ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩২

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩২
তাজরীন ফাতিহা

রাত দেড়টা। বেশ পুরোনো দ্বিতল বাড়ির সামনে একটি জিপগাড়ি দাঁড়ানো। বাড়িটির ভিতরে জঙ্গলে আবৃত। কেউ থাকে না বিধায় পুরো বাড়িটা ভৌতিক আবহ তৈরি করে আছে। অন্ধকারে বিলীন বাড়িটি। ঢুকতে গেলেই ভ্যাপসা ম্যাড়ম্যাড়ে একটা অদ্ভুত তীব্র গন্ধ নাসারন্ধ্রে বারি খায়। পুরোনো স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল জুড়ে রক্তের দাগ শুকিয়ে আছে। জিনান আদহাম খুবই সূক্ষ্ম নজরে দেয়ালটি পর্যবেক্ষণ করলো। হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক, চোখে নাইট ভিশন গগলস। গ্লাভস পড়া হাতে UV টর্চ জ্বালিয়ে শুকনো রক্তের পরিমাপ করে ফেললো। তার অভিজ্ঞ চোখজোড়া পুরো রুমকে স্ক্যান করে ফেললো মুহূর্তের মধ্যে। পোর্টেবল ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানারের সাহায্যে আসবাবপত্র, জালালা সবকিছু দক্ষ হাতে স্ক্যান করে গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেলো সে।
জিনান রুম থেকে বেরিয়ে দেখলো মুনতাজির জায়েদ একটা কাঠের দরজা পোর্টেবল স্ক্যানার দিয়ে স্ক্যান করছে। জিনান তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে শুধালো,

“Did you find anything, Mr. Muntazir?”
মুনতাজির গম্ভীর মুখে বললো,
“ইয়েস। এবার মনে হয় অপরাধী খুব সহজেই ধরা পড়ে যাবে।”
জিনান নিজের লং কোটে হাত ঢুকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“খুনি খুবই বোকামো করেছে বুঝলেন? খুনের চিহ্ন মুছতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।”
মুনতাজির রহস্যময় ভঙ্গিতে হেঁসে বললো,
“উহু তার আস্তানাই এটা। তাই ভেবেছে নিজের আস্তানা সাফ করে কি হবে? প্রতিদিনই তো এখানে তার পদধূলি পড়ে। আমরা যে তার এই গোপনীয় আস্তানা পেয়ে যাবো বেচারা বোঝে নি। খুবই দুঃখজনক।”
জিনান কৌতুকপূর্ণ কথায় হালকা ঠোঁট বাঁকালো। নেওয়াজ পিছন থেকে বললো,
“খুনিকে এবার শীগ্রই আমাদের ডেরায় নেয়ার পালা কি বলেন মিস্টার জিনান অ্যান্ড মুনতাজির?”
জিনান আদহাম ও মুনতাজির জায়েদ একই সাথে উত্তর দিলো,
“ইয়েস মিস্টার নেওয়াজ।”
উভয়ই একসাথে বলায় তিনজন গম্ভীরভাবে হেঁসে উঠলো। আলো আঁধারির ওই বাড়িটি যেন তাদের হাসিতে ভৌতিক রহস্যময়তা ছড়িয়ে দিলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। রাত আটটার একটু কম বেশি হবে। নিশাত দ্রুত হাতে খিচুড়ি আর গরুর গোশত রান্না করছে। স্কুল থেকে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। রান্না করা হয়নি। সকালে রান্না করে গিয়েছিল সেটাই দুপুরে খেয়েছে বাবা ও শ্বশুর। মারওয়ান ঘরে নেই। এই বৃষ্টির মধ্যে লোকটা কোথায় গিয়েছে কে জানে? ইদানিং লোকটা কেমন রহস্যময় আচরণ করে। কোনো কথাই তেমন বলে না। বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকে যদিও আগেও থাকতো তবে ইদানিং একটু বেশিই বাইরে বাইরে থাকছে। এক সপ্তাহ আগে অ্যাকসিডেন্ট করে এক দণ্ড ঘরে থাকেনি। একদিন কোনরকম একটু রেস্ট নিয়ে টো টো করতে বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। কি যে এতো বাইরে কে জানে? এসব ভাবতে ভাবতে গরুর গোশত কষাতে মনোযোগ দিলো। মাহাবুব আলম রান্নাঘরে ঢুকে দেখলেন নিশাত তাড়াহুড়ো করে রান্না করছে। তিনি এগিয়ে এসে বললেন,

“কি রাধছো মা? দারুন সুঘ্রাণ বেরিয়েছে তো।”
“এইতো আব্বা খিচুড়ি করছিলাম। বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি খেতে পছন্দ করে আপনার ছেলে আর নাতি।”
নিশাতের কথা শুনে মাহবুব আলম নিশাতের পাশে দাঁড়িয়ে গোশত কষানো দেখতে লাগলেন। তার খিচুড়ির সাথে ভীষণ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু নিশাতের কষ্ট হবে ভেবে কিছু বললেন না তিনি। গোশত কষাতে কষাতে নিশাত খেয়াল করলো মাহাবুব আলম উশখুশ করছেন। গোশত কষানো হলে গোশতে পানি দিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রেখে মাহাবুব আলমের দিকে চেয়ে বললো,
“কিছু বলবেন আব্বা?”
মাহাবুব আলম ইতস্তত করতে করতে বললেন,
“না কিছু না। ওই আগামীকাল বাড়ি চলে যাবো তো নাতিটার জন্য মন পুড়বে। এতো মায়া লাগায় বাচ্চাটা। ভুলতে পারিনা।”

নিশাতের নিজেরও ভীষণ খারাপ লাগছে। আগামীকাল বাবা, শ্বশুড় কেউ থাকবে না। চলে যাবে ভাবতেই বুকটা কেমন কামড়ে ধরছে। নিশাত কত অনুরোধ করলো কিন্তু তাদের কাজ রয়েছে তাই চাইলেও থাকা সম্ভব নয়। নিশাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আপনি রুমে যান আব্বা। আমি ঝটপট রেঁধে আপনাদের খেতে দিচ্ছি। এখনই হয়ে যাবে।”
বলেই আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লো রান্নায়। মাহাবুব আলম তা দেখে বললেন,
“এতো তাড়াহুড়ো কেন মা? খেতে তো দেরি আছে। একটু আগে সন্ধ্যার নাস্তা করলাম। পেট ভরা। ধীরে ধীরে রান্না করো অতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই।”
বলেই তিনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। নিশাত আবারও রান্নায় মনোযোগ দিলো।

কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরলো মারওয়ান। জামাকাপড় ভিজে জবজবে হয়ে আছে। বাসায় ঢুকেই গোসল করতে চলে গেছে। খানিক পরে নিশাত পাটিতে খিচুড়ি, গরু ভুনা, সালাদ, লেবু এনে রাখলো। নাসির উদ্দিন, মাহাবুব আলমকে ডেকে এনে প্লেটে খিচুড়ি বেড়ে দিচ্ছে। নাসির উদ্দিন তা দেখে বললেন,
“টো টো কোম্পানির ম্যানেজারটা কই? দেখলাম ভিজে টিজে এলো। তা ভবঘুরের চাকরি কেমন চলছে তার? তাকে তো দেখাই যায়না বহুত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কিনা।”
নিশাত কিছু বললো না। বাবা, শ্বশুরের পাতে সালাদ, লেবুর টুকরো উঠিয়ে দিলো সে। মাহাবুব আলম বললেন,
“নাতি কই রে মা? খাবে না?”

“ও ঘুমাচ্ছে আব্বা। ওর বাবার সাথে খাবে।”
মাহাবুব আলম একটু মন খারাপ করেই বললেন,
“ওহ্ ঘুমাচ্ছে! নাতিটাকে আবার কবে না কবে পাবো।”
বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নিশাত উঠে রান্নাঘর থেকে একটা প্লেট এনে মাহবুব আলমের সামনে রাখলো। মাহাবুব আলম প্লেটে তাকিয়ে দেখলেন ইলিশ মাছ ভাজা। পাশে বড় বড় ইলিশ মাছের ডিম ও ভাজা শুকনো মরিচ। তার চোখ চকচক করে উঠলো। তিনি চট নিশাতের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন,
“ইলিশ মাছ!!”
নিশাত একটু হেঁসে বললো,

“আপনার ছেলে নিয়ে এলো। ভাবলাম টাটকা টাটকা ভেজে দেই খিচুড়ির সাথে দারুন জমবে। আপনি, আপনার ছেলে, নাতি সবার তো আবার ইলিশ মাছ পছন্দের তাই গরম গরম ভেজে আনলাম। নিন বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া শুরু করুন।”
বলেই একটুকরো ইলিশ মাছ ও মাছের ডিম শ্বশুরের পাতে তুলে দিলো নিশাত। নাসির উদ্দিন গালে হাত ঠেকিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ হ্যাঁ সব মাহাবুব আর মাহাবুবের আওলাদের জন্য। আমি তো দুধ ভাত।”
মাহাবুব আলম হেঁসে নিজের পাত থেকে অর্ধেক ডিম ভেঙে বললেন,
“তুই দুধ ভাত হতে যাবি কেন? যে অমন আস্ত রত্নের জনক সে কি কোনদিন দুধ ভাত হয়?”
বলেই দুই বন্ধু নামক বেয়াই হেঁসে দিলেন একযোগে। নিশাতও হেঁসে নাসির উদ্দিনের পাতে মাছ, ডিম তুলে দিলো। দুই বন্ধু গল্প করতে করতে বেশ আরাম করে তৃপ্তি নিয়ে খেতে লাগলো। নিশাত তাদের তৃপ্তি নিয়ে খেতে দেখে নিজেও তৃপ্তি পেলো।

নিজেদের রুমে খাবারের প্লেট নিয়ে ঢুকলো নিশাত। দেখলো দুই বাপ, ছেলে ঠোঁট ফুলিয়ে ঘুমাচ্ছে। মারওয়ানের মাথায় ব্যান্ডেজ এখনো বিদ্যমান। রক্তে ভিজে আছে ব্যান্ডেজ। এই অসুস্থ শরীর নিয়েও প্রতিদিন বাইরে যেতে হবে কেন তার? কাজ করিস না ঘরে থাকবি তা না বাইরে বাইরে গিয়ে শরীর খারাপ করে আসিস। কি ক্লান্ত দেখাচ্ছে মুখশ্রী! ক্লান্তিতে কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে লোকটা। ভারী মায়া লাগলো তার।
প্লেটটা টেবিলে রেখে মারওয়ানের মাথার কাছে বসলো নিশাত। ব্যান্ডেজের উপরে হালকা করে হাত ছুঁয়ে দিলো। জেগে থাকলে তাকে ছুঁতেও দেয়না। এমন খিটখিট শুরু করে যেন সে ছুঁয়ে দিলে ব্যথা আরও বেড়ে যাবে। ইশ কতটা গভীর ক্ষত হয়েছে! কিভাবে যে অ্যাকসিডেন্ট করলো এখনো ক্ষত শুকায়নি। ওষুধ নিয়মিত খাচ্ছে তবুও ক্ষত তেমন একটা সারে নি। এতো গভীর ব্যথা নিয়েও দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে হলে তো একমাসেও বিছানা থেকে উঠতে পারতো না। এসব ভেবে কিছুক্ষণ ওই রুক্ষ চেহারার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে ডাকতে লাগলো,

“শুনছেন? খাবেন না? উঠুন দ্রুত।”
মারওয়ান ঘুমের মধ্যে বিরক্ত হয়ে অন্যপাশে ঘুরতে নিলে নিশাত তাকে বাঁধা দিয়ে বললো,
“উঠুন, উঠুন। খিচুড়ি রান্না করেছি। গরম গরম খেয়ে নিন নাহলে মজা লাগবে না। আপনার হাতে খাবে বলে নাহওয়ানও খায়নি।”
ছেলে খায়নি শুনে মারওয়ান বিরক্ত হয়ে চোখ খুললো। মাথা ভার হয়ে আছে। উঠতে গেলে নিশাত সাহায্য করতে চাইলে মারওয়ান তাকে সরিয়ে দিলো। নিজেই উঠলো। ক্ষততে টান লেগে মাথা ব্যথায় খিঁচে উঠলো। ব্যথায় মারওয়ানের মুখ কুঁচকে গেলো তবুও ব্যথা সূচক একটা শব্দও করলো না সে। চুপচাপ বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে বের হলো। এর মধ্যে নিশাত ছেলেকে উঠিয়ে ফেলেছে। বাচ্চাটা মায়ের কোলে বসে ঘুম ঘুম চোখে বাবার দিকে চেয়ে ডাকলো,
“বাবা।”
মারওয়ান ডাক শুনে ছেলের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। নাহওয়ান ভেবেছে বাবা এসে তাকে কোলে নিবে কিন্তু তা না হওয়ায় মায়ের দিকে চাইলো। নিশাত ছেলের চাহনি দেখে বললো,

“বাবার অসুখ আব্বা। ভালো হয়ে গেলে আপনাকে কোলে নিবে কেমন?”
“উসুক?”
“জ্বি, অসুখ।”
গত সাতদিন ধরে নাহওয়ান প্রায়ই এই কথাটা শুনছে যে বাবার অসুখ। বাবা আগের মতো দুষ্টুমি করে না, মজা করে না তার সাথে। অসুখ মানেই এখন তার কাছে অনেক বড় কিছু। অসুখ হলে বাবা কথা বলে না। নাহওয়ানের এটা মোটেও ভালো লাগে না। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ছলছল নয়নে বললো,
“উসুক পুচা। বাবা কতা বলে না। উসুককে চলি যেতে বলো?”
নিশাত ছেলেকে ঝাপটে ধরে বাথরুমে নিয়ে এসে বললো,
“অসুখ সময় হলে চলে যাবে। বাবা তখন অনেক কথা বলবে, আদর করবে কেমন?”

নাহওয়ান মায়ের কথা শুনে মাথা নাড়লো। নিশাত ছেলের মুখ ধুয়ে দিয়ে বাথরুম থেকে বের হলো। মারওয়ান খাটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। নিশাতের কথার আওয়াজে চোখ খুললো। নিশাত ছেলেকে বিছানায় দাড় করিয়ে একটা গামছা মারওয়ানের সামনে বিছিয়ে দিলো। টেবিল থেকে প্লেট এনে মারওয়ানকে দিলো। প্লেট হাতে তুলে মারওয়ান নাহওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এদিকে আয় কবুতরের ছাও।”
নিশাত তা শুনে বললো,
“ওকে আমি খাইয়ে দেবো নে। আপনি খান।”
মারওয়ান সেই কথার তোয়াক্কা না করে নাহওয়ানকে আবারও ডাকলো,
“ওই পান্ডা ডাকলাম না?”

নাহওয়ান বাবার ডাক শুনে লাফাতে লাফাতে মারওয়ানের কাছে এলো। মারওয়ান ছেলেকে নিজের ভাজকৃত পায়ের উপর বসিয়ে খিচুড়ি খাওয়াতে লাগলো। ইলিশ মাছের ডিম মুখে দিলে নাহওয়ান মাথা নাড়িয়ে বললো,
“মুজা মুজা।”
বাবা ছেলের কাণ্ড দেখতে দেখতে নিশাত গ্লাসে পানি ঢেলে দিলো। সেও বাপ, বেটার পাশে বসে চারটে খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষে মারওয়ানকে বললো,
“ওষুধ দিবো?”
মারওয়ান বিরক্ত হয়ে বললো,
“ওসব বড় বড় টেবলেট খেতে ভালো লাগে না।”
নিশাত ওষুধ এনে বললো,
“অসুখ যখন বাঁধিয়েছেন ভালো না লাগলেও খেতে হবে।”

বলেই মারওয়ানের হাতে টেবলেট গুলো দিলো। নাহওয়ান পাশে বসে বাবার হাতে এতো বড় বড় ওষুধ দেখে বললো,
“ইগুলো কি?”
মারওয়ান পা নাড়িয়ে বললো,
“টেবলেট।”
নাহওয়ান ঘাড় কাত করে বললো,
“টেলবেল কি?”
“ওষুধ। অসুখ হলে খায়।”
ওষুধ নাহওয়ানেরও অপছন্দ। অসুখ হলে মা যখন তাকে ওষুধ খাওয়ায় তখন তার ভালো লাগে না। তাই সে ফুলো ফুলো গাল আরও ফুলিয়ে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললো,
“টেলবেল ইট্টুও মুজা না।”
মারওয়ান ছেলের কথা শুনে বললো,
“ঠিক বলেছিস। পুরাই ফালতু।”
নাহওয়ান হাত নাড়িয়ে বললো,
“পুলাই পালতু।”

কথাটা শুনে মারওয়ান ছেলের নাক টিপে দিয়ে টেবলেট গুলো গলধঃকরণ করলো। তারপর বালিশে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজলো। নিশাত ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো। মাঝ রাতে তীব্র উত্তাপে নিশাতের ঘুম ছুটে গেলো। ঘুম ভাঙতেই খেয়াল করলো মারওয়ান তাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরা। নিশাত একটু অবাকই হলো। সচরাচর ঘুমের মধ্যে জড়িয়ে ধরে না মারওয়ান। মারওয়ানের মুখ তার গলার কাছে। মনে হচ্ছে গলাটা পুড়ে যাচ্ছে। নিশাত ঘুরে মারওয়ানের কপালে হাত দিলো। গরমে পুড়ে যাচ্ছে শরীর। মৃদু কাঁপছে দেহটা। শীত করছে দেখে ঘুমের মধ্যে তাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে।
নিশাত নিজেকে ছাড়িয়ে কম্বল এনে মারওয়ানের গায়ে দিলো। থার্মোমিটার দিয়ে মেপে দেখলো জ্বর একশো চার ডিগ্রি। বেশ চিন্তিত হলো নিশাত। মাথায় ব্যান্ডেজ থাকায় জলপট্টি দিতে পারলো না সে। নাপা এনে মারওয়ানকে একটু জাগিয়ে ওষুধটা খাইয়ে দিলো। বিছনায় শুয়েও সারারাত আর ঘুম এলো না নিশাতের। এতো জ্বর নিয়েও কোনরকম টু শব্দ ছাড়া কিভাবে একটা মানুষ থাকতে পারে। এ কি মানুষ নাকি রোবট! কোনো অনুভূতিই নেই এই লোকের। সারারাত না ঘুমিয়ে একটু পর পর কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর কমেছে কিনা। চোখে ঘুম থাকলেও জ্বরে পড়ে থাকা অসুস্থ লোকটার জন্য পুরো রাত চোখের পাতা এক করতে পারলো না সে। ভোরের দিকে জ্বর হালকা কমে ঘাম ছেড়ে দিলে নিশাত একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

সকাল থেকেই ইহাবের মেজাজ আজকে চড়া। সাধারণত ইহাব রাগে না কিন্তু রেগে গেলে মেজাজ হারিয়ে ফেলে। সকাল সকাল কি নিয়ে যেন তুমুল কথা কাটাকাটি হয়েছে ফোনে। মানহা ইহাবকে এই প্রথম এতো রাগতে দেখেছে। তার কাছে ভয়ংকর লাগছে লোকটাকে। যে বর্তমানে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে ফোন কানে নিয়ে সমানে চিল্লিয়ে যাচ্ছে। উর্মি ভুঁইয়া দুজনের নাস্তা তার হাতে ধরিয়ে উপরেই খেতে বলেছেন। তাই নাস্তা হাতে বর্তমানে রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে।
এদিকে ইহাব ফোন কেটে ঢিল দিয়ে বিছানায় ছুড়ে মারলো। রাগে শরীর জ্বলছে তার। একটা কাজও ঠিক করে করতে পারেনা। যা করতে বলে সব ঘেঁটে মুড়িঘণ্ট বানিয়ে ফেলে। মানহাকে দরজার সামনে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

“কি সমস্যা? এরকম খাম্বার মতো প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
মানহা একটু ঢোক গিলে সাহস সঞ্চয় করে বললো,
“নাস্তা এনেছিলাম।”
“তো টেবিলে রাখো। এরকম দরজার সামনে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকার মানে কি?”
মানহার কেন যেন কথাটায় খারাপ লাগলো। শরীর ঘেমে উঠছে। কাঁপা কাঁপা হাতে চুপচাপ টেবিলে নাস্তা রাখতে গিয়ে কাঁচের প্লেটটা হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেলো। প্লেট ভাঙার শব্দে ইহাব ঘুরে সেদিকে চাইলো। এমনিতেই মেজাজ কন্ট্রোল করতে পারছিল না তার উপর মানহার কাঁপাকাঁপি। মেজাজ হারিয়ে বললো,
“সবকিছুতে তোমার কাঁপতে হবে কেন? তোমাকে এখন ধরেছি না ছুঁয়েছি? বিয়ে করে মানুষ বউ আনে আর আমি রোগী এনেছি। কিছু হলেই কাঁপাকাঁপি। পুরাই ননসেস কার্যক্রম। This is absolutely ridiculous, get a grip! (এটা একেবারেই হাস্যকর, নিজেকে সামলাও!).”

বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। এদিকে মানহা ইহাবের শেষের ইংরেজি না বুঝলেও এতটুকু ভালোই বুঝেছে ইহাব তার প্যানিক অ্যাটাকে বেশ বিরক্ত। বিয়ের একমাস পেরুতে পারলো না এখনই এই ব্যবহার! সে নিজেকে শক্ত করতে চাইলো কিন্তু কেন যেন শরীরটা তার সাথে বেইমানি করছে। কাঁপা কাঁপা হাতে ভাঙা প্লেটটা ওঠাতে গেলে হাতে ভাঙা অংশ বিদ্ধ হয়ে গলগল করে রক্ত বের হতে লাগলো তবুও টুকরো টুকরো অংশ ওঠানো থামালো না সে।
ইহাব নিচে গিয়ে রুম পরিষ্কারের জন্য মেইড ডেকে এনেছে। কিন্তু রুমে ঢুকে এই দৃশ্য দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো। সাথে রাগে শরীর ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। মেইড গিয়ে দ্রুত ভাঙা প্লেট উঠিয়ে পরিষ্কার করে চলে গেলো। মানহা আস্তে আস্তে উঠে বেরিয়ে যেতে নিলে ইহাব রাগে দেয়ালে ঘুষি বসিয়ে দিলো। এমনিতেই রাগ কন্ট্রোল করতে পারছে না তার উপর মানহার ত্যাড়ামি। সব মিলিয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করা একেবারেই দায় হয়ে পড়েছে। মানহা সেদিকে কঠিন চোখে চেয়ে বেরিয়ে যেতে নিলে ইহাব শক্ত করে তার বাহু চেপে ধরে খাটে বসিয়ে হাতে ব্যান্ডেজ করে দিতে নিলে মানহা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

“কোনো রোগীর সেবা আপনাকে করতে হবে না। আমি নিজেরটা নিজে করতে পারি। আমার রোগ নিয়ে কারো যদি সমস্যা হয় ডিরেক্ট বাবার বাড়ি রেখে আসবেন। এই বিয়ে আপনি করেছেন আমি আপনাকে জোর করিনি আমায় বিয়ে করতে।”
ইহাব মানহার কথা শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না। চুপচাপ ব্যান্ডেজ করে রেডি হয়ে কাজে চলে গেলো। মানহা নিজের ব্যান্ডেজ করা হাতের দিকে চেয়ে রইলো। কোত্থেকে ফ্লাফি এসে তার পায়ের কাছে মাথা ঘষতে লাগলো। মানহা অন্য হাত দিয়ে তার মাথায় আদর করে দিয়ে বললো,
“মানুষের চেয়ে তোরা বেশি ভালো বুঝলি? সারাজীবন একসাথে থাকার পর মানুষের কাছে হওয়া লাগে বিরক্তকর আর তোদের কাছে আস্থাভাজন।”
ফ্লাফি কি বুঝলো কে জানে মানহার হাত অনবরত চাটতে চাটতে মিউ মিউ শব্দ করতে লাগলো।

জিনান মনোযোগ দিয়ে ফ্রিঙ্গারপ্রিন্ট দেখছে। সুইয়াব কিটের সাহায্যে DNA সংগ্রহ করেছে। খুনিদের তালিকার একজনের সাথে পুরোই ম্যাচ করছে এগুলো। নেওয়াজ ও মুনতাজির গম্ভীর মুখে কম্পিউটারের স্ক্রীনে চেয়ে আছে। খুনির ডিটেইলস স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে। তারা একে অপরের দিকে সরু চোখে চাইলো। খুনির পরিবারে সদস্য মোটে দুইজন। কিন্তু দুইজন কারা কারা এই তথ্য এখনো জোগাড় করা সম্ভব হয়নি।

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩১

নামের জায়গায় স্পষ্ট লেখা কিলার আজাদ। যাকে সংক্ষেপে কিলার জাদ নামে চেনে সকলে। একটা ত্রাসের নাম এই কিলার জাদ। গত পাঁচ বছরে ঢাকায় অসংখ্য খুন, অপহরণ, গুম করেছে এই ঠান্ডা মাথার খুনি। তার মুভমেন্ট দেখলে বোঝার উপায় নেই যে সে খুনি। পাক্কা খিলাড়ি সে। যাকে সাইকো বললেও কম হবে। অপরাধী, নিরপরাধী কাউকে খুন করতে বাদ রাখেনি এই কিলার জাদ। টাকার জন্য নয় খুন করা তার একধরণের নেশা। জিনান আদহাম স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে ক্রুর হেঁসে বললো,
“আপনার খেলা শেষ মিস্টার সাইকো কিলার। শীগ্রই আমাদের মোলাকাত হবে, অপেক্ষায় থাকুন।”

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩৩+৩৪