ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২৯+৩০
তাজরীন ফাতিহা
ভোরের নির্মল হাওয়ায় নিশাত, মানহা ও নাজিয়া হাঁটতে বেরিয়ে পড়েছে। চারপাশে এখনো আলো ফোটেনি। ফজর পড়েই পুরোনো ভিটা দেখানোর উদ্দেশ্যে ননদকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে নিশাত। মানহাও অনেক আনন্দিত ভাবিদের আগের বাড়ি দেখবে বলে। নিশাত মাটির রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আশপাশ দেখাতে দেখাতে এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন গাছগাছালি, বুনোফুল, লতাপাতা যুক্ত মেঠোপথ পেরিয়ে তারা পৌঁছুলো নিশাতদের আগের ভিটায়। যেখানে বর্তমানে বিভিন্ন শাকসবজি চাষ করা হয়। নাজিয়া বড় বোনের কথায় ঝাঁপি এনেছিল একটা। শাকসবজি হলে তুলে নেয়ার জন্য। তারা গল্প করতে করতে শাকসবজি তুললো। নিশাত শাক তুলতে তুলতে মুচকি হেঁসে মানহাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“ঘরের বেডাকে রেখে আসায় খারাপ লাগছে নাকি নতুন বউ?’
মানহা চমকে ভাবির দিকে চাইলো। নাজিয়া একটু দূরে সবজি উঠাচ্ছে। মানহা লজ্জা পেলো ভাবির কথায়। বললো,
“খারাপ লাগবে কেন?”
“এইযে স্বামীকে রেখে একা একাই হাঁটতে বেরিয়েছো তাই? শত হোক নতুন নতুন সবারই মনে স্বামী, বিয়ের ফ্যান্টাসি থাকে। বিয়ের বছর খানেক পর ফ্যান্টাসি বার্নটাসিতে রূপ নেয়।”
মানহা অবুঝ সুরে বললো,
“বার্নটাসি কি?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“বার্ন মানে পোড়া, জ্বলা। ফ্যান্টাসির সাথে মিলিয়ে বললাম আরকি। বাকিটুকু আর না বলি। তুমিই নাহয় বুঝে নাও।”
বলেই মুচকি হেঁসে কাজে কাজে মনোযোগ দিলো। মানহা ভাবির কথায় চিন্তায় পড়ে গেলো। আসলে বিয়ে নিয়ে তার এমনিতেই ভীতির শেষ নেই। ছোট থেকেই বিয়েকে সে ভীষণ ভয় পায়। প্রায় সবার মুখে শুনেছে, দেখেছে শ্বশুরবাড়ি অন্যরকম হয়। প্রথম প্রথম ভালো ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে তাদের আসল খোলস উন্মোচিত হয়। ধীরে ধীরে শুরু হয় বউয়ের প্রতি মানসিক টর্চার। স্বামীও নাকি যা ইচ্ছে তাই ব্যবহার করে।
সারাদিন পর কাজ করে এসে কোনো পুরুষেই সাংসারিক ক্যাচাল শুনতে পছন্দ করেনা। তারপর শুরু হয় ঝগড়া, মারধর, বিচার, সালিশ, ডিভোর্স। ভাইয়াও তো ভাবির সাথে ঠিক আচরণ করেনা। ভাবির ইনকামে সংসারটা চলে। পরবর্তীতে ইহাবও কি এমন হয়ে যাবে? মানহা আর ভাবতে পারলো না। তার গা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে। নিশাত মানহার দিকে তাকিয়ে দেখলো মানহা কাঁপছে। সে দ্রুত মানহাকে ধরলো। নিশাত বললো,
“কি হলো তোমার?”
মানহা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
“ভাবি আমার প্যানিক অ্যাটাক আছে।”
নিশাত মানহার এই রোগ সম্পর্কে অবগত নয়। সে উদ্বিগ্ন হয়ে মানহার মাথা ডলে দিতে লাগলো। নাজিয়াও কাজ ফেলে ছুটে এসেছে। নিশাত নাজিয়াকে দেখে বললো,
“একটু পানি আন নাজি।”
নাজিয়া বোনের কথায় এক ছুটে পানি আনতে চলে গেলো। নিশাত মানহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
“আমাকে মাফ কোরো বোন। তুমি কি আমার কথায় অ্যাটাকের শিকার হয়েছো?”
