ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩
তাজরীন ফাতিহা
প্রত্যুষে উঠে সংসারের সকল কাজ করা বোধহয় প্রতিটি নারীরই চিরায়ত রূপ। খুব ভোরে উঠে স্বামী, সন্তান পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেয়ার জন্য গরম কিংবা শীত কোনো কিছুই তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনা। হাড়কাঁপানো শীতে সেই ঊষাকালেই উঠে পরেছে নিশাত। ফজরের নামাজ পড়ে লেগে গেছে সংসারের যাবতীয় কাজে।
রান্নাঘরে পানি গরম হচ্ছে। নিশাত আটা দিয়ে কিছুক্ষণ সেদ্ধ করে নামিয়ে নিলো। গরম আটা মদিয়ে গোল গোল ছয়টি লেচি বানালো। রুটি বেলে ছেঁকে নিলো। সবজি ভাজি আগেই করে রেখেছে। গাজর, ফুলকপি, বরবটি আর আলু দিয়ে বানানো এই সবজি ভাজি রুটি দিয়ে খেতে দারুন লাগে। যদিও নিশাত প্রতিদিনই খাবারে ভিন্ন আইটেম রাখার চেষ্টা করে। বাচ্চাটা একই খাবার প্রতিদিন খেতে চায়না। বাবা, ছেলে জ্বালিয়ে মারে তাকে। এখন তার কাজ দুই নবাবজাদা ও শাহেনশাহকে ডাকা। বাপটা যেমন ভাদাইম্মা ছেলেকেও ওরকম বানাচ্ছে।
নিশাত রুমে গিয়ে দেখলো মারওয়ান আজাদের বুকের উপর ঠোঁট ফুলিয়ে ঘুমিয়ে আছে মিনি মারওয়ান আজাদ। দুই বাপ, বেটা আরামে নিশ্চিন্তে কি সুন্দর ঘুমাচ্ছে! নিশাতের ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে হলো না। কি আদুরে লাগছিল বাপ, বেটা দুটোকে। মাশাআল্লাহ! চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো দৃশ্য।
নিশাত বাবা, ছেলেকে খাইয়ে একটু পর স্কুলে যাবে। তাই না চাইতেও ওদেরকে জাগিয়ে তুলতে হবে তার। সে মশারী খুলে ছেলেকে কোলে নিতে চাইলো কিন্তু মারওয়ান আজাদ শক্ত করে বাচ্চাকে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে। নিশাত এবার মুখ খুললো। বললো,
“এই যে নবাবের বংশধর উঠুন। নাস্তা খেয়ে আমাকে কৃতার্থ করুন। সারাদিনই তো মরার মতো ঘুমান। কাজবাজ তো কিছু নেই। খেয়েদেয়ে আবার নাহয় ঘুমাবেন। উঠুন।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নিশাত ঝুঁকে মারওয়ানকে ঝাঁকিয়ে বলছিল কথাগুলো। মারওয়ান চোখ বন্ধ করেই ছেলেকে নিয়ে পাশ ফিরে আরাম করে শুলো। নিশাত ক্ষেপে গেলো। জোরে ধাক্কা দিলো কিন্তু মারওয়ান ত্যাড়ার মতো পড়ে রইলো। নিশাত বললো,
“আমি জানি আপনি জেগে গেছেন। জিদ দেখিয়ে শুয়ে আছেন যেন আমাকে শায়েস্তা করা যায়। আমি বুঝি না ভেবেছেন? আপনি নাস্তা না খেলে নাই আমার ছানাকে আমার কাছে দিন। ওকে খাইয়ে স্কুলে যাবো। আজাইরা বসে থাকার টাইম নেই।”
মারওয়ান তাও লড়লো না। নিশাত ক্ষেপে গিয়ে নাহওয়ানকে জোর করে নিতে চাইলো কিন্তু মারওয়ান দিতে নারাজ। যেন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে দুই পক্ষের মাঝে। কে কাকে হারাবে আর বাচ্চাকে তার কাছে রাখবে। স্বাভাবিকভাবেই নিশাত ওই শক্তিশালী পুরুষের থেকে তার ছানাকে আনতে পারলো না। সে ব্যর্থ হয়ে বসে পড়লো। মারওয়ান এক চোখ খুলে দেখলো নিশাত মুখ কালো করে রেখেছে। নিশাতের গোমড়া মুখ দেখে চোখ বন্ধ করেই মুচকি হাসলো সে। কিন্তু হাসি বেশিক্ষণ টিকলো না। এতক্ষণ দুজনের ধাক্কাধাক্কিতে নাহওয়ানের ঘুম ভেঙে গেছে। সে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। যেন বুঝাতে চাইলো আমাকে ঘুম থেকে উঠানো হলো কেন?
