ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩১

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩১
তাজরীন ফাতিহা

ঘোর তমসায় নিমজ্জিত কক্ষ। বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে আছে মারওয়ান। তার হাতের লালচে উজ্জ্বল গোলকটি জ্বলে উঠছে প্রতি নিঃশ্বাসে। মৃদু কম্পমান তার শরীর। কম্পনরত একটি হাত উঠিয়ে ললাটে ঠেকালো। সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে মন্থর গতিতে মস্তক টিপতে লাগলো সে। কিছু একটা ভেবে চলছে অনেকক্ষণ। কিছুক্ষণ আগে প্যান্টের পকেটে একটা ভাঁজ করা চিরকুট পায়। চিরকুটটি খুলে সে থম মেরে ছিল কয়েক মুহূর্ত। এটা কি ছিল?
মারওয়ান,

জানি সম্বোধনে বিরক্ত হবি তাই সম্বোধনে না যাই। তোকে যেটা বার বার বলতে চাচ্ছিলাম শুনলি তো না তাই চিঠিতেই জানাতে হলো। মাহাবুব আঙ্কেল নিশ্চয় তোকে বলেছেন মানহাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্য। আশা করি বিয়ের ব্যাপারে আর রাগ নেই তোর। ওকে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। আংকেল আর আমি তাদের পরিকল্পনা বানচাল করে দিয়েছি। প্ল্যান মাফিক এই বিয়েতে এগিয়েছি। আংকেল এই বিয়েতে রাজি না, আমি জোর করে বিয়ে করছি এরকম অভিনয় করে শত্রু পক্ষদের মনে কনফিশন তৈরি করেছি। আমার মনে হয় ওকে যারা পাত্র সেজে দেখতে এসেছিল ওরা ওই দলের কেউ হবে। তোর চারপাশে বিপদ ওৎ পেতে আছে। সাবধানে থাকিস।
ইতি
কেউ না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মারওয়ান চিঠিটা পড়ে ছিঁড়ে ফেলেছে। এই চিঠি কখন রেখেছে ইডিয়টটা। দুদিন ধরে খেয়াল করেনি তো? ভাগ্যিস প্যান্ট ধোয়নি নাহলে তো চিঠি ভর্তা হয়ে যেতো। কিছুই ভালো লাগছে না তার। মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। তাই ঘর অন্ধকার করে রেখেছে। নিশাত পাশের রুমে শ্বশুর আর বাবার সাথে গল্প করছে। নাহওয়ানও মনে হয় ওখানে। কবুতরের বাচ্চাটা থাকলে মাথাটা টিপিয়ে নেয়া যেতো। তখনই রুমের পর্দা সরিয়ে ছোট্ট মাথা উঁকি দিলো। অবয়বটি ধীরে ধীরে হেঁটে বিছানার কাছে এসে ডাকলো,
“বাবা, বাবা?”
মারওয়ান মাথা যন্ত্রণায় ছটফটাচ্ছিলো। ওষ্ঠে এখনো সিগারেট ধরা। ছেলের ডাক শুনে সিগারেট খাটের কোণা দিয়ে নিচে ফেললো। ছেলেকে বিছানায় উঠিয়ে তার বুকের উপর বসালো। কথা বলতে গেলে মুখ থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে গেলো। নাহওয়ান নাকে হাত দিয়ে বললো,

“ডোয়া, ডোয়া। উম পুঁচা গন্ড।”
মারওয়ান নাক, মুখ দিয়ে ধোঁয়া বার করে বললো,
“চুপ। তোর জল্লাদ নানা হাজির হয়ে যাবে সিগারেট খেয়েছি শুনে। শান্তি মতো একটু সিগারেটও টানতে পারিনা তোর মায়ের গুষ্টির জন্য। পঁচা গন্ধ আবার কি? মায়ের গুষ্টির সাথে থাকতে থাকতে সাধু হচ্ছিস? আগে তো চুপচাপ থাকতি এখন গন্ধ বলা হচ্ছে একদম আলু ভর্তা বানিয়ে ফেলবো।”
নাহওয়ান মায়া মায়া নজরে তাকিয়ে বাবার বুকের উপর শুয়ে বললো,
“ইননা। বত্তা কললে মাইল ডিবে।”
মারওয়ান ছেলেকে চেপে ধরে বললো,
“কার এতো বড় স্পর্ধা আমাকে মারবে? তাকেও ভর্তা করে ফেলবো।”
নাহওয়ান বাবার বুকে শান্ত হয়ে পড়ে রইলো। মারওয়ান ছেলেকে ডাকলো,

“ওই কবুতরের ছাও?”
“কি?”
“আমার মাথাটা একটু টিপে দে বাপ। অনেক দোয়া দিবো যেন তাড়াতাড়ি বড় হয়ে আমার মাজাটাও টিপে দিতে পারিস।”
নাহওয়ান বাবার কথার অর্থ পুরোপুরি উৎঘাটন করতে পারলো না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বললো,
“আচ্চা টিপি ডেই।
মারওয়ান বুঝলো ছেলে তার কথার মর্মার্থ বোঝে নি। ছেলের ছোট্ট ছোট্ট হাত যখন তার কপালে পড়লো তখন দারুন শান্তি লাগলো। ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখলো বাচ্চাটা দুই হাত দিয়ে বহু কসরত করে জোর দিয়ে কপাল টিপতে চাচ্ছে কিন্তু ছাওটার শরীরের এতো জোর মারওয়ানের কাছে হালকা পালকের ছোঁয়ার মতো লাগছে। আরামে কখন গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেলো ঠিক ঠাহর করতে পারলো না সে।

ইহাব মানহাকে সাদা কালো মিশেলের একটা পার্সিয়ান বিড়াল এনে দিয়েছে। বাবার বাড়ি থেকে এসে মানহার প্রায়ই মন খারাপ থাকে। একা একা বোরিং লাগে তাই উর্মি ভুঁইয়া ইহাবকে বিড়ালের কথা বলেছেন। পোষা প্রাণী থাকলে মনটা যদি একটু ভালো হয়। মানহা বিড়াল দেখে লাফ দিয়ে ওঠেছিল। তার কাছে প্রাণী দূর থেকেই সুন্দর। ওদেরকে আদর করতে গেলে মানহার হার্ট অ্যাটাক হয়। প্রচণ্ড ভয় লাগে। ইহাব তো মানহার কাণ্ড দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিল আর বলছিল,
“যার সামান্য বিড়ালে এতো ভয় তার তো আমাকে ভয় হবে এটাই স্বাভাবিক। তোমাকে খেয়ে ফেলবে নাকি?”
মানহা চোখ মুখ লাল করে বলেছিল,

“এটাকে সরান। আমার ভয় লাগে পশুপাখিতে। যেকোনো সময় কামড় দিতে পারে। দূরে সরান।”
ইহাব পায়ের উপর পা তুলে সোফায় হাত ছড়িয়ে দিয়ে বলেছিল,
“আমি কামড়ালেও ও কামড়াবে না। She’s such a gentle and loving cat (ও অনেক শান্ত ও আদুরে)। ওকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ফ্লাফি কাম হেয়ার।”
ফ্লাফি বিড়ালের নাম। ডাক শুনেই ফ্লাফি লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে মালিকের কাছে দৌঁড়ে এসেছিল। মানহা চেয়ে চেয়ে দেখছিল আর ভাবছিল অসভ্য লোকটা নাকি তাকে কামড়াবে? ছিঃ ছিঃ কিসব কথা!