ভাবি জড়িয়ে ধরায় আস্তে আস্তে একটু শান্ত হলো মানহা। তারপর আস্তে বললো,
“না। আমার বিয়ে ভীতি আছে ছোট থেকেই। তাই ওসব ভেবে কাঁপুনি দিয়েছে গায়ে।”
নিশাত মানহার ওড়নার উপর দিয়েই মাথা ডলতে থাকলো। তারপর ধীর কণ্ঠে বললো,
“তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ভালো নয় মানহা? সত্যি বলবে।”
নিশাতের কথা শুনে মানহা দ্রুততার সহিত বলতে লাগলো,
“অনেক ভালো। বিশেষ করে আমার শাশুড়ি আম্মু এতো চমৎকার একজন ব্যক্তিত্বের মানুষ। তুমি দেখলে অবাক হতে বাধ্য হবে ভাবি। এই মানুষটার সাথে থাকলে এত্তো ভালো লাগে কি বলবো? আমার তো শাশুড়ি আম্মুর সাথেই সারাক্ষণ কাটাতে ইচ্ছে করে। আমার জীবনে এরকম চমৎকার ব্যক্তিত্বের নারী আমি খুব কম দেখেছি। একজন তুমি আরেকজন আমার শাশুড়ি। তোমাদেরকে চোখ বন্ধ করে আমি একশোতে একশো দিবো।”
মানহা নিশাতের কোলের মধ্যে আরেকটু গুটিয়ে বললো। নিশাত মানহার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
“তাহলে প্যানিক অ্যাটাক করেছো কেন?”
“ওই শয়তান মনের মধ্যে কত কুচিন্তা এনে দেয় ওসব ভেবেই আরকি। আলহামদুলিল্লাহ এখন ঠিক আছি।”
নিশাতও আলহামদুলিল্লাহ পড়লো। নাজিয়া পানি এনেছে দূরের টিউবওয়েল থেকে। তাই দেরি হয়েছে। মানহা বিসমিল্লাহ বলে পানি তিনবারে খেলো। মানহাকে বিশ্রাম নিতে বলে তারা বাকি কাজ করলো। তারপর চারদিক একেবারে ফকফকা পরিষ্কার হয়ে এলে বাড়ির দিকে রওনা হলো সবাই।
বাড়িতে ঢুকতেই দেখলো রাবেয়া খাতুন সকালের নাস্তার জন্য লাকড়ি নিয়ে রান্নাঘরে যাচ্ছেন। নিশাতকে দেখে বললেন,
“ঘোরা শেষ?”
নিশাত মায়ের হাতে ঝাঁপি তুলে দিয়ে বললো,
“ঘোরা আর কি? এখান থেকে ওখানে। দেখো কত সবজি হয়েছে? কতদিন যাও না ও বাড়িতে?”
রাবেয়া খাতুন ঝাঁপি নিয়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় রাখলেন। বললেন,
“বেশ অনেকদিন হয়েছে যাওয়া পড়ে না। তাই তো কাল তোকে বললাম তোর ননদকে নিয়ে যেতে। একটু ঘোরাও হলো সাথে সবজি টবজি পেলে নিয়ে আসাও হলো।”
নিশাত আর কিছু না বলে পুকুরে মুখ ধুতে চলে গেলো। মানহা, নাজিয়াও মুখ ধুয়ে ঘরে চলে গেলো। নিশাত ঘরে ঢুকে অবাক হলো। মারওয়ান, নাহওয়ান কেউ নেই ঘরে। নিশাত ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে বললো,
“মা তোমার জামাই আর নাতি কই?”