নিশাত তাড়াহুড়ো করে বাচ্চাকে নিতে চাইলো কিন্তু মারওয়ান না দিয়ে নিজেই আদর করতে লাগলো। নাহওয়ান তাও কান্না থামাচ্ছে না। ওর কান্না মায়ের কোলে গেলেই একমাত্র থামবে। কারণ মায়েরা জাদু দিয়ে সন্তানের কান্না ভ্যানিশ করতে পারে যা বাবারাও মাঝে মাঝে পারেনা। মারওয়ান হাল ছেড়ে ওকে নিশাতের কোলে দিলো। নিশাত তা দেখে বললো,
“হাওয়া ফুরিয়ে গেলো বুঝি? বাচ্চার কান্না থামাতে পারলেন না এখন আমাকে দিয়েছেন কেন? খুব তো গায়ের জোর খাটিয়ে নিজের কাছে রাখতে চাইলেন দেখলেন বাচ্চা আপনার কাছে থাকলো না।”
মারওয়ান বিরক্ত হলো বেশ। বললো,
“তোর কারণেই তো ফাইয়াজের ঘুম ভাঙলো আর ও কাঁদলো। আমাদের বাপ, বেটাকে একসাথে দেখলে তোর তো সহ্য হয়না। তাই আলাদা করতে টানাহেঁচড়া শুরু করেছিস। যত্তসব!”
নিশাত ছেলেকে শান্ত করতে করতে বললো,
“নিজের মুরোদ নেই এক আনার আসছে মানুষকে বলতে যত্তসব। আপনার নাস্তা আজকে বন্ধ। দেখি কে আপনাকে নাস্তা দেয়, হুহ্।”
মারওয়ান আড়মোড়া ভেঙে বললো,
“এখনো যদি রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটু মুচকি হাসি দেই তাহলে দেখবি মেয়েদের লাইন লেগে যাবে। তখন ভাতের অভাব হবে না। আফটার অল আমি যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। তোর মতো লিলিপুটের পাশে আমার মতো জোয়ান, তাগড়া যুবককে কখনোই মানায় না।”
নিশাত মুখ মুচড়ে বললো,
“শুধু হ্যান্ডসাম, সুন্দর দিয়ে কি হবে? মেয়েরা আপনার সুন্দর চেহারার আড়ালে এই ভাদাইম্মা, বিড়ি’খোর লুকের কথা জানে? জানলে আপনার ত্রিসীমানায়ও ওরা ঘেঁষবে না। আসছে তার মতো ভাদাইম্মার পাশে নাকি আমাকে মানায় না? আসলেই আমার পাশে আপনাকে মানায় না। খাম্বা একটা।”
কথাটুকু বলেই নিশাত প্রস্থান করলো। যতক্ষণ থাকবে তর্ক বিতর্ক চলতেই থাকবে। তাই এখান থেকে চলে যাওয়াই শ্রেয়।
অন্যদিকে মারওয়ান আজাদ ভিতরে ভিতরে রেগে গেলো। সে আলসেমি ঝেড়ে উঠে সিগারেট ধরালো।ধোঁয়া ছাড়াতে ছাড়াতে কিছু ভাবলো। তাকে এতগুলো কথা শুনালো আর সে চুপ থাকবে এটা মানা যায়না। এর একটা বিহীত করতেই হবে।
নিশাত বাচ্চাকে খাইয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হতে রুমে আসলো। নাহওয়ান খেলনা দিয়ে খেলছে পাশের রুমে। সে রুমে ঢুকে দেখলো খাম্বাটা আলমারির সামনে দাড়িয়ে আছে। সে বোরকা নিবে কিভাবে? এমনিতেই ঝগড়া লেগেই থাকে এখন কিছু বললে এক গাদা কথা শুনতে হবে। তাই আস্তে আস্তে হেঁটে আলমারির সামনে দাঁড়ালো। মারওয়ান ভ্রু কুঁচকে সিগারেট খাচ্ছে। সে কেশে উঠলো। তবুও সরলো না। আবারও কাশি দিলো। তাও কোনো নড়াচড়া নেই। নিশাত বললো,
“সমস্যা কি? এতো জায়গা থাকতে আলমারির সামনে কি আপনার? সরুন সামনে থেকে। স্কুলে যাওয়ার সময় যাচ্ছে।”
মারওয়ান ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নিশাতকে দেখলো। তারপর শক্ত করে ঝাপটে ধরলো। নিশাত মোচড়ামুচড়ি শুরু করলো। বললো,
“সমস্যা কি? ছাড়ুন বলছি।”
মারওয়ান বললো,
“তোমাকে যদি এখন একটা আছাড় দেই কেমন হবে?”
নিশাত একটু জোরেই বললো,
“আপনি দূরে সরুন। সিগারেটের গন্ধে বমি আসছে আমার। মাথা ঘুরাচ্ছে। সরুন প্লিজ।”
মারওয়ান তাও ছাড়লো না। ঝাপটে ধরে রাখলো। তার মেজাজ হঠাৎই খারাপ হয়ে গেছে। মেজাজ খারাপ হলে তার মানুষকে পিটানোর বাতিক আছে। জীবনে সে বহুত মারামরি করেছে। ওগুলো বর্তমানে অতীত। নিশাত তার মারামারির রূপ কখনোই দেখেনি। শুধু এতটুকু জানে অতিরিক্ত রাগ উঠলে মারওয়ান হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে কিন্তু নিশাতকে কখনোই আঘাত করেনি। চোয়াল চেপে ধরে এতটুকুই কিন্তু আজকে এমন ঝাপটে ধরলো কেন?
নিশাতের দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে শরীর ছেড়ে দিলো একেবারে। মারওয়ানের হুঁশ ফিরলো। নিশাতকে ধাক্কা দিয়ে সরালো। বললো,
“নেক্সট টাইম মুখে মুখে আর তর্ক করলে খবর আছে তোমার।”
ছাড়া পেয়ে নিশাত দম ছাড়লো যেন। বাপরে এই খাম্বার এতো শক্তি! নিশাতের শরীর কাঁপছে এখনো। মারওয়ান আলমারির সামনে থেকে সরে পড়লো। নিশাত বিছানায় বসে কিছুক্ষণ ধাতস্থ হলো। তারপর রেডি হয়ে নিলো। সে তওবা পড়লো আর জীবনে যদি এই খাম্বার সাথে তর্কে জড়ায় তাহলে তার নাম পাল্টে ফেলবে। তাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করছিল বিড়ি’খোরটা।
নাহওয়ানকে আদর করে স্কুলে চলে গেলো সে।
“ম্যাডাম আপনার হাজব্যান্ডকে চায়ের দোকানের সামনে সিগারেট টানতে দেখেছি কাল। উনি কি কোনো কাজ করেন না?”
কথাটা নাজমা ম্যাডাম বলে উঠলেন। গ্রামে যাওয়ার জন্য একদিন রিক্সায় করে বাস স্টেশন যাচ্ছিলো সে আর মারওয়ান আজাদ। সেদিন নাজমা ম্যাডাম মারওয়ান আজাদকে দেখে ফেলেন। সেই থেকেই মারওয়ানকে কোথাও সিগারেট খেতে দেখলেই নিশাতের কাছে খুব রসিয়ে রসিয়ে আলাপ করেন তিনি। যেন এটা করে ভীষণ মজা পান তিনি। তার স্বামী নামকরা কোম্পানির ম্যানেজার আর নিশাতের স্বামী ভবঘুরে কোম্পানির ম্যানেজার। ব্যাপারটা তাকে খুব উৎফুল্ল করে মনে হয়। নিশাত এসব কথা খুব সন্তপর্নে এড়িয়ে চলে। তবে আজকে যেন নাজমা ম্যাডাম ছাড়বেন না বলে পণ করেছেন। সেখানে রুবি ম্যাডামও উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানতেন না নিশাতের হাজব্যান্ড যে এমন। তাই তিনি বললেন,
“ম্যাডাম আপনার স্বামী কি কোনো কাজ করেন না?”
নিশাতের লজ্জায় মাথা কেমন নিচু হয়ে গেলো যেন। আজ একজন জেনেছে কাল সবাই জানবে তখন নিশাতের এই স্কুলে চাকরি করাই বন্ধ হয়ে যাবে।
অনেক কথাই তারা জানতে চাইলেন নিশাতের কাছ থেকে কিন্তু নিশাত কিছু বলার মুখ পেলো না। ক্লাসের সময় হয়ে যাওয়ায় যে যার মতো ক্লাসে চলে গেলো আর নিশাত শক্ত কঠিন মুখ করে বসে রইলো।
“বাবা, তক্কেট কাবো।”
মারওয়ান ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে বেড়িয়েছে। ছেলের আবদার রাখতে চকলেট কিনে দিলো। আজকে হাতে টাকার শর্ট আছে। তাই বেশি কিছু কিনে দিতে পারলো না। মারওয়ান বললো,
“ফাইয়াজ চল আজকে দুই বাপ বেটা পার্কে যাবো।”
নাহওয়ান মাথা নাড়ালো। বাবার আঙুল ধরে চকলেট খেতে খেতে বললো,
“তলো দাই।”
মারওয়ান ছেলেকে কোলে নিয়ে গালে চুমু খেয়ে বললো,
“তোকে খেয়ে ফেলি ফাইয়াজ?”
নাহওয়ান মাথা নাড়িয়ে না বললো। মারওয়ান আবারও তার গালে চুমু খেলো। বললো,
“একটু খাই?”
নাহওয়ান চকলেট মাখা হাত দিয়ে বাবার মুখে হাত দিয়ে বললো,
“ইন না।”
“আমার মুখে চকলেট মাখলি কেন? তোকে আজকে খেয়েই ফেলবো।”
বলেই মারওয়ান নাহওয়ানের ফুলো ফুলো গালে কামড় দিলো। বাচ্চাটা কেঁদে দিলো। বাবার কোল থেকে নামার জন্য ধস্তাধস্তি করতে লাগলো। মারওয়ান তা দেখে হেঁসে উঠে বললো,
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২
“চিপস খাবে যেন কে?”
নাহওয়ান কান্না থামিয়ে বললো,
“আমি।”
মারওয়ান জোরে হেঁসে ছেলেকে কাঁধে চড়ালো। নাহওয়ান কাঁধে চড়ে বাবার সাথে তাল মিলিয়ে ফিচ ফিচ করে হাসলো। আশেপাশের মানুষজন তাকালো হাস্যরত দুই বাবা ছেলের দিকে।