ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২৮
তাজরীন ফাতিহা
মারওয়ান ঘরে ঢুকে দেখলো মানহা নাহওয়ানকে কোলে নিয়ে শক্ত করে চেপে আদর করছে। নিশাত তার ভালোমন্দ খবর নিচ্ছে। মারওয়ান গলা উঁচিয়ে বললো,
“তোদেরকে এই বাড়ি আসতে কে বলেছে? এতো মাতব্বরি করিস কেন? না জানিয়ে হুট করে যে চলে আসলি বিষয়টা বাজে দেখায় না? এমনিতেই এই বাড়ির লোকজন অন্যরকম এখন তোরা উড়ে এসে জুড়ে বসেছিস। বিশ্রী একটা ব্যাপার না? ওই বেয়াদবটার নাহয় আক্কেল বুদ্ধি নেই তোরও কি ওর সাথে থাকতে থাকতে সব চলে গেছে?”
মানহা বড় ভাইয়ের কঠিন কথা শুনে ছলছল চোখে ভাইয়ের দিকে চাইলো। মারওয়ান শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিশাত তড়িঘড়ি করে দাঁড়িয়ে বললো,
“কি বলছেন এসব?”
মারওয়ান নিশাতের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বললো,
“ভাইবোনের কথার মাঝে বা’হাত ঢোকাবে না। তোমার কোনো কথা শুনতে চাইনা। ওকে জিজ্ঞেস করেছি ওই উত্তর দিবে।”
কথাটুকু বলে ঘাড় ঘুরিয়ে মানহার দিকে চেয়ে বললো,
“কেন এসেছিস না জানিয়ে? এটা কি তোর মামার বাড়ি মনে করেছিস? লিসেন এই বাড়ি তোর কিচ্ছু লাগে না। না মানে না। আমারও কিছু লাগে না জাস্ট তোর ভাবির বাড়ি। আমার, তোর কিংবা তোর আহাম্মক জামাইয়ের কিচ্ছু না। তাই ঢেং ঢেং করে চলে আসার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল নিশ্চয়ই?”
মানহা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে নাহওয়ানকে কোলে নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। মারওয়ান বিরক্ত হয়ে নিজেও বেড়োতে নিলে নিশাত পথ আটকে দাঁড়ালো। নিশাতের মুখভঙ্গি কঠোর। মারওয়ান ভ্রু ভাঁজ করে চাইলো। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“সামনে থেকে সর। এখন মাথা গরম আছে। পরে খারাপ ব্যবহার করলে ভালো লাগবে না।”
নিশাত কথাটা শোনেনি এমন ভাব করে আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। খানিকপর বললো,
“আপনার সমস্যা ঠিক কোন জায়গায়? আপনি সবসময় আমাকে ছোট করে ঠিক কি মজা পান? মানহার সামনে ওসব কথা বলার মানে কি? ও কাল রাতেই আমাকে ফোন করে বলেছে এখানে আসবে। বাবাকেও জানিয়েছি। বাবা আমার ননদ আর ননদের জামাই আসবে শুনে ভীষণ খুশি হয়েছেন। তাই সকাল সকাল বাজার সদাই করে এনেছেন। গাছের টাটকা টাটকা ফল পাড়িয়ে এনেছেন লোক দিয়ে। কিন্তু আপনার ব্যবহারে মানহা কি ভাবলো? নিশ্চয়ই ভেবেছে ভাবি ডেকে এনে ভাইকে দিয়ে অপমান করালো। আপনি কি কোনোদিনও আমাকে একটু শান্তি দেবেন না?”
বলেই নিশাত বেরিয়ে গেলো। মারওয়ান হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নাসির উদ্দিনের মুখে ওই কথা শুনে সে ভেবেছে শ্বশুরমশাই বোধহয় ওদের আসায় বিরক্ত হয়েছে তাই বোনকে অপমানিত হতে দেখে তার সহ্য হয়নি। সেজন্যই তো এতগুলো কথা শুনালো। উফফ যন্ত্রণা! এখন কি করবে?
