ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫০

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫০
তাজরীন ফাতিহা

নিশীথের আঁধারে নিমজ্জিত চারিপাশ। নিশাচর বাদে সব প্রাণীরাই নিজ নিজ বাসস্থানে অবস্থান করছে এই নিস্তব্দ রজনীতে। নিশাত রাগে দুঃখে মারওয়ানের সাথে না ঘুমিয়ে মানহার সাথে ঘুমাতে চলে এসেছে। অবশ্য মানহারা না থাকলে সে এই রুমেই ঘুমাতো। এত বড় ধোঁকাবাজির পর কোনমতেই ওই লোকের মুখ দেখবে না সে। এমন বাটপার লোক জিন্দেগীতে দেখেনি সে। কয়টা টাকা নিজ থেকে দিতে চায়না। কঞ্জুস কোথাকার। মানহা ইহাবকে বলল,

“আজকে ভাইয়ার সাথে ঘুমান কষ্ট করে। ভাবি যেহেতু ঘুমাতে চাচ্ছে কিভাবে না করি?”
ইহাব ঠোঁট উল্টে বলল মানহার ওড়না হাতে পেঁচিয়ে বলল,
“বউ ছাড়া আমার ঘুম আসবে না।”
“আরে একদিনেরই তো ব্যাপার। এমন বাচ্চাদের মতো করছেন কেন? স্বাভাবিক হন।”
ইহাব এবার স্বাভাবিক হয়ে বলল,
“তোমার ভাই যে মানুষ আমাকে রুমে ঢুকতে দেয় কিনা সন্দেহ।”
“দেবে যান।”
“ধুর আজকেই জামাই বউয়ের ঝগড়া লাগতে হলো।”
“আপনাকে কে বলেছে ভাইয়া, ভাবির ঝগড়া লেগেছে? আজাইরা কথা বলবেন না। সবসময় আমাকে পায়না তাই আজকে ঘুমাতে চেয়েছে।”
ইহাব মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ছাড়তো বেকুবি কথা। ঝগড়া ছাড়া কোনো জামাই বউ আলাদা থাকতে পারে নাকি? তুমি কী তাদের ভেতরের খবর জেনে বসে আছ? দেখ গিয়ে বিরাট ফাটাফাটি হয়েছে।”
“ফাটাফাটি না হোক কাটাকাটি হোক। আপনার কী?”
“আমার কী মানে? আমারই তো সব। তোমার ভাইয়ের তোপের মুখে এখন আমি পড়ব। দেইখো রুমে ঢুকলে ষাঁড়ের মতো কেমন কোঁৎ কোঁৎ করে।
মানহা কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল,
“উফ এতবেশি কথা বলে এই লোকটা।”
তারপর ইহাবের হাত টেনে মারওয়ানের রুমের সামনে টোকা দিল। মারওয়ান ভিতর থেকে জবাব দিল,

“কে?”
“ভাইয়া আমি। আসব”
“আয়।”
মানহা ইহাবের হাত টেনে ভিতরে ঢুকল। ইহাব বারবার না করছিল তবে মানহা শুনলে তো? ভিতরে ঢুকে দেখল মারওয়ান ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। মানহাকে ইহাবসহ দেখে কপাল গোটালো। মানহা ভাইয়ের অভিব্যক্তি বুঝে বলল,
“আসলে ভাইয়া আজকে ভাবি আমার সাথে ঘুমিয়েছে তো তাই উনি তোমার সাথে ঘুমাবে।”
মারওয়ান কপাল আরও কুঁচকে বলল,
“তোর ভাবি আবার ওই রুমে ঘুমিয়েছে কেন?”
“তা তো জানি না। বলল ওখানে থাকবে আজ।”
মারওয়ান বালিশে মাথা দিয়ে বলল,

