ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪৭
তাজরীন ফাতিহা
ফজরের আযানের ধ্বনি চারদিকে মুখরিত হচ্ছে। নিশাত ঘুম ঘুম চোখ মেলে ধীরে ধীরে চাইল। চোখ খুলেই মারওয়ানের পিঠ নজরে এল। যে তার উল্টো ফিরে শুয়ে আছে। নিশাত ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ হাতড়াল। কাউকে পেল না। চমকে তাকিয়ে দেখল পাশটা খালি। তার ছানা কই? মুহুর্তের মাঝে উঠে বসে খাটের নিচে দেখল, আশপাশ দেখল। নেই, কোথাও নেই। মারওয়ানের দিকে দৃষ্টি ফেলে দেখল তার কনুইয়ের ফাঁক গলিয়ে গুলুমুলু মুঠকৃত একটি হাত বেরিয়ে আছে। নিশাত ফোঁস করে দম ছাড়ল। আরেকটু হলে তার দমটাই বেরিয়ে আসতো। ঘুম থেকে উঠে মানুষের মস্তিষ্ক কম কাজ করে। অন্যান্য সময় সবার আগে মারওয়ানের আশপাশ চেক করত আর আজ মারওয়ান বাদে সবকিছু তন্নতন্ন করে খুঁজে সারা। নিশাত কপালে হাত ঠেকিয়ে একটু ধাতস্থ হল। চুলগুলো হাত খোঁপা করে ওযু করে নামাজ আদায় করল।
নিশাতের আজ নাস্তা বানাতে ইচ্ছে করছে না। কেমন ব্যথা আর ম্যাজম্যাজ করছে শরীরটা। স্কুলে বলে ছুটি নিয়ে নেবে কিনা সেটাও বুঝতে পারছে না। আজকাল শরীরটা বড্ড খারাপ লাগে। একটু হলেই অসুস্থ হয়ে যাওয়ার এক বাতিক দেখা দিয়েছে। বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইল। ভালো লাগলে স্কুলে যাবে নয়ত ফোনে না করে দেবে। কর্তৃপক্ষ ছুটি দেবে কিনা সেটাও বড় বিষয়। এমনিতেই গত কয়েকমাসে ছুটির সংখ্যা তার বেশি। আজকে ছুটির কথা বললে সোজা হাতে কাগজ ধরিয়ে আবার বের করে না দেয়। কাগজ ধরিয়ে দিলে কাগজ নিয়ে সোজা চলে আসবে। এত ক্লান্তি, অবসাদ, চাপ নিতে পারছে না সে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
নিশাতের মতো চাকরিজীবীরা কাজ থেকে ইস্তফা নিতে মাঝেমধ্যেই ভেবে থাকে। সামনাসামনি বলার সাহস, ক্ষমতা কোনোটাই তাদের থাকে না। কারণ মধ্যবিত্তরা কল্পনায় একটা প্রসাদের মালিক হলেও বাস্তবে পেটের দায়ে কামলা খাটতে দুবার ভাবে না। বাঁচতে তো হবে। লোকে কি বলবে তা দিয়ে তো আর পেটের ক্ষুধা নিবারণ হবে না। যদিও মধ্যবিত্তদের চক্ষু লজ্জাটা বেশি। দুনিয়াতে পেটটাই যত নষ্টের গোড়া, অশান্তির মূল। একে ভর্তি করতে মানুষের কত আয়োজন। এটা না থাকলে বিশাল পৃথিবীর এক কোণে পড়ে থাকত, এত ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হত না। এসব ভাবতে ভাবতে কখন তার চোখ লেগে এসেছে বলা মুশকিল।
মুখে সুড়সুড়ি লাগায় ঘুম হালকা হয়ে এল নিশাতের। আঁখি পল্লব জোর করে টেনে খুলে দেখল নাহওয়ান ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে তার মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নিশাতকে চোখ খুলতে দেখে হাসলো বাচ্চাটা।
“মা?”
নিশাত আওয়াজ দিল,
“হু।”
নাহওয়ান ঘাড় বেঁকিয়ে ফোকলা হেঁসে বলল,
“গুম বাংগিচে?”
নিশাত উঠে বসে চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে বলল,
“এইতো ভাঙলো। আপনি উঠে পড়েছেন?”
“আমি উটচি, বাবা উটচে। কাবার নাই।”
নিশাত বুঝল, তার ছানার খিদে পেয়েছে। আজ তো সে নাস্তাও বানায়নি। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো স্কুলের আর ত্রিশ মিনিট আছে। নিশাত বলল,
“তোমার বাবা কই?”
“বাবা কায়।”
নিশাতের কপাল কুঁচকে গেল,
“কি খায় তোমার বাবা?”
নাহওয়ান মায়ের পাশে তার ছোট্ট গুলুমুলু হাত পা মেলে বসে বলল,
“উইযে চিরে চিরে কায়।”
নিশাত বুঝল রুটির কথা বলছে নাহওয়ান। সে দ্রুত ছেলেকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পাশের রুমে গেল। পর্দা সরিয়ে দেখল মারওয়ান খাটে হেলান দিয়ে চা খাচ্ছে আর পেপার পড়ছে। পরনে শুধু লুঙ্গি আর ঘাড়ে দুই পাশ দিয়ে গামছা ঝুলছে। নিশাত হঠাৎ রেগে গেল। রান্নাঘরে গিয়ে জোরে জোরে বাসনকোসন রাখছে আর চিল্লিয়ে বলছে,
“একা একা পাশের রুমে নাস্তা এনে নিজের উদরপূর্তি করছে অথচ বাচ্চাটাকে না খাইয়ে রেখেছে এখনো। ও কি খুব বেশি খেত? সভ্যতার বলাই নাই, থার্ড ক্লাস লোক।”
নিশাত রাগে গজগজ করতে করতে চুলায় গতকাল রাতের দুধ জ্বাল করছে। কোলে নাহওয়ান মায়ের চিৎকারে ভয় পেয়ে গুটিয়ে আছে। মায়ের ঘাড়ে মুখ লুকিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখল বাবা দাঁড়িয়ে। যার চোখ মুখ বর্তমানে কুঁচকে গম্ভীর হয়ে আছে। নাহওয়ান বাবার দিকে দুই হাত মেলে দিল। মারওয়ান নিশাতের পিছনে দাঁড়িয়ে বলল,
“সকাল সকাল গলা এত চড়া কেন? ঘরের মধ্যে প্রতিদিন অশান্তি করতে হবে কেন? সমস্যা কি?”
নিশাত কোনো কথার জবাব দিল না। নিজ মনে কাজ করতে লাগল। নাহওয়ানের হাত বাড়িয়ে ‘বাবা বাবা’ বলে ডাক দিতে দেরি কিন্তু নিশাতের ধমকে উঠতে দেরি হয়নি,
“চোপ!! থাপ্পড় মেরে বাবা বাবা করা ছুটিয়ে দেব। সেদিনের মাইরের কথা ভুলে যাওনি নিশ্চয়ই।”
মারওয়ানের রাগ আকাশ ছুঁলো। দোষ না করেও অযথা কথা আর চিল্লাচিল্লি কেইবা সহ্য করে? রান্নাঘরের সবগুলো বাসন রাগে জিদে এক ধাক্কায় ফেলে দিল। ঝনঝন শব্দে নিশাত কেঁপে উঠলো। নাহওয়ান বাবার অগ্নিমূর্তি দেখে কেঁদে দিল। বুঝ হওয়ার পর এই প্রথম বাবাকে এত রাগতে দেখল ভয় তো পাবেই। মারওয়ান দেয়ালে থাবা মেরে গর্জে উঠে বলল,