মানহা কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠিয়ে ফেলেছে। নাহওয়ান ফুপির কোলে বসে ফুপির কান্না দেখছে। ইহাব বিছানায় সটান হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মানহার কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে মানহা তার পায়ের কাছে বসে কাঁদছে। সে তড়াক করে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? কাঁদা কি তোমার কোনো রোগ নাকি? যখনই দেখি ফ্যাচ ফ্যাচ করে ছিঁচকাদুনের মতো কাঁদতে থাকো। ভাইয়ের কাছে এনেছি কই আনন্দে থাকবে তা না শুরু হয়েছে কাঁদা কাঁদি।”
মানহা কোনো জবাব না দিয়ে কাঁদতেই থাকলো। নাহওয়ান অপরিচিত পুরুষের কণ্ঠ শুনে ফুপির কোল থেকে উঁকি দিয়ে ইহাবের দিকে চাইলো। ইহাব মানহার কোলে বসা ছোট্ট ছোট্ট গুলুমুলু দেহের দিকে চাইলো। যে বর্তমানে তার দিকে গোল গোল চোখে চেয়ে আছে। ইহাব বেশ খানিকক্ষণ বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এ দেখি শ্লা ব্রোর কপি। মিনি মারওয়ান আজাদ। সেই চোখ, সেই নাক, সেই ঠোঁট, সেই চেহারা। পুরো বাপের কপি। রাগটাও বাপের মতো নাকি?”
বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো। নাহওয়ান কিছু বললো না। এসব কথা তার বোধগম্য নয়। বাবা, মা ছাড়া বাকি সবার কথা বুঝতে তার সমস্যা হয়। মানহার কান্না কমে গিয়েছে ইহাবের নাহওয়ানের সাথে কথা বলায়। এখন সে ফোঁপাচ্ছে। নাহওয়ান একবার ইহাব আরেকবার মানহার দিকে গোল গোল নজরে চাইলো। তারপর ইহাবের দিকে তাকিয়ে বললো,
“পুপি কাডে। বাবা মাইল ডিচে।”
ইহাব চোখ কপালে তুলে মানহার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমার ভাই তোমাকে মেরেছে? কেন? কি করেছো তুমি?”
মানহা নাহওয়ানের ফুলো ফুলো গালে চুমু দিয়ে বললো,
“মারে নি। বকেছে একটু। দুপুরের খাবার খেয়েই বাবার বাড়ি যাবো। এখানে এক মুহুর্তও থাকতে ইচ্ছে করছে না। বাবার বাড়ি এসেছি বেড়াতে আপনি আমাকে ধরে বেঁধে এই বাড়ি কেন আনলেন?”
ইহাব মুখ গম্ভীর করে বললো,
“তোমার ভাই এই নিয়ে কিছু বলেছে? বাচ্চারা কখনো মিথ্যা বলে না। নিশ্চয়ই তোমাকে মেরেছে।”
মানহা বিরক্ত হলো। বললো,
“আমার বড় ভাইয়া আমাকে কখনো মারে না। মারলে মেঝো কিংবা সেঝো ভাইয়া মেরেছে। তাই অহেতুক কথা প্যাঁচাবেন না। নাহওয়ান বকা, মারা সবকিছুকে মাইর দেয়া বোঝে।”
ইহাব বাচ্চাটার দিকে লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মন চাচ্ছে এই রসগোল্লাটাকে কতক্ষণ কচলাতে। সে মানহার কোল থেকে নাহওয়ানকে কোলে নিলো। নাহওয়ান অপরিচিত পুরুষের কোলে গিয়ে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিলো। মানহা নিতে চাইলে দিলো না ইহাব। বাচ্চাটার গালে, কপালে আদর করে বললো,
“এই রসগোল্লা, আরেকবার কাঁদলে তোমাকে নিয়ে যাবো আমার সাথে।”
নাহওয়ান কোল থেকে নামার জন্য রীতিমত ধস্তাধস্তি শুরু করেছে। এরমধ্যে মারওয়ান ঢুকলো। নাহওয়ান বাবাকে দেখে ‘বাবা বাবা’ বলে ডেকে উঠলো। মারওয়ান রাগী গলায় বললো,
“আমার ছাওকে মেরে ফেলবি নাকি? ওকে এরকম ঝাপটে ধরে চুম্মাচ্ছিস কেন? ওর এসব চুমু টুমু পছন্দ না। ছাড় ওকে। রীতিমত নির্যাতন শুরু করেছে আমার ছাওটার উপর সবাই। কোথাও শান্তি নেই।”
