ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩৬
তাজরীন ফাতিহা
ইন্টেলিজেন্ট ডিপার্টমেন্টে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে। মুনতাজির দৃঢ় গলায় একটা ফাইল রিপ্রেজেন্ট করছে। ডিপার্টমেন্টের হেড মুখ টান টান করে তার বক্তব্য শুনছে। এরিমধ্যে মুনতাজিরের ইশারায় নেওয়াজ ল্যাপটপ খুলে একটা ভিডিও ক্লিপ দেখালো। যেখানে দেখা যাচ্ছে কালো কাপড়ে আবৃত একজন অনবরত কুপিয়ে যাচ্ছে দুজন লোককে। চেহারা তার সম্পূর্ণ আবৃত। শুনশান রাস্তায় সিসিটিভির সামনে যেন ইচ্ছাকৃতভাবে হাজির হয়েছে এই ব্যক্তি। কোপানো শেষ হলে ক্যামেরার সামনে এসে রক্তাক্ত হাতটা ডলে দিলো। পুরো ক্যামেরা রঞ্জিত হয়ে গেলো। ভিডিও শেষ। মুনতাজির বললো,
“আমরা শিওর এটা কিলার জাদ। লোকটা মারাত্মক ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছে। তাকে ধরাটা অনেক মুশকিল। অনেক ঘোল খাওয়াবে এই ব্যক্তি। যেন গেইম খেলছে আমাদের সাথে।”
জিনান এতক্ষণ পর মুখ খুললো,
“সেদিন দেয়ালে চ্যালেঞ্জিং টাস্ক লেখা ছিল। তখন পাত্তা না দিলেও আমি শিওর এটা ওই মার্ডারার ইচ্ছে করেই লিখে গেছে। ও চেয়েছে বিধায় আমরা ঐ ঠিকানায় যেতে পেরেছি এটাই বোঝাতে চেয়েছে সে। এখন আমার কাছেও তাই মনে হচ্ছে। এত এত তথ্য জোগাড় করলাম নিমিষেই সম্পূর্ণ প্ল্যান ফ্ল্যাপ হলো। তারপর পরশু নেওয়াজ শাবীর ডান হাতে গুলি খেলো।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
হেড মাথা নাড়িয়ে বললো,
“মারাত্মক ধূর্ত কিলার। তবে যাই বলো আট তারিখ দুটো তিন মিনিটের মিশনটা সফল হয়েছে তার জন্য প্রাউড অফ ইউ অল। তোমাদের উপর আস্থা আছে। কিলার জাদকে ধরতেও তোমরা সফল হবে। চিন্তা কোরো না মনোবল দৃঢ় রাখো। সে গভীর জলের মাছ ধরতে তো একটু মেহেনত হবেই।”
হেডের কথায় তিনজনই মাথা নাড়ালো। তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এই প্রফেশনে। কোনো অবস্থাতেই মাথা নোয়াবে না তারা। পর্বতের মতো অটল থেকে এই লুকোচুরি খেলার শেষ দেখে ছাড়বে। এতে যত কাঠখড় পোহানো লাগে পোহাবে। তবুও হাল ছাড়বে না। তাদের তিনজনের চোখেই এখন শিকারের ক্ষুধা জ্বলজ্বল করছে। শিকারের নাম কিলার জাদ। যেন হাতের কাছে পেলেই হিংস্র থাবা বসাবে।
প্রকৃতিতে যেমন কখনো দাবদাহ কখনো শীতলতা নামে ঠিক তেমনই মানবজীবনেও সুখ দুঃখের উত্থান পতন ঘটে। কেউ কখনো চিরসুখী কিংবা চিরদুঃখী হতে পারেনা। সুখ কিংবা বিরহ জীবনে একটু হলেও সবার জীবনে হাতছানি দেয়। যে নিজেকে চিরসুখী দাবি করে সে কখনো বলতে পারবে না তাকে দুঃখ কিংবা কষ্ট ছুঁয়ে দেয়নি আবার যে নিজেকে চিরদুঃখী ভাবে তারও অস্বীকার করবার জো নেই যে একটু হলেও সে সুখ, আনন্দ অনুভব করেনি। মোদ্দাকথা সুখ, দুঃখের মিশেল কিংবা উত্থান পতনের নামই জীবন। নিশাত আকাশের দিকে তাকিয়ে এরকম কত শত ভাবনা ভেবে চলে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েই পাশে খেলারত ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো,
“নাহওয়ান বাবাকে ছাড়া থাকতে পারবে?”
নাহওয়ান মায়ের দিকে তাকিয়ে অবুঝ গলায় বললো,
“বাবা কুতায় যাবে?”
নিশাত উদাসীন কণ্ঠে বললো,
“যাবে অনেকদূর। থাকতে পারবে?”
নাহওয়ান ঘাড় নাড়িয়ে বললো,
“ইননা। আমিও যাব।”
নিশাত মলিন হেঁসে থেমে থেমে বললো,
“মাকে ছাড়া থাকতে পারবে?”
বাচ্চাটা খেলা থামিয়ে বললো,
“টুমিও বাবার সাতে যাবে?”
“নাহ। আমি একা যাবো তোমাকে তোমার বাবার কাছে রেখে।”
নাহওয়ান খেলা থামিয়ে ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টালো। এক্ষুনি কেঁদে দেবে ভাব। নিশাত ছেলের ফুলোনো ঠোঁট দেখে কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ আদর করে বললো,
“কোথাও যাবো না। কাঁদবে না।”
নাহওয়ান নিশাতের কথা শুনে গলা জড়িয়ে ধরে মায়ের ঘ্রাণ নিলো। এরমধ্যে ফোন বাজলে নিশাত রিসিভ করলো। মানহা কল দিয়েছে। কুশলাদি বিনিময় শেষে মানহা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,
“ভাবি, উনি নাহওয়ানের সাথে কথা বলার জন্য আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়ছে। ওকে একটু দেবে। লোকটা পাশেই আছে। কথা বলতে চায় বাবুর সাথে।”
কথাটা শুনে নিশাত একটু খেই হারালো যেন। নাহওয়ান তো কথা শিখিয়ে না দিলে ঠিকমতো কথার জবাব দিতে পারেনা। সামনাসামনি যদিও একটু আধটু পারে ফোনে একেবারেই অপরপাশের কথা ক্যাপচার করতে পারে না। ইহাব কথা বললে তো সে এপাশ থেকে শিখিয়েও দিতে পারবে না নন মাহরাম বলে কথা। কণ্ঠ শুনে ফেলার চান্স আছে। মানহার হ্যালো হ্যালো আওয়াজে ভাবনার সুতো ছিঁড়লো। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“নাহওয়ান ফুপির সাথে কথা বলবে?”
বাচ্চাটা ঘাড় নাড়িয়ে সায় জানালো। নিশাত ফোনটা ছেলের কানে ধরে বললো সালাম দাও। নাহওয়ান সালাম দিলো,
“আচচালামু আলায়কুম।”
ওপাশ থেকে মানহা উত্তর দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেও পারলো না অমনি ইহাব চিলের মতো ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে বললো,
“এই রসগোল্লা আমাকে ভুলে গেছো?”
নাহওয়ান মাথা চুলকে মায়ের দিকে চাইলো। নিশাত ফোনের আওয়াজ বাড়িয়ে দিয়েছিল। সে ফিসফিস করে ছেলেকে বললো,
“তোমার ফুপা। বলো ভুলিনি।”
নাহওয়ান মায়ের শিখিয়ে দেয়া কথা রিপিট করে বললো,
“বুলি নাই। টুমি বুলি গেচো?”
নাহওয়ানের প্রশ্নে ইহাব পাল্টা জবাব দিলো,
“ভুললে কল দিলো কে?”
নাহওয়ান ফোন কানে ধরে খেলায় মনোযোগ দিয়েছে। ইহাবের কথা তার কানে ঢোকেনি। ইহাব নাহওয়ানের জবাব না পেয়ে বললো,
“এই গোলুপ্পা আমার কাছে আসবে? তোমাকে খেলনা, চিপস, চকলেট, জামাকাপড় কিনে দেবো। আসবে?”
নাহওয়ানের এদিকে একদমই মনোযোগ নেই। সে খেলনা নিয়ে ব্যস্ত। নিশাত রান্নাঘরে তরকারি নাড়তে গিয়েছে। ইহাব ওপাশ থেকে হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে। শেষে বিরক্ত হয়ে বললো,
“এই সমুন্ধির ব্যাটা কথা কস না ক্যা?”
নাহওয়ান ওপাশ থেকে ইহাবের চিৎকার শুনে মুখ খুললো,
“চুমুন্ডি কি?”
“তোর বাপ।”
“বাবা চুমুন্ডি না।”
ইহাব মজা পেয়ে বললো,
“চুমুন্দি? বাহ ভালো বলেছিস তো। আয় তোরে চুমু দি চুমুন্দির বেটা।”
“ইননা।”
“না কেন? ভয় পাচ্ছিস? আরেহ ভয় পাস না ব্যাটা। চুমু খেলে আরও সুন্দর হবি। লাল টকটকে নাদুস নুদুস গাল দুটো এক্কেবারে রক্তজবার মতো করে দেবো চুমিয়ে।”
মানহা ইহাবের কথা শুনে চোখ কপালে তুলে ফেললো। তার ভাইস্তাকে কি বলে এই লোক? বাচ্চাটা এমনিতেই চুমু পছন্দ করেনা এখন কেউ চুমু দেবে শুনলেই ভয়ে দৌঁড় দেয় আর ইনি কি সুন্দর করে বলছে চুমু খেলে নাকি সুন্দর হবে। সে ইহাবকে চোখ দিয়ে ইশারা করছে এসব না বলতে। কিন্তু ইহাব পাত্তা দিলে তো। এদিকে নাহওয়ান ইহাবের সম্পূর্ণ কথা বুঝতে না পারলেও যতটুকু মাথায় ঢুকাতে পারলো ততটুকু বুঝে বললো,
“চুমা ডিলে চুন্দল হবো?”
“অবশ্যই। খালি খেয়েই দেখো। ইটস ইহাব’স চুমু। গালটা মোবাইলে ধরো রসগোল্লা। আমি এপাশ থেকে আনলিমিটেড চুমু সাপ্লাই করছি।”
ছেলের কথার মাঝেই মারওয়ান ঘরে ঢুকেছে। বাইরে থেকে ঘেমে অস্থির হয়ে এসেছে সে। নাহওয়ানকে মেঝেতে বসে মোবাইল হাতে নিয়ে কথা বলতে দেখে এগিয়ে এলো। ওপর পাশের জবাব শুনে ওপাশে কে বুঝতে এক মুহূর্তও সময় লাগলো না তার। ছেলের থেকে ঝট করে ফোন কানে নিয়ে বললো,
“তোকে আমি কাঁচা চিবিয়ে খাবো ভুঁইয়ার বাচ্চা।”
ইহাব ফোনের ওপাশ থেকে মারওয়ানের কণ্ঠ শুনে থতমত খেয়ে গেলো। তারপর একটু ধাতস্ত হয়ে বললো,
“কেন শ্লা ব্রো? আমি কি ফলমূল যে কাঁচা চিবিয়ে খাবেন?”
“ইতরামি করলে তোকে ছিঁড়ে ফেলবো নাটকির নাতি। নাটক করার জায়গা পাস না। আমার ছাওকে এসব চুমু টুমু শিখাচ্ছিস কেন?”
ইহাব সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে বললো,
“তো কি আপনাকে শেখাবো? তাহলে কৃতার্থ করিয়া ফোনটা আপনার কপোলে ধরুন আমি চুম্মাই। উম্মাহ!”
ফোনের উপর শব্দ করে চুমু খেলো ইহাব। ওপাশ থেকে চুমুর শব্দে মারওয়ানের নাক, মুখ কুঁচকে বললো,
“ওয়াক থুহ! থু থু!!”
মারওয়ানের রিয়েকশন দেখে ইহাব ফোনের ওপাশে মুখ লটকিয়ে বসে আছে। পাশেই মানহা হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। বড় ভাইয়া আর ইনি একত্র হলেই হয়েছে বিনোদন আর বিনোদন। মানহাকে হাসতে দেখে ইহাবের প্রেস্টিজে লাগলো। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
“তোর পেটে কৃমি হয়েছে নাকি? লক্ষণ তো ভালো ঠেকছে না। শুনেছি কুকুরের পেটে ভালো জিনিস হজম হয়না। তুই তো আর কুকুর নোস নিশ্চয়ই কৃমির বাচ্চা হয়েছে। ডাক্তার দেখাস।”
ইহাবের কথা শুনে মারওয়ান রাগে চেঁচিয়ে উঠে বললো,
“কৃমির বাচ্চা হয়েছে মানে? শালা তোর চুমুতে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক, জলাতঙ্ক, এইচআইভি, ক্যান্সার, মহামারী। দূরে গিয়ে মর।”
বলেই ফোস ফোস করতে করতে ফোন কেটে দিতে নিলে ওপাশ থেকে ইহাব বলতে লাগলো,
“আরে মরার আগে ইহাব স্পেশাল চুমু তো খেয়ে যা।”
“তোর বা**ল স্পেশাল চুমুর গুষ্ঠি কিলাই। ক্যারেক্টারলেস ছাপড়ি।”
চেঁচিয়ে উঠে মারওয়ান ফোন কেটে দিলো। টুট টুট শব্দে ফোন কান থেকে নামিয়ে জোরে হাসতে লাগলো ইহাব। মানহা তার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলো। ইহাব মানহাকে এরকম করে তাকাতে দেখে চোখ মেরে বললো,
“খাবে নাকি ইহাব’স চুমু? আসো দেই।”
মানহা রক্তিম গাল নিয়ে দ্রুত পায়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। ইহাব মানহাকে পালিয়ে যেতে দেখে জোরে বলে উঠলো,
“পালিয়ে লাভ নেই। তুমি, তোমার ভাই আর রসগোল্লা ইহাব স্পেশাল চুমু খাওয়ার জন্য রেডি থেকো। ইহা চিরন্তন সত্য, খেতেই হবে তোমাদের।”
নিশাত ঘরে ঢুকে মারওয়ানকে ফুঁসতে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত করলো। রান্নাঘর থেকে সবই শুনেছে সে। মানহার জামাইয়ের সাথে লেগেছে আবারও। দুটো একসাথে হলেই হয়েছে। ভূমিকম্প লেগে যায়। নাহওয়ান মাকে দেখে দৌঁড়ে এলো। বাবাকে চিৎকার করতে দেখে ভয় পেয়েছে বাচ্চাটা। পায়ের পা জড়িয়ে ধরে বললো,
“মা, পুপা চুমায়। বাবাকে চুমাইচে।”
নিশাত কপাল গোটালো। মারওয়ান ছেলের কথা শুনে কেশে উঠে বললো,
“এই আমাকে চুমাইছে মানে? উল্টাপাল্টা কথা বললে সব নাটবল্টু খুলে ফেলবো পটলের বাচ্চা।”
বলেই আর এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে গামছা নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। নিশাত ছেলের ময়লা গেঞ্জি পাল্টে আরেকটা পড়িয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ক্ষুধা লেগেছে?”
নাহওয়ান মাথা নাড়িয়ে না জানালো। নিশাত আবার বললো,
“এখানে থাকবে নাকি আমার সাথে রান্নাঘরে যাবে?”
“ইকানে তাকবো।”
নিশাত আর কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে গেলো। খানিকপর মারওয়ান মুখ মুছতে মুছতে বের হলো। গামছা থেকে বিকট গন্ধ বেরোচ্ছে। সে নাক কুঁচকে নিশাতকে ডাকলো। নিশাতের সাড়া না পেয়ে গামছা নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো নিশাত শাক ধুচ্ছে। মারওয়ানের নাক আবারও কুঁচকে গেলো। আজকেও নিরামিষ রান্না হবে নাকি? গত এক সপ্তাহ টানা নিরামিষ রান্না হচ্ছে আজকেও নিরামিষ রান্না হলে ঘরেই থাকবে না সে। এসব শাক, লতা, পাতা তার মুখে রোচে না। হোটেলে গিয়ে এক প্লেট ভাত আর গোশত খেয়ে পেট শান্ত করা এর থেকে ঢের ভালো। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
“গামছা থেকে বাজে গন্ধ আসছে। ধোও না?”
নিশাত ঘাড় ঘুরিয়ে মারওয়ানের হাতের গামছার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ওটা দিয়ে ফ্লোর মুছি। নাহওয়ান আজকে ফ্লোরে টয়লেট করে দিয়েছিল ওটা মুছেছি। এখনো ধোঁয়া হয়নি।”
বলে আমার সামনে ফিরে কাজ করতে লাগলো। নিশাতের কথা শুনে মারওয়ানের নাড়িভুড়ি উল্টে আসতে নিলো। ওয়াক ওয়াক করতে করতে নিশাতকে সরিয়ে বমি করে বেসিন ভাসিয়ে দিলো । নিশাত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। একটু স্থির হয়ে মুখে পানি দিয়ে বললো,
“মাথামোটা মহিলা, টেবিলের উপর এটা সাজিয়ে রেখছিলে কেন? গামছা নিয়ে যখন ঢুকি তখনও তো কিছু বলো নি। নাকি ইচ্ছে করেই এসব করেছো?”
নিশাত গম্ভীর মুখে বললো,
“আপনার কাজ হয়ে গেলে এখান থেকে বের হন।”
হাত দিয়ে বাইরে দেখিয়ে দিলো। মারওয়ান নিশাতের পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করে ধীরে ধীরে বললো,
“কত্তবড় পাষাণ নারী। স্বামী বমি করছে আর উনি চোখ রাঙাচ্ছে।”
“চোখ দিয়ে গেলা হয়ে গেলে যেতে পারেন।”
মারওয়ান গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেলো। এতো বড় অপমানের পর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানেই হয়না। তাকে চরিত্রহীন ইন্ডিকেট করা? রুমে ঢুকেই নাহওয়ানকে কাঁধে তুলে বললো,
“ওই পোটকার বাচ্চা যেখানে সেখানে হিসু করিস কেন?”
নাহওয়ান বাবার কাঁধে ঝুলতে ঝুলতে বললো,
“বাইল হয়ি যায়।”
“বাইর হয়ে যায় কেন? কন্ট্রোল করতে পারিস না? বদ কোথাকার।”
নাহওয়ান ঠোঁট উল্টে ফেললো। একটুপর মারওয়ান ছেলেকে রেডি করিয়ে চুল আঁচড়ে দিলো। তারপর নিজে রেডি হয়ে ছেলেকে বগলদাবা করে বললো,
“তোর মাকে বলবি, আমরা বাইরে খেতে যাই। জিজ্ঞেস করবি আমাদের সাথে যাবে কিনা, ওকে?”
নাহওয়ান ঘাড় নাড়ালো। মারওয়ান রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে নাহওয়ানকে ইশারা করলো। বাচ্চাটা চেঁচিয়ে মাকে ডেকে উঠলো। নিশাত এগিয়ে এসে অবাক হয়ে বললো,
“কি ব্যাপার কোথায় যাচ্ছো নাহওয়ান?”
“বাইলে যাই। টুমি যাবে?”
“বাইরে যাচ্ছো কেন এই দুপুরবেলা?”
নাহওয়ান জিব্বা বের করে বললো,
“মুজা মুজা কাবো।”
নিশাত চোখ রাঙিয়ে বললো,
“কোথাও যাবে না তুমি। বাসায় রান্না হচ্ছে না? বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কোলে আসো।”
নাহওয়ান মায়ের ধমক শুনে বাবার কোলে আরও গুটিয়ে গেলো। মারওয়ান রেগে বললো,
“ও আমার সাথে যাবে। তুমি যাবে না ঠিক আছে ছেলেকে ধমকাচ্ছো কেন? আমাদের বাপ, বেটার তোমাকে লাগবে না, যাও।”
বলেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। নিশাত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।
কি এক বিচিত্র কারণে ইমতিয়াজ ভুঁইয়া উর্মি ভুঁইয়ার ভাইদের পছন্দ করেননা। ইহাবের সাথে আবার তার মামাদের বন্ডিং ভালো তবে ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার তাদের একেবারেই পছন্দ না। তাদের দেখলেই এড়িয়ে চলেন তিনি। আজকে সকালে লনে বসে চা খাচ্ছিলো অমনি গেট দিয়ে মামা, ভাগ্নে তিনজনকে ঘেমে নেয়ে বাড়িতে ঢুকতে দেখলেন। হাতে তিনজনেরই র্যাকেট অর্থাৎ ব্যাডমিন্টন খেলে এসেছে তারা। রাগে তার শরীর জ্বলছিল। কেন তার বাড়ির সামনে এত বড় ফ্রন্ট ইয়ার্ডটা চোখে পড়েনি এদের। মামা, ভাগ্নে এক হলেই পুরো এলাকা চষে বেড়াতে হবে, ক্লাবে যেতে হবে, মাঠে যেতে হবে। কেন? ইমতিয়াজ ভুঁইয়াকে দেখে উমায়ের ভুঁইয়া এগিয়ে এসে হাত মেলালেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে হাত মেলালেন। উজান ভুঁইয়া ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার পাশে বসে বললেন,
“দুলাভাই চা খাচ্ছেন?”
প্রশ্ন শুনে মনে মনে বেজায় বিরক্ত হলেন তিনি। আকাম্মক কোথাকার দেখছিস যেহেতু চা খাচ্ছি তাহলে প্রশ্ন করছিস কেন? মনে মনে তাদের গুষ্ঠি উদ্ধার করে ঠোঁটে মিথ্যা হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
“না শালা বাবু সালফিউরিক এসিড খাচ্ছি। তুমি খাবে নাকি?”
উজান ভুঁইয়ার চোয়াল ঝুলে গেলো। সালফিউরিক এসিড কেউ খায় নাকি? সে মুখ ঝুলিয়েই বললো,
“দুলাভাই কি মজা করছেন?”
“নাতো, ফান করছি।”
উজান ভুঁইয়া মুখ লটকিয়ে বললো,
“দুলাভাই!”
“কি ভাইই?”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া বেশ মজা পাচ্ছেন উজান ভুঁইয়াকে নাস্তানাবুদ করতে পেরে। এবার উমায়ের ভুঁইয়া বললেন,
“আপনার ব্যবসা কেমন চলছে?”
“এইতো আল্লাহ ভালোই চালাচ্ছেন।”
“উর্মিকে নিয়ে যান না কেন? বোনটা এমনিতেই মনমরা থাকে। ঘোরাফেরা করলে মন ভালো হতো।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া কোনো উত্তর দিলেন না। উজান ভুঁইয়া আর ইহাব উঠে গেলে উমায়ের ভুঁইয়া ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
“আগের কথা ভুলে যান। আমরাও ভুলে গেছি। ভুলে গেলে সবার জন্যই মঙ্গল। উর্মিকে নিয়ে বাড়িতে আসবেন।”
বলেই হেঁসে চলে গেলো। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া শক্ত হয়ে বসে থাকলেন।
নিশাতের চোখ, মুখ গম্ভীর। চুপচাপ কাজ করছে। নাহওয়ান মায়ের পিছুপিছু ঘুরছে। মারওয়ান খাটের উপর শুয়ে শুয়ে মা, ছেলের কাণ্ড দেখছে আর ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং উঠিয়ে অনবরত নাড়াচ্ছে। এদিকে নাহওয়ান মায়ের পাত্তা না পেয়ে মায়ের ওড়নার কোণা টেনে ধরে বললো,
“মা ইট্টু ডুডু ডাও।”
নিশাত ওড়নার কোণা ছাড়াতে ছাড়াতে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“আমার কাছে নেই। বাবার কাছে যাও।”
মারওয়ান তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললো,
“আমার কাছে আসবে মানে? দুধ কি আমার কাছে আছে নাকি? আমার দিকে ঠেলছো কেন?”
নিশাত রুম থেকে বেরুতে বেরুতে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“বাবা দেবে যাও।”
মারওয়ান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বললো,
“অ্যাহ! আমি কোত্থেকে দিবো?”
মায়ের কথা শেষ হতেই নাহওয়ান বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো দুধ খাওয়ার জন্য। মারওয়ান বলতে লাগলো,
“আরে আমার কাছে কিছু নেই। তোর মা মিথ্যা বলেছে।”
খানিক পর বিধ্বস্ত হয়ে মারওয়ান নাহওয়ানকে কোলে নিয়ে রান্নাঘরে এসে বললো,
“কাজটা মোটেও ঠিক করোনি লিলিপুট। আমাকে পাগল বানিয়ে ফেলেছে দুধের জন্য। তুমি জানো না ওর দুধের নেশা উঠলে পাগলামি করে। ছেলেকে মিথ্যা বললে কেন?”
নিশাত অবাক হয়ে বললো,
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩৫
“ওমা, মিথ্যা হতে যাবে কেন? যেহেতু আপনাদের বাপ, বেটার আমাকে প্রয়োজন নেই সেহেতু আমি দুধ দেবো কেন? আপনি দেবেন। আমাকে তো দরকার নেই তাই না?”
উত্তর শুনে মারওয়ান ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। লিলিপুট দুপুরের কথা এভাবে ফিরিয়ে দেবে ভাবেনি সে। নাহওয়ান মাকে দেখে কোলে যাওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে কান্না করতে করতে বললো,
“মা ডুডু ডেয়না।”