“প্রতিদিন নাটক মারায়। বা**লের সংসার করতে আসছি। এটারে বলে বা**লের সংসার। খালি সারাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান, প্যানপ্যান। কানটা আমার ঝালাপালা করে দিচ্ছে। শরীর খারাপ ভেবে নাস্তা আনলাম, ওর ছেলেকে খাওয়ালাম এটা দোষ হয়েছে আমার? সকাল সকাল তেজ দেখাচ্ছে, চিল্লানো শুরু করেছে যেন রেডিও শোনাচ্ছে। একটু কামাই করে খাওয়ায় এর দাপটে ঘরে টেকা যায়না। গুষ্ঠি কিলাই এই সংসারের।”
বলেই পায়ের কাছের এক বোতলে লাথি মেরে চলে গেল। বোতল ফেটে পানি বেরিয়ে এল। নিশাত লণ্ডভণ্ড রান্নাঘরে ছেলেকে চেপে ধরে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। সংসারে একজন আগুন হলে আরেকজনকে পানি হতে হয়। তবে সেই পানি যদি পেট্রোলে রূপ নেয় সেখানে বিস্ফোরণ হওয়া স্বাভাবিক। নাহওয়ান হেঁচকি তুলে কাঁদছে। সম্ভবত এই সংসার যুদ্ধে বাচ্চা ও বাচ্চার মা উভয়ই বিধ্বস্ত। সম্পর্কের ছেঁড়া সুতোটা বোধহয় এবার পুরোপুরিই ছেঁড়ার বন্দোবস্ত হলো।
‘পদ্মালয়’ নামক চেয়ারম্যান বাড়িতে সকাল সকাল ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে গিয়েছে। যেই সেই কাণ্ড না একেবারে খবরে ছাপানোর মতো কাণ্ড। শাশুড়ির হাতে পুত্রবধূ চড় খেয়ে বোবা হয়ে গেছে। উর্মি ভুঁইয়ার ভাষ্যমতে মানহা তাকে চায়ের সাথে কিছু মিক্স করে দিয়েছে। তার ধারণা সেটা বিষ। ভাগ্যিস সেইসময় সে ওখানে গিয়েছিল নয়তো এই মেয়ে তাকে যমের দুয়ারে পাঠিয়ে দিত। মানহাকে যত ভোলা ভেবেছিল আদতে মেয়েটা দুনিয়ার বাজে। সেই থেকেই ঘটনার সূত্রপাত। দিন দিন উর্মি ভুঁইয়ার আচরণ আক্রমনাত্মক হয়ে যাচ্ছে। স্বামী, কন্যা, পুত্র, পুত্রবধূ কাউকে দুই চোখে সহ্য করতে পারছেন না।
বিশাল হলরুমে বৈঠক বসেছে। উর্মি ভুঁইয়ার দুই ভাই উমায়ের ভুঁইয়া এবং উজান ভুঁইয়াও উপস্থিত। ইহাব সকলকে ডেকে হুলস্থূল ঘটিয়ে ফেলেছে। উপস্থিত সকলের মুখে চিন্তার রেখা ফুটে আছে। অথচ যাকে নিয়ে বৈঠক সে নির্বিকার চিত্তে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন আর বই পড়ছেন। যেন এসব বৈঠকে তার কিছুই যায় আসেনা। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া পড়েছেন গ্যারাকলে। এদিকেও যেতে পারছেন না ওদিকেও যেতে পারছেন না। দুদিকেই বিপদ। ইহাব মুখ শক্ত করে উমায়ের ভুঁইয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
“মামু, তোমার আদরের বোনকে জিজ্ঞেস করো আমার বউয়ের সাথে তার কিসের শত্রুতা? প্রথম প্রথম তো মাথায় তুলে নাচত এখন মাথা থেকে ফেলে আছাড় দিচ্ছে কেন?”
উমায়ের ভুঁইয়া বললেন,
“একটু শান্ত হ।”
“কিসের শান্ত হব? মমের এমন গিরগিটির মতো রূপ বদলানো দেখে আমিই হতভম্ভ আর বেচারি তো পরের মেয়ে। সে তো বুঝে উঠতেই পারছে না কী ঘটছে আর কেন ঘটছে? আমি নাহয় ছেলে একটা কেন দশটা থাপ্পড় খেলেও প্রবলেম নেই কিন্তু আমার বউকে মারে, কথা শুনায় কোন যুক্তিতে? মানহা কি তার মেয়ে?”
“তোর মা তো বলল, চায়ের সাথে কিছু মিশাতে দেখেছে তাই এমন রিয়েক্ট করেছে।”
ইহাব কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল,
“ওটা চিনি ছিল মামা। মমের কি হয়েছে বুঝতে পারছি না। সব কিছুতে অহেতুক সন্দেহ করা শুরু করেছে। মারতে হলে ছেলেকে মারতো পরের মেয়েকে মারার দরকারটা কি ছিল? মেয়েটার চোখে আমি কালার হলাম না? ওর মা, বাবা, ভাইয়েরা জানলে কি হবে বুঝতে পারছ?”
উমায়ের ভুঁইয়া বললেন,
“তোর বউ কি উচ্চবংশীয়? ধনী পরিবারের? তাহলে আমাকে ফোন নম্বর দে, আমি যোগাযোগ করব। অত টেনশন করতে হবে না। তোর মামু আছে কি করতে?”
ইহাব গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“প্রয়োজন নেই। আমি দেখব।”
উর্মি ভুঁইয়া এবার মুখ খুললেন,
“পুরোপুরি দেখি বউয়ের গোলাম হয়ে গেছিস, বাহ্! নিশ্চয়ই কান পড়া দিয়েছে। ওই মেয়ে একটা কূটনী। ঠিক ছেলেকে মায়ের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। একে কি দেখে ভালো ভাবতাম? ভাবলেই তো শরীর কুটকুট করছে।”
ইহাব দাঁড়িয়ে বলল,
“মম এবার কিন্তু বেশি বেশি হচ্ছে। কান পড়া দেয়ার কিছু নেই। সবকিছু আমার চোখের সামনেই ঘটেছে। তাই অযথা পরের মেয়েকে টেনো না এরমধ্যে। ভালো ফ্যামিলির মেয়ে দেখে এখনো চুপ করে আছে নয়তো অন্য মেয়ে হলে এই ঘটনার পর বাপের বাড়ি গিয়ে কেস করে দিত আমাদের নামে। তখন জেলে বসে সর্ষে ফুল দে…”
ঠাস শব্দে পুরো বসার ঘর স্তব্ধ। ইহাব ডান গালে হাত ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উমায়ের ভুঁইয়া, উজান ভুঁইয়া, ইমতিয়াজ ভুঁইয়া, ইনাবা সকলে থাপ্পড়ের শব্দে দাঁড়িয়ে গেছে। উর্মি ভুঁইয়া ইহাবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মায়ের চোখে চোখ রেখে কথা বলা শিখেছ? যাও তোমাকে ও তোমার বউ দুজনকেই থাপ্পড় দিলাম। এবার জামাই বউ দুজনে যেয়ে আমার নামে কেস করে এসো, যাও। বেয়াদব পেটে ধরেছি। রক্ত কথা বলে। তোমার রক্তও কথা বলছে। হেডম দেখাচ্ছে আমাকে।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া উর্মি ভুঁইয়াকে ধরতে এলে উর্মি ভুঁইয়া চোখ রাঙিয়ে বলল,