আগের কথা ভাবতে ভাবতে মানহার ধ্যান ভঙ্গ হয়। লজ্জাও লাগছিল ইহাবের ওই কথা মনে করে। বিড়ালটা বেশিরভাগ সময় তার শাশুড়ির কাছেই থাকে। উর্মি ভুঁইয়া একটু একটু করে মানহার অ্যানিমেল ফোবিয়া দূর করছেন। মানহার আস্তে আস্তে বিড়ালের প্রতি ভয় কেটে যাচ্ছে। এখন বিড়াল দেখলেই লাফ দিয়ে ওঠে না। মাথায় আদর করে দেয়। কি যে কিউট বিড়ালটা! ফ্লাফির শরীর হাতালে অনেক আরাম লাগে। ওর ঘন সাদা মোলায়েম লোমগুলো সারাক্ষণ হাতাতে ইচ্ছে করে। সাধারনত পার্সিয়ান বিড়াল দ্রুত পোষ মানে না তবে ফ্লাফি খুব দ্রুতই পোষ মেনে গেছে। দারুন মিশুক ফ্লাফি। একটু আদর করলেই চুপচাপ আদর খেতে থাকে। ওর পুরো শরীরটাই সাদা শুধু পিঠের কাছটা কালো। ফ্লাফি সারাক্ষণ উর্মি ভুঁইয়ার কোলে আদুরে বাচ্চার মতো পড়ে থাকে আর মানহা চেয়ে চেয়ে দেখে।
উর্মি ভুঁইয়া আর মানহা বাড়ির লনে বসে আছে। সকালের মিষ্টি রোদ পোহাচ্ছে দুই শাশুড়ি বউ। মানহা খেয়াল করেছে উর্মি ভুঁইয়া তার সাথে মাত্রাতিরিক্ত মিশেন এবং তাকে খুবই স্নেহ করেন। সচরাচর কোনো শাশুড়ি তার ছেলের বউকে এতটা আদর ও যত্ন করেনা। তার জানা মতে শাশুড়িরা ছেলের বউকে তেমন পছন্দ করেনা কিন্তু উর্মি ভুঁইয়া যেন ব্যতিক্রম শাশুড়ি।

মানহা এটাও খেয়াল করেছে উর্মি ভুঁইয়া বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের তুলনায় তার সাথে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তার কাছে কেন যেন এটা অস্বাভাবিক লাগে। এতো চমৎকার একজন নারী তার স্বামী, সন্তানের সাথে এমন নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে থাকেন কেন? তার শ্বশুর তো যথেষ্ট যত্নশীল মানুষ তবুও শাশুড়ির এরকম বীতরাগ আচরণের কারণ কি হতে পারে? তার কেন যেন উর্মি ভুঁইয়াকে রহস্যময়ী নারী মনে হয়। মনে হয় অনেক লুকায়িত কথা জমে আছে তার মনে কিন্তু হাসির আড়ালে তা চাপা দিয়ে রাখেন। মানহা আচমকা জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা আম্মু; আব্বু তো আপনার কাজিন হন। আপনাদের কি প্রেমের বিয়ে?”
উর্মি ভুঁইয়া ফ্লাফিকে আদর করতে করতে বললেন,
“কে বলেছে তোমার আব্বু আমার কাজিন হন?”
“সেদিন বললেন না আপনারা একই বংশের। কাজিন না হলে এক বংশের কেউ হয়?”
উর্মি ভুঁইয়া মুচকি হেঁসে বললেন,

“বোকা মেয়ে। ভুঁইয়া বংশ কি খালি একটাই নাকি? তোমার শ্বশুর শাহবাজপুর গ্রামের ভুঁইয়া বংশের আর আমি রাজনপুর গ্রামের ভুঁইয়া বংশের মেয়ে।”
মানহা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এতদিন তো সে ভেবেছে তার শ্বশুর শাশুড়ি কাজিন বর কনে। এখন তো পুরাই উল্টে গেলো। এ কিভাবে সম্ভব? একই পদবীতে ভিন্ন অঞ্চলের মানুষের বিবাহ আদৌ সম্ভব? এগুলো তার কাছে একেবারেই অদ্ভুত এবং আলাদা ঘটনা। মানহা তার শ্বশুর শাশুড়ির কাহিনী শুনতে উদগ্রীব হয়ে পড়লো। সে খুবই কৌতুহল নিয়ে শাশুড়িকে জিজ্ঞেস বললো,
“ইন্টারেস্টিং। আপনাদের বিয়ে কিভাবে হলো আম্মু? জানতে পারি কি?”
উর্মি ভুঁইয়া ফ্লাফিকে ছেড়ে শাড়ির আঁচল ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর লনের সামনের গাছ গুলো ছুঁতে ছুঁতে বললেন,

“ওগো উর্মি মালা,
তরঙ্গের ন্যায় ঢেউ খেলো
আমার মনের উঠোনে।
তোমার প্রেমেতে পড়ে
ঝাঁপ দিয়েছি মন পুকুরে।”
তোমার স্মৃতিতে কাটে আমার
সকাল বিকেল রাত্রি,
তুমি কি আমার সাথে
থাকবে দিবারাত্রি?”
কবিতাটি আবৃত্তি করে তিনি বললেন,

“তোমার শ্বশুরের সাথে আমার প্রথম যেদিন দেখা হয় সেদিন এই কবিতা আবৃত্তি করে তিনি ভালোবাসা নিবেদন করেছিলেন। আমি পাত্তা দেইনি। ওরকম মাস্তান রাজনীতিবিদকে কেইবা পাত্তা দিবে? মেয়েরা এতে গললেও আমার এসব পুরুষের প্রতি কোনো আকর্ষণ কাজ করতো না। যদিও তাকে আমি সেদিন প্রথম দেখেছিলাম কিন্তু তিনি আমায় বহু আগেই দেখেছেন এটা বিয়ের পর জানতে পারি। সারা রাত জেগে নাকি সে এই কবিতাটা শুধু আমার জন্য লিখেছিলো। বিয়ের পর এই কবিতাটি আমার কবিতা সমগ্র ডাইরিতে টুকে রেখেছিলাম। সে জানে না। আমার মুখস্থ হয়ে গেছে এটা। আনাড়ি হাতে একেবারে খারাপ লেখেনি। রাজনীতি কোরে এইটুকু যে লিখেছে এটাই তো অনেক। তার হয়তবা মনেও নেই এই কবিতার কথা। বহু আগের কাহিনী। মাথায় ছন্দ এসেছে আর লিখে ফেলেছে। কাগজটাও হারিয়ে ফেলেছে সম্ভবত ভাগ্যিস আমি টুকে রেখেছিলাম।”
মানহা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শাশুড়ির কথা শুনছিল। উর্মি ভুঁইয়া থেমে যাওয়ায় শাশুড়ির দিকে চোখ পড়তেই লক্ষ্য করলো তার ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি। মানহার ঠোঁটেও হাসি। শাশুড়িকে স্মৃতি মন্থন করতে দেখে ভালো লাগছে তার। শ্বশুর শাশুড়ির কাহিনী শুনতে দারুন লাগছে। সে চাচ্ছিলো তার শাশুড়ি আরও কিছু বলুক কিন্তু উর্মি ভুঁইয়া আর কিছু বললেন না। পাইপ দিয়ে গাছ গুলোতে পানি দিতে লাগলেন।

চেয়ারের উপর চোখ, হাত পা পিছনে বাঁধা অবস্থায় রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে একজন। তার মাথা ও মুখ থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে। তার সামনেই পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে কেউ একজন। তার মুখশ্রী কঠিন। লোকটির পিছনে অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। তার শিকারী নজর চেয়ারে বাঁধা ব্যক্তির উপর। ক্ষিপ্র গতিতে উঠে বাঁধা ব্যক্তিটির চুল মুঠ করে মুখ উপরে তুলে বললো,
“তুই আমার লোককে মেরেছিস? তোর এতো বড় কলিজা কিভাবে হয়? বহুত বার বেড়েছিস তাই না? আমার প্রত্যেকটা চাল ভেস্তে দিচ্ছিস তোকে টুকরো টুকরো করে কুত্তা*রে খাওয়াবো কু***বাচ্চা। আমার সঙ্গে পাঙ্গা?”
চেয়ারে বাঁধা ব্যাক্তিটি রক্তাক্ত ঠোঁট এলিয়ে হেঁসে বললো,

“বেশ করেছি। তুই যেমন আমার চাল ভেস্তে দিয়েছিস আমিও দিয়েছি। হলো না সমান সমান?”
বলে আবার হো হো করে হাসলো। সামনের লোকটি ব্যক্তিটির হাসির শব্দে চোয়াল বরাবর ঘুষি বসিয়ে দিলো। ব্যক্তিটির হাসি তবুও থামলো না। লোকটি ফিসফিস করে বললো,
“বহু বছর আগে সম্পর্কে ফাটল ধরেছিল মনে আছে নিশ্চয়ই? তোকে কিভাবে নাচাতে হয় সব আমার জানা আছে। তোর হেডম বার করবো। আমার খেয়ে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তোকে পিস পিস করবো শু*** বাচ্চা। তোকে খুন করতে বলেছি আর তুই আমার লোককে খুন করলি? তোকে দেখে নেবো।”
“ওকে। আয়েম ওয়েটিং।”
আশপাশ থেকে গাড়ির আওয়াজে লোকটি তার দলবল নিয়ে ব্যক্তিটিকে শাসিয়ে চলে গেলো। মানুষের পায়ের আওয়াজে চেয়ারে বাঁধা ব্যাক্তিটি নড়ে চড়ে বসলো। একটু পরে কানে বাড়ি খেলো,
“কিলার জাদ।”

মধ্যরাতে মারওয়ান বাসায় এসেছে মাথায় ব্যান্ডেজ করে। মাহবুব আলম উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“মাথায় আঘাত পেলি কি করে?”
মারওয়ান ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জবাব দিলো,
“ওই হালকা অ্যাকসিডেন্ট করেছি।”
নাসির উদ্দিন বলেলন,
“হালকা অ্যাকসিডেন্ট করেছো মানে? রাত বাজে একটা। তুমি এই রাতের বেলা কোত্থেকে এলে এইরকম গুরুতর অ্যাকসিডেন্ট করে? এতো রাতে কোনো ভদ্র বাড়ির পুরুষ বাইরে থাকে? খুন খারাবি করতে নামো নাকি এই মধ্যরাতে?”
মারওয়ান গম্ভীর কণ্ঠে শুনলো কিন্তু কোনো প্রতিউত্তর করলো না। নাসির উদ্দিন বললেন,

“ভাগ্যিস মেয়েটাকে নাতি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলেছিলাম নাহলে এর এই দশা দেখে কান্নাকাটি শুরু করতো। মেয়েটাকে জ্বালিয়ে খেলো এই ছেলে। ভাত খেয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়। এতো রাত পর্যন্ত বাইরে থাকো কিজন্য? কোনো কাজ কাম করো না সারাদিন বাসায় থাকবে তা না টইটই করে বাইরে গিয়ে আকাম ঘটানো। কাজের কাজ কিছু নেই অকাজে এক্সপার্ট।”
বলে রুমে চলে গেলেন। মাহাবুব আলম ছেলের দিকে কড়া চাহুনি নিক্ষেপ করলেন। মারওয়ান বাবার নজরকে পাত্তা না দিয়ে বেসিনে মুখ ধুয়ে ভাত বেড়ে খেতে বসলো। উফ মাথায় ভালোই আঘাত পেয়েছে। ভাত চিবোতে কষ্ট হচ্ছে। নাসির উদ্দিন হনহন করে হেঁটে এসে বললেন,
“এই ছেলে এই নাপাটা খেয়ে ঘুমিও। কোথায় মাস্তানি করতে গিয়ে গণপিটুনি খেয়ে এসেছে কে জানে দোষ দেয় অ্যাকসিডেন্টের।”

বলে আবারও রুমে চলে গেলেন। মারওয়ান মুখ কুঁচকে শ্বশুর নামক আজব চিড়িয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। মাহাবুব আলম ছেলের ভাত খাওয়া পর্যন্ত পাশে বসে রইলেন সাথে টুকটাক আলাপও করলেন।
মারওয়ান রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো। মাথা ব্যথায় টনটন করছে। ধীরে ধীরে শার্ট পাল্টিয়ে বিরক্ত মুখে কনুইয়ে মলম লাগালো। নিঃশব্দে খাটে শুতে নিলে দেখলো নিশাত তার জায়গায় শুয়ে আছে। ছেলেকে দেয়ালের পাশে কোলবালিশ দিয়ে বর্ডার দিয়ে রেখেছে। মারওয়ান একটা নিঃশ্বাস ফেলে খুব সাবধানে নিশাতকে বিছানার মাঝ বরাবর এগিয়ে দিলো। নিশাত হালকা নড়ে উঠলো। মারওয়ান কোনো শব্দ না করে ছেলেকে চুমু খেয়ে নিশাতের পাশে শুয়ে পড়লো। ঘুম একটু গাঢ় হতেই বুকের উপর কারো ভার টের পেলো। ঘুমের মধ্যেও বুঝতে পারলো কে এটা।

নিশাত ভোরে ঘুম থেকে উঠেই দেখলো মারওয়ানের পাশটা ফাঁকা। লোকটা রাতে আসেনি বাসায়? বাবা, আব্বা বাসায় থাকতেও খামখেয়ালীপনা দেখাতে হবে তার? নিশাত চিন্তিত ভঙ্গিতে ওযু করে নামাজে দাঁড়ালো। নামাজ শেষে দোয়া, দুরুদ পাঠ করে কুরআন তিলাওয়াত করলো। কেমন যেন লাগছে তার। আল্লাহর কাছে অব্যক্ত কথাগুলো পেশ করে রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো মারওয়ান চা খাচ্ছে। মাথায় ব্যান্ডেজ। নিশাত মারওয়ানের মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে আতঙ্কিত গলায় এগিয়ে এসে বললো,
“আপনার মাথায় ব্যান্ডেজ কেন? কি হয়েছে?”
মারওয়ান চা খেতে খেতে বিরক্ত হলো। চোখ কঠিন করে বললো,
“এতো চিৎকার চেঁচামেচি করার কি হয়েছে? সামান্য আঘাত এমন ভাব করছো যেন মরে গেছি। মরলে দুই একদিন কেঁদে আরেকটা ভালো দেখে বিয়ে করে ফেলো। তোমার বাপ তো আছেই তক্কে তক্কে। কোনদিন আমি খালাশ হবো আর তিনি তোমাকে ভালো একটা ঘরে বিয়ে দিয়ে উদ্ধার করবেন।”

নিশাতের চোখ ছলছল করে উঠলো। এতোবড় একটা কথা বলতে এই লোকের আটকালো না? আঘাত পেয়ে এসেও তার সাথে মেজাজ দেখানো হচ্ছে? নিশাতের ভারী রাগ হলো। একটা কথাও বলবে না এই লোকের সাথে। কেউ তাকে পাত্তা না দিলে ন্যাকামি করার সময় নেই। ভেবেছিল কিভাবে আঘাত পেয়েছে জানবে এখন জানার কোনো ইচ্ছেই নেই। সে চুপচাপ গম্ভীর মুখে সকালের নাস্তা বানাতে লেগে গেলো। মারওয়ান একবার নিশাতকে দেখে চা শেষ করে কাপ রেখে বেরিয়ে গেলো। নিশাত চায়ের কাপ ধুয়ে রেখে দিলো। শ্বশুড় ও বাবার জন্য চায়ের পানি বসিয়ে দিলো। সকালে ওনাদের হালকা চা, বিস্কুট দিতে হয়।

জিনান তার স্টাডি রুমে বসে পেপার পড়ছে আর কফি খাচ্ছে। তার নীল চোখ দুটো প্রথম দেখাতেই সবার নজর কাড়ে। একধরণের ঠাণ্ডা নিরপেক্ষতা বিরাজ করে সেখানে যা তাকে আরও রহস্যময় করে তোলে। সংবাদপত্র ঘেঁটে দেশের নিত্যদিনের হালচাল দেখে রেখে দিলো সে। ফোন ঘেঁটে কারো নম্বরে ডায়াল করলো। ওপাশ থেকে কল ওঠালে বললো,

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২৯+৩০

“আদহাম স্পিকিং, আপনি আজকে ইন্টিলিজেন্স ইউনিটে থাকবেন মিস্টার মুনতাজির?”
“নো। আয়েম সিক। গতকাল আমি ছিলাম বাট আপনি ছিলেন না ব্যাড লাক।”
“Okay, No problem. I am eagerly waiting for you. Take care of your health.”
“থ্যাংকস মিস্টার আদহাম।”

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩২