ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪৩

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪৩
তাজরীন ফাতিহা

মার্ভ জেনের সাথে হেড খোশগল্পে মেতে আছেন। জিনান আদহাম, মুনতাজির জায়েদ, নেওয়াজ শাবীর এখনো আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে। তাদের কারো মুখে হাসি নেই। প্রত্যেকের মুখ গম্ভীর। এর অবশ্য যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গত দেড় ঘণ্টা ধরে হেড তাদেরকে দাড় করিয়ে রেখে ননস্টপ কথা বলে চলেছেন। গল্পে এতই মজেছেন যে তাদেরকে যাওয়ার পারমিশন পর্যন্ত দিতে ভুলে গেছেন। রাগ লাগছে ভীষণ তবে কিছু করার নেই। এই প্রফেশনে এরকম অভিজ্ঞতা নতুন নয়। তাই মুখ বুঝে হজম করছে তারা। উইন্ডো গ্লাসে আবারও টোকা পড়ার শব্দে হেডের কথা বলায় ফুলস্টপ পড়লো। তিনি আসার পারমিশন দিলেন। গ্লাস ডোর ঠেলে প্রবেশ করলো আজারাক সাইফার। তার পরনে কালো লেদারের হুডি, চোখে সানগ্লাস, কানে ব্লুটুথ ইয়ারবাড। এসেই জিনান আদহাম, নেওয়াজ সবার সাথে হাত মিলালো। মুনতাজির তাকে দেখে হাত মিলানোর পাশাপাশি জড়িয়ে ধরে বললো,

“ওয়েলকাম AC।”
আজারাক সাইফার অধর বেঁকিয়ে বললো,
“থ্যাংকস এমজে (MJ)।”
বলেই হেডের দিকে এগিয়ে গেলো। হেড দাঁড়িয়ে তার সাথে মোলাকাত করে বললো,
“অনেকদিন পর সাইফার।”
আজারাক এর বিপরীতে শুধু হাসি ফেরত দিলো। মার্ভ জেন এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বললো,
“হ্যালো মিস্টার এসি।”
আজারাক সাইফার ঘুরে তার দিকে চাইলো। এতক্ষণ খেয়াল করেনি তাকে। এক মুহুর্ত তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলো। তারপর চেয়ারে বসলো। হেড সবাইকে বসার পারমিশন দিলেন। সবাই বসলো। হেড বেশ খানিকক্ষণ আলোচনা করলেন এবারের মিশন নিয়ে। কথা শেষে আজারাক সাইফার বললো,
“পুলিশ কাস্টডিতে দেয়ার আগে আমি কি কিলার জাদের সাথে একটু একাকী কথা বলতে পারি?”
হেড মাথা নাড়িয়ে পারমিশন দিলেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কিলার জাদের সামনে পায়ের উপর পা তুলে কপাল ও গালে দুই আঙ্গুল ঠেকিয়ে ঘাড়টা একপাশে হেলে রেখে রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাইফার। কিলার জাদের পায়ে ব্যান্ডেজ করা। যেখানে গতকাল বুলেট ছুঁড়েছিল সাইফার। কিলার জাদ সামনের চেয়ারে বসে হিংস্র নজরে দাঁত খিঁচিয়ে তাকিয়ে আছে তার পানে। যেন এখনই গিলে ফেলবে তাকে। আজারাক হুডির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ঠোঁটে ধরলো। তারপর লাইটার জ্বালিয়ে খুবই ধীর গতিতে এক আঙুল দিয়ে আগুন ধরালো। আগুনের ঝলকানিতে তার মুখটা হলুদ, কমলার মিশ্রণে অব্যাখ্যেয় ও গূঢ় প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করেছে। লাইটার সরিয়ে সিগারেট হাতে নিয়ে মুখ থেকে ধোঁয়া বের করতে করতে বললো,

“দুনিয়াতে এত নাম থাকতে কিলার আজাদ কিংবা জাদ নামে পরিচিত হওয়ার কারণ?”
কিলার জাদের ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গাত্মক হাসি যেন জানতো এই প্রশ্নটাই তাকে করা হবে। সে পায়ের উপর পা তুলে সিনা টানটান করে বললো,
“বাপ মায়ে রাখছে কি আর করার?”
আজারাক সাইফারের ভ্রু সংকুচিত হলো। বোঝাই যাচ্ছে কথাটা তার মনঃপুত হয়নি। সে সিগারেটে লম্বা টান মেরে বললো,

“উহু তোর বাপ তো রেখেছে আমজাদ পাঠান। সেখান থেকে কিলার আজাদ হওয়ার রিজন তো বুঝলাম না।”
আমজাদ পাঠান ওরফে কিলার জাদ দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“চেয়েছিলাম তোকে বদনাম করতে কিন্তু সব পরিকল্পনা কিভাবে যে ভেস্তে গেলো। আমার এতদিনের এত পরিশ্রম মাঠে মারা গেলো”
একটু আগে সাইফারের ঠোঁটে বাঁকা হাসি থাকলেও এখন তা মিলিয়ে গিয়ে ভর করেছে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত মুখশ্রীতে। মহূর্তের মধ্যে গর্জন করে উঠে চেয়ারে লাথি দিয়ে কিলার জাদকে সুদ্ধ উল্টে ফেললো। কিলার জাদ ছিটকে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেলো। মাথায় আঘাত পেয়ে উঃ শব্দ করে উঠলো। আজারাক এগিয়ে গিয়ে চুল মুঠো করে ধরে বললো,

“কু****বাচ্চা আমার জীবনটা শেষ করে তোদের শান্তি হয়নি, না? আমার জীবন থেকে চার চারটা বছর নষ্ট করেছিস তোরা? শুধুমাত্র তোদের কুকর্মের প্রমাণ জোগাড় করেছিলাম বলে আমার প্রফেশনে দাগ লাগিয়ে দিয়েছিস তোরা? আমাকে মানুষের সামনে অপমানিত, লাঞ্ছিত করেছিস তোরা? আমাকে পাথরে পরিণত করেছিস তোরা? তারপরও কোন মুখে আমার জীবনকে বদনামের ভাগীদার করতে উঠে পড়ে লেগেছিলি তোরা? বল নিমকহারামের বাচ্চা।”

বলেই দেয়ালের সাথে শক্ত করে ঠেসে ধরে বারি মারলো। কিলার জাদের মাথা থেকে রক্তের ফোয়ারা বইছে। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে জিনান, মুনতাজির, নেওয়াজ, মার্ভ জেন আরও কয়েকজন এজেন্ট ছুটে এলো। জিনান আদহাম দৌঁড়ে আজারাককে সরাতে চাইলো কিন্তু তার গায়ে অদ্ভুত শক্তি ভর করেছে যেন। এক চুলও নড়াতে পারলো না। তারপর নেওয়াজ, মুনতাজির এগিয়ে এসে জোরপূর্বক টেনে সরাতে সরাতে বললো,
“কি করছেন মিস্টার সাইফার? পুলিশের হাতে হস্তান্তর না করা পর্যন্ত অপরাধীর গায়ে হাত দেয়া নিষিদ্ধ আপনি ভুলে গেছেন? কেন আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন? তার শাস্তি কোর্ট বিবেচনা করবে। এসব করে আপনি কেন কালার হচ্ছেন?”

আজারাক ছটফটিয়ে উঠে বললো,
“ওকে নিজ হাতে খুন করবো আমি। আমার জীবনটা জাহান্নাম বানিয়ে ছেড়েছে এই কুলাঙ্গারের দল।”
মুনতাজির তাকে ধরে বললো,
“ঠাণ্ডা হন। আপনি কি ভুলে গেছেন আপনি সাসপেন্ড এজেন্ট? এরপর সাসপেন্ড হলে কিন্তু চিরজীবনের জন্য এই পেশা আপনার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। আগের বার সাময়িক নিষিদ্ধ করলেও এবারে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করে দেয়ার চান্স আছে। তাই ঠান্ডা মাথায় কাজ করুন।”
আজারাক সাইফার জিদ নিয়ে বললো,
“করুক সাসপেন্ড। এতে আমার চুলও ছিঁড়বে না।”
জিনান আদহাম পরিস্থিতি শান্ত করতে বললো,
“কুল মিস্টার এসি। এসির বৈশিষ্ট্য কিন্তু ঠান্ডা থাকা। সো কাম ডাউন।”
নেওয়াজ বললো,