“দূরে থাকুন। ছেলেকে শাসন করতে পারেনা আসছে আমাকে শান্ত করতে।”
ইনাবা এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“আম্মু একটু ঠান্ডা হও। তোমার প্রেশার বাড়বে।”
“তোমারও ভাই, ভাবির সঙ্গে চড় খাওয়ার শখ জেগেছে? তোমার কাছে জ্ঞান চেয়েছি? দূরে থাকো।”
উর্মি ভুঁইয়ার কাঠিন্য স্বর। ইহাব আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে গটগট পায়ে হেঁটে উপরে চলে গেল। পুরো হলরুমে নীরবতা নেমে আসলো। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া চিন্তিত বদনে বসে রইলেন।
জিনানের আজকে ডিউটি নেই। বাকি চারজনেরও অফ ডে। কানে ব্লুটুথ। যেটা দিয়ে নেওয়াজ, মুনতাজির, মার্ভ, সাইফার সকলের সাথে কথা বলছে। ঘরে বসেই আর্জেন্ট ফাইল চেক করছে আর রেড মার্কার দিয়ে ক্রস চিহ্ন দিচ্ছে কিছু কাগজে। হঠাৎ তার পার্সোনাল ফোন ভাইব্রেট করতে লাগল। জিনান কেটে দিল। তবে অপরপক্ষ মারাত্মক অধৈর্য বোঝা যাচ্ছে। বার বার বিরতিহীন ভাবে কল দিয়েই যাচ্ছে। জিনান শেষে ফোন সুইচ অফ করে রাখল। জরুরি আলাপ, কাজ সেরে একটু রিল্যাক্স হয়ে বসতেই কলিং বেলের শব্দে টনক নড়ল। এই ফ্ল্যাটে সে একাই থাকে। এসময়ে আবার কে এল? কুঁচকানো গেঞ্জি টানটান করে টাউজারের পকেটে এক হাত ভরে দরজার পিপহোলে চোখ রাখল। আশপাশে কাউকে দেখল না।
জিনান কপাল ভাঁজ করে চলে যেতে নিলে আবারও অনবরত কলিং বেল বাজতেই থাকল। সে এবার ঘর থেকে পিস্তল নিয়ে এসে ধীরে ধীরে দরজা খুলে দিতেই কেউ যেন তার গায়ের উপর হামলে পড়ল। জিনান অতর্কিত হামলায় উল্টেপাল্টে পড়ে গেল। গায়ের উপরের ভারী বস্তুটার দিকে নজর দিয়ে বলল,
“এখানে কি?”
উপরের মানুষটা আরাম করে একপায়ের উপর আরেক পা ভাঁজ করে আসনের মতো বসে বলল,
“তুমি।”
জিনান দ্রুত উঠে দরজা বন্ধ করে বলল,
“তুমি পাগলামি বন্ধ কবে করবে ইরা?”
ইরা নামক মেয়েটি ছুটে এসে জিনানের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“কোনোদিন না। তুমি তো আমাকে একটুও মনে করো না।”
জিনান মুখের অভিব্যক্তি পরিবর্তন না করেই বলল,
“আমার কাজ থাকে সেটা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়। তুমি বাসার ঠিকানা পেয়েছ দেখে যখন তখন এখানে চলে আসবে এটার পারমিশন কিন্তু তোমায় দেয়া হয়নি।”
ইরা মুখ কালো করে বলল,
“তোমার বাসায় আসতে আমার পারমিশন লাগবে নীলাভ্র?
জিনান বিরক্তিসূচক শব্দ করে নিজের কপাল চুলকে বলল,
“অবিয়েসলি লাগবে। তোমার পাগলামি তুমি বাসা পর্যন্ত বজায় রাখো। আমার গুরুত্বপূর্ণ ফাইলের ভিতরে তোমার প্রেম কাহিনী শোনার জন্য নিশ্চয়ই কেউ বসে নেই। এইজন্যই এই পেশার কথা তোমাদের মতো মেয়েছেলেকে জানানো উচিত না। এরা কাজের কাজ তো কিছু করেইনা উল্টো অযথা প্যারা দেয়। পুরো অফিসরুমে আমার মান, ইজ্জত খেয়েছ তুমি। এখনো বাচ্চা নেই তুমি। অবুঝের মতো বিহেভ এবার অন্তত ছাড়ো।”
ইরা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। এতদিন পর দেখা হয়েছে কোথায় জড়িয়ে ধরবে তা না করে কড়া কড়া কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। ইরা কি এত কিছু বুঝে কাগজগুলো রেখেছিল? মনটা তার বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। এসব পুরুষদের বিবাহ করাই ভুল। এদের কাছে নারীর প্রেমকে ঢং, ন্যাকামি লাগে। বাবার জোরাজুরিতে এই কাজিন নামক বাঁশটাকে বিবাহ করে তার জীবন যৌবন সব শেষ। সে ছাড়া এই কারেন্টের তারকে কেইবা বিয়ে করতো। একটু ধরলেই চিলিক মেরে ওঠে শালার বিদেশি মাল। এসব ভেবেই ইরা মুখ মোচড়ালো। জিনান তার মুখের সামনে তুড়ি বাজাতেই ইরা নিজের ব্যাগ নিয়ে সোজা শোবার ঘরে চলে এল। জিনান পিছু পিছু এসে বলল,
“তুমি কি এখানে থাকবে?”
ইরা না ঘুরেই নিজের হ্যান্ড ব্যাগ আলমারি খুলে রাখতে রাখতে বলল,
“না, আমার ভূত থাকবে।”
জিনান এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“তোমাকে এখানে আসতে বারণ করেছিলাম আমি।”
ইরা প্রতিউত্তর করল না। মনে মনে বলল, এ্যাহ উনি বারণ করলেই আমি শুনব। জিনান দরজায় হেলান দিয়ে বলল,
“জামাকাপড় তো আনোনি। কি পড়ে থাকবে?”
“দরকার হলে জামাকাপড় ছাড়াই থাকব। কোনো সমস্যা?”
জিনান হেলানরত অবস্থায় হাত ভাঁজ করে বলল,
“তোমার সমস্যা না হলে আমার সমস্যা হবে কেন? জামাকাপড় ছাড়া তো আর আমি থাকব না।”
ইরা জিনানের কথার মানে বুঝতে পেরে চোখ রাঙিয়ে বলল,
“অসভ্য।”
তারপর আলমারি খুলে জিনানের একটা সাদা গেঞ্জি আর টাউজার নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল। জিনান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। শুরু হয়েছে তার ব্র্যান্ডের গেঞ্জি, টাউজারে দখলদারিত্ব। এই মেয়ে এখানে আসলে তার আলমারি লণ্ডভণ্ড করে ফেলে। জিনান মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। সব গুরুত্বপূর্ণ ফাইল গুছিয়ে লকারে ঢুকিয়ে রাখল। কোথায় কোথায় হাত দেয় বলা যায়না। একটু সুস্থে থাকে না মেয়েটা। এত চঞ্চল আর অস্থির! উফ জিনান আর ভাবতে পারল না। ইরার বেরুনোর অপেক্ষা করতে লাগল। এসেছে যেহেতু বেশি বেশি খাটিয়ে নিতে হবে। তাহলে ঘন ঘন এখানে আসার স্বাদ মিটে যাবে।
ইহাব মানহার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে তবে মানহা তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। ফ্লাফিকে আদর করছে, খাবার দিচ্ছে। একদম চুপচাপ হয়ে আছে। ইহাবের মনে হচ্ছে ঝড় আসার পূর্বের লক্ষণ এটা। উর্মি ভুঁইয়ার চড় খেয়ে জবাব বন্ধ হয়ে গেছে নাকি। বেচারি ওই মুহুর্ত থেকেই বোধহয় এখনো বেরুতে পারেনি। ইহাব গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“শোনো চড় তুমিও খেয়েছ, আমিও খেয়েছি। হয়ে গেল না শোধবোধ? কথা না বললে কি গাল থেকে চড়টা উঠে যাবে? আমার সাথে কথা না বলার কারণ কি? চড় কি আমি দিয়েছি? যে দিয়েছে তার সাথে কথা বলো না। আমি তো নিজেও ভুক্তভুগী। তাই আসো কোলাকুলি করে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলি।”
মানহা প্রতিউত্তর করল না। মানহার উত্তর না পেয়ে ইহাব নিজ থেকেই এগিয়ে এসে মানহাকে পিছন থেকে ঝাপটে ধরল। অমনি মানহা চোখ ঘুরিয়ে ইহাবের দিকে চাইল। ইহাব বলল,
“রাগ করেনা রিন পাউডার
খুলে দেও মুখের লাউডার।”
মানহা ইহাবকে সরিয়ে বলল,
“উল্টাপাল্টা ছন্দ বলা বন্ধ করুন। আমার ভালো লাগছে না এসব।”
ইহাব এগিয়ে এসে বলল,
“যাক অবশেষে কথা বললে রিন পাউডার।”
মানহা বিরক্তি নিয়ে বলল,
“আশ্চর্য রিন পাউডার কে?”
“কে আবার তুমি।”
“আমার একটা সুন্দর নাম আছে। মানহা আফরিন। ডাকলে সেই নামেই ডাকবেন।”
“আমি তো সেই নামেই ডাকছি আফরিইইন ওরফে রিন পাউডার। কঠিন দাগ সরিয়ে কাপড়কে করে নিমেষেই পরিষ্কার।”
রাতে মারওয়ান দুটো ইলিশ মাছ এনেছে নিশাত ছুঁয়েও দেখেনি। নাহওয়ান বাবাকে দেখে প্রথমে ভয় পেলেও মারওয়ানের আদরে আবারও প্রাণবন্ত হয়ে গেছে। বেশি রাত হয়ে যাওয়ার পরেও যখন নিশাতকে মাছ ছুঁতেও দেখল না তখন ছেলেকে নিয়ে ইউটিউব দেখে কোনরকম ইলিশ মাছ কেটে ভেজে তুলে রাখল। ভাগ্যিস এটা ইলিশ মাছ ছিল নয়তো এই মাছ খাওয়ার উপযোগী আর হত না। বাসায় আসার পথে জ্যান্ত লাল টসটসে ইলিশ মাছ দুটো দেখে লোভ সামলাতে পারেনি। সকালের কথা এরমধ্যেই ভুলে গেছে নাহলে রাতে অন্তত ভুলেও ইলিশ নিয়ে বাসায় ঢুকতো না। পকেটে টাকা থাকলে খরচ করতে শরীর শিরশিরায় তার।
এসব ভাবতে ভাবতে গরম গরম মাছ দিয়ে ভাত খেতে বসল। মাছের পেটের একপিস নিল। যেই কামড় দিয়েছে তিতায় মুখ বিদঘুটে রূপ ধারণ করেছে। মাছের পেটে গুতাগুতি করতে গিয়ে নিশ্চয়ই ভিতরে পিত্ত গলিয়ে ফেলেছে। ভালো করে সাফ হয়নি। মারওয়ান কোনরকম ডাল দিয়ে খেয়ে উঠল। এত টাকার এত সাধের মাছ পুরোটাই জ্বলে গেল। নারীরা সংসার কিভাবে সামলায়? সে একটু মাছ কাটতে গিয়েই গড়মিল করে ফেলেছে বাকিগুলো করতে গেলে তো একদিনেই সবকিছু তছনছ করে ফেলত। এজন্যই গুরুজনেরা বলেন,
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪৬
“সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে।”
এসব ভাবতে ভাবতে মারওয়ান ঘুমের দেশে পাড়ি জমাল। হয়তবা কাল আবারও রমণীর গুণের কথা ভুলে গিয়ে নতুন উদ্যমে তাদের ভেঙে দিতে মারওয়ানের মতো পুরুষরা জেগে উঠবে।