“এত নাটক পারে এরা। তোর পাশেরটাকে রান্নাঘরে বিছানা পেতে দে ওখানে ঘুমাক।”
ইহাব চোখ বড় বড় করে তাকাল। মানহা অবুঝের মতো বলল,
“কী বললে ভাইয়া?”
“আমি কাউকে সাথে নিয়ে ঘুমাতে পারিনা।”
মানহা মাথা নিচু করে মন খারাপ করে ফেলল। বোনের মন খারাপ বুঝতে পেরে মারওয়ান বলল,
“আচ্ছা এক কোনায় ঘুমাতে পারলে ঘুমাক। শর্ত হলো, আমার গায়ে হাত, পা লাগানো যাবে না। যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে যদি ঘুমাতে পারে তাহলে ওটাকে ঘুমাতে বলিস। তবে এতটুকু জায়গায় হবে বলে মনে হয়না। যেই হাতির মতো শরীর আমার ছাওয়ের উপর হাত পা উঠিয়ে দেয় কিনা কে জানে!”
ইহাব কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মানহা বলল,

“নাহওয়ানকে নিয়ে যাই। তোমরা রিল্যাক্সে ঘুমাও।”
মারওয়ান না চাইতেও নাহওয়ানকে নিয়ে যাওয়ার পারমিশন দিল। এত বড় বড় দুই তাগড়া পুরুষের মাঝে বাচ্চাটা চ্যাপ্টা হয়ে গেলে খুনাখুনি হয়ে যাবে। মানহা নাহওয়ানকে কে নিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলে ইহাব ঘুমন্ত বাচ্চাটার গালে ঠেসে চুমু খেল। পাশেই মানহার গালেও চুমু বসিয়ে দিল। মানহা চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই ইহাব বলল,
“এভাবে চোখ উল্টানোর কিছু হয়নি তোমার ভাই দেখেনি। আমার পাওনা দিয়ে ভাগো।”
ইহাব কথা শেষ করে গাল এগিয়ে দিল। মানহা ইহাবের গালের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

“আপনার পাওনা ঘোড়ার ডিম,
হা করে খান মুরগির ডিম।”
বলে নাহওয়ানকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। ইহাব মিনমিন করে বলল,
“এর শোধ আমি নেব মিসেস। আমার দেখানো পথে আমার সাথে চিটিংবাজি।”
মারওয়ান ইতিমধ্যে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে খাটের অর্ধেকের বেশি দখল করে শুয়ে পড়েছে। ইহাব বাঁকা হেঁসে মারওয়ানের শরীরের সাথে ঘেঁষে হাত পা ছড়িয়ে চোখ বুজল। মারওয়ান বিরক্তিতে দাঁতে দাঁত পিষল। ইহাবকে ঝাড়া মেরে অপরপাশ ফিরে শুলো। বেশ খানিকক্ষণ যেতেই মারওয়ানের ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেই শরীরের উপর হাত, পা উঠে যাওয়ায় চোখ কুঁচকে সরিয়ে দিল। ঘুমের মধ্যে হাত, পা উঠিয়ে দিলে মারাত্মক বিরক্ত হয় সে। শেষে শরীর হাতানো শুরু করায় মারওয়ান ছিটকে সরে এক লাথি দিয়ে ইহাবকে খাটের নিচে ফেলে দিল। চিল্লিয়ে বলল,
“বউ রেখে ঢলাঢলি করতে এসেছে বউয়ের ভাইয়ের সাথে। জায়গা বরাবর এমন লাত্থি মারব বংশের মুখ আর দেখা লাগবে না। বেডা শরীর আর বেডি শরীর বুঝিস না বা*ল।”

ইহাব কোমর ধরে থতমত মুখ করে নিচে বসে আছে। মারওয়ানকে জ্বালাতে ইচ্ছে করেই মূলত এমন করছিল। মারওয়ান লাত্থি মেরে বসবে বোঝেনি। সে নিচে বসে মুখ চেপে হাসছে। যাক রাগাতে পেরেছে। কোনো মানুষকে রাগাতে এত মজা ইহাব আগে জানলে মারওয়ানকে পকেটের মধ্যে নিয়ে ঘুরত। যখনই মন খারাপ হতো পকেট থেকে বার করে টোকা দিয়ে রাগাতো আর সে খুশি হতো। ইহাব আবারও উঠে বিছানায় আসতে নিলে মারওয়ান সতর্কবার্তা জারি করে দিল,

