ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২১
তাজরীন ফাতিহা
রাত বারোটা ত্রিশ। সারাদিন বাইরেই কেটেছে ইহাবের। বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর কিছু দরকারী কাজ সেরে মাত্র বাড়িতে ঢুকলো সে। উর্মি ভুঁইয়া ডাইনিং টেবিলে খাতা কলম নিয়ে বসা। ইহাবকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে বললেন,
“তোমার যে বিয়ে হয়েছে তা তুমি ভুলে গেছো?”
ইহাব মায়ের শান্ত কণ্ঠে চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেলো। ইতোমধ্যে সিঁড়ি বেয়ে ইমতিয়াজ ভুঁইয়া নামলেন। ইহাবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,
“দাঁড়িয়ে আছো কেন? রুমে যাও ফ্রেশ হও।”
উর্মি ভুঁইয়া চশমা খুলে টেবিল থেকে উঠলেন। ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
“কথার জবাব দিচ্ছ না কেন? কালকেও তুমি বিয়ে করে বউকে সাথে নিয়ে ঢোকো নি, তুমি চাও কি? বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও এমন বুলশিট কাজকর্ম করার মানে কি?”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া বললেন,
“আহা, ছেলেটা মাত্র আসলো তুমি পরে জেরা কোরো উর্মি।”
উর্মি ভুঁইয়া ছেলের দিকে তাকিয়েই বললেন,
“মা, ছেলের কথার মাঝে কারো কথা বলা অ্যালাউ না।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া আর কিছু বললেন না। ইহাব মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“একটু কাজ ছিল আম্মু। ব্যবসা আবারও রিস্টার্ট করবো তো এই নিয়ে কয়েকদিন ব্যস্ততা যাচ্ছে।”
উর্মি ভুঁইয়া বললেন,
“তোমার ব্যবসায়িক ব্যস্ততা বিয়ের পরই শুরু হলো কেন হঠাৎ?”
“ঘরে আমার অধীনে একজন এসেছে এখন তার ভরণপোষণ, দেখাশোনা তো আমাকেই করতে হবে আম্মু। বাবার টাকা দিয়ে নিশ্চয়ই আমার স্ত্রীকে পালবো না তাই না?
উর্মি ভুঁইয়া আর কিছু বললেন না। ছেলেকে ঘরে যেতে ইশারা করলেন। ইহাব মায়ের সামনে থেকে চলে গেলো। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া বললেন,
“উর্মি রুমে আসো, ঘুমাবো।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
উর্মি ভুঁইয়া আবারও ডাইনিং টেবিলে বসে খাতায় লিখতে বসে গেলেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া তার পাশে বসে বললেন,
“এখন আবার খাতা, কলম নিয়ে বসলে কেন? এখনই রুমে চলো ঘুমাবে তুমি। এতো রাত পর্যন্ত জেগে থাকলে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে উর্মি।”
“হবো না। আপনি ঘুমাতে যান। আমি কাজটা শেষ করে আসছি।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া বললেন,
“সব কিছুতে তোমার ত্যাড়ামি এখনো গেলো না? যা নিজে বলবে সেটাই হবে। সেই ইয়াং বয়স থেকে আমাকে জ্বালিয়ে মারছো তুমি?”
উর্মি ভুঁইয়া বললেন,
“আপনাকে নিশ্চয়ই আমি জ্বলতে বলি নি? যেহেতু যেচে পড়ে জ্বলেছেন সেহেতু এর দায় আমার নয়।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া আর কিছু না বলে স্ত্রীর পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকলেন। তারপর আচমকা স্ত্রীকে টেনে উপরে নিয়ে যেতে লাগলেন। উর্মি ভুঁইয়া বললেন,
“আরে কি সমস্যা?”
“এতো কাজ করার প্রয়োজন নেই। এসব কাজের জন্য দাম্পত্য জীবনে দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। চুলোয় যাক কাজকর্ম।”
ইহাব রুমে ঢুকে দেখলো মানহা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে। সে আর কোনো কথা না বলে ওয়াশরুমে চলে গেলো। খানিকক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখলো স্টাডি টেবিলে ভাত, দরকারি রাখা। ইহাব চুপচাপ চেয়ারে বসে খাওয়া শুরু করলো। মাঝপথে খাওয়া থামিয়ে বললো,
“খাওয়া হয়েছে?”
মানহা ‘হু’ বলে চুপ করে রইলো। ইহাব খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করলো,
“কালকে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলে কেন?”
মানহা জবাব দিলো না। ইহাব আবারও বললো,
“নাটক করেছিলে?”
“উহু।”
মানহা এবার কাঁথা সরিয়ে উঠে বসলো। ইহাব তার দিকে চেয়ে বললো,
“তাহলে?”
মানহা রয়েসয়ে বললো,
“আচ্ছা আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন কেন জানতে পারি?”
ইহাব আস্তে ধীরে খাওয়া শেষ করে বেসিনে হাত ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে হাত মুছলো। তারপর মানহার পাশে গিয়ে বসলো। মানহা তা দেখে দুরত্ব বজায় রেখে বসলো। ইহাব সেটা খেয়াল করলেও কিছু বললো না। সে বললো,
“আসলে তোমার ভাইয়ের উপর প্রতিশোধ নিতে তোমাকে বিয়ে করেছি। শ্লা নিজেকে কি ভাবে কে জানে। এখন তোমার উপরে সিনেমার মতো অত্যাচার করবো আর তোমার ভাই সুরসুর করে ভালো হয়ে যাবে।”
মানহা বুঝলো লোকটা ইতরামি করছে। রাগ লাগছে তার। সে বিরোক্তসূচক শব্দ করলো। ইহাব মজা পেলো। সে এবার বললো,
“বউ স্বামীর কাছে আসো। আমি আসলেই তুমি পালাই পালাই করো কেন? এটা কিন্তু ঠিক না।”
মানহা বললো,
“দয়া করে আমার সামনে বার বার স্বামী, স্ত্রী শব্দটা উচ্চারণ করবেন না। আমার এই সম্পর্ক নিয়ে ফোবিয়া আছে। কালকে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কারণও এটা। আমাকে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে দিন। বিয়ে করলেই খালি কাছাকাছি আসতে হবে এমনটা ভাবেন কেন? আর তাছাড়া আজীবন তো আছেই সংসার, স্বামী ধর্ম পালন করার জন্য তখন এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবো। অদ্ভুত ইঙ্গিতপূর্ণ কথাগুলো তখনের জন্য তুলে রাখুন। এখন আমার এগুলো শুনলে গায়ে কাঁপুনি ধরে। যদিও আপনাকে আমার পছন্দ নয় তবুও যেহেতু এখন স্বামী হয়েই গেছেন তাই আপনাকে কথাগুলো জানানোর প্রয়োজন দেখে এসব জানালাম আশা করি তার মান রাখবেন।”
ইহাব বললো,
“বিয়ে করে বউয়ের কাছে যেতে পারবো না তাহলে বিয়ে করলাম কেন?”
“সেটার আমি কি জানি? আপনাকে বিয়ে করার জন্য আমি বা আমার পরিবার জোর করিনি। আপনিই হম্বিতম্বি করে বিয়ে করেছেন। এখন সম্পূর্ণ দায়ভার আপনার।”
ইহাব ফোঁস করে দম ছাড়লো। যেমন ভাই ঠিক তেমন বোন। কোনো কিছু হলেই সব দায়ভার তার। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“ঠিক আছে। তুমি সময় নাও। তবে বেশিদিন নিও না কেমন।”
মানহা কিছু বললো না। মুখ মুচড়ালো। আসছে বেশিদিন সময় নিও না ঢং। ইহাব বললো,
“তা ঘুমাবে কই?”
মানহা ভ্রু বেঁকিয়ে বললো,
“ঘুমাবো কই মানে?”
ইহাব পায়ের উপর পা তুলে বললো,
“একটু আগেই না বললে স্বামী, স্ত্রীর সম্পর্ক না ভাবতে তাহলে যদি সম্পর্ক বাদ দেই তুমি আমার সাথে ঘুমাবে কি পরিচয়ে?”
“অহেতুক কথা বলবেন না। ঘুমানোর সাথে স্বামী, স্ত্রী এলো কোত্থেকে? আপনি এক পাশে আমি অন্য পাশে ব্যাস কাহিনী খতম।”
“কিন্তু আমি তো বউকে না জড়িয়ে ঘুমাবো না। কোলবালিশ আলমারিতে ঢুকিয়ে ফেলেছি তাই আমার সাথে ঘুমাতে চাইলে এরকম করেই ঘুমাতে হবে তুমি রাজি?”
মানহা গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“একটু আগে আপনাকে কি বললাম আপনি কি আমার কথা বোঝেন নি?”
“বুঝেছি।”
“তো বুঝলে এক কথা বার বার বলেন কেন? আমার প্যানিক অ্যাটাক আছে এসবে তবুও ইতরামি করছেন কেন? এগুলো ফান মনে হচ্ছে আপনার?”
“মানুষ যেসবে ভয় পায় সেসবকে জয় করতে হয়। ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে বা দূরে দূরে থাকলেই কি এর সমাধান হবে? এখন ফোবিয়ার জন্য দূরে থাকলে কিন্তু একটা সময় তো ঠিকই এগিয়ে আসতে হবে তখন? তাই ধীরে ধীরে সহজ হওয়ার চেষ্টা করা উচিত।”
“সেটা সময় অনুযায়ী হবো। এখন এতো কথা বলার প্রয়োজন নেই। অনেক রাত হয়েছে এখন ঘুমাবো আমার ঘুম পাচ্ছে।”
বলেই চেয়ার থেকে উঠে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ইহাব নাক কুঁচকে বললো,
“শালার জীবন। বিয়ে করেও যেই বিয়ে না করেও সেই। আল্টিমেটলি যেই লাউ সেই কদু।”
শুনশান রাস্তায় কালো ডোরাকাটা রঙের লং কোটে আবৃত একজন হেঁটে আসছে। হাতে ব্যাগ জাতীয় কিছু। লোকটা বিশাল আলিশান বাড়ির সামনে থামলো। সে ব্যাগ থেকে রোপ বের করে সেটার সাহায্যে বাড়িটির উঁচু দেয়াল টপকালো। খুবই ধীরে ধীরে সামনে এগোতে লাগলো তবুও মধ্যরাতের এই নিরিবিলি পরিবেশে বুট জুতার হালকা খটখট আওয়াজ শোনা গেলো। লোকটা আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করে বারান্দায় ক্যারাবিনা (ধাতব লক যার সাহায্যে উপরে ওঠো যায়) দিয়ে উপরে উঠে গেলো।
লোকটি বারান্দার থাই গ্লাস খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো। ঘরটি ড্রিম লাইটের হালকা আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। সেই আলোতে একজনকে বিছানায় শায়িত দেখলো। লোকটি তার নীল চক্ষু দ্বারা বাজের ন্যায় আশপাশ পর্যবেক্ষণ করে ফেললো। শেলফের নিকটে গিয়ে অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে নিজের কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি পেলো। জিনিসটি হাতের মুঠোয় নিয়ে ক্রুর হাসলো। বিছানার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেঁসে বললো,
“Your game is finished.”
ঘুম থেকে উঠেই মারওয়ানের মাথা ভার ভার লাগছে। আজকে অন্যান্য দিনের তুলনায় মাত্রাতিরিক্ত ঘুমিয়েছে। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখলো না। সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে তার মানে। মারওয়ান আড়মোড়া ভেঙে ঘড়ি দেখলো। সাড়ে বারোটা বাজে। আজকে লিলিপুট, লিলিপুটের ছাও কেউ তার ঘুম ভাঙায় নি অদ্ভুত! মারওয়ান ব্রাশ নিয়ে কলপাড়ে গেলো। মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো আর রান্নাঘরে কেউ নেই। তার ভ্রু জোড়া বেঁকে গেলো। বাড়ি এতো নিস্তব্ধ কেন?
মারওয়ান ঘরে গিয়ে ব্রাশ রেখে বেরিয়ে এসে জোরে ডাকলো,
“মাহদী, মাহফুজ কোথায় তোরা?”
মাহফুজ ঘর থেকে বেরিয়ে বড় ভাইয়ের সামনে দাঁড়ালো। মারওয়ান বললো,
“বাড়ি এতো নিশ্চুপ কেন? সবাই কই?”
মাহদী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“আম্মা ঘরে শুয়ে আছে, মেঝ ভাইয়া কাজে আর আব্বা…”
“কি হলো আব্বা কি?”
“আব্বা ভাবিকে তার বাপের বাড়ি রাখতে গিয়েছেন।”
মারওয়ান আর কিছু বললো না। চুপচাপ হেঁটে ঘরে চলে গেলো। মাহফুজ ভারী অবাক হলো। বউ বাচ্চা চলে গেছে শোনার পরও কোনো হেলদোল নেই একটা মানুষ এতো নির্লিপ্ত কি করে হতে পারে?
মারওয়ান ঘরে ঢুকে প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করে তা ধরিয়ে টানতে লাগলো। তারপর কালকের শার্টের পকেট হাতড়ে চিঠিটা বের করলো। চিঠিটা বার বার পড়লো। তারপর উঠে শার্ট গায়ে জড়ালো। চিঠিটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে লাইটার দিয়ে পুড়িয়ে ফেললো। পোড়ানো শেষ হলে ঘর আটকে বেরিয়ে পড়লো গন্তব্যে।
নাসির উদ্দিন বহুদিন পর মেয়েকে দেখে তব্দা খেয়ে গেলেন। যখন হুঁশে ফিরলেন তখন জোরে নিশাতের মাকে ডেকে উঠলেন। রাবেয়া খাতুন রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন। নিশাত মা, বাবাকে দেখে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। রাবেয়া খাতুন মেয়েকে দেখে সব কিছু ভুলে দৌঁড়ে গিয়ে ঝাপটে ধরে কেঁদে উঠেলন। নিশাতও তাল মিলিয়ে কাদঁছে। নাসির উদ্দিন নিজের চোখের কোণা মুছে দাঁড়িয়ে রইলেন।
নিশাত মাকে ছেড়ে বাবাকে ধরে কেঁদে দিলো। নাসির উদ্দিন বহু কষ্টে চোখের পানি আটকে রেখেছেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। সেই ছোট্ট নিশাত আজ কত বড় হয়ে গেছে। মেয়েকে চোখের দেখাও দেখেনি আজ কতগুলো বছর। বিয়ে হয়ে গেলে মেয়ে বুঝি এতো পর হয়ে যায়? তার সেই ঘর মাতিয়ে রাখা মেয়েটা কতদিন পর বাবার বাড়ি আসলো। নাসির উদ্দিন ভাঙা কণ্ঠে বললেন,
“বাড়ির কথা মনে পড়লো তাহলে।”
নিশাত ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো,
“তোমাদের কথা সারাক্ষণ মনে পড়ে। নিজের জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা কাজ করে এখন বাবা। সংসার আর ভালো লাগে না। আর যাবো না ওই সংসারে।”
বলেই আবার কেঁদে দিলো। নাসির উদ্দিন বুঝলেন মেয়ের আক্ষেপ। তিনি বললেন,
“জামাই, নাতি কই?”
নিশাত বাবার বুক থেকে উঠে চোখ মুছে বললো,
“শ্বশুর আব্বা নাহওয়ানকে নিয়ে বাইরে দাঁড়ানো ভুলেই গেছি। মা ভিতরে যাও।”
রাবেয়া খাতুন সম্মতি জানিয়ে ভিতরে চলে গেলেন। নিশাত বাইরে গিয়ে মাহাবুব আলমকে ভিতরে আসতে বললেন। মাহাবুব আলম নাতিকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। নাসির উদ্দিন বন্ধুরুপী বেয়াইকে দেখে কোলাকুলি করলেন। মাহাবুব আলম বললেন,
“কিরে বাড়িতে যাওয়া যায় না? মেয়ে নেই দেখে ওই বাড়িতে পা- ই দিস না এখন। বেয়াই হয়ে না যাস অন্তত বন্ধু হিসেবেও তো যেতে পারিস।”
নাসির উদ্দিন বললেন,
“আরে ব্যস্ত থাকি ইদানিং। তাছাড়া জমিজমা দেখতে হয়। সময় হয়ে ওঠে না আগের মতো। তুইও তো আসিস না এখন।”
বলেই মাহাবুব আলমের কোলে নাতিকে দেখে হাত বাড়িয়ে দিলেন। নাহওয়ান মুখ ফিরিয়ে নিলো। নানাকে চেনে না সে এই প্রথম দেখলো। তাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নাসির উদ্দিন বললেন,
“আরে আমার নানু ভাই রাগ করেছেন? নানার কোলে আসবেন না?”
মাহাবুব আলম নাতিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“নানা ভাইয়ের কোলে যাও দাদুভাই। ওটা নানা হয় তোমার।”
নাহওয়ান বললো,
“নানু বাই?”
মাহবুব আলম মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললেন। নাহওয়ান নাসির উদ্দিনের দিকে আবারও চাইলো। তারপর দাদার ঘাড়ে মাথা ফেলে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো,
“বাবা কুই? বাবার কাচি যাবু। বাবা বাবা।”
নাসির উদ্দিন বললেন,
“তোর ছেলে কই?”
মাহাবুব আলম কিছু বললেন না। নিশাতের দিকে নাতিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“এবার আমি যাই মা। তোমার শাশুড়ি বাড়িতে একা আছেন।”
“না আব্বা বসুন কিছুক্ষণ। কিছু মুখে দিয়ে তারপর যান।”
“নারে মা। এখনই যেতে হবে। কাজ আছে। তুই সাবধানে থাকিস।”
নাসির উদ্দিন মাহাবুব আলমকে উদ্দেশ্য করে। আবারও বললেন,
“প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলি মনে হলো। তোর ছেলে কি জীবনেও ঠিক হবে না? আমার মেয়ের জীবনটা তোরা নষ্ট করেছিস সাথে আমিও দোষী। এরকম অকর্মণ্য ছেলের কাছে কেন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলাম? তোর ছেলে নাকি কাজ করবে বিয়ের পর এসব বলে বিয়েতে রাজি করিয়েছিলি কই সে তো এখনো কোনো কাজবাজ করে না। মিথ্যা বলিছিলি কেন? শুধুমাত্র বন্ধুত্বের খাতিরে এতবড় ভুল সিদ্ধান্ত কেন যে নিয়েছিলাম এখন হারে হারে টের পাচ্ছি। এর চেয়ে একটা চাষাভূষার হতে মেয়ে দিলেও আজকে মেয়ে স্বামীর সাথে বাবার বাড়ি আসতে পারতো।”
মাহাবুব আলম মাথা নিচু করে থাকলেন। নিশাত বাবাকে ধরে বললো,
“প্লিজ বাবা আব্বাকে কিছু বোলো না। ওই মানুষটার জন্য ফেরেশতার মতো এই মানুষটাকে কথা শুনিও না। তাকে যদি দোষী করো তাহলে অর্ধেক দোষ তোমাদেরও আছে। তোমার সায় না থাকলে এই বিয়ে হতো না। তাই অহেতুক একে অপরকে দোষ দেয়া বন্ধ করো।”
নাসির উদ্দিন ছলছল চোখে বললেন,
“ঠিকই বলেছিস। দোষ আমারও আছে নাহলে কেউ বেকার ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়? শুনেছিলাম বিয়ে হয়ে গেলে আল্লাহ রুজী রোজগার বাড়িয়ে দেন, বেকারের কর্মসংস্থান জুটিয়ে দেন সেই হিসেবে দিয়েছিলাম কিন্তু এমন হবে ভাবিনি রে।”
মাহাবুব আলম আর দাঁড়িয়ে না থেকে চলে যেতে লাগলেন। নিশাত নাহওয়ানকে নামিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে বললো,
“আব্বা মেয়েকে রেখে চলে যাচ্ছেন?”
কথাটা শুনে মাহাবুব আলম চোখের পানি আড়াল করে দাঁড়িয়ে গেলেন। চোখ মুছে ঘুরে বললেন,
“মেয়েকে তার আসল বাবার কাছে দিয়ে গেলাম এই নকল বাবাকে কি দরকার?”
নিশাত দ্রুত এসে মাহাবুব আলমকে জড়িয়ে ধরে জরজর করে কেঁদে দিয়ে বললো,
“আসল নকল বুঝি না। আমার কাছে আমার দুই বাবাই শ্রদ্ধার, ভালোবাসার। নকল বাবা বলে আমাকে পর করে দিচ্ছেন কেন আব্বা?”
মাহাবুব আলম নিশাতের মাথায় হাত ঠেকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
“একদিন তুই অনেক সুখী হবি দেখিস।”
নিশাত কাঁদতেই থাকলো। নাহওয়ান মাকে দেখাদেখি দাদার পা জড়িয়ে ধরলো।
“জিনান আদহাম?”
“ইয়েস স্যার।”
কালো কোট ও মাথায় হ্যাট পড়া নীল চক্ষু বিশিষ্ট জিনান আদহাম নামক ব্যক্তিটি প্রতিউত্তর করলো। বুদ্ধিদীপ্ত মুখ ও অদ্ভুত তার গেটআপ। তার সামনে ইন্টিলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের হেড বসা। হেড টেবিলে দুটো হাত এগিয়ে বললেন,
“Why is your work progressing slowly?”
“আমি তো আমার সর্বোচ্চ ইফোর্ট দিচ্ছি স্যার আপনার কেন এমন মনে হচ্ছে যে কাজ স্লো এগোচ্ছে?”
হেড গম্ভীর মুখে বললেন,
“I have received some allegations about you Adham and my question is based on that.”
“এলিগেশন??”
“ইয়েস।”
আদহামের নীল চক্ষু দুটো কুঁচকে গেলো। পরক্ষণেই তা স্বাভাবিক হয়ে গেলো। সে ক্যাজুয়ালি বললো,
“কেমন এলিগেশন?”
“সেটা জানিয়ে দেয়া হবে। প্রায় অনেকদিন অন্য ডিপার্টমেন্টে ছিলে এখন আবার ইন্টিলিজেন্স গ্রুপের সাথে কাজ করছো তোমার অনুভূতি কেমন?”
“গুড।”
হেড ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“অনলি গুড?”
“কাজে আগের মতো ফ্লো আসলে আশা করি দ্রুতই ফ্যান্টাস্টিক অ্যান্ড আউটস্ট্যান্ডিং বলতে পারবো।”
“বেস্ট অফ লাক। আশা করি দ্রুতই আগের মতো ব্যাক করবে। তোমার অন্যান্য এজেন্টদের সাথে কথা বলে নিবে। অপরাধী কেউ যেন হাতের নাগাল থেকে বেরিয়ে না যায় সেদিকে অল টাইম ফোকাস রাখবে।খুব শীগ্রই তোমার ব্যাজ তোমার হাতে পৌঁছে যাবে।”
“থ্যাঙ্কস স্যার।”
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২০
বলেই আদহাম চমৎকার এক হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। হেড হাসির দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হলেন। সেও হাসির বিপরীতে মুচকি হেঁসে যাওয়ার জন্য ইশারা করলেন। আদহাম ইশারা বুঝে মুখ গম্ভীর করে হেঁটে বেরিয়ে গেলো। হেড তাকিয়ে রইলেন আদহামের যাওয়ার দিকে। এই ইন্টিলিজেন্স গ্রুপের তিনজন তার স্নেহভাজন। জিনান আদহাম, নেওয়াজ শাবীর এবং মুনতাজির জায়েদ।