“বাইরে গিয়েছে সবাই। তোর বাবাই নিয়ে গেলো তোর জামাই আর ননদের জামাইকে। জামাই যেতে চাচ্ছিলো না। তোর বাবা ধমকে টমকে নিয়ে গেলো।”
নিশাত অবাক হয়েছে। মারওয়ানকে জোর করেও কেউ কোনো কাজ করাতে পারেনা যতক্ষণ না তার মর্জি হয়। আজকে বাবার ধমকেই চলে গেলো। কাহিনী কি? যাইহোক বেশি কিছু না ভেবে মায়ের হাতে হাতে কাজ করে দিতে লাগলো।
বেশ বেলা করেই মারওয়ান, ইহাব আর নাসির উদ্দিন বাড়িতে আসলেন। মারওয়ান মুখ একেবারে বিদঘুটে হয়ে আছে। ইহাবের কোলে নাহওয়ান জুস খাচ্ছে। মারওয়ান মুখ গম্ভীর করে ঘরে চলে গেলো। ইহাবও ঘরে গেলো। নাসির উদ্দিন নিশাতের হাতে প্যাকেট দিয়ে বললেন,
“এখানে তোর আর তোর ননদের কিছু জামা আছে। তুই নিজের হাতে দিস মেয়েটাকে। মাহাবুবের বেটা, বেটিকে তো কিছুই দিতে পারলাম না তাই ভাবলাম কিছু দেই। নিশাত খুশি হয়ে নিলো। ব্যাগ গুলো নিয়ে ঘরে চলে গেলো। ঢুকেই মারওয়ানকে শোয়া দেখলো। বললো,
“কি হয়েছে?”
মারওয়ান কপালের উপর থেকে হাত সরিয়ে বললো,
“ঢাকা হওয়ার টিকিট কেটেছি। সবকিছু গোছগাছ করে নাও।”
নিশাত অবাক হয়ে বললো,
“হঠাৎ ঢাকা যাওয়ার টিকিট কেটেছেন কেন?”
“তা জেনে তোমার কাজ কি? স্কুলের চাকরিটা কি হারাতে চাও? কত দিন হয়েছে এখানে এসেছি হিসেব আছে? বাড়িওয়ালা ফোন দিয়েছিল ভাড়ার জন্য। আর তোমার বাবা ও আমার বাবা দুজনই যাবেন আমাদের সাথে।”
নিশাত অবাক হয়েই বললো,
“বাবা, আব্বা দুজনই যাবেন? আপনি মিথ্যা বলেছেন নাকি?”
“না। বিশ্বাস না হলে তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করো।”
নিশাত ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলো যেন।
“উফ মা কেঁদোনা তো। এই মহিলা মানুষের কাজ খালি ফ্যাচফ্যাচ করা। যেখানেই মহিলা সেখানেই কান্নাকাটি। এতো কাঁদার কি হলো? মরে তো যাইনি। বেঁচে যেহেতু আছি আবার আসবো। তাও দয়া করে কান্না থামাও।”
খুব ত্যক্তবিরক্ত হয়ে কথাটা বললো মারওয়ান। ছেলের কথা শুনে মায়মুনা বেগমের কান্না আরও বেড়ে গেলো। মাকে কিছু বলতে না পেরে মারওয়ান এবার নিশাতের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললো,
“বাপ সাথে যাচ্ছে না? এতো কান্নার কি হয়েছে? সেই সকাল থেকে শুরু হয়েছে এখন বিকেল হয়ে গেছে তাও ফ্যাচর ফ্যাচর থামে না। বলি গলাও কি ব্যথা করেনা?”
তারপর ধমকে কান্না থামালো নিশাতের। নিশাতের হেঁচকি উঠে গিয়েছে লোকটার ধমকে। এতো পরিমাণে পাষাণ, হৃদয়হীন লোক জীবনেও দেখেনি সে। কান্নাও নাকি কারো বিরক্ত লাগতে পারে। একটু মন খুলে কাঁদতেও দিলো না। পাথর একটা!
মারওয়ান যখন তাদের ধমকাচ্ছিলো ইহাব তখন কোত্থেকে দৌঁড়ে এসে নাহওয়ানকে জড়িয়ে ধরে চিল্লিয়ে কান্নার ভঙ্গিতে বললো,
“রসগোল্লাটাকে ঠিক মতো খেতেও দিলো না আমাকে। এখন লোভ দেখিয়ে এই রসগোল্লাকে নিয়ে গেলে আমি বাঁচবো কি করে? এই রসগোল্লা আমার কাছে থাকবে।”
বলে আবার কান্নার ভঙ্গি শুরু। নাহওয়ান ভয়, অবাক দুটোই হয়েছিল। বাবার দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
“বাবা পুপা কাডে।”
মারওয়ান রেগে ফায়ার হয়ে ইহাবকে ধাক্কিয়ে সরিয়ে বললো,
“ওই বেডি ঢং করিস কিজন্য? চুপ কর নাহলে থাপড়ে চুপ করাবো।”
ইহাব মুহূর্তের মাঝে থেমে গিয়ে অবাক হয়ে বললো,
“বেডি? কে বেডি?”
মারওয়ান কিড়মিড় করতে করতে বললো,
“কেন নিজেকে বেডা ভাবিস নাকি?”
ইহাব নিরীহ গলায় বললো,
“তো কি ভাববো? আমি তো বেডাই। অ্যানি ডাউট?”
“তুই বেডা বেডি কোনোটাই না। তুই হলি বা’ল। বা’লের ঘ্যানোর ঘ্যানোর শুরু করছে বেডি গো মতো।”
ইহাব মুখ গম্ভীর করে বললো,
“মুখ খারাপ করিস কেন?”
মারওয়ান নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,
“একশোবার করবো। আমার সাথে যতবার কথা বলতে আসবি ততবার করবো। যদি নিজের প্রেস্টিজ নিয়ে থাকতে চাস তাহলে আমার সামনে পড়বি না। পড়লেই আমার মুখ খারাপ হবে আর তোরে গাড়াতে ইচ্ছে করবে। সো বি কেয়ারফুল।”
বিকেল পাঁচটা। বাসের মধ্যে বসে আছে নিশাত, মারওয়ান, নাহওয়ান, মাহাবুব আলম এবং নাসির উদ্দিন। নিশাতের বিশ্বাস হচ্ছে না সে ঢাকা যাচ্ছে। মাকে ছেড়ে আসতে কলিজা ছিঁড়ে আসছিল। সকালে নাস্তা করেই বাবাকে সাথে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে এসেছিল। শাশুড়ির সাথে দেখা করে গোছগাছ করে নিয়েছে সে। মা এবং শাশুড়ি দুজনই রান্না করে দিয়েছেন। বিভিন্ন শাকসবজি, ফল, পিঠা দুই মা’ই দিয়ে দিয়েছেন। এতকিছু বহন করা কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছিলো তবুও নিতে হয়েছে নাহলে কষ্ট পাবেন তারা।
মা আর শাশুড়ির কান্নায় নিশাত ভেঙে পড়ছিল বার বার। মাকে আবার কতদিন পর দেখবে এই ভেবে কাঁদতে কাঁদতে গলা বসে গেছে নিশাতের। মানহাও নিশাতকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছে। সবকিছু এতো তাড়াহুড়ায় হলো যে নিশাত কিছু বলার সুযোগ পায়নি। বাবা আর শ্বশুর সাথে যাচ্ছে বলে একটু ভরসা পাচ্ছে। মারওয়ান একেবারেই চুপ। কোনো কথা তেমন বলছে না। কি লোক! মা কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু কোনো সান্ত্বনা দেয়নি। উল্টো আরও গম্ভীর গলায় মেজাজ দেখিয়ে এসেছে। নিশাত ক্লান্ত হয়ে বাসের সিটে হেলান দিয়ে রইলো। নাহওয়ান বাবার বুকের উপর শোয়া। বাস চলছে। ঠান্ডা বাতাস তাদেরকে ছুঁয়ে যেন বলছে নিজের গন্তব্যে ফেরার সময় হয়েছে।
নিত্যদিনের মতো সকাল সকাল নিশাত তাড়াহুড়ো করে নাস্তা তৈরি করছে। একা হাতে কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে সে। এতদিন মা, শাশুড়ির রান্না খেতে খেতে শরীরে অলসতা ঝেঁকে ধরেছে। কাল রাত বারোটায় বাসায় পৌঁছেছে। এসে মায়েদের দেয়া তরকারি গরম করে ভাত বসিয়ে দিয়েছিল। তারপর গরম গরম ভাত শ্বশুর ও বাবাকে দিয়েছে চটপট। তাদের খাওয়া হয়ে গেলে ফাঁকা রুমটা তাদের জন্য গুছিয়ে দিয়েছে। বেচারি কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে গিয়েছিল। রাত তিনটায় সব কাজ থেকে ইস্তফা নিতে পেরেছিল সে। রাতে দেরি করে ঘুমানোর জন্য উঠতে কষ্ট হচ্ছিলো তবুও ফজরের নামাজ পড়ে রান্নাঘরে চলে এসেছে। ঘরে বাবা, শ্বশুর আছেন তাদেরকে তো নাস্তা দিতে হবে টাইম টু টাইম।
