ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪৯

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪৯
তাজরীন ফাতিহা

দুর্নিবার এই যাত্রাপথ ঘটায় আকস্মিকতা
জীবন রচে অমরগাঁথা, মন কেন দিশাহারা?
~তাজরীন ফাতিহা
মানবজীবনে মাঝে মধ্যে কিছু অভাবনীয় পরিবর্তনের ঝলক দেখা যায় যা আকস্মিক ভাবে তার চমকপ্রদ উপস্থিতির জানান দেয়। একরাশ সীমাহীন কষ্ট পেরিয়ে দুঃখ ক্লেশ গুলো অন্তরীক্ষের শূন্যগর্ভের ন্যায় অতলে তলিয়ে যায় মুহুর্মুহু। অদৃশ্য ঝলকানির পেরেক গেঁথে মনকে করে আন্দোলিত। নিশাতের ব্যাপারটা কোন পর্যায়ে ফেলা যায় তার পরিধি এখনো করা হয়নি।

বিছানায় শায়িত এক সত্তা। মাথার উপরে সিলিং ফ্যান ঘুরছে বিরামহীন। বালিশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে এলোমেলো। অদূরে জানালার পর্দাগুলো দুলছে। পিটপিট করে চোখ খুলে আশেপাশে নজর বুলালো নিশাত। কেউ নেই রুমে। দীর্ঘক্ষণ চোখ বন্ধ থাকায় মাথা ব্যথা করছে তার। কোথায় ছিল, কি ঘটেছিল এসব স্মৃতিপটে উঁকি দিতেই নিশাত তড়াক শোয়া থেকে উঠে বসল। দ্রুত রুম থেকে বেরুতেই দেখল মারওয়ান রান্নাঘরে কি যেন করছে। নিশাত হুড়মুড় করে মারওয়ানের বাহু ধরে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
“এই আপনি আমার স্কুলে গিয়েছিলেন?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মারওয়ান চা বানাতে গিয়ে চিনির শরবত বানিয়ে ফেলেছে। এটা নিয়েই তার মেজাজ খিটমিট করছিল এখন আবার নিশাতের প্রশ্নে আরও মেজাজ চড়া হলো। রুক্ষ গলায় বলল,
“তোমার স্কুলে আমি যাব কেন? Why? সেখানে আমার কাজ কি”
নিশাত মারওয়ানের শার্টের দুপাশ চেপে ধরে বলল,
“খবরদার মিথ্যা বলবেন না। আমি স্পষ্ট আপনাকে দেখেছি। ওটা আপনিই ছিলেন। আমার সাথে কোনো লুকোচুরি খেলা খেলবেন না বলে দিলাম।
খরখরে গলায় মারওয়ান প্রতিউত্তর করল,

“আশ্চর্য তোমার সাথে কি আমার খেলাধুলার সম্পর্ক? তুমি ফুটবল খেলোয়াড় নাকি ক্রিকেট খেলোয়াড়?”
নিশাত শার্ট আরও শক্ত করে চেপে বলল,
“ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলবেন না। যা বলার সাফ সাফ বলুন। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলে ভীতু আর অপরাধীরা। আপনি কি সেরকম কিছু? একদম হেলা করবেন না বলে দিচ্ছি। মোটেও ভালো হবে না।”
মারওয়ানের শ্লেষাত্মক কণ্ঠ,
“আচ্ছা করলাম না হেলা। হ্যাঁ তোমার স্কুলে আমিই ছিলাম। এবার কি করবে?”
নিশাত আশ্চর্যান্বিত হয়ে কলার ছেড়ে দিল। একবার জেরা করতেই ঘাড়ত্যাড়া লোকের কাছে এমন ফটাফট উত্তর আশা করেনি নিশাত। ধীর কণ্ঠে বলল,

“আপনি পুলিশ?”
মারওয়ান বাঁকা হাসল,
“হ্যাঁ। এবার তোমাকে থানায় ট্রান্সফার করব। একজন আইনের লোকের কলার ধরার অপরাধে, এতদিন মুখে মুখে তর্ক করার কারণে তোমাকে গ্রেফতার করা হলো ফৌজিয়া নিশাত। ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।”
নিশাত জবাব না দিয়ে ঢোক গিলতে লাগল। মারওয়ান এক ভ্রু উঁচিয়ে তার দিকে চেয়ে। নিশাত একটু স্থির হয়ে বলল,

“বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।”
“তো কোরো না। কে বলছে বিশ্বাস করতে?”
মারওয়ানের খাপছাড়া উত্তর। নিশাত একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
“কতদিন হলো এই পেশায় আছেন?
“বহুদিন।”
“আপনি ভাদাইম্মা, আকাইম্মা দেখাতেন আদতে আপনি তা নন তাইতো?”
“জানি না।”
“কখনো বলেননি কেন?”
“আমার ইচ্ছা।”
“আমার সাথে এত গোপনীয়তা কেন?”
“কারণ তুমি বিশ্বাসভাজন নও তাই।”
“বিশ্বাসভাজন কে তাহলে?”
“আমার একান্তজন।”
“আপনার একান্তজন কে?
মারওয়ানের বিরক্ত কণ্ঠ,

“এত প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই। চা বানিয়ে দাও।”
নিশাত জেদি গলায় বলল,
“আমিও চা বানাতে বাধ্য নই। আপনার একান্তজনকে বলুন।”
“ত্যাড়ামি কোরো না ফৌজিয়া নিশাত। একদম জেলে ভরে দেব।”
“দিন। এই সংসারের চেয়ে জেল অত্যাধিক শ্রেয়।”
“ভয় ডর নেই?”
“না।”

“স্বামীর মুখে মুখে তর্ক করা বেত্তমিজ মহিলাদের কাজ। তুমি কি বেত্তমিজ?”
মারওয়ানের গুরুগম্ভীর প্রশ্ন। নিশাত সোজাসাপ্টা বলল,
“আপনাকে স্বামী কে বলল? জালিমদের উচিত জবাব দেয়া ভালো কাজ।”
“স্পর্ধা কত? আমাকে ইনডাইরেক্টলি জালিম বলছো?”
“ইনডাইরেক্টলি বলিনি ডাইরেক্টই বলেছি। অবশ্য আপনার গায়ে লাগলে তো? যেই গন্ডারের চামড়া, বাপরে!”
মারওয়ান ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আজকে মনে হয় বেশি মুখ চলছে? ভুলে যাচ্ছ নাকি আমি কে?”
নিশাত চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে বলল,
“ভুলিনি। আগে তর্ক করতাম না বেকার, ভবঘুরে দেখে। এদের সাথে তর্ক জমিয়ে বিশেষ ফায়দা নেই। তর্ক জমে সেয়ানে সেয়ানে।”

“বলতে চাচ্ছ আগে আমি বুদ্ধিমান ছিলাম না?”
“অবশ্যই না। বুদ্ধিমান পুরুষ কোনোদিন শুয়ে বসে থেকে বউকে ইনকামে পাঠায় না। বুদ্ধিমান বলছি কি প্রকৃত পুরুষ মানুষ কখনো বউয়ের টাকায় চলে না। উল্টো বউকে ঘরের রাণী করে রাখে। ঠিক যেমন ঝিনুক তার মুল্যবান মুক্তা খোলসে সযত্নে রাখে ঠিক তেমন।”
মারওয়ান হামি দিয়ে নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“ও আচ্ছা।”
“যাইহোক আপনি এসব কাজ আমার আড়ালে করতেন তো নাহওয়ানকে রাখতেন কোথায়?”
“কোথায় আবার রাখব, আমার কাছেই থাকত। আর তুমি স্কুলে থাকতে কাজে গিয়েছি আজকেই শুধু। বেশিরভাগ সময় তুমি বাসায় ফিরলে যেতাম।”

“কই আজ তো দেখলাম না। আজকে ছেলেকে কোথায় রেখেছিলেন?”
“ও ঘুমে ছিল। তাই ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছিলাম। ওর ঘুম থেকে উঠতে উঠতে আমি হাজির হয়ে যেতাম।”
কথা শেষ হতেই নাহওয়ানের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। ঘুম ঘুম চোখ ডলতে ডলতে বাচ্চাটা উঠে এসেছে। মাকে সামনে দেখে ডেকে উঠল,
“মা।”
নিশাত এগিয়ে এসে ছেলেকে কোলে নিয়ে গালে ওষ্ঠ চেপে ধরে বলল,
“আমার ছানার ঘুম ভেঙেছে?”
নাহওয়ান নিশাতের ঘাড়ে মাথা ফেলে ঘুম ঘুম গলায় বলল,
“বাংগিচে। সুসু কলব।”
“চলুন চলুন হিস করিয়ে আনি।”
নিশাত ছেলেকে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরুতে নিলেই পিছন থেকে মারওয়ান বলে উঠল,
“মিসেস মারওয়ান এক কাপ মশলাদার চা পেতে পারি?”
সম্বোধনে নিশাতের চলন্ত পাজোড়া থেমে গেল মুহুর্তেই। চেহারায় ফুটে উঠল কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা নাকি প্রশান্তি বোঝা গেল না। বিস্মিত নেত্রে কেবল মাথা নাড়াল।

আজকে মানহার ইয়ার ফাইনাল এক্সাম শুরু হয়েছে। ইহাব মানহার কলেজের সামনে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গেট দিয়ে ঢুকতে বেরুতে প্রায় সকলের চক্ষু তার উপরে পড়ছে। পড়াটাই স্বাভাবিক। স্বয়ং চেয়ারম্যান পুত্রের পদধূলি পড়েছে কলেজ প্রাঙ্গণে এটা তো খুশির সংবাদ। অধ্যক্ষ মহোদয়ের সাথে মোলাকাত করে এসেছে ইহাব। তিনি ইহাবের ব্যাপারে হৃদ্যতা প্রকাশ করেছেন। ইহাব বেশিক্ষণ থাকেনি। পরিকল্পনা করেছে মানহাকে নিয়ে এখান থেকে শ্বশুরবাড়ি যাবে। যেহেতু মানহার ক্যাম্পাসের কাছেই তাদের বাড়ি তাই একবার দেখা দিয়ে আসা দরকার। অনেকদিন কাউকে জ্বালানো হয়না। ইশ মারওয়ানটা যদি থাকত তাহলে একেবারে জমে যেত। ভাবনার মাঝে মানহাকে দৃষ্টিগোচর হলো তার। নিকাব থাকায় মানহার ভাবমূর্তি বোঝা যাচ্ছে না তবে ইহাবের কেন যেন মনে হচ্ছে পরীক্ষা ভালো হয়নি মানহার। মানহা এগিয়ে এসে বলল,

“আপনাকে চলে যেতে বলেছিলাম না?”
“তুমি যেতে বললেই আমি যাব কেন? আমার মর্জি।”
মানহা গম্ভীর স্বরে বলল,
“এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নারীদের দর্শন দিচ্ছেন সেটা বললেই তো হয়। মহিলা কলেজের সামনে আপনার দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কিজন্য? অন্য কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না?”
ইহাব সানগ্লাস খুলে বলল,
“আর ইউ জেলাস?”
“না স্বামীর জন্য জেলাস হব না, হব অন্য বেডার জন্য। যত্তসব সিনেমার ডায়লগ মারাইতে আসে আমার সামনে।”
ইহাব হতবাক হয়ে বলল,

“এসব কি ভাষা! তুমি এমন ভাষা ইউজ করো?”
“কেন এসব ভাষা কি কারো জন্য দলিল করা যে আমি বলতে পারব না? সরুন সামনে থেকে। মটকা গরম থাকলে আমি সব ভাষায় কথা বলি। তাই যথাসম্ভব দুরত্ব বজায় রাখুন যেকোনো সময় মটকা ফেটে যেতে পারে।”
“মটকা ফেটে গেলে ব্রেইনও নিশ্চয়ই ফেটে যাবে? ভালোই হবে, এরকম আনরোমান্টিক ব্রেইনের প্রয়োজন নেই।”
মানহা রাগে কথা বলতে ভুলে গেল। সিরিয়াস সময়ে এমন ইতরামি কার ভালো লাগে? খিটমিটে মেজাজে বলল,
“আপনি ভালো হবেন না?”
ইহাব বাইকে বসে বলল,
“আমি খারাপ হলাম কবে?”
“আমি সিরিয়াস কথা বলছি।”
“আমিও তো সিরিয়াসলি বলছি। কেন তোমার মনে হচ্ছে না? কাছে আসো মটকা ফাটিয়ে দেই।

ছু মন্তর ছু
কালি কুত্তার গু
লাক ভেলকি লাক
দ্রুত মটকা ফাট।”
মানহা আর এক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে না থেকে রাগান্বিত হয়ে হেঁটে যেতে লাগল। পথিমধ্যে তার ক্লাসের এক মেয়ের কথায় থেমে যেতে বাধ্য হলো।
“চেয়ারম্যান বাড়ির বউ হয়ে ভাবের ঠেলায় পা মাটিতে পড়ে না। না চাইতেও পেয়ে গেছে তো তাই মূল্য দেয়না। আমার জামাই এত্ত কেয়ারিং, মজার হলে আমি তো মাথায় করে রাখতাম। এইজন্যই ছোট বাড়ির মেয়ে বড় বাড়িতে বউ করা উচিত না। বেশি পেয়ে এরা দাপটে পা ফেলে না। ঢং দেখলে বাঁচি না।”
ইহাবের কর্ণকুহরে কথাটা পৌঁছাতেই চোখ মুখ ক্রোধে লাল হয়ে উঠল। তৎক্ষণাৎ সেদিকে ঘুরে বলল,
“বাঁচতে বলেছে কে? মরে যান। বিশ্বাস করুন, মানহার ঢংয়ে যদি আপনি মরেন তাহলে আমি নিজ দায়িত্বে ওকে আরও ঢং শেখাব। ঢংয়ের বদৌলতে আপনাদের মতো দু চারটা মরলে তার আরও সওয়াব হবে। আমি চেয়ারম্যান পুত্র ইহাব ভুঁইয়া বলছি, সমাজ থেকে এরকম বিষাক্ত কীট দূর করার দায়ে মিসেস আফরিনকে পুরস্কারে ভূষিত করব। মাইন্ড ইট।”

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪৮

কথা শেষ করে মানহার দিকে একপল চেয়ে বলল,
“রাস্তার কুকুর ঘেউ ঘেউ করবেই। এতে দাঁড়িয়ে না থেকে সামনে এগিয়ে যেতে হয়।”
কথা শেষ করে হাত মুঠো করে একনজর মেয়েটির পানে চেয়ে মানহার হাত ধরে চলে গেল। সহপাঠী মেয়েটি চরম অপমানিত হলো। ভরা রাস্তায় এতগুলো মানুষের সামনে এমন অপমান ও কুকুর সম্বোধনে লজ্জাও পেল বেশ। ভবিষ্যতে মানহার সাথে পাঙ্গা দেয়ার আগে আজকের কথা অবশ্যই মনে পড়বে তার। সাপের লেজে পাড়া দিয়েছে ছোবল তো খেতেই হবে।

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪৯ (২)