ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩৫
তাজরীন ফাতিহা
অপরাহ্ণানের শেষ প্রহর। প্রভাকরের অবসন্ন ছায়া নিঃশব্দে মিশে যাচ্ছে দিগন্তে। প্রকৃতি তার নিয়মে এগিয়ে চলছে, চলবে। মহান রবের বিচিত্র সৃষ্টি এই জগৎসংসার। দিন যায় রাত আসে আবার রাত পেরিয়ে দিনের আগমন ঘটে। কোথাও একটু খামতি কিংবা বিশৃংখলা নেই। কি নিখুঁত সৃষ্টিকর্তার নিপুণ সৃষ্টি! বাড়ির লনে বসে বিকেলের এই স্নিগ্ধ সময়টুকু উপভোগ করছেন উর্মি ভুঁইয়া। একটু পর পর কফিতে চুমুক দিচ্ছেন আর গভীর আননে বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রেখেছেন। হাতে মার্কিন রাইটার Carol L. Anway এর ‘Daughters of Another Path’ বইটি। বইটি একজন খ্রিস্টান মায়ের নিজের মেয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত। এই মুহূর্তে উর্মি ভুঁইয়ার সম্পূর্ণ মনোযোগ বইটিতে নিমগ্ন। একধরনের কৌতূহল, পরবর্তী কাহিনী জানার প্রবল আকাঙ্ক্ষা তার চোখে মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
মানহা নিজেও একটু আগে শাশুড়ির সাথে সাথে সময়টাকে উপভোগ করছিল তবে শাশুড়িকে সম্পূর্ণভাবে বইয়ে ডুবে যেতে দেখে আশপাশের প্রকৃতিতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে মনে মনে দোয়া, দুরুদ, জিকির পড়ায় মনোযোগী হয়েছে। একটু পর সন্ধ্যার নাস্তা বানানোর তাগিদ উঠলে গলা পরিষ্কার করে বার কয়েক উর্মি ভুঁইয়াকে ডেকে উঠলো। উর্মি ভুঁইয়া বইয়ে এমন মজেছেন আশেপাশের কথা কিংবা আওয়াজ তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করছে না। শেষে মানহা কিছুটা জোরে ডেকে উঠলে উর্মি ভুঁইয়া বইয়ের পাতা হতে নেত্র জোড়া উঠিয়ে মানহার পানে চাইলো। চশমার ভিতরের গম্ভীর নেত্রপল্লব ঝাপটিয়ে শুধালেন,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ডাকছিলে? কিছু বলবে?”
মানহা একটু ইতস্তত করতে করতে বললো,
“আম্মু ডিস্টার্ব করলাম। আসলে সন্ধ্যার নাস্তায় আজকে কি খাবেন সেটা জানতেই ডাকা।”
“তোমার ইচ্ছে অনুযায়ী একটা কিছু করে ফেলো।”
বলে আবারও বইয়ে মনোযোগী হলেন। মানহার উর্মি ভুঁইয়ার হাতের বইটি পড়ার তীব্র ইচ্ছে জাগ্রত হলো কিন্তু ইংরেজি কম বোঝায় সেই ইচ্ছে সেখানেই দমে গেলো। একটু ধীর স্থির স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“আম্মু বইটা কি নিয়ে লেখা জানতে পারি?”
উর্মি ভুঁইয়া তার মুখশ্রী মানহার পানে তাক করে বললেন,
“একজন কনভার্টেড মুসলিম নারীর কাহিনী। বইয়ের লেখক সেই কনভার্টেড মুসলিম নারীর মা। লেখকের মেয়ে জোডি (Jodi Anway Mobammadzadeh) পারিবারিক খ্রিস্টান পরিবেশ থেকে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং সেই প্রেক্ষাপটেই বইটির কাহিনি আবর্তিত। বইটি শুধু দুজনের অভিজ্ঞতা নয় বরং এটি ৫৩ জন আমেরিকান মুসলিম, নও মুসলিম নারীর সাক্ষাৎকার-সংকলন ও বিশ্লেষণ অতঃপর ইসলাম গ্রহণের কারণ, প্রক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে।”
কাহিনী শুনে মানহা আকর্ষণবোধ করলো যেন। কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করলো,
“মেয়েটির মা অর্থাৎ লেখকও কি পরবর্তীতে মুসলিম হয়েছিলেন?”
উর্মি ভুঁইয়া কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন,
“নাহ। সেরকম কোনো কথা বইয়ে উল্লেখ নেই। সম্ভবত তিনি খ্রিস্টানই থাকে।”
“ও আচ্ছা। খ্রিস্টান হয়েও মেয়েকে ইসলাম ধর্ম পালন করতে দিয়েছেন? বাধা দেননি?”
“অবশ্যই দিয়েছে। কেউই ধর্মান্তরিত হওয়াকে স্বাভাবিকভাবে নেয়না। এই বইয়ে তার মেয়ের সংগ্রাম, তাদের দ্বন্দ্ব, মানিয়ে নেয়া, ইসলামকে জানা, বিভিন্ন আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে শ্রদ্ধা বাড়ার কাহিনী উল্লেখ আছে। তার মেয়ে কিংবা ইসলাম গ্রহণকারী আমেরিকান নারীরা তাদের থেকে এই ভিন্ন পথ কিংবা ধর্ম অনুসরণ করেছে দেখেই বইয়ের নাম দিয়েছেন Daughters of Another Path”
মানহা মনোযোগী শ্রোতার মতো এতক্ষণ বইয়ের কাহিনী শুনছিল। ভালোই লাগছিলো শুনতে। উর্মি ভুঁইয়ার অসংখ্য গুণের মধ্যে অন্যতম একটি গুণ হলো চমৎকার করে কথা বলতে পারা। যখন কথা বলে যেন সারাক্ষণ শুনতেই ইচ্ছে করে। বুদ্ধিদীপ্ত এই সুবক্তা ও মাধুর্যভাষিণীকে মানহা যত দেখে ততই অবাক হয়। মাশাআল্লাহ। মাগরিবের আজানের শব্দে চিন্তা ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো সে। অতঃপর আজানের উত্তর দিতে লাগলো। উর্মি ভুঁইয়াও বই বন্ধ করে আজানের বাক্যগুলো মুয়াজ্জিনের পর পুনরাবৃত্তি করতে লাগলেন ব্যতিক্রম কিছু জায়গা ছাড়া। এটা মানহা তাকে কয়েকদিন আগে শিখিয়ে দিয়েছিল। এরপর থেকে পাঁচ বারই আজানের জবাব দেন তিনি। ধর্মীয় জ্ঞান যদিও সীমিত তার তবে মানহার সংস্পর্শে এসে অনেক কিছুই জানতে পারছেন। আলহামদুলিল্লাহ। আজানের উত্তর এবং দোয়া শেষে দুই শাশুড়ি বউমা নামাজ পড়তে চলে গেলো।
ইহাব আজকে সন্ধ্যার পর পরই বাসায় চলে এসেছে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে খেয়াল হলো রান্নাঘরে কেউ আছে। সে উর্মি ভুঁইয়া মনে করে সেদিকে পা বাড়ালো। মায়ের সাথে জরুরি কিছু আলাপ সাড়া দরকার। বাইকের চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে মায়ের উদ্দেশ্যে গেয়ে উঠলো,
“আমি একদিন তোমায় না দেখিলে
তোমার মুখের কথা না শুনিলে
পরাণ আমার রয়না পরাণে..”
ব্যাস বাকিটুকু আর গাইতে পারলো না। মায়ের পাশে মানহাকে দেখে গান গলায় ঢুকে গেছে। উর্মি ভুঁইয়া ছেলে আর ছেলের বউয়ের দিকে চেয়ে সোজা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এসেছিলেন মানহাকে সাহায্য করতে এখন ছেলে যে বউয়ের জন্য গান গাইতে গাইতে ঢুকবে সেটা তো বোঝেনি। তার সেখানে কাবাব মে হাড্ডি হওয়ার দরকার কি?
অন্যদিকে ইহাব মাকে বের হয়ে যেতে দেখে পুরোই বোকা বনে গেছে। গানটা তো মাকে উদ্দেশ্যে করেই গেয়েছিল কিন্তু মা দেখি উল্টা বুঝলো। ধুর ছাই!! এই গান কোন কুক্ষণে গাইতে গিয়েছিল সে? মানহা এদিকে লজ্জায়, রাগে লাল হয়ে উল্টো ফিরে কাজ করছে। শাশুড়ির সামনে কি বেইজ্জতিটাই না হলো আজ। লোকটা তলে তলে শয়তান আছে। একা পেলেই চেপে ধরতে চায়। ছিঃ ছিঃ!
ইহাব গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
“শোনো….”
ইহাবকে কথা শেষ করতে না দিয়ে মানহা অন্যদিকে ফিরেই বলতে লাগলো,
“আমি কিচ্ছু শুনতে চাইনা। কখনো গান গায় না আজকে শাশুড়ির সামনে ইজ্জতের দফারফা করতে এসেছে। আম্মু কি ভাববেন? আপনার থেকে কি এসব গান টান শোনার সম্পর্ক হয়েছে আমার? বেলাজ পুরুষ খালি ছোঁক ছোঁক স্বভাব।”
ইহাব রেগে গেলো। কত বড় সাহস তাকে ইনডিরেক্টলি বেহায়া, লুচ্চা বলছে। গলায় জোর বাড়িয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“ও হ্যালো গানটা তোমার জন্য গাইনি। এটা মাকে উদ্দেশ্যে করে গেয়েছি। বোঝায় ভুল হয়েছে তোমাদের। তাই নিজেকে এতো প্রায়োরিটি দেয়ার কিছু নেই। আমার নাকি ছোঁক ছোঁক স্বভাব। মন চাচ্ছে, ছোঁক ছোঁক স্বভাব কি ও কত প্রকার উদাহরণ সহ বুঝিয়ে দেই।”
মানহা আঁতকে উঠে বললো,
“না না দরকার নেই। দুঃখিত বোঝায় ভুল হয়েছে। আপনি যান।”
ইহাব মুখ গম্ভীর রেখে বললো,
“মনে থাকে যেন। নাহলে আরেকবার অপবাদ পেলে গোড়াসহ সব বুঝিয়ে দেবো। দেখতে শুনতে হাফ হাতা, বোঝে পুরো কলকাতা।”
বলেই গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো। মানহা ভীষণ লজ্জা পেলো। পুরো অপমানিত হয়ে গেলো। সে মাথা থেকে সবকিছু ঝেড়ে নাস্তা বানানোতে মন দিলো।
‘পদ্মালয়’ বাড়ির হলরুমে আয়েশ করে দুজন ব্যক্তি বসা। মানহা লোক দুটোকে এক পলকের জন্য দেখেছে। সুঠাম দেহ, গায়ে কোট জড়ানো, মাথায় কাঁচা পাকা চুল দুজনের। একজনের একটু বেশি পাকা। সম্পর্কে ইহাবের মামা হন তারা। বড় জনের নাম উমায়ের ভুঁইয়া এবং ছোট জনের নাম উজান ভুঁইয়া। উভয়ে উর্মি ভুঁইয়ার মতোই বেশ ব্যক্তিত্ববান। কথাবার্তা, চাল চলনে শৌখিনতা প্রকাশ পায়। ইহাব ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে মামাদের দেখে এগিয়ে আসলো। উমায়ের ভুঁইয়া ও উজান ভুঁইয়া ভাগ্নেকে জড়িয়ে ধরলো। উর্মি ভুঁইয়া নাস্তা এনে টেবিলে দিলেন। উমায়ের ভুঁইয়া বোনকে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন,
“কিরে ইদানিং খোঁজ খবর নেই। ভুলে গেছিস নাকি তোর জামাই খোঁজ নিতে দেয়না?”
উজান ভুঁইয়া বড় ভাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
“আপা ভুলে গেছে আমাদের। ফোন দিলেও পাইনা।”
উর্মি ভুঁইয়া তাদের ওপর পাশে বসে বললেন,
“ভুলি নি। ব্যস্ততা বেড়েছে রে। ভাইজান তুমিও তো এখন আর এবাড়ি আসো না।”
কথাটা উমায়ের ভুঁইয়ার উদ্দেশ্যে বললেন। উমায়ের ভুঁইয়া চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
“আমারও কাজের প্রেসার বেড়েছে। কয়েকদিন ধরে আসতে চাচ্ছিলাম কিন্তু সময়ে কুলিয়ে উঠতে পারিনি। আমি ফ্রী হলে উজানের ব্যস্ততা বাড়ে আবার ওর ব্যস্ততা কমলে আমারটা বাড়ে।”
“হয়েছে আর অজুহাত দিতে হবে না। কিরে উজান চা নিচ্ছিস না কেন?”
উজান ভুঁইয়া এতক্ষণ ভাগ্নের সাথে ফিসফিস করে আলাপ করছিলেন। বোনের ডাকে চা নিয়ে আবারও ভাগ্নের সাথে আলাপে মগ্ন হলো। উর্মি ভুঁইয়া আবারও বললেন,
“ওদেরকে আনো নি ভাইজান? কতদিন দেখিনা বাচ্চাগুলোকে।”
কথাটা শুনে উমায়ের ভুঁইয়া একটু গম্ভীর হলেন। তারপর ধীরে বললেন,
“উমা, রিমা কেউই আসতে চায়না। জোর করেও আনতে পারিনা। যাইহোক ইনাবা কই? শুনলাম ইহাবের বিয়ে দিয়েছিস? আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করানো কি ঠিক হয়েছে?”
উর্মি ভুঁইয়া চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বললেন,
“এখনো অনুষ্ঠান করিনি ভাইজান।”
“এরকম অনুষ্ঠান ছাড়া অনাড়ম্বরহীন ভাবে বউ তুলে এনেছিস কেন? চেয়ারম্যান বাড়ির মান ইজ্জত আর রাখলো না ইমতিয়াজ ভুঁইয়া। বউ কই? দেখি কেমন বউ এনেছিস আমাদের ভাগ্নের জন্য।”
ইহাব চিকেন ফ্রাইয়ে কামড় দিতে দিতে বললো,
“ও মাহরাম ছাড়া কাউকে দেখা দেয়না মামু। তোমাদের সামনে আসবে না।”
উমায়ের ভুঁইয়ার ভ্রু কুঞ্চিত হলো। ভ্রু কুঁচকে রেখেই জিজ্ঞেস করলেন,
“মাহরাম আবার কি? আমরা হলাম মামা শ্বশুর আমাদের দেখা দিলে কি হবে?”
“তোমরা মামা শ্বশুর হলেও ওর জন্য পরপুরুষ মানে নন মাহরাম। ইসলামে মামা শ্বশুরকে দেখা দেয়া জায়েয নেই।”
ইহাবের নির্বিকার উত্তর। সসে চিকেন ফ্রাই ডুবিয়ে আবারও খেতে লাগলো। উমায়ের ভুঁইয়া গম্ভীর বদনে চেয়ে ভাগ্নের দিকে চেয়ে রইলেন। উর্মি ভুঁইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“ধার্মিক বউ এনেছিস ইহাবের জন্য? ধার্মিক মেয়েরা তো অসামাজিক হয়। এরা কাউকে দেখা দেবে না, কিছু হলেই হাদীসের বাণী ছুড়বে, মাসালা দেবে। কিছু থেকে কিছুই হলেই খালি জ্ঞান ঢালবে। এরকম মেয়ে আদৌ চেয়ারম্যান বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্যতা রাখে? এই বাড়ির বউরা হবে শিক্ষিত, স্মার্ট, সামাজিক, কালচারাল। আর এতো…হতাশ!”
উর্মি ভুঁইয়া মুখ খোলার আগেই ইহাব একগুঁয়ে স্বরে বললো,
“শোনো মামু, আমরা ধর্মকর্ম ঠিক করে পালন করিনা দেখে ভেবে নিয়েছো আমাদের কাজকর্ম স্মার্টনেসের মধ্যে পড়ে? উহু একদমই না। আমরা ভুল লাইফস্টাইল বেছে নিয়েছি দেখে অন্যকেউ সঠিক লাইফস্টাইল বেছে নিলে তাকে অসামাজিক, আনস্মার্ট, ক্ষেত বলাটা কাইন্ড অফ হিপোক্রেসি। বিশ্বজাহানের মালিক তোমাকে সৃষ্টি করে কিছু গাইডলাইন ও বিধিনিষেধ দিয়েছেন তা তোমার কাছে অসামাজিক আর মানুষের বানানো এসব সামাজিক, স্মার্টনেস? সৃষ্টিকর্তা বেশি জানেন নাকি তার সৃষ্টি?”
ইহাবের কথায় উমায়ের ভুঁইয়ার মুখ রাগে নাকি অপমানে লাল হয়ে গেছে ঠিক ঠাহর করা গেলো না। ইহাব উঠে চলে যেতে নিলে হঠাৎ কি মনে করে আবারও পিছু ঘুরে বললো,
“বেশি পশনেস্ দেখাতে গিয়ে আল্লাহর বিধানের উপর নাক ছিটকানো, আঙুল তোলা কিংবা তাচ্ছিল্য করা বন্ধ করো। তুমি বা আমরা ধর্ম পালন না করলে আল্লাহর কিছুই আসবে যাবে না। বরঞ্চ আমাদের নিজেদেরই ক্ষতি হবে আফটার অল সবাইকেই একদিন মরতে হবে এবং হাশরের দিন আল্লাহ তায়ালার মুখোমুখি হতে হবে।”
এই কথাগুলো মানহা কয়েকদিন আগে তাকে বলেছিল। সে ধর্মীয় কোনো একটা বিষয়ের উপর হেসেছিল দেখে মানহা সেদিন এমন উত্তরই দিয়েছিল তাকে। আজকে কাজে লেগেছে। উমায়ের ভুঁইয়া ভাগ্নের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রুক্ষ কণ্ঠে উর্মি ভুঁইয়াকে বললেন,
“তোর ছেলে দেখি বউয়ের গোলাম হয়ে গেছে। সামান্য একটা কথায় কত জ্ঞান ঝেড়ে গেলো। নিশ্চয়ই বউয়ের থেকে শিখেছে। জামাই বউ মিলে জ্ঞান ঝাড়ার প্রতিযোগিতায় নামবে এবার।”
কথা শুনে উর্মি ভুঁইয়া ভাইকে বোঝাতে লাগলেন।
নিশাত কয়েকদিন ধরে একেবারেই চুপচাপ হয়ে গেছে। স্কুল, ঘর সামলে বাকি সময়টুকু ইবাদতে মশগুল থাকে। আজকেও ঘরের কাজ সম্পূর্ণ করে জায়নামাজ বিছিয়ে ইবাদতে মনোনিবেশ করলো। নাহওয়ান মায়ের কোলে বসে মনোযোগ দিয়ে কোরআন তেলওয়াত শুনছে। ইবাদতের সময় বাচ্চাটা কথা বলে না। একেবারেই শান্ত হয়ে থাকে। নিশাত কোরআন তেলওয়াত শেষে ছেলের মাথায় ফুঁ দিয়ে কোলে ঢুকিয়ে বললো,
“আব্বা আমাদের মালিক কে?”
“আল্লা।”
“আমরা কার গোলাম?”
“আল্লার।”
“তুমি কি আল্লাহর উত্তম বান্দা হবে?”
নাহওয়ান ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বললো,
“হবো।’
নিশাত ছেলের ফুলো ফুলো গালে চুমু বসিয়ে বললো,
“আমাদের নবী কে নাহওয়ান?”
নাহওয়ান মাথা চুলকে একটু ভাবতে লাগলো। বাচ্চাটার মাথায় এতকিছু থাকে না। অনেক ভেবে উত্তর দিলো,
“হজলট মুহাম্মড।”
নিশাত বাকিটুকু বলে দিলো,
“সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।”
বাচ্চাটা মাকে অনুসরণ করতে চাইলো কিন্তু ঠিক করে পারলো না। নিশাত কয়েকবার মুখেমুখে পড়ালো। পরে একটু আয়ত্ত করতে পারলো। ছেলেকে আরও কিছু শিক্ষা দিলো। বাচ্চাটাও মন দিয়ে শিখতে লাগলো।
দরজা খুলে দিতেই নাহওয়ান বাবাকে লম্বা সালাম দিলো যা একটু আগে নিশাত শিখিয়েছে।
“আচচালামু আলায়কুম অলহমাটুল্লাহি অবালাকাটু।”
মারওয়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো পাঞ্জাবি পড়া নাদুসনুদস বাচ্চাটার দিকে। যে বর্তমানে নিশাতের কোলে বসে তার দিকে মাসুম চেহারায় তাকিয়ে আছে। মারওয়ান অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো,
“কি বললি কবুতরের ছাও?”
“চালাম ডিচি। উট্টোল ডাও?”
“আচ্ছা আচ্ছা। ওয়ালাইকুম আসসালাম থুক্কু ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।”
নিশাত সালামের ভুল উত্তর দেয়া পছন্দ করেনা। মারওয়ানের মুখ থেকে খালি ভুলটাই বেরিয়ে যায়। নিশাত কয়েকবার শিখিয়ে দিয়েছিল তবুও ভুলে যায়। উত্তর দেয়া হলে নাহওয়ান বাবার কোলে ঝাপিয়ে পড়লো। মারওয়ান ছেলেকে কোলে নিয়ে রুমে যেতে যেতে বললো,
“কিরে আজকে হাজী হয়েছিস কেন?”
নাহওয়ান হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলতে লাগলো,
“আচকে নামায পচ্চি, অনেক কিচু শিকচি।”
হাত প্রসারিত করে অনেক বোঝালো। মারওয়ান বললো,
“তাই? কে শিখিয়েছে?”
“মা শিকিয়েচে।”
ছেলেকে বিছানায় দাড় করিয়ে ঘামে ভেজা শার্ট ছাড়তে ছাড়তে বললো,
“তোর মা তো ফুলে আছে। মুখ খুলতে গিয়ে উড়ে টুরে যায়নি?”
নাহওয়ান ঘাড় নাড়িয়ে না বললো। মারওয়ান খালি গায়ে ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে বললো,
“উড়লো না কেন? উড়া উচিত ছিল। কয়েকদিন ধরে ফুলে আছে। এতে করে ফোলাটা কমতো।”
বলেই কপালের ঘাম হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেললো। নিশাত রুমে ঢুকে বাবা ছেলের দিকে একনজর তাকিয়ে ড্রয়ার খুলে শুকনো জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখলো। মারওয়ান কোমরে হাত দিয়ে নিশাতের দিকে ত্যাছড়া চোখে চাইলো। উদ্দেশ্য নিশাত কি করে তা দেখা। ঘটনা কিছুই বুঝতে পারছে না। কয়েকদিন ধরে পুরো সাইলেন্ট হয়ে গেছে। ছেলের সাথে কথা বললেও তার সাথে একদম কথা বলে না। প্রথম প্রথম পাত্তা না দিলেও গতকাল থেকে খেয়াল করছে নিশাতের অদ্ভুত আচরণ। কাহিনী তো কিছু একটা ঘটেছেই। স্কুলের ওই ফালতু মহিলা কলিগটা তার নামে আবার রসিয়ে রসিয়ে বদনাম করেনি তো। কিন্তু সে তো এখন আর নিশাতের স্কুলের এরিয়ায় সিগারেট টানতে যায়না তাহলে?
নিশাত নিজের কাজ গুছিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পাশের রুমে চলে গেলো। মারওয়ান আর কিছু না ভেবে ছেলেকে খেলনা দিয়ে গোসল করতে ঢুকলো। ঘামে পুরো চিটচিটে হয়ে আছে শরীর। এই শরীরে ঘুমাতে পারবে না। অস্বস্তি লাগবে।
গোসল শেষ করে খালি গায়ে লুঙ্গি পড়ে বের হলো মারওয়ান। সে বাথরুমে ঢোকার পর নাহওয়ানকে পাঞ্জাবি পাল্টে সেন্ডুগেঞ্জি পড়িয়ে দিয়ে গেছে নিশাত। তাকে গাড়ি নিয়ে লাফাতে দেখে বললো,
“এই পেঙ্গুইন লাফাচ্ছিস কেন?”
নাহওয়ান ফোকলা হেঁসে বললো,
“গালি বুম বুম কলি চলে।”
মারওয়ান ভেজা চুল গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বললো,
“তুইও গাড়ির মধ্যে ঢুকে গেছিস নাকি?”
“গালি চুটো। ডুকা যায় না।”
মারওয়ান ছেলের দিকে চাইলো। বাচ্চাটা গাড়ি নিয়ে কি আনন্দ নিয়ে খেলছে! যেন সে নিজেই গাড়িটা চালাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলো,
“বড় গাড়ি হলে ঢুকতি?”
নাহওয়ানের চোখ চকচক করে উঠলো। মারওয়ান চোখ সরিয়ে নিলো। ওই চোখে বেশিক্ষণ তাকানো যায়না। সে নিশাতকে জোরে ডেকে উঠে ভাত দিতে বললো। বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেলেও নিশাতের সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। মারওয়ান রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো কেউ নেই। তারপর পাশের রুমে গিয়ে দেখলো নিশাত গভীর ঘুমে নিমগ্ন। মারওয়ান ধীর স্থির ভঙ্গিতে হেঁটে নিশাতের শিয়রের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। চোখের নিচে কালো দাগ পড়া ক্লান্ত অবসাদপূর্ণ চেহারার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো। সারাদিনের হাঁপিয়ে ওঠা ক্লান্ত দেহ ঘুমের মাধ্যমে একটু বিশ্রাম পায় যেন। মানুষ ঘুমের মধ্যেই একমাত্র সুখী। নেই কোনো চিন্তা, নেই কোনো কাজ। ইহজাগতিক সকল কাজের ইস্তফা ঘটিয়ে নিশ্চিন্ত এক যাত্রা।
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩৩+৩৪
ছেলেকে ভাত খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে টেবিলে বসে কি যেন লিখছে মারওয়ান। চোখমুখ গম্ভীর। গভীর রাত কলমের খচখচ আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। একটু পর সবকিছু গুছিয়ে নিশাতের রুমে গেলো। মশারী টাঙিয়ে দিয়েছে সে। মশার উপদ্রব বেড়েছে। নিশাতকে আরেকবার দেখে লাইট বন্ধ করে ছেলের কাছে চলে গেলো।
ফজরের খানিক আগেই নিশাতের ঘুম ভেঙে গেলো। উঠে ওযু করে তাহাজ্জুদ নামাজে দাঁড়ালো। কয়েকদিন ধরে নিয়মিত ইস্তেখারার নামাজ পড়ছে নিশাত। একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। সংসার এখন তার কাছে বিষের মতো লাগে। বিপরীত পাশের মানুষটাকে সহ্য হয়না। তাই বড় রকমের সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছে। এজন্য ইস্তেখারার মাধ্যমে আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানতে চায় সে। এখন শুধু আল্লাহ তায়ালার ইশারা ইঙ্গিতের অপেক্ষা।