মাহাবুব আলম ও নাসির উদ্দিন মসজিদ থেকে এসেছেন অনেকক্ষণ হয়। নিশাত চা, বিস্কুট দিয়ে গেছে তাদের। দুই বন্ধু সারা রাত গল্প করে কাটিয়েছেন। এখনো চা খেতে খেতে গল্প করছেন। চা শেষ হলে মাহাবুব আলম খালি চায়ের কাপ রান্নাঘরের রেখে আসার জন্য এলেন। এসে দেখলেন নিশাত ঘেমে অস্থির হয়ে রুটি বেলছে আর ভাঁজছে। তার ভীষণ মায়া লাগলো। ঢাকায় মেয়েটা সারাক্ষণ কাজ করতে করতে শেষ হয়ে যায় আর ওই বেয়াদবটা নাক ডেকে ঘুমায়। বেয়াদব জন্ম দিয়েছে সে। তিনি বেসিনে চায়ের কাপ দুটো ধুতে লাগলেন। নিশাত তা দেখে দ্রুত এগিয়ে এসে বললো,
“আব্বা এসব কি করছেন? রাখুন রাখুন।”
মাহাবুব আলম কাপ ধুতে ধুতে বললেন,
“ছেলেকে তো মানুষ বানাতে পারিনি তাই নিজেই নাহয় কাজ করে কিছুটা পুষিয়ে দেই। তুমি বাকি কাজ করো মা।”
নিশাত বুঝলো বলেও লাভ হবে না। তিনি ঢাকায় এলে নিশাতকে সবসময় কাজে সাহায্য করবেন। এটা তার অভ্যাস। তাই আর কথা না বাড়িয়ে রুটি বেলতে লাগলো নিশাত। মাহাবুব আলম কাপ ধুয়ে রেখে দিলেন। তারপর নিশাতকে বললেন,
“দেও কয়টা রুটি ভেঁজে দেই।”
“লাগবে না আব্বা। আপনি যান তো। আমার হয়ে এসেছে। এখুনি আপনাদের নাস্তা দিবো।”
মাহাবুব আলম কোনো কথা শুনলেন না। রুটি একটা তাওয়ায় দিয়ে সেঁকতে সেঁকতে বললেন,
“এই মাত্র চা, বিস্কুট খেয়েছি এখন আবার কিসের নাস্তা। পরে খাবো। তুমি আস্তে আস্তে কাজ করো মা।”
নিশাতের চোখ ফুরে জল বেড়োতে যায়। এতো চমৎকার শ্বশুর, শাশুড়ি তাকে দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া জানায়। এতো ভালো মানুষগুলোর ছেলে এমন হলো কেন? সেটাই ভেবে পায়না নিশাত। সে আর কিছু না ভেবে আবারও রুটি বেলায় মনোযোগ দিলো।
এদিকে নাসির উদ্দিন মাহাবুব আলমকে আসতে না দেখে রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে যেতে যেতে মেয়ে আর বন্ধুর গলা শুনতে পেলেন। তিনি চুপচাপ হেঁটে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলেন নিশাত বলছে,
“আব্বা রুটি পুড়ে গেলো তো।”
মাহাবুব আলম দাঁত দিয়ে জিহ্বা কামড়ে ‘হায় হায়’ করতে করতে রুটি নামালেন। এরপর মাহাবুব আলম বললেন,
“বুঝলি বুড়ো হয়ে গেছি তো তাই কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পারিনা।”
নিশাত মুচকি হেঁসে বললো,
“তাই তো বললাম আমাকে দিন। আপনি রেস্ট করুন।”
“আরে মেয়ের কাজে একটু হেল্প করি। আব্বা হয়েছি কি এমনি এমনি। মানহা আর তুমি আমার কাছে সমান। ওকে যেমন একা একা কাজ করতে দেখলে খারাপ লাগতো তেমন তোমাকেও একা কাজ করতে দেখে খারাপ লাগে। তুমি তো আমার কাছে তোমার বাবার আমানত মা। এই আমানতের খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব।”
কথাটা শুনে নাসির উদ্দিন পিছন থেকে বললেন,
“আমানতটা তোর ছেলেকে দিয়েছিলাম আদর, যত্ন করে রাখতে অথচ সে নাক ডেকে ঘুমায় আর আমার মেয়ে রান্নাবান্না, ইনকাম সব করে তাকে খাওয়ায়। দেখছি তো মেয়ের বাসায় এসে কেমন যত্ন করে মেয়ের। ভেবেছিলাম রান্নাবান্নায় অন্তত সাহায্য করে কিন্তু আমার ধারণা তো পুরোটাই ভুল।”
নিশাত বুঝলো বাবা রেগে যাচ্ছেন। তাই তাড়াহুড়া করে বললো,
“না না বাবা। সে সাহায্য করে। কালকে জার্নি করে এসেছে তো তাই সারারাত ঘুমায়নি। সকালে একটু চোখ বুজেছে। তোমাদের জামাইয়ের ঠিকমতো ঘুম না হলে মাথা ব্যথা করে।”
“জামাইয়ের সাফাই গাওয়া বন্ধ কর। জার্নি তো তুইও করেছিস। তুই সবার শেষে ঘুমাতে গিয়েছিস আমি দেখিনি? ও তো খেয়েই নাক ডেকে ঘুমানো শুরু করেছে আর তুই বলছিস সারারাত ঘুমায়নি। ওর হয়ে একটা কথাও তোর মুখে শুনতে চাইনা। এসেছি তোর সংসার দেখতেই। ওর সব গতিবিধি দেখে তোকে এবার সাথে করে নিয়ে যাবো। শেষ সুযোগ এটা ওর। মাহাবুব তুইও কান খুলে শুনে রাখ, তোর ছেলেকে ঠিক হতে বল নাহলে বউ হারাবে বলে দিস। এবার আর কোনো ছাড় দেয়া হবে না।”
বলেই তিনি চলে গেলেন। নিশাত আর মাহবুব আলম হতাশ হলেন। তারপর সব কাজ দুই শ্বশুর বউমা মিলে শেষ করলো।
ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেয়ে আজ কিছু কাজ করে দিয়েছে মারওয়ান। কালকের জার্নি, কাজে নিশাত ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাই মারওয়ান নিজ থেকেই কাজ করেছে। নিশাত ঘুম থেকে উঠে দেখলো বাজার করা। নিশাত অবাক হয়ে গিয়েছিল। ঘরে কোনো বাজার ছিল না যেহেতু বেশ কিছুদিন গ্রামে ছিল তাই। বাজার দেখে ভেবেছে মাহাবুব আলম বাজার করে এনেছেন কিন্তু যখন শুনলো মারওয়ান বাজার করেছে তখন একেবারেই বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল। যাকে ধরে বেঁধেও বাজারে পাঠানো যায়না সে বাজারে গিয়েছে অবিশ্বাস্য! সে আর কিছু না ভেবে রান্নার জোগাড়ে লেগে গেলো।
নাসির উদ্দিন নাহওয়ানকে উঁচু করে ধরে বললেন,
“ভাই আপনি হিসি করে দিয়েছেন নানার কোলে?”
নাহওয়ান ঠোঁট ফুলিয়ে কান ডলে বললো,
“বাইল হয়ে গেচে। ইট্টু কচ্চি। বিশি কলি নাই।”
নাসির উদ্দিন হতাশ হয়ে বললেন,
“তাই বলে আমার সদ্য গোসল করা শরীরে? একটু সিগন্যাল দিতেন।”
মারওয়ান লুঙ্গি ধরে বীরের মতো হেঁটে আসতে আসতে বিড়বিড় করে বললো,
“একদম উচিত হয়েছে। বুড়ো জ্বালিয়ে খেয়েছে কয়েকদিন। ইস ছোট থাকলে আমিও করতে পারতাম! মনের জ্বালা কমতো।”
নাহওয়ান বাবাকে দেখে তার কোলে যাওয়ার জন্য হাত বাড়ালো। নাসির উদ্দিন নাতির প্যান্ট পাল্টে মারওয়ানের কোলে দিয়ে আবার গোসল করতে চলে গেলেন। মারওয়ান ছেলেকে উঁচিয়ে বললো,
“শুধু ছোটটা করেছিস? বড়টাও করতি। করবি যখন করার মতো করতি। খুবই দুঃখজনক। শুধু সুসু করেছিস দেখে কেবল চকলেট পাবি চিপস পাবি না।”
“ইননা।”
“হ্যাঁ।”
বলে ছেলেকে নিয়ে নিজেদের রুমে চলে গেলো। ছেলেকে গোসল করিয়ে নিজেও করলো। তারপর ছেলেকে খেলনা দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেস্ট রুমের সামনে দিয়ে যেতে যেতে শুনলো নাসির উদ্দিন বলেছেন,
“বুঝলি মাহাবুব নাতি পুরাই তোর ছেলের মতো হয়েছে। মনে আছে তোর ছেলেকে নিয়ে একবার ছোট থাকতে আমার বাসায় গিয়েছিলি। তখন আমি কোলে নেয়ার সাথে সাথে হাগু করে দিয়েছিল। আজকে তোর নাতিও তার বাবার ধারা অনুসরণ করে হিসু করে দিয়েছে। একেবারে ষোলোকলা পূর্ণ করেছে বাপ, বেটা। একজন হাগু আরেকজন হিসু কোনোটাই বাদ রাখেনি তোর আওলাদরা।”
কথাটা শুনে মারওয়ান একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলো। একটু আগে শ্বশুড়ের কোলে মূত্র বিসর্জন করার ইচ্ছে যে আরও বছর কয়েক আগেই হাগু করে পূরণ করে এসেছে এটা তো জানতো না সে। তার খুশি খুশি লাগলো কেন যেন। একদম উচিত কাজ করেছিস তুই মারওয়ান। মনে মনে নিজেকে বাহবা দিতে দিতে রান্নাঘরের দিকে এগোলো। সেখানে গিয়ে দেখলো নিশাত চুলোয় তরকারি রান্না করছে। কি সুগন্ধ বের হয়েছে আহা! নিশাত গরুর গোশত রান্না করছে একমনে। মারওয়ান নিশাতের পিছনে দাঁড়ালো। নিশাতের মাথার উপর দিয়ে দেখলো গোশত কষাচ্ছে নিশাত। মারওয়ানের মনটা একটু আগের কথা শুনে ফুরফুরা হয়ে আছে।
তাই তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। কি মনে করে দুই হাত দিয়ে নিশাতকে পিছন থেকে বেষ্টনীর মতো ধরলো। অমনি নিশাত গরম কাঠি লাগিয়ে দিলো হাতে। মারওয়ান শব্দ না করে দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো। মারওয়ান সরে যেতেই নিশাত পিছনে ফিরে রাগী গলায় বললো,
“গরমের মধ্যে আলগা পিরিত দেখাতে এসেছেন? ভিমরতি হয়েছে আপনার? গরমে বাঁচি না আর উনি নাটক করতে এসেছেন। নাটক সিনেমা পেয়েছেন? নায়ক জড়িয়ে ধরলে নায়িকা গলে গিয়ে লুতুপুতু শুরু করবে এরকম ভেবেছেন? দূরে যান। রান্নাঘরে রান্নার সময় গরমে সবকিছু বিরক্ত লাগে। আপনাকেও এখন বিরক্ত লাগছে। উফ অসহ্য!”
বলে মাথার ওড়না খুলে বেসিনে মুখ ধুলো। গরমে মুখ তৈলাক্ত হয়ে গেছে। ঘামে পিঠ ভিজে জবজব করছে। মাথা থেকে আগুন বের হচ্ছে তার। মারওয়ান বুঝলো বেচারি আসলেই গরমে অস্থির হয়ে গেছে। তাই বললো,
“ওড়না খুলে রান্না করো। এখানে তো কেউ আসবে না।”
নিশাত মুখ ধুয়ে বললো,
“হ্যাঁ ঘরে বাবা, শ্বশুড়ের সামনে ওড়না খুলে রাঁধবো। যেমন লোক তেমন তার বুদ্ধি।”
বলে আবারও গোশত নাড়তে লাগলো। মারওয়ান মুখ গম্ভীর করে চলে গেলো। নিশাতকে একটু জ্বালাতে এসেছিল এখন নিজেই জ্বলে যাচ্ছে। মনে মনে বললো,
“বালের নাটক করতে গিয়েছিলাম হাতটা পুড়িয়ে আসলাম। যদিও অতটা লাগেনি তবুও লেগেছে তো।”
বিশাল রুমে টেবিলের চতুর্দিকে গোল হয়ে বসে আছে নেওয়াজ শাবীর, জিনান আদহামসহ আরও অনেকে। টুকটাক আলোচনা হচ্ছে সবার মধ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যে হেড প্রবেশ করলে সবাই দাঁড়িয়ে গেলো। হেড সবাইকে ইশারায় বসার অনুমতি দিলেন। তিনি বসে আশেপাশে কাউকে খুঁজলেন। তারপর নেওয়াজকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“মুনতাজির জায়েদ ছুটি কাটিয়ে এখনো আসেনি?”
নেওয়াজ খুবই মোলায়েম গলায় বললো,
“জ্বি না স্যার। তবে দুই একদিনের মধ্যে অ্যাটেন্ড করবেন জানিয়েছেন।”
“ওহ, ওকে।”
তারপর বেশ খানিকক্ষণ মিটিং চললো রুমটিতে। সকলে খুবই মনোযোগী শ্রোতার মতো হেডের কথা ও ইন্সট্রাকশন শুনলো। একে একে সবার মতামতও নিলেন হেড। এরপর সবাইকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে যেতে বললেন। সবাই চলে গেলেও বসে রইলো নেওয়াজ শাবীর ও জিনান আদহাম। হেড তাদেরকে বললেন,
“তোমাদের মিশনের খবর কি? কতদূর এগোলো কাজ?”
জিনান কাচের টেবিলে হাত ঠেকিয়ে বললো,
“বেশ কিছু তথ্য জোগাড় করেছি আমি। টেরোরিস্ট মনে করে নির্দোষ কিছু মাদ্রাসার ছাত্র ও হুজুরকে গুম করা হয়েছে। এছাড়াও খুন করা হয়েছে বেশকিছু নিরপরাধ ব্যক্তিকে। এগুলোর মাত্রা বেড়েই যাচ্ছে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এসবের পিছনে একজনই রয়েছে।”
নেওয়াজ শাবীরও গম্ভীর গলায় বললো,
“গত একমাসে আশ্চর্যজনকভাবে খুন বেড়ে গিয়েছে। এরমধ্যে নিরীহদের পাশাপাশি অপরাধীদের লাশও পাওয়া যাচ্ছে। কয়েক মাস আগে রেপ কেসের আসামিদের যে ভয়ানক খুন দুটো হলো সেটার কোনো ক্লু এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি স্যার।”
হেড গম্ভীর হয়ে দুজনের কথা শুনছিলেন। তাকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে। তিনি ভাবছেন কিছু। বেশ কিছুক্ষণ পর বললেন,
“মার্ভ জেনের সাথে পরিচয় হয়েছে তোমাদের?”
“নো। এখনো তিনি সরাসরি জয়েন হননি এই ডিপার্টমেন্টে।”
“শীগ্রই হবে। Don’t worry. Rely on your own strength and intelligence and keep pushing forward. Trust in Allah.”
নেওয়াজ প্রফেশনালি বললো,
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২৮
“Thank you Sir for your guidance.”
হেড মাথা নাড়ালেন। এতক্ষণ জিনান চুপ করে ছিল। এখন মৌনতা ভেঙে বললো,
“স্যার সাইফার ও জেন সাহেব দুজনে কি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তি?”
হেড মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন। জিনান আদহাম তার নীল চক্ষু কুঞ্চিত করে ফেললো। এরা বয়স্ক কেউ হবে তার দৃঢ় বিশ্বাস। তিনজন যুবক থাকতে নিশ্চয়ই আরও জোয়ান কাউকে একটা মিশনে দিবেন না হেড। এইটুকু পুরো ডিপার্টমেন্টের সবাই জানে। কি আছে সামনে সেটাই দেখার বিষয়।