নাহওয়ান বাবার সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
“কুতাও সান্টি নাই। কালি চুমায়।”
বলেই বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে কাঁদতে লাগলো বাচ্চাটা। মারওয়ান দ্রুত ছেলেকে কোলে তুলে নিলো। ইহাবের মোটেও দিতে ইচ্ছে করছিল না। এরকম রসগোল্লার মতো বাচ্চা পেলে আর কি লাগে? মানহা বড় ভাইকে দেখে উল্টো ঘুরে বসে আছে। মুখ দেখাতে ইচ্ছুক নয় সে। মারওয়ান ইহাবকে বললো,
“মানহার সাথে কথা আছে। তুই বের হ ঘর থেকে।”
ইহাব বললো,
“আমি বের হবো কেন? আমার সামনে বলুন শ্লা ব্রো নাহয় দরকার নেই বলার।”
মারওয়ান চোখ গরম করে বললো,
“বেরোবি নাকি ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করবো।”
ইহাব সিনা টানটান করে দাঁড়িয়ে বললো,
“আপনি কিন্তু আসার পর থেকে অপমান করছেন শ্লা ব্রো? কথায় কথায় বাড়ি থেকে বের করার থ্রেট দিচ্ছেন কেন? বাড়ি কি আপনার বাপের?”
“না আমার শ্বশুরের। এখন বের হ।”
ইহাব হামি দিতে দিতে বললো,
“যাচ্ছি যাচ্ছি। শুধু মুখটা ধোয়ার দরকার তাই যাচ্ছি নাহলে যেতাম না। এই রসগোল্লা যাবে আমার সাথে?”
নাহওয়ান এতক্ষণ বাবার কোলে বসে গোল গোল চোখে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিল। ইহাবের কথা শুনে আঁতকে উঠে বাবার গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ইহাব তা দেখে বললো,
“যাহ বাবা ওকে তো শুধু আদরই করেছি এরম আঁতকে উঠলো কেন?”
মারওয়ান ছেলেকে বুকে চেপে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললো,
“এইটুকু বাচ্চাও বুঝে গেছে তুই সুবিধার না।”
ইহাব আফসোসের সুরে শিস বাজাতে বাজাতে বের হতে হতে বলে উঠলো,
“এই দুনিয়ার তালবাহানা বুঝলাম না এক রত্তি।”
ইহাব বেরিয়ে যেতেই মারওয়ান বোনের পাশে বসলো। মানহা এখনো ঘাড় ঘুরিয়ে আছে। ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে না। মারওয়ান ‘চ’ কারান্ত শব্দ করে রসকষহীন গলায় গড়গড় করে বললো,
“শোন উল্টাপাল্টা কথা বলে ফেলেছি। রাগ করিস না।”
মানহা মুখ ঘুরিয়েই রাখলো। মারওয়ান আশপাশ পর্যবেক্ষণ করে দু’টাকা দামের একটা চকলেট বোনের দিকে বাড়িয়ে বললো,
“নে খা। অর্ধেক ভেঙে তোর ভাতিজাকে দিস।”
মানহা চকলেটের দিকে তাকিয়ে ভাইয়ের মুখের দিকে চাইলো। তারপর আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলো। মারওয়ান তা দেখে বললো,
“আরে রাগ কমবে কিসে? আমি তো রাগ টাগ ভাঙাতে পারিনা বা’ল। আচ্ছা ঠিক আছে। আয় তিনজন মিলে খাই। দাড়া চকলেটটা ভাঙি।”
বলে চকলেটের প্যাকেট কামড়ে তিন টুকরো করলো। টুকরো তিনটে ছোট বড় হয়েছে। ব্যাপার না। মারওয়ান ছেলেকে এক টুকরো খাইয়ে এক টুকরো বোনের মুখের সামনে ধরলো। মানহা মুখ ঘুরিয়ে নিতে গেলে মারওয়ান ঘাড় ধরে মুখে ঢুকিয়ে দিলো। মানহা এবার কেঁদে দিলো। মারওয়ান বোনের মাথা বুকে টেনে আদর করে বললো,
“থাক থাক আর কাদিস না। ভাইরা অমন একটু আধটু বকে। তুই তো আমার কাছে নাহওয়ানের মতোই।”
মানহা ভাইকে ঝাপটে ধরে কাঁদতে কাঁদতে অভিমানী গলায় বললো,
“আমাকে তোমার একটুও মনে পড়ে না ভাইয়া? একটু খোঁজও তো কখনো নেও না। খালি সবসময় বকো।”
মারওয়ান বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
“মনে সবসময় পড়ে।”
“কচু পড়ে। মনে পড়লে বুঝি খোঁজ নিতে না?”
“আমার মানুষের সাথে আলগা প্যাঁচাল পাড়তে ভালো লাগে না। আর খোঁজ নিলেই বুঝি মনে পড়ে তা বোঝা যায়?”
মানহা নাক টানতে টানতে বললো,
“হু।”
“আচ্ছা বাদ দে। চকলেটের টুকরোটা খাইয়ে দে দেখি।”
মানহা চকলেটের টুকরো ভাইয়ের মুখে ঢুকিয়ে দিলো। মারওয়ান মুখে নিয়ে চিবুতে চিবুতে বললো,
“আয় তোর ভাবির কাছে যাবি। হেব্বি রেগে গেছে আমার উপর।”
মানহা চোখের পানি মুছে ভাইয়ের সাথে বেরিয়ে গেলো।
মারওয়ান ঘর থেকে বেরোতেই দেখলো ইহাব নাসির উদ্দিনের সাথে ঠ্যাং ছড়িয়ে দিয়ে গল্প গুজব শুরু করেছে। নাসির উদ্দিন মুখটা কুঁচকে রেখেছেন। বোঝাই যাচ্ছে ইহাবের কথায় সাংঘাতিক বিরক্ত হচ্ছেন। ইহাব প্রত্যেকটা কথার আগে, এতো জোরে কাক্কু বলছে যেন পুরো মহল্লা শুনতে পাবে। নাসির উদ্দিন একটা ডাব কেটে ইহাবের হাতে দিলেন। ইহাব ডাব উঁচু করে ঢগ ঢগ করে পানি চালান করতে লাগলো পেটে। নাহওয়ানকে কোলে নিয়ে মারওয়ানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নাসির উদ্দিন বললেন,
“আসেন নানুভাই।”
নাহওয়ান কান ডলে বাবার দিকে চাইলো। মারওয়ান বললো,
“যাবি? ওখানে দুটো রাক্ষস আছে। গেলেই চুমাবে।”
নাহওয়ান জোরে ‘না’ বলে উঠলো। নাসির উদ্দিন বললেন,
“কি হলো চিৎকার দিলো কেন?”
মারওয়ান বললো,
“ও যাবে না তাই।”
নাসির উদ্দিন চোখ ছোট করে বললেন,
“নিশ্চয়ই তুমি কিছু বলেছো নাহলে আসবে না কেন আমার ভাই?”
মারওয়ান চোখ মুখ শক্ত করে ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে বাইরের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলো। নাহওয়ান দাঁড়িয়ে কান ডলতে লাগলো। তারপর বাবাকে চলে যেতে দেখে নিজেও দৌঁড় লাগাতে নিলো তার আগেই নাসির উদ্দিন নাতিকে কোলে তুলে নিলেন। তারপর কাটা ডাবের ভিতর পাইপ দিয়ে নাতির মুখে দিলেন। নাহওয়ান বুদবুদ শব্দ করে পাইপ টানতে লাগলো। ইহাব ডাবের পানি শেষ করে বাইরে হাঁটা দিলো।
“মারওয়ান দাড়া।”
ডাক শুনে বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে গেলো মারওয়ানের। কোনো উত্তর দিলো না। চুপচাপ লুঙ্গি ধরে হাঁটতে লাগলো। ইহাব দৌঁড়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
“তোর সাথে জরুরি কথা আছে। দাঁড়াতে বললাম না।”
“বিশ্বাসঘাতকের সাথে আমার কোনো কথা নেই। এটা আমার বাড়ি না। এখানে কোনো সিনক্রিয়েট করবি না।”
ইহাব মারওয়ানের পথ রোধ করে বললো,
“আমার কথা না শুনে তোকে যেতে দিবো না আমি। জরুরি দেখেই এখানে আসা।”
মারওয়ান ইহাবকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললো,
“তোর বালের প্যাঁচাল শোনার টাইম আমার নেই। আমার বোনকে বিয়ে করে নিজেকে হিরো ভাবিস না। শুধুমাত্র বোনের জামাই দেখে তোকে সহ্য করছি নাহলে এতদিন হাতাহাতি লেগে যেতো। আমার চোখের ত্রিসীমানায় তুই পড়িস না নাহয় খুনাখুনি হয়ে যাবে।”
মারওয়ান হেঁটে সামনে এগোতে নিলে ইহাব বললো,
“এতো চ্যাতার কি হলো? কোনো কথাই তো তোকে বলা যায়না। গরম তেলে পানি পড়ার মতো সবসময় ছ্যাঁত করে উঠিস। মাহাবুব আংকেল তোকে কিছু বলেনি?”
মারওয়ান কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে হেঁটে চলে গেলো। ইহাব বুঝতে পারলো না মারওয়ান আদৌ কিছু জানে নাকি জানে না? তার ভ্রু জোড়া বেঁকে গেলো।
আলো আঁধারির রুমটায় বিভিন্ন কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কলমের খচ খচ আওয়াজে রুমে একটা রহস্যময় তরঙ্গ সৃষ্টি করছে। রুমটায় অল্প পাওয়ারের একটা লাইট জ্বলছে। একটা টেবিল, চেয়ার পাতা। টেবিলে ল্যাপটপ, পিস্তল, চকচকে ছুরি, দূরবীন, মাইক্রোফোন রাখা। চেয়ারে বসে হুডি পড়া একজন কিছু লিখে চলেছে। তার বাম হাত রক্তে ভেজা। কিছুক্ষণ পর কাগজটা ভাঁজ করে রুমের দরজা খুলে একজনকে দিলো। চোখের ইশারায় বুঝালো চিঠিটা ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে। সামনের লোকটি ব্যক্তিটির হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে ব্যক্তিটির হাতের বাহুতে চাইলো। যেখান থেকে অবিরত রক্ত ঝরছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মারাত্মক জখম হয়েছে। লোকটি বললো,
“স্যার আপনার হাত..”
সামনের ব্যক্তিটি তার কথা শেষ করতে না দিয়ে তার দিকে কঠিন চোখে চাইলো। লোকটা ব্যক্তিটির নীল চোখের তীব্র দৃষ্টিতে কথা বন্ধ করে দিলো। তারপর চিঠি হাতে দ্রুত প্রস্থান করলো। ব্যক্তিটি বর্তমানে উইগ, গোঁফ পড়ে আছে। চশমা পড়েও ছিল কিন্তু সেটা ভেঙে যাওয়ায় খুলে রেখেছে। সে চেয়ারে বসে ল্যাপটপে কি যেন টাইপিং করে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে নিজের হাতের বাজুতে ব্যান্ডেজ করলো। রক্ত ব্যান্ডেজের উপর ভেসে আছে। একটু পর ফোনের রিংটন বেজে ওঠায় ব্যক্তিটি কল রিসিভ করে বললো,
“জিহাম স্পিকিং।”
ওপাশ থেকে কিছু বলা হলো। তারপর বেশ কিছুক্ষণ কথা চললো। কল কেটে ব্যক্তিটি রহস্যময় ভঙ্গিতে হেঁসে বললো,
“তোমরা ফেঁসে গেছো। I’m really enjoying your trouble.”
রাতে ইহাবের পরিকল্পনায় খোলা উঠোনে বারবিকিউ এর আয়োজন করা হয়েছে। নাসির উদ্দিন চেয়ার পেতে ইহাব আর মারওয়ানের কাজ দেখেছে। মারওয়ান কাজ করছে কম চিল্লাচ্ছে বেশি। ইহাবের কাজের একশো একটা ভুল ধরা ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। ইহাব মেরিনেট করা মুরগির টুকরো গুলোতে সরিষার তেল ব্রাশ করতে করতে কয়লার উপরে গরম স্ট্যান্ডের উপরে রাখতে গেলেই মারওয়ান চিৎকার করে বললো,
“স্ট্যান্ড আরেকটু উঁচু কর। পুড়িয়ে ফেলবি নাকি?”
ইহাব এবার বিরক্ত হলো। এতো হুমকি ধমকি, চিল্লাচিল্লি হজম করা যায়না। সে দাঁড়িয়ে মারওয়ানের হাতে মুরগির বোল ধরিয়ে বললো,
“এতো যখন বুঝিস তুইই কর।”
মারওয়ান ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। সেতো এসব কাজ পারে না। শ্বশুরকে দেখানোর জন্য একটু হাঁক ডাক দিয়েছে কিন্তু ইহাব যে ডিরেক্ট তার হাতে বোল ধরিয়ে দেবে তা তো বোঝেনি। মারওয়ানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নাসির উদ্দিন বিরক্ত হয়ে বললেন,
“দাঁড়িয়ে আছো কেন? ছেলেটাকে তো কাজ করতে দাওনি। একশো একটা ভুল ধরেছো এবার নিজে করে খাওয়াও। আমরাও দেখি তোমার কেরামতি। চিল্লাচিল্লি, ঘুম আর খাওয়া বাদে তুমি আর কি পারো আমাদেরও তো দেখা উচিত।”
মারওয়ান বেশ অপমানিতবোধ করলো কথাটায়। তাই রাগে কিড়মিড় করতে করতে গরম স্ট্যান্ডের উপর মুরগির টুকরো দিতে নিলে স্ট্যান্ডের গরম সেঁক লাগে। মারওয়ান টু শব্দ না করে সয়ে গেলো। একে একে সবগুলো দিয়ে উঠে গিয়ে কলে হাত ভিজালো। কিছুক্ষণ হাত ভিজিয়ে গিয়ে দেখলো ইহাব মুরগি উল্টে দিচ্ছে। তাই আর সেখানে না গিয়ে ঘরে চলে গেলো। নিশাত আর মানহা ঘরে বসে গল্প করছিল। মারওয়ানকে ঢুকতে দেখে মানহা বেরিয়ে গেলো। তার পিছনে নিশাতও বের হয়ে গেলো। ওই লোকের সাথে কোনো কথা বলার ইচ্ছে তার নেই। সকালের পর একটা কথাও বলেনি নিশাত।
নাসির উদ্দিন নিশাতকে দেখে বললেন,
“তোর জামাই তো বারবিকিউ করতে গিয়ে নিজেই বারবিকিউ হয়ে গেছে।”
নিশাত তা দেখে বললো,
“কেন কি হয়েছে?”
“হাত পুড়িয়ে ফেলেছে।”
নিশাতের ভ্রু কুঁচকে গেলো।
“হাতে এভাবে দাগ হয়েছে কিভাবে?”
মারওয়ান কিছুই বললো না। নিশাত আবারও জিজ্ঞেস করায় বললো,
“এমনি।”
নিশাত হাত ধরে দেখলো জায়গাটা অনেকখানি পুড়ে গেছে। নিশাত বললো,
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২৭
“পুড়লো কি করে?”
“স্ট্যান্ডে মুরগি দিতে গিয়ে।”
“আপনি দিতে গেছেন কেন? যেটা পারেন না সেটা করতে গিয়েছেন কেন?”
মারওয়ান কোনো কথা বললো না। নিশাত পোড়া জায়গায় মলম দিয়ে দিলো।