“তাছাড়া হেডের কানে এটা গেলে তিনি কিন্তু আপনার উপর নারাজ হবেন মিস্টার সাইফার।
আজারাক সাইফার কিছুটা শান্ত হলেও রাগ কমলো না তার। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুঁসতে লাগলো। কিলার জাদ নিজের ঠোঁট ও মাথার রক্ত মুছে সাইফারের দিকে তাকিয়ে নির্লজ্জ হেঁসে বললো,
“তোর কাছের বন্ধুর তো বা**লডাও ছিঁড়তে পারিস নাই খালি ত্যাজ দেখাস আমগো লগে। আমরা তোর সর্বনাশ করলেও তোর পিঠে ছুরি কিন্তু সেই বসাইছে। আহা কি দোস্তি তোগো, একবারে লা জবাব!”
এই কথা শুনে আজারাক একেবারে শান্ত হয়ে গেলো। অধর একটু বেঁকিয়ে ধীরগতিতে মার্ভ জেনকে ক্রস করে বাইরে বেরিয়ে গেলো। জিনান, নেওয়াজ, মুনতাজির, মার্ভ জেন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কি হলো? সাইফারের প্রস্থানে রুম একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেলো। শুধু একজনের ঠোঁটে নির্লজ্জ হাসি এবং দুজনের চোখ প্রজ্জ্বলিত।

সকাল সকাল দরজায় টোকা পড়ায় মারওয়ান দরজা খুলে দিলো। নিশাত রান্নাঘরে ব্যস্ত। দরজা খুলেই দেখলো দরজার ওপাশে একজন ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। মারওয়ানের ভ্রু কুঁচকে গেলো। এরা কারা? ভদ্রমহিলা মিষ্টি হেঁসে জিজ্ঞেস করলেন,
“এটা ফৌজিয়া নিশাতের বাসা না?”
মারওয়ান অসস্তুষ্ট কণ্ঠে বললো,
“জ্বি না। এটা মারওয়ান আজাদের বাসা।”
ভদ্রমহিলা আবারও হেঁসে বললেন,

“হ্যাঁ আপনাকেও চিনি। একটু জরুরি কথা ছিল। আমরা কি ভেতরে আসতে পারি?”
মারওয়ান না চাইতেও তাদেরকে ঢুকতে দিলো। সকাল সকাল ভেজাল এসে হাজির। ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাকে তাদের গেস্টরুমের বিছানায় বসতে দিলো। নাহওয়ান বাবার পিছন পিছন এসে অচেনা দুজন মানুষকে দেখে চুপসে গেলো। দ্রুত মারওয়ানের কোলে উঠে গেলো। ভদ্রমহিলা নাহওয়ানকে দেখে বললেন,
“কি মিষ্টি বাচ্চা! তোমার মা, বাবা কোথায়?”
মারওয়ানের চোখে মুখে বিরাগ দেখা দিলো। এতক্ষণ আপনি বলে এখন তুমিতে নেমে এসেছে। অপরিচিত কাউকে ফট করে তুমি বলা কেমন ম্যানার্স? তবুও অসন্তোষ চেপে বললো,

“গ্রামে।”
ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক বোধহয় একটু অবাকই হয়েছেন। ভদ্রমহিলা ধাতস্থ হয়ে বললেন,
“ওনারা কবে আসবেন।”
মারওয়ান কথা বাড়াতে চাচ্ছিলো না। তাই সংক্ষেপে বললো,
“যেদিন সময় হবে।”
ভদ্রমহিলা নাহওয়ানকে দেখিয়ে বললেন,
“এতটুকু বাচ্চাকে রেখে গেলেন কেন?”
মারওয়ান এবার চরম বিরক্ত হলো। এই মহিলা কি বলছে আবোল তাবোল আল্লাহ জানে? দাঁত খিঁচে বললো,
“তো কি নিয়ে যাবে?”

ভদ্রলোক এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার মুখ খুললেন,
“তুমি বোধহয় বিরক্ত হচ্ছো আমাদের কথায়। যদিও তোমাদের পরিবারের বিষয়ে জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে ছিল না। আসলে তোমার বাবা, মাকে একটু দরকার ছিল তাই জিজ্ঞেস করছি। কিছু মনে কোরো না বাবা।”
মারওয়ান কপাল ভাঁজ করে বললো,
“আমার মা, বাবাকে আপনাদের কি দরকার? আমাকে বলুন। তাদেরকে বলে দেবো।”
ভদ্রমহিলা একটু কাঁচুমাচু করে বললেন,
“আসলে আমার ছেলের জন্য তোমার বোনকে চাইতে এসেছি।”
মারওয়ান আগের ভঙ্গিতেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে বললো,
“আমার যে বোন আছে আপনারা কিভাবে জানলেন?”
প্রশ্নটি করে পরক্ষণেই মনে হলো তার পিতা মাহাবুব আলম এখানে এসে মসজিদে গিয়ে বন্ধুবান্ধব পাতায়নি তো আবার? হতেই পারে মাহাবুব আলমের পরিচিত এরা। সম্ভবত মানহার বিয়ের কথা জানাতে পারেননি। ভদ্রমহিলার কথায় তার চিন্তা ভঙ্গ হলো।
“চারপাশে খোঁজ নিয়েই জেনেছি আরকি। আমার ছেলে গোয়েন্দা অফিসার। তার জন্যই পাত্রী খুঁজছিলাম। তোমার বোনকে নিয়ে এসো। একটু দেখি।”

মারওয়ান ছেলেকে চেপে ধরে ভাবলো মানহাটার বিয়ে এই ছেলেটার সাথে হলে কত ভালো হতো। একটা ভালো পরিবার, ভদ্র ছেলে পেতো। অথচ আমার বাচ্চা বোনটা পেয়েছে একটা স্টুপিডকে। ভাবলেও রাগে দুঃখে মাথায় রক্ত উঠে যায় তার। রাগ ঝেড়ে বললো,
“ও তো গ্রামে। এখানে নেই।”
ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোকের মুখটা কালো হয়ে গেলো। তারপর দাঁড়িয়ে বললেন,
“আচ্ছা আরেকদিন আসবো তাহলে।”
মারওয়ান আরও কিছু বলতে চাইলো তার আগেই তারা বেরিয়ে গেলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে জুতো পড়ার সময় মারওয়ান বললো,

“কিছু খেয়ে যান।”
ভদ্রমহিলা হেঁসে বললেন,
“না বাবা। আরেকদিন আসবো। এরপর তো অনেকবার আসতে হবে তখন নাহয় খাবো। তোমার বাবা, মা আসলে একটা খবর দিও। তোমার নাম্বারটা দাও সেইভ করে রাখি।”
মারওয়ান মানহার বিয়ে হয়ে গেছে কথাটা যখনই জানাতে যাবে তখনই নিশাত রেডি হয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হলো। নিশাত ভেবেছে তারা চলে গেছেন। নিশাতকে দেখে ভদ্রমহিলা একটু জোরেই বললেন,
“ঐযে তোমার বোন? মিথ্যা বললে কেন? ও তো ঘরেই আছে। দেখি মেয়েটার মুখটা একটু দেখে যাই।”
মারওয়ান, নিশাত উভয়ই থতমত খেয়ে গেলো। মারওয়ান পিছু ঘুরে নিশাতকে দেখে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,

“কোথায় আমার বোন?”
ভদ্রমহিলা এবার একটু বিরক্তই হলেন। বললেন,
“আশ্চর্য তোমার সামনেই তো দাঁড়িয়ে আছে। ঐযে নিকাব পড়া মেয়েটা।”
মারওয়ান চোখ ঘুরিয়ে এমন রিয়েকশন দিলো যে ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক উভয়ই ভয় পেয়ে গেলেন। মারওয়ান এতক্ষণে বুঝলো আসল কাহিনী। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“তাকে আপনাদের অবিবাহিত লাগে কোন দিক দিয়ে? একটু এক্সপ্লেইন করুন দেখি। তার বয়স আপনাদের থেকে সর্বোচ্চ ধরলে দশ বছরের কম হবে মনে হয়। আর আপনারা এসেছেন এই অর্ধবুড়া নারীর সাথে আপনাদের কচি ছেলের বিয়ে দিতে?”
ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা উভয়ই একসাথে বললেন,

“What! বুড়া?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। বোরকার ভিতরে বুড়া না জুয়ান বুঝবেন কিভাবে? এজন্যই মূলত কটটা খেয়েছেন।”
ভদ্রমহিলা তবুও বিশ্বাস করতে নারাজ। তিনি মিনমিন করে বললেন,
“চোখ দুটো কি সুন্দর, বাচ্চাদের মতো হাইট। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না সে বুড়ো।”
মারওয়ান নির্লিপ্ত গলায় বললো,
“আরে সব মেকআপের ফল। নিচে তরতাজা তাগড়া বুড়ি।”
“তরতাজা তাগড়া বুড়ি মানে?”
মারওয়ান মনে মনে গালি দিয়ে বললো,

“মানে আপনি।”
“আমি মানে।”
“মানে আপনিও বুড়ো সেও বুড়ো। হয়ে গেলো না এক থুরো।”
ভদ্রমহিলা তাও মাথা নাড়িয়ে নিজের সংশয় প্রকাশ করে বললেন,
“কণ্ঠটাও তো কি মিষ্টি ছিল? কোনোভাবেই তো বয়স্ক কণ্ঠ লাগেনি।”
মারওয়ান এবারও কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই নিশাত এগিয়ে এসে বললো,
“আপনারা ভুল ভাবছেন। আমি বিবাহিত। আমার স্বামী, বাচ্চা সব আছে। ভুল ধারণা মনে রাখবেন না।”
ভদ্রমহিলা আশ্চার্যন্বিত কণ্ঠে বললেন,
“তবে তুমি মা, বাবা, ভাইয়ের সাথে থাকো কেন?”
নিশাত শান্ত কণ্ঠে বললো,
“জানি না আপনারা এই মিথ্যা গুজব কোথা থেকে শুনেছেন তবে আমি মা, বাবার সাথে থাকি না। আমি আমার স্বামীর সাথেই থাকি বাচ্চা নিয়ে। আর ইনিই আমার স্বামী। কোলে যে বাচ্চাটা দেখছেন সে আমার ছেলে নাহওয়ান।”
ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। আসলে এত এত শক নিতে পারছেন না তারা। স্বামী ছেলেকে ভাই ভেবেছিলেন তারা? কি সাংঘাতিক অদ্ভুত কথা!

“শুনুন ফ্লাফি না বমি করছে?”
ইহাব কফি খাচ্ছিলো আর ফোন স্ক্রল করছিল। হঠাৎ মানহার কথা শুনে সেদিকে চেয়ে বললো,
“বমি করছে কেন?”
মানহা চিন্তিত কণ্ঠে ফ্লাফিকে ঝুড়ির মধ্যে রেখে বললো,
“জানি না। কয়েকদিন হলো খাওয়াদাওয়াও কমিয়ে দিয়েছে। সারাক্ষণ ঘুমায়।”
ইহাব কপালে হাত ঠেকিয়ে ফোন দেখতে দেখতে বললো,
“তোমার রোগে ধরেছে। ঘন ঘন অসুস্থ হওয়া, খাবারে অরুচি।”
মানহা বিরক্তি নিয়ে বললো,
“আমি মজা করছি না।”
ইহাব ফোনের দিকে নজর দিয়েই বললো,

“আমিও সিরিয়াস।”
“আশ্চর্য কেমন সিরিয়াস আপনি? বললাম ফ্লাফি বমি করছে, খাওয়াদাওয়া কমিয়ে দিয়েছে, সারাক্ষণ এক জায়গায় বসে থেকে ঝিমায় নয়তো ঘুমায়। এগুলো নরমাল লাগছে আপনার কাছে?”
ইহাব ভ্রু কুঁচকে বললো,
“লক্ষণ তো ভালো ঠেকছে না। ও কি পাশের বাড়ির আশপাশ ঘেঁষে নাকি?”
“হ্যাঁ যায় তো মাঝে মাঝেই।”
“সর্বনাশ! এগুলো তো প্রেগন্যান্সির সিমটমস্।”
মানহা অবাক হয়ে বললো,
“কিন্তু কিভাবে…”
ইহাব দাঁত খিঁচে বললো,
“কিভাবে মানে? আসো দেখিয়ে দেই।”
মানহা থতমত খেয়ে বললো,
“বুঝেছি বুঝেছি। দেখানো লাগবে না।”
“ঘোড়ার ডিম বুঝেছো। একটা বিড়ালও তোমার চেয়ে বুদ্ধিমান। ঠিক নিজের পার্টনার খুঁজে আসল কাজ সেরে ফেলেছে। আর তুমি একটু কাছে ঘেঁষলেই ফিট খাও। আমার ভবিষ্যতের রেড লাইট জ্বালায় দিছি এই অ্যাটাকরে বিয়ে করে।”

মানহা চোখ মুখ শক্ত করে বললো,
“আমি এখন মোটেও ফিট খাই না।”
“ও আচ্ছা তাহলে কি খাও? আমার বাইট??”
“ছিঃ আস্তাগফিরুল্লাহ!”
ইহাব গালে হাত ঠেকিয়ে বললো,
“আস্তাগফিরুল্লাহ কেন? বরং আলহামদুলিল্লাহ, সুবহানাল্লাহ পড়।”
মানহা ভ্রু কুঁচকে মুখ কঠিন রেখে বললো,
“আলহামদুলিল্লাহ, সুবহানাল্লাহ কেন পড়বো?”
ইহাব দু’হাত পিছনে নিয়ে আড়মোড়া ভেঙে বললো,
“আলহামদুলিল্লাহ পড়বে তোমাকে কামড়ের অফার করেছি দেখে। আর সুবহানাল্লাহ পড়বে আমার অতি সুশ্রী ওষ্ঠ দিয়ে তোমাকে দংশন করবো বলে।”

মানহার কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। সে দ্রুত ‘অসভ্য’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ইহাব তা দেখে পিছন থেকে জোরে জোরে বলতে লাগলো,
“আরে কই যাচ্ছো? ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করছিলাম তো?”
তারপরই সুর টেনে গাইতে লাগলো,
“তুমি জ্বালাইয়া গেলা লাল বাতি,
নিভাইয়া গেলা না।”

মানহা আজ সারাদিন আর ঘর মুখো হয়নি। শাশুড়ির সাথে সাথে থাকার চেষ্টা করেছে যদিও উর্মি ভুঁইয়া আগের মতো তার সাথে কথা বলেন না তবুও এই কাজ সেই কাজ করে সময় কাটিয়েছে। এখন রান্নাঘরে সন্ধ্যার জন্য সিঙ্গারা, পুরি বানাচ্ছে। সিঙ্গারায় আলুর পুর ভরে ডুবন্ত তেলে ছেড়ে দিলো। ইহাব বাইরে থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো মানহা মনোযোগ দিয়ে রুটি বেলছে। ইহাব আশপাশটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিঃশব্দে মানহার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। মানহা একমনে পুর ভরে রুটি বেলছে। ইহাব মানহার কানের কাছে গিয়ে একটু মোটা আর বিকৃত কণ্ঠে ফিসফিস করে বললো,
“এই মেয়ে তোরে আমার ভাল্লাগছে। আমি তোরে জ্বিন নগরীতে নিয়া যামু। এখন শুধু একখান কামড় দিয়া যামু গা। তাই বেশি তেড়িবেড়ি না কইরা সোজা হইয়া খাড়ায় থাক।”

আচমকা কানের কাছে অদ্ভুত কণ্ঠ শুনে মানহা ভয়ে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠলো। দ্বিতীয়বার চিৎকার দিতে নিলে ইহাব মানহার মুখ চেপে ধরলো। মানহা ভয়ে ঘেমে একাকার। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। কেমন যেন চারপাশ অন্ধকার লাগছে। সে সম্পুর্ণ ভর ইহাবের উপর ছেড়ে দিলো। ইহাব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মানহাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মানহার মুখের দিকে তাকিয়ে আফসোসের স্বরে বলতে লাগলো,

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪২

“দিতে চাই বাইট,
হয়ে যায় কাইত।
এদিকে আমার ভবিষ্যৎ
আসার জন্য করতেছে ফাইট।
আল্লাহ গো লাল বাত্তি নিভে
কবে জ্বলবে আমার লেড লাইট?”

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪৪