালামের প্রতিউত্তর করলেন। ইনাবা মানহাকে দেখে বললো,
“আরে পুতুলের মতো দেখতে তুমি। ভীষণ মিষ্টি।মেকআপ ছাড়াই এত্তো কিউট লাগছে মনে হচ্ছে গাল দুটো টেনে দেই তাই না আম্মু?”
উর্মি ভুঁইয়া কিছু বললেন না। তিনি বিছানার দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখানে গাঢ় লাল রঙের কাঞ্জিভরম শাড়ি রাখা। শাড়িটা হাতে তুলে নিয়ে মানহার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
“আমার সাথে ম্যাচ করে তোমার জন্য এই শাড়িটি নিয়েছি দেখো তো পছন্দ হয় কিনা?”
মানহা শাশুড়ির হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু বললো না। উর্মি ভুঁইয়া বললেন,
“বেনারসি চেঞ্জ করে এটা পড়বে।”
মানহা ঢোক গিলে শাড়ির দিকে চেয়ে রইলো। এতো ভারী শাড়ি পড়তে হবে ভেবেই দম বন্ধ হয়ে আসছে। উর্মি ভুঁইয়া মানহার চেহারায় ঘাম জড়ো হতে দেখে বললেন,
“তোমার ইচ্ছে না করলে পড়ার প্রয়োজন নেই। ইনাবা তোমার ভাবিকে খাবার দাও।”
“আচ্ছা আম্মু।”
মারওয়ান ছেলেকে কোলে নিয়ে খোলা উঠোনে হাঁটছে। নাহওয়ান চাঁদের দিকে তার ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুল উঁচিয়ে বললো,
“বাবা মুন, মুন!”
মারওয়ান সেদিকে তাকিয়ে বললো,
“হুম। শহরে এত্তো সুন্দর ভাবে চাঁদ দেখছিস কখনো?”
নাহওয়ান মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বললো। মারওয়ান ছেলেকে চাঁদের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,
“ভালো করে দেখে রাখ। পরে নাও দেখতে পারিস।”
নাহওয়ান বাবার কথা শুনে মনোযোগ দিয়ে চাঁদ দেখছে আর খিলখিল করে হাসছে। মাহদী, মাহফুজ নিজেদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলো বড় ভাই উঠোনে দাঁড়ানো। তারা চট জলদি সেদিকে এগিয়ে গেলো। মাহফুজ নাহওয়ানের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
“আব্বাজান চাচ্চুর কোলে আসেন।”
নাহওয়ান অসম্মতি জানিয়ে বাবার গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মাহফুজ নাহওয়ানের অসম্মতির তোয়াক্কা না করে তাকে জোর করে কোলে নিয়ে বললো,
“আপনার অনুমতির দরকার নেই। সামনে এরকম গোলুপ্পা থাকলে কেউই আদর না করে থাকতে পারবে না। তাই শান্ত হয়ে আদর উপভোগ করুন আব্বাজান।”
নাহওয়ান এতো দ্রুত ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রথমে আঁচ করতে না পারলেও যখন দেখলো বাবার কোল থেকে চাচ্চুর কোলে ট্রান্সফার হয়েছে তখন ছলছল চোখে বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
“বাবা..।”
মাহফুজ নাহওয়ানের অমন কান্না কান্না গলা শুনে বললো,
“মেঝো ভাইয়া দেখো কোলে নেওয়ায় কেঁদে দিচ্ছে।”
মাহদী হেঁসে নিজের ভাতিজার দিকে চাইলো। মারওয়ান বললো,
“মাহদী তোর চাষাবাদের কি অবস্থা?”
মাহদী মুখ কুঁচকে বললো,
“ওটা চাষাবাদ না ভাইয়া। কৃষি নিয়ে পড়েছি দেখেই চাষাবাদ করবো এমনটা ভাবো কেন? তুমি সবসময় আমাকে পিঞ্চ মারো।”
মারওয়ান লুঙ্গি হাঁটুতে গুঁজে থু ফেলে বললো,
“ঢং করিস না। কৃষি নিয়ে গবেষণা, কোন মৌসুমে কোনটার ফলন ভালো হবে, বিদেশী বীজ এদেশের মাটিতে স্যুট করবে কিনা, কৃষকদের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহায়তা করা এসব আমার চোখে চাষাবাদই। তোরটা হলো ডিজিলটাল চাষাবাদ। দুটোই দেশের জন্য মারাত্মক উপকারী।”
মাহদী কিছু বললো না। বড় ভাইয়া সবসময় এমন করে। তাই অযথা কথা পেঁচিয়ে লাভ নেই। নাহওয়ান বাবাকে এখনো কোলে নিতে না দেখে জোরে চিল্লিয়ে উঠলো। মারওয়ান, মাহদী, মাহফুজ তিনজনই হকচকিয়ে গেলো। মারওয়ান বললো,
“এক নম্বরের ব্রিটিশ। এক্কেবারে মায়ের মতো হয়েছে। এর জ্বালায় কোথাও একটু শান্তিতে দাঁড়াতে পারি না
তোকে কোলে নিবো না আজ। থাক চাচাদের কোলে।আমি গেলাম। টা টা।”
বলেই লুঙ্গি উপরে উঠিয়ে হাঁটা দিলো ঘরের উদ্দেশ্যে। নাহওয়ান বাবাকে চলে যেতে দেখে মাহফুজের কোলে বাইম মাছের মতো লাফালাফি করতে লাগলো। মাহফুজ ভাতিজাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। নাহওয়ান ছাড়া পেয়ে বাবার দিকে দৌঁড়ে গেলো। মারওয়ান হাঁটতে গিয়ে বাঁধা পেলো। নিচে তাকিয়ে দেখলো নাহওয়ান তার পা জড়িয়ে ধরেছে। সে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর পিছনে তাকিয়ে বললো,
“এতো বড় দামড়া গরু হয়েছিস অথচ একটা বাচ্চাকে কয়েক মিনিট রাখতে পারলি না তোরা? সো স্যাড। বেশি বেশি ঘাস খাবি এতে যদি শক্তি সামর্থ্য হয় আরকি।”
বলে নাহওয়ানকে ছাড়িয়ে লুঙ্গি ধরে দৌঁড় দিলো। নাহওয়ান বাবাকে দৌঁড় দিতে দেখে নিজেও বাবার পিছন পিছন হেঁসে দিয়ে দৌঁড়াতে লাগলো। মাহদী, মাহফুজ বোকার মতো বড় ভাই আর ভাতিজার দৌড়াদৌড়ি দেখছে। তাদের কাছে উপভোগ্য লাগছে। মানহার চলে যাওয়ায় মন খারাপ হলেও এখন একটু ভালো লাগছে। মারওয়ান দৌঁড়ে তাদের কাছে এসে বললো,
“এই হাঁদারাম গুলো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? লাগা দৌঁড়।”
বড় ভাইয়ের কথা শুনে তারা দুই ভাই উঠোনের মাঝখানে দৌড়ানো শুরু করেছে আর নাহওয়ানকে বলছে,
“চাচ্চুকে ধরেন আব্বাজান।”
আর মারওয়ান পাঁচ টাকার নোট দেখিয়ে বলছে,
“ধরতে পারলে পাঁচ টাকা, পাঁচ টাকা।”
নাহওয়ান তিনজনকে দৌঁড়াতে দেখে ভীষণ মজা পাচ্ছে। ছোট্ট ছোট্ট গুলুমুলু শরীরটা হেঁসে হেঁসে দৌঁড়ে যাচ্ছে বাবা, চাচাদের পিছনে। চমৎকার এক মায়াময় দৃশ্য!
একটু আগে মানহাকে ইহাবের ঘরে দিয়ে গেছে সবাই। রুমটি বেশ বড় ও দামী আসবাবপত্রে ঠাসা। মানহার প্রচুর নার্ভাস লাগছে। হাতের তালু ঘেমে উঠছে বার বার। এতোটা নার্ভাস বোধহয় জীবনে কোনোদিন হয়নি সে। সম্পূর্ণ অপরিচিত, অচেনা একজন মানুষের সাথে পুরো রাত থাকতে হবে ভেবেই মানহার প্যানিক অ্যাটাকের মতো অনুভূত হচ্ছে। যেকোনো সময় অজ্ঞান হয়ে যাবে এমন লাগছে। দুম করে দরজা খুলে ইহাব রুমে ঢুকলো। মানহাকে তার স্টাডি টেবিলের চেয়ারে রোবটের মতো বসে থাকতে দেখে বিরক্ত হলো সে। পাঞ্জাবির কলার ঠিক করে মানহার বিপরীত পাশে বসলো। মানহা তাকালো না পর্যন্ত। একদম শক্ত হয়ে বসে থাকলো। ইহাব মানহাকে ভ্রু কুঁচকে পর্যবেক্ষণ করলো। মানহা বেশ কিছুক্ষণ পর মুখ নিচু করেই মিনমিন করে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
ইহাব কৌতুকপূর্ণ হাসলো। বললো,
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। ওরে বাপরে সালাম দেয়া হচ্ছে। খুব সভ্য আপনি? ভাঁজা মাছ উল্টে খেতে জানেন না মনে হয় অথচ আপনি মোটেও এমন না। আপনার দুপুরের বিহেভ ভুলিনি কিন্তু।”
মানহা চমকালো মনে মনে। ইহাব বললো,
“দেখি আমার দিকে তাকান।”
মানহা তাকালো না। হাত মুঠো করে চুপটি করে বসে রইলো। ইহাব জোরে ধমক দিয়ে বললো,
“তাকাতে বললাম না। ভাইটা যেমন পল্টিবাজ বোনটা ঠিক তেমন। সকালে এক সুরুৎ, দুপুরে আরেক আবার রাতে আরেক রূপ। পুরাই গিরগিটির বংশধর।”
মানহা হাত মুঠো করে রাগটা কন্ট্রোল করলো। তারপর ইহাবের দিকে চাইলো। ইহাব টেবিলে কুনুই ঠেকিয়ে মাথায় হাত রেখে মানহার দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বললো,
“মেহেগনি গাছের ফল খেয়ে এসেছো নাকি? মুখে হাসি কই? স্বামীর সামনে তিতা করল্লা চিবানোর মতো মুখ করে আছো কেন? সুন্দর করে হেঁসে তাকাও।”
মানহার রাগে পিত্ত পর্যন্ত জ্বলে যাচ্ছে। কোথায় অপরিচিত মেয়ের সাথে নরম সুরে পরিচিত হবে তা না সেই তখন থেকে ধমক দিয়েই যাচ্ছে। ইহাবের দিকে ঠোঁট টেনে চাইলো। ইহাব আবারও ধমকের স্বরে বললো,
“ভালোই লাগছে। তোমার তুলনায় শাড়িটা বেশি সুন্দর। অবশ্য শাড়ির জন্যই দেখতে ভালো লাগছে। মাকেও এমন একটা শাড়ি পড়নে দেখলাম। নিশ্চয়ই মা দিয়েছে?”
মানহা মাথা নাড়ালো। ইহাব আবারও ধমকে উঠে বললো,
“মুখে কথা নেই কেন? সেই কখন থেকে শুধু মাথাই নাড়িয়ে যাচ্ছো, মুখ নেই তোমার?”
মানহার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো এবার। প্রত্যেকটা কথা এমন ধমক দিয়ে বলতে হবে কেন? সে দাঁড়িয়ে মাথা থেকে আঁচল ফেলে কোমরে গুঁজে ইহাবের দিকে কঠিন নজরে চাইলো। ইহাব থতমত খেয়ে তাকালো। পরক্ষনেই নিজের গুরুগম্ভীর রূপে ফিরে গিয়ে বললো,
“কি হলো? এভাবে দাঁড়িয়ে গেলে কেন? বসো দুপুরের হিসেবটা নিয়ে নেই আগে।?”
“কি হিসেব নিবেন? আপনাকে ভয় পাই নাকি? আপনার চাকর নই আমি তাই ভুলেও ধমক দিয়ে কথা বলতে আসবেন না।”
ইহাব পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে দুই লক্ষ টাকার বান্ডিল বের করে টেবিলে রাখলো। বান্ডিল দুটো উঁচিয়ে বললো,
“নিবা?”
“না।”
“আর একবার জিজ্ঞেস করবো, নিবা?”
“উহু। আমি টাকার লোভী না।”
ইহাব বান্ডিল দুটো পকেটের ভিতর ঢুকিয়ে বললো,
“তাহলে তো আমারই ভালো। দেনমোহর আর দিতে হলো না। আল্লাহ আমাকে এতবড় লুট হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।”
মানহা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বললো,
“এটা অন্যায়। আমার হক আমাকে দিন।”
ইহাব দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির বোতাম খুলে বললো,
“দিতাম কিন্তু দুটো কারণে এখন আর দিবো না। প্রথম কারণ আমার সঙ্গে উঁচু স্বরে কথা বলেছো আর দ্বিতীয় কারণ তোমাকে কয়েকবার টাকা সাধার পরেও তুমি নাও নি। এসব চড়াল মেজাজের অহংকারী মেয়েছেলেকে একটা টাকাও দিবো না আমি।”
মানহা বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। সব বললো ওই লোক এখন দোষ পড়েছে তার? ধমক দিলো, কথা শুনলো আর সে জাস্ট একটু প্রতিউত্তর করেছে তাই তাকে তার মোহরানা দিবে না? কতবড় জালিয়াতি তার সাথে। মানহার ছোট বেলা থেকেই স্বভাব কেউ তার ভাগ অথবা হকের কিছু কেড়ে নিলে আক্রমণ করে নিয়ে নেয়া। তার মাথায় এখন সেটাই ভর করছে। ইহাবের ফোলা পকেটের দিকে চেয়ে আচমকা হামলে পড়লো। ইহাব আঁতকা আক্রমণে কিছুটা পিছিয়ে গেলো। সাথে ভয়ও পেলো। মানহা পকেট হাতড়ে টাকা নিতে গেলে ইহাব মানহার হাত শক্ত করে ধরে বললো,
“ছিনতাইকারী; এক নাম্বারের পকেটমার। ছাড়ো আমার পাঞ্জাবি। এই না বললে টাকার লোভী নও তাহলে এখন পকেট মারছো কেন?”
মানহা ইহাবের চোখের দিকে চেয়ে বললো,
“আমার হাত ছাড়ুন। আমার হক আমাকে দিন। আমার সাথে প্রতারণা করে পার পাবেন ভেবেছেন? আর পকেটমার, ছিনতাইকারী এসব কি? আমার পাওনা আমি নিচ্ছি এতে পকেটমার হলাম কিভাবে? প্রতারক লোক কোথাকার।”
ইহাব কঠিন নজরে মানহার দিকে চেয়ে রইলো। অপরদিকে মানহাও চোখমুখ শক্ত করে ইহাবের পকেটে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। ইহাব বললো,
“আমি ঘুমিয়ে গেলে নিতে।”
মানহা অন্যদিকে চেয়ে বললো,
“ওসব চোরা অভ্যাস আমার নেই। মোহরানা হাতে হাতে আদায় করবো। লুকিয়ে নিতে যাবো কোন দুঃখে?”
ইহাব পরাজিত ভঙ্গিতে মানহার হাত ছেড়ে দিলো। মানহা এক লক্ষ টাকার দুটো বান্ডিল নিয়ে তার আনা ব্যাগের মধ্যে জামাকাপড়ের ভাঁজে ঢুকিয়ে রাখলো। ইহাব তা দেখে বললো,
“কোথায় রেখেছো দেখে ফেললাম তো।”
মানহা ব্যাগে জামাকাপড় ভরতে ভরতে বললো,
“তাতে কি? এই টাকা এখান থেকে সরলে আপনার গলায় ছুরি ধরে আবারও দুই লক্ষ টাকা আদায় করে নেবো কারণ এখানে টাকা রেখেছি সেটা কেবল আপনিই জানেন আর তাছাড়াও আপনি ছাড়া আমার ব্যাগ বা টাকা হাতাতে কেউই আসবে না।”
ইহাব নাক মুখ কুঁচকে বললো,
“আমি যার তার ব্যাগ হাতাই না। এসব স্বভাব তোমার থাকলেও আমার নেই। এসেই আমাকে খালি করে দিয়েছো। তুমি যে কতো ডেঞ্জারাস মাল সেটা বুঝে গেছি অনেক আগেই। উপরে ভোলাভালা আর ভিতরে কদমতলা।”
মানহা ইহাবের দিকে কঠিন নজরে চাইলো। বললো,
“আমি মানুষের সাথে তার স্বভাব অনুযায়ী আচরণ করি। আপনি ফালতু তাই আচরণও করলাম এমন।”
ইহাব বললো,
“রাস্তায়, বাড়িতে যে কয়বার গিয়েছি এরকম উড়নচণ্ডী তো দেখি নি। রুমে ঢুকেই কি সুন্দর লাজুক, নার্ভাস মুখ দেখলাম। এখন এই হাল কেন?”
মানহা একটা সুতির সেলোয়ার কামিজ নিয়ে বাথরুমে যেতে যেতে বললো,
“তখন আপনি পর পুরুষ ছিলেন তাই আমার কণ্ঠও শোনেন নি আর উড়নচণ্ডী রূপ দেখা তো দূরের কথা। এখন থেকে প্রতিদিন দেখবেন আমার রূপ। আপনাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে দিবো আমি।”
ইহাব হেঁসে বললো,
“সেই পোড়া কয়লা গায়ে মেখে আলকাতরা সুন্দরী হয়ে যেও কেমন।”
মানহা প্রতিউত্তর করলো না আর। ততক্ষণে বাথরুমে ঢুকে গিয়েছে সে। অনেকক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে বের হলো। ভারী কাঞ্জিভরম শাড়ীটা শুধু পাল্টেছে সে। মাথায় চুলগুলো খোপা করে হেয়ার ক্লিপ দিয়ে আটকানো। ইহাব সেদিকে চেয়ে বললো,
“বউ দ্রুত বিছানায় আসো। মোহরানা প্রতিশোধ করে তোমার হক আদায় করেছি এখন আমার হকটা দ্রুত আদায় করতে দাও। কুইক।”
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৮
মানহা চমকে তাকালো। আবারও হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগলো তার। ইহাব সেদিকে তাকিয়ে ভ্রু বাকালো। মানহা কাঁপতে কাঁপতে নিচে বসে পড়লো। ইহাব এতক্ষণ মজা করলেও মানহাকে মাত্রাতিরিক্ত কাঁপতে দেখে দ্রুত গিয়ে ধরলো। ইহাব ধরার সাথে সাথে মানহা জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়লো।