ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২৪
তাজরীন ফাতিহা
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘরময় পায়চারি করছেন। তার চোখ মুখ গম্ভীর। দু’হাত পিছনে মুড়ে পুরো ঘর হেঁটে বেড়াচ্ছেন। উর্মি ভুঁইয়া অসুস্থ বিধায় আজ বেলা করে শুয়ে ছিলেন। চোখ মেলে ইমতিয়াজ ভুঁইয়াকে অনবরত পায়চারি করতে দেখে কিছুটা আশ্চর্য হলেন। তিনি আস্তে আস্তে শোয়া থেকে উঠে বসে বললেন,
“কি হয়েছে?”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার চলন্ত পা থেমে গেলো। তিনি তড়িঘড়ি করে হেঁটে স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
“আরে উঠছো কেন? শুয়ে থাকো। তোমার জ্বর এখনো কমেনি। ডাক্তার কল করেছি। একটু পরই এসে যাবেন।”
উর্মি ভুঁইয়া শান্ত চোখে চেয়ে বললেন,
“প্রয়োজন নেই। এখন ভালো লাগছে। অযথা কোনো ডাক্তার ডাকবেন না। এখন ডাক্তারের সামনে বসে থাকতেও বিরক্ত লাগবে। তাই আমাকে আমার মতো থাকতে দিন। আপনি এরকম অস্থির হয়ে পায়চারি করছেন কেন?”
“এমনিতেই।”
উর্মি ভুঁইয়া আর কিছু বললেন না। ধীরে ধীরে খাট থেকে নামতে লাগলেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া স্ত্রীকে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলেন। উর্মি ভুঁইয়া কয়েকবার ‘প্রয়োজন নেই’ বলেছিলেন কিন্তু ইমতিয়াজ ভুঁইয়া শুনলে তো।
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া স্ত্রীকে ধরে ধরে সিঁড়ি বেয়ে নামাচ্ছেন। মানহা টেবিলে সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখছিল। শ্বশুর শাশুড়িকে সিঁড়ি ভেঙে নামতে দেখে এগিয়ে গেলো। মানহা উর্মি ভুঁইয়াকে ওপর পাশে ধরে বললেন,
“আব্বু বললেন আপনি অসুস্থ। এই অবস্থায় নামতে গেলেন কেন? ”
উর্মি ভুঁইয়া কিছু বললেন না। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“তোমার ধরতে হবে না। আমি আছি সামলাতে। তুমি তোমার কাজ করো। যাও।”
মানহা মন খারাপ হলো ভীষণ। এই বাড়িতে আসার পরে বুঝেছে তার শ্বশুর তাকে পছন্দ করেনা। দেখলেই দূর দূর করেন। মানহা মুখ নামিয়ে চলে গেলো। উর্মি ভুঁইয়া সবই লক্ষ্য করলেন। বিষয়টা তিনি পছন্দ করলেন না। ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার ধরা হাতটা ছাড়িয়ে নিজেই হাঁটতে লাগলেন আস্তে আস্তে। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া বোকা বনে গেলেন। স্ত্রীর পিছন পিছন যেতে যেতে বললেন,
“কি সমস্যা? হাত ছাড়ালে কেন? সবকিছুতে তোমার জেদ দেখানো লাগে কেন উর্মি?”
উর্মি ভুঁইয়া পিছনে না ফিরেই বললেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আমার ইচ্ছে।”
“সবসময় তোমার ইচ্ছা হলে তো হবে না।”
উর্মি ভুঁইয়া সোফায় বসতে বসতে বললেন,
“নিজের ব্যবহারের দিকে আগে তাকান। আপনার মেয়ের বয়সী পুত্রবধূর সাথে আপনার বিহেভিয়র এমন কেন? ভুলে যাবেন না আপনারাই তাকে পছন্দ করে এই বাড়িতে এনেছেন তাই অন্য বাড়ির মেয়ের অসম্মান হয় এমন কিছু করবেন না আশা করি।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া স্ত্রীর পাশে বসতে বসতে বললেন,
“শোনো আমরা সবাই যদি তুলুতুলু করি তাহলে বিগড়ে যাবে। তাই একজনকে কঠোর হওয়া লাগে। যেহেতু প্রায় বাড়িতে শাশুড়ি, ননদ, ননাসরা ভিলেন হয় আর শ্বশুর ভালো হয় সেহেতু এবারের চিত্রটা একটু ভিন্ন হোক। তুমি কিংবা ইনাবা তো ওরকম ভিলেনগিরি করতে পারবে না তাই আমিই নাহয় সেই দায়িত্বটুকু নিলাম।”
কথাটুকু শুনে উর্মি ভুঁইয়া বেশ বিরক্ত হয়েছেন তা তার চেহারা দেখেই আন্দাজ করতে পারছেন ইমতিয়াজ ভুঁইয়া। উর্মি ভুঁইয়া কিছু না বলে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া আরও কিছুক্ষণ স্ত্রীর পাশে থাকতে চেয়েছিলেন কিন্তু জরুরি ফোনকল আসায় বেরিয়ে যেতে হলো তাকে। এদিকে শ্বশুরকে বেরিয়ে যেতে দেখে মানহা রান্নাঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে শাশুড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“আম্মু নাস্তা এখানে দিবো নাকি টেবিলে?”
উর্মি ভুঁইয়া চোখ খুলে চোখের সামনে দাঁড়ানো মায়াবী মুখাবয়বের ওড়না পেঁচানো মুখটার দিকে চাইলেন। মেয়েটার চেহারায় একটা নূর আছে। দেখলেই খালি তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। উর্মি ভুঁইয়ার সাথে অতটা সখ্যতা হয়নি তবুও আম্মু বলে যখন ডাকে তখন মনটা জুড়িয়ে যায়। তার ইহাব, ইনাবাও তাকে আম্মু ডাকে কিন্তু এই মেয়েটার মুখে আম্মু ডাকটা কেমন যেন মায়ায় মেশানো। মানহার ডাকে বাস্তবে ফিরলেন তিনি। বললেন,
“টেবিলেই দাও। আমি আসছি।”
মানহা ‘জ্বি আচ্ছা’ বলে চলে গেলো। উর্মি ভুঁইয়া কিছুক্ষণ বসে থেকে টেবিলে গিয়ে বসলেন। মানহা ইতোমধ্যে সবকিছু রেডি করে ফেলেছে। উর্মি ভুঁইয়া বসতে বসতে বললেন,
“তুমি খেয়েছো?”
“জ্বি আম্মু।”
“ইহাব কোথায়?”
“উনি খুব সকালে নাস্তা করে বেরিয়ে গেছেন।”
উর্মি ভুঁইয়া ‘ও আচ্ছা’ বলে খাবার খাওয়ায় মনোযোগী হলেন। খাওয়া শেষ করে উঠতে নিলে মানহা বাঁধা দিয়ে বললো,
“আম্মু ওষুধটা খেয়ে যান।”
উর্মি ভুঁইয়া দেখলেন পুত্রবধূ ওষুধ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি আবার বসে ওষুধগুলো গলধঃকরণ করলেন। তারপর ধীরে ধীরে হেঁটে বাইরের লনে গিয়ে বসলেন। এখানে বসলে তার শরীর, মন দুটোই ভালো হয়ে যায়। আজকেও ভালো লাগছে। আশপাশের প্রকৃতি যেন তাকে ডাকে তার সাথে মিশে যাওয়ার জন্যে। তিনি নাক টেনে প্রকৃতির সোঁদা গন্ধ নিলেন। আজকের আকাশটা মেঘলা মেঘলা। বৃষ্টি হলে দারুন হবে। তিনি ভিজবেন আজ। এই বৃষ্টির পানি তার সমস্ত রোগ, মন খারাপ শুষে নিক। তার ইচ্ছেকে বাস্তবায়ন করতে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। ইশ কি আরাম লাগছে! গাছের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ে এক ধরনের মনমাতানো তরঙ্গের সৃষ্টি হচ্ছে। বাতাসে গাছের পাতাগুলো হেলতে দুলতে তাদের আনন্দ জানান দিচ্ছে। দূরে হালকা বজ্রধ্বনি শোনা গেলো।
উর্মি ভুঁইয়া দাঁড়িয়ে দু’হাত দুপাশে ছড়িয়ে গগণমুখী হয়ে দাঁড়ালেন। বৃষ্টির ফোঁটাফোঁটা তার মুখে পড়ছে। তার ভীষণ স্বস্তি লাগছে। জুতো খুলে ভেজা ঘাসের উপর হেঁটে হেঁটে গাছগুলোকে ছুঁয়ে দিতে লাগলেন তিনি। মুখে মুখে আওড়াতে লাগলেন,
“আজি বসুন্ধরা সাজিয়াছে বর্ষণে,
ধরিত্রী থমকিয়াছে তীব্র গর্জনে।
বারিধারা বাহিত হয় মৃত্তিকায়,
আনন্দ বহিছে মন পিঞ্জিরায়।
পুষ্প ছড়িয়াছে সুবাস,
ধরণির ঘ্রাণ চিত্ত করে উপবাস।
নবরূপে করিছে স্নান ধরা।
নিসর্গ সিক্ত করে জলকণা,
সুললিত হয় মননধারা।”
~ তাজরীন ফাতিহা
মানহা মনোমুগ্ধ হয়ে আবৃত্তি শুনছিল। সে বৃষ্টি পড়ছে দেখে শাশুড়িকে ডাকতে এসেছিল তখনই উর্মি ভুঁইয়াকে গাছের পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে কবিতা আবৃত্তি করতে শুনে এগিয়ে গিয়ে কবিতা শুনতে শুরু করেছে। বেশ চমৎকার উর্মি ভুঁইয়ার আবৃত্তির কণ্ঠ। উর্মি ভুঁইয়া আবৃত্তি শেষে গাছ থেকে ভিজে ফুল ছিঁড়ে কানে গুঁজলেন। মানহা বললো,
“মাশাআল্লাহ আম্মু, এতো সুন্দর করে আবৃত্তি করতে পারেন আপনি?”
উর্মি ভুঁইয়া চমকে গেলেন। পিছন ফিরে মানহাকে দেখে হাসলেন তিনি। তারপর গাছ থেকে আরেকটু ফুল ছিঁড়ে মানহার কানে গুঁজে দিয়ে বললেন,
“চলো বৃষ্টিতে ভিজি দুই শাশুড়ি, বউমা।”
বলেই মানহাকে নিয়ে ভিজতে লাগলেন। মানহা অনেক বাঁধা দিতে চাইলো কিন্তু উর্মি ভুঁইয়া শুনলেন না। মানহা ভিজতে ভিজতেই বললো,
“আম্মু বৃষ্টির সময় দোয়া কবুল হয়। আপনি আল্লাহর কাছে আপনার প্রয়োজনীয় কিছু চাইতে পারেন।”
উর্মি ভুঁইয়া ভাবলো কিছুক্ষণ। তারপর মনেমনে মহান রবের নিকট কিছু চাইলো। মানহাও চাইলো।
অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভেজায় মানহা, উর্মি ভুঁইয়া দুজনেরই হাঁচি শুরু হয়েছে। বাড়ির সার্ভেন্ট দুজনকে আদা, চা করে দিয়ে গেলো। দুজন এখন সোফায় বসে চা পান করছে। মানহা হাঁচি দিয়ে বললো,
“আম্মু নাবা আপু কবে আসবে?”
উর্মি ভুঁইয়া চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
“ওর এক্সাম শেষ হলে আসবে। ওতো আমাদের সাথে বেশি থাকে না। তবে ছুটি পেলেই হয়েছে তাকে কেউ ধরে বেঁধে আর ঢাকায় রাখতে পারেনা।”
মানহা বললো,
“আচ্ছা আম্মু একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“করো।”
“আপনার পুরো নাম কি উর্মি ভুঁইয়া?”
“হ্যাঁ। কে বলেছে? ইহাব?”
“না। আব্বু আর আপনার ম্যারেজ ডিটেইলস যে লিখা আছে দুতলার সিঁড়ি মুখে ওখান থেকে জেনেছি।”
“ও আচ্ছা। কি জানতে চাও বলো। সাধ্যের মধ্যে থাকলে অবশ্যই বলবো।”
মানহা একটু ইতস্তত করতে করতে বললো,
“আসলে আম্মু ইসলামে স্বামীর পদবী স্ত্রীর নামের পাশে ব্যবহার করা উচিত নয় তবে হারামও নয় যদি না তা বিভ্রান্তি বা বংশগত পরিচয় বিকৃতি না ঘটায়। মোটকথা এটি ইসলামিক আদর্শ নয়, পিতার পদবীই সন্তানের ব্যবহার করা উচিত।”
কথাটুকু বলে মানহা শাশুড়ির দিকে চাইলো কিন্তু উর্মি ভুঁইয়া তৎক্ষণাৎ কিছু বললেন না। চুপচাপ চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
“তোমাকে কে বলেছে ভুঁইয়া তোমার শ্বশুরের পদবী?”
মানহা অবাক হয়ে তাকালো। অবাক হয়েই বললো,
“তাহলে কি আব্বু আপনার পদবী ব্যবহার করেছেন?”
উর্মি ভুঁইয়ার মানহার বোকা বোকা কোথায় হাসলেন। বললেন,
“না।”
মানহা কৌতূহলী হয়ে বললো,
“তাহলে?”
উর্মি ভুঁইয়া চা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন,
“আমিও ভুঁইয়া পরিবারের মেয়ে।”
মানহা ভীষণ অবাক হয়ে বললো,
“আপনিও ভুঁইয়া আব্বুও ভুঁইয়া? দুই ভুঁইয়া পরিবার মিললো কিভাবে?”
“তোমার শ্বশুরের পাগলামিতে।”
বলেই আর না দাঁড়িয়ে উপরে চলে গেলেন তিনি। মানহা এখনো হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মাথায় কেমন জট পাকাতে লাগলো। এরকমটা এই প্রথম শুনলো মানহা। মানুষ যখন প্রথম কিছু শোনে তখন অবাকই হয় বটে।
নাসির উদ্দিন বাজার থেকে এসে মারওয়ানকে দেখে রাগে ফেঁটে পড়লেন। চিৎকার করে বললেন,
“তুমি আমাদের বাড়ি কেন এসেছো?”
মারওয়ান শ্বশুরকে দেখে কদমবুসি করতে এলে নাসির উদ্দিন দূরে সরে গেলেন। মারওয়ান হেঁসে মুখেই লম্বা সালাম দিলো। নাসির উদ্দিন জবাব দিলেন না। বললেন,
“আমার মেয়েকে তোমাকে দিবো না। এমন ছেলের কাছে একবার দিয়েই ভুল করেছি। দ্বিতীয়বার আর সেই ভুল করবো না।”
মারওয়ান কথাটা শুনেইনি এমন ভাব করে শাশুড়িকে বললো,
“আম্মা, আব্বাকে পানি দিন।”
রাবেয়া খাতুন ভীষণ ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আজকে বড় কিছু না ঘটে যায় আবার। মারওয়ানকে তিনি চেনেন। মাত্রাতিরিক্ত ঘাড় বাঁকা স্বভাবের। প্রথম প্রথম ঠান্ডা থাকবে কিন্তু শেষে রেগে গেলে ত্যাড়ামি করে বসবে। প্রথমবার যেবার এসেছিল সেবারই বুঝেছেন তিনি। তিনি দ্রুত নিশাতকে ডাকতে ঘরে গেলেন। নাসির উদ্দিন বললেন,
“আমার কথা তুমি শুনতে পাওনি?”
“আরে আব্বা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি। আপনি উত্তেজিত নাহয়ে রেস্ট নিন। এই বয়সে এতো উত্তেজনা ভালো না।”
নাসির উদ্দিন রাগে গজরাতে গজরাতে বললেন,
“বেয়াদব কোথাকার, আমার সাথে মস্করা করতে আসলে পিটাতে পিটাতে তালগাছে ওঠাবো।”
মারওয়ান যেন মজা পেলো কথাটায়। বললো,
“দ্রুত উঠান। ঢাকায় যাওয়ার পর থেকে তাল খাওয়া হয়নি। কয়েকটা তাল পেড়ে আম্মাকে দেই। পিঠা বানিয়ে দিবে। সেই মজা হবে।”
বলে জিহ্বা বের করে মজা বোঝালো। মারওয়ানের এমন কথা শুনে নাসির উদ্দিনের মন চাচ্ছে সামনে দাঁড়ানো বেহায়া ছেলের মুখের জবান বন্ধ করে দিতে। তিনি রাগান্বিত স্বরে বললেন,
“শুধু গায়ে গতরে বেড়েছো বুদ্ধি এক আনাও বাড়েনি। কোথায় কি বলতে হয় সেটাও জানো না।”
মারওয়ান দুঃখ পাওয়ার ভঙ্গিতে বললো,
“আপনি আমার গতরের দিকে নজর দিচ্ছেন কেন আব্বা? মানলাম আপনি আমার থেকে খাটো, স্বাস্থ্য কম তাই বলে এভাবে নজর দিবেন? ইটস নট ফেয়ার।”
নাসির উদ্দিনের পুরো শরীর রিরি করতে লাগলো। মেয়েকে আসতে দেখে তিনি আর একমুহুর্ত দাঁড়িয়ে না থেকে ঘরে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে মারওয়ানকে ‘বেয়াদব’ বলতে ভুললেন না। নিশাত শেষের সব কথাই শুনেছে। সে মারওয়ানের দিকে কটমট করে চাইলো। মারওয়ান মুখ গম্ভীর করে ডোন্ট কেয়ার ভঙ্গিতে ঘরে চলে গেলো।
নিশাত নিজের ঘরে ঢুকে দেখলো মারওয়ান পায়ের উপর পা তুলে শুয়ে আছে। নিশাত রাগী কণ্ঠে বললো,
“বাবার সাথে ওরকম করলেন কেন?”
মারওয়ান পা নাড়াতে নাড়াতে বললো,
“কি করলাম?”
“কি করলাম মানে? বেয়াদবি করলেন কেন?”
মারওয়ান অবাক হয়েছে এমন ভাব করে বললো,
“কবে, কখন? এতো মধুর সুরে কোনো জামাই আজ পর্যন্ত কথা বলেছে কিনা ইতিহাস ঘেঁটে দেইখো।”
“ওটাকে মধুর সুর নয়, বেয়াদবি বলে। তিনি আপনার গুরুজন। আপনি গুরুজনের মুখে মুখে তর্ক, মজা করে কোন অসাধ্য সাধন করলেন শুনি?”
“তো কি বসে বসে গালি খাবো নাকি?”
“অবশ্যই খাবেন। গালি খাওয়ার কাজ করলে গালি খাবেন না?”
“মেয়ে জামাইকে গালাগালি করে কে?”
নিশাত ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,
“আসছে মেয়ে জামাই। এরকম মেয়ের জামাই শত্রুরও না হোক।”
মারওয়ান হামি দিতে দিতে বললো,
“আমিন।”
নিশাত বললো,
“দ্রুত উঠে বাবার কাছে মাফ চান। যান।”
মারওয়ান শুয়ে থেকেই বললো,
“কখনোই না। তিনি আমার সুন্দর গতরের দিকে নজর দিয়েছেন। আমার প্রেস্টিজে লেগেছে ব্যাপারটা। যেখানে এতো লম্বা, সুদর্শন, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী জামাইকে নিয়ে গর্ব করবেন সেখানে তিনি নজর লাগিয়ে অসুস্থ বানাতে চাচ্ছেন।”
নিশাত বললেন,
“শুধু বাহ্যিক দিক দিয়ে ফিট হলেই হয় না, আগাগোড়া সুপুরুষ হতে হয়। যেটা আপনি নন তাই আপনাকে নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই। আর আপনার খাম্বা সাইজ নিয়ে যে বড়াই, মগোমা। সরি টু স্যে আমার পরিবারের কারো এমন খাম্বা সাইজের দরকার নেই।”
মারওয়ান ঠ্যাং নাড়াতে নাড়াতে বললো,
“বুঝি, বুঝি সবই বুঝি। চাইলেও কি আর আমার সমান হতে পারবে? হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছো দুই বাপ, বেটি। দেখি আমার কবুতরের ছাও কই। এখনো লিলিপুট সাইজ হয়ে আছে ছাওটা। টেনে টেনে লম্বা বানাই গিয়ে।”
বলে উঠে বাইরে চলে গেলো। নিশাত রাগে চেঁচিয়ে বললো,
“খাম্বার বাচ্চা..আ।”
মারওয়ান পর্দা সরিয়ে মাথা ঢুকিয়ে বললো,
“তাকেই আনতে যাচ্ছি। দেখলে আমার সঙ্গে থাকতে থাকতে আমার কথা রপ্ত করে ফেলেছো। গুড চালিয়ে যাও।”
বলে দ্রুত প্রস্থান করলো। নিশাত বুঝলো মারওয়ান তাকে রাগাতে ইতরামি করছে। নিশাত বাথরুমে ঢুকে তাড়াতাড়ি ওযু করে নিলো। মাথায় এখনো রক্ত চড়ে আছে। রাগ কমাতে ওযু করেছে। জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলো সে।
নাহওয়ান তার ছোট্ট শরীরটা নিয়ে মুরগির পিছনে দৌঁড়ে দৌঁড়ে ছুটছিল। মারওয়ান দেখেই ছেলেকে উল্টো করে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“এই কবুতরের ছাও, তুই কোথায় কোথায় ঘুরিস?”
নাহওয়ান বাবার কাঁধে উল্টো ঝুলে ফিচফিচ করে হেঁসে বললো,
“মুনির কাচে চিলাম।”
“ওহ শালির কাছে ছিলি। তোর মুনিকে চিপস দিয়েছিলি?”
নাহওয়ান মাথা কাত করে বললো,
“ডিয়েচি।”
“গুড, ভেরি গুড। গোসল করবি?”
নাহওয়ান খুশিতে ফাল দিয়ে উঠলো। মারওয়ান বললো,
“জামা, কাপড় তো কিছু আনিনি। কি পড়বো?”
নাহওয়ান বাবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো। ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে মারওয়ান চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকলো। উদ্দ্যেশ্য নিশাতের কাছে জামা কাপড় পাওয়া যায় কিনা তা জানতে। একটু পর মুখ কালো করে বেরিয়ে এলো। নিশাতের কাছে কিছু নেই। হতাশ হলো সে। নাহওয়ান দৌঁড়ে এসে বাবার পা জড়িয়ে ধরলো। মারওয়ান তাকিয়ে দেখলো নাহওয়ানের হাতে লুঙ্গি। তার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। জিজ্ঞেস করলো,
“কই পেয়েছিস রে ফাইয়াজ?”
নাহওয়ান আঙুল দিয়ে ঘরের সামনের সিঁড়ি দেখিয়ে দিলো। মারওয়ান খুশি হয়ে গামছা নিয়ে ছেলেকে কাঁধে উঠিয়ে পুকুরে চলে গেলো। নিজের জামা, কাপড় খুলে রেখে লুঙ্গি পড়ে নাহওয়ানকে সিঁড়িতে দাঁড় করিয়ে পুকুরে ডুব দিলো। তারপর পানি থেকে মাথা উঠিয়ে ছেলের দিকে হেঁসে চাইলো। নাহওয়ান বাবাকে মাথা ওঠাতে দেখে হাত তালি দিয়ে লাফাতে লাগলো। বেশিক্ষণ না থেকে নিজেকে ও ছেলেকে গোসল করিয়ে পুকুর থেকে উঠলো। লুঙ্গি ও নাহওয়ানের গেঞ্জি, প্যান্ট ধুয়ে ছেলেকে গামছায় জড়িয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলো।
বাড়িতে ঢুকার সাথে সাথেই শ্বশুরের চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেলো। তিনি জোরে জোরে বলেছন,
“মাত্র গোসল করবো বলে লুঙ্গি গামছা সিঁড়ির উপরে রেখে সাবান আনতে ঘরে ঢুকেছি এসে দেখি লুঙ্গি গায়েব। লুঙ্গি চুরি করতে কে আসবে এখানে? জীবনে যা হয়নি। রাবেয়া তোমার মেয়ে জামাইকে জিজ্ঞেস করো আমার লুঙ্গি নিয়েছে কিনা? সে ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই যে লুঙ্গি ধরবে। চরম মাত্রায় বেয়াদব ছেলে।”
রাবেয়া খাতুন কিছুতেই স্বামীকে শান্ত করতে পারছেন না। নিশাত আর নাজিয়া পাশে দাঁড়িয়ে আছে। নাজিয়া দুলাভাইকে দেখতে পেয়ে নিশাতকে বলে দ্রুত ঘরে চলে গেলো। নিশাত মারওয়ানকে দেখে দ্রুত এগিয়ে গেলো। হাতে ভেজা লুঙ্গি দেখে বললো,
“আপনি না বলে বাবার লুঙ্গি ধরেছেন কেন? আপনি কি আমাকে একটুও শান্তি দিবেন না। আমাকে তো জ্বালিয়ে কয়লা কয়লা বানিয়ে ছেড়েছেন এখন বাবাকে পাগল বানাতে এসেছেন?”
মারওয়ান নিশাতের হাতে লুঙ্গি দিয়ে বললো,
“এটা তোমার বাবার লুঙ্গি আমি কিভাবে জানবো। সামনে পেয়েছি নিয়ে গোসল করতে গেছি। তাছাড়া লুঙ্গি আমি আনিনি এই পোটকার বাচ্চা এনে দিয়েছে আমাকে। তাই আমাকে না ধরে ওকে ধরো।”
বলেই নাহওয়ানকে নিশাতের কোলে দিতে গেলে নাহওয়ান শক্ত করে বাবার গলা জড়িয়ে রাখলো। যেন বোঝাতে চাচ্ছে এখন কোনভাবেই মায়ের কোলে যেতে ইচ্ছুক নয় সে। মারওয়ান ছেলেকে চেপে ধরে বললো,
“তোর কারণে কথা শুনলে, খবর আছে।”
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২৩
নাসির উদ্দিন এতক্ষণে খেয়াল করলেন মারওয়ানকে। নিশাতের হাতে ভেজা লুঙ্গি দেখে তিনি হুংকার দিয়ে বললেন,
“শেষ পর্যন্ত লুঙ্গি নিয়ে টানাটানি। তোমাকে ছাড়বো না বেয়াদব ছেলে।”
মারওয়ান শ্বশুরের হুংকার শুনে ছেলেকে নিয়ে পগারপার।