“দূরত্ব বজায় রেখে না ঘুমালে এবার লাত্থি দিয়ে বাসা থেকে বার করব। এসব ঢলাঢলি, ঘেষাঘেষি অন্য জায়গায় করবি। আমার সঙ্গে ফার্দার এসব নষ্টামি করতে আসলে ব্যাপারটা মোটেও ভালো হবে না বলে রাখলাম।”
ইহাব ঠোঁট টিপে বিছানায় পিঠ ছোঁয়ালো। কিছুক্ষণের মধ্যে মারওয়ান ঘুমের দেশে পাড়ি দিলে ইহাব আস্তে আস্তে মারওয়ানের গায়ে হাত, পা উঠিয়ে গালে আলতো করে গাল ঠেকিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“I love you, Number One.”
মারওয়ান কানের কাছে সুড়সুড়ি অনুভব করায় ঘুমের মধ্যে বিরক্তিসূচক শব্দ করে গাল, কান ডলে অস্ফুট স্বরে বলল,
“বা**ল।”
ইহাব খুবই ধীরস্থিরভাবে হাত, পা মারওয়ানের শরীরের উপর থেকে সরিয়ে নিল পাছে তার ঘুম ভেঙে না যায়। তারপর মারওয়ানের কুঁচকে রাখা মুখের দিকে তাকিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে বলল,

“রাগ করিস কিউ
আই লাভ ইউ।”
কথা শেষ হতে না হতেই তার গাল বরাবর জোরসে থাপ্পড় পড়ল। কানে তব্দা লাগানোর জোগাড়। মারওয়ান চোখ খুলে রাগান্বিত দৃষ্টিতে ইহাবের দিকে চাইল। উঠে বসে ইহাবের বালিশ নিচে ফিক্কা মেরে বলল,
“নিচে ঘুমা। তোর চরিত্র নিয়ে সংশয়ে আছি। এমন গা ঘেষাঘেষি তো নষ্টরাও করেনা। তোরে আমার বোন সহ্য করে কেমনে?”

ইহাব আস্তে ধীরে উঠে বসে মারওয়ানের দিকে চাইল। মারওয়ান নিচে ঘুমাতে তাড়া দিল। ইহাব ধীরে ধীরে মারওয়ানকে ক্রস করে নিচে নামতে নামতে হঠাৎ মারওয়ানের দিকে এগিয়ে আসতে নিলে মারওয়ান তার মুখের সামনে পা উঁচিয়ে ধরল। ইহাব মনে মনে হেঁসে কুটিকুটি। মারওয়ানকে নাস্তানাবুদ করতে পেরে দারুন আনন্দ লাগছে। ইহাব নিচে শুতেই মারওয়ান তাকে পিঠ করে বালিশে মাথা রাখল। অমনি ইহাব উঠে মারওয়ানের গালে ঠেসে চুমু বসিয়ে দিল। মারওয়ান চিল্লিয়ে উঠে বলল,
“ভুঁইয়ার বাচ্চা। বের হ রুম থেকে, এক্ষুণি বেরো।”
ইহাব নিচে শুয়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মারওয়ান দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বালিশ দিয়ে মুখ ঢেকে বলল,

“বা**লডা এসেই ঘুমের বারোটা বাজাচ্ছে।”
ইহাব মাথার নিচে দুই হাত ভাঁজ করে গুনগুন করে গেয়ে উঠল,
“আমার একখান বন্ধু ছিল
জানলো না তো কেউ
এই খানে এক বন্ধু ছিল
জানলো না তো কেউ।
বন্ধু রাগ করেছে, গোসসা করেছে
মনে মনে ঠিক আমায় মনে রেখেছে।”

“মনের কিঞ্চিৎ পরিমাণ জায়গাতেও তুই নেই। রাগ, গোসসা আপনজনদের সাথে করে বাট ইয়্যু আর নাথিং টু মি। Whether you live or die, it doesn’t matter to me.”
মারওয়ানের কথা শেষ হতেই পুরো রুম জুড়ে পিনপন নীরবতা নেমে আসল।
পরদিন সকাল হতেই ইহাব মানহা চলে গেল। মানহা অবশ্য একদিন থাকতে চেয়েছিল তবে ইহাবের কাজের অজুহাতে বেচারি যেতে বাধ্য হয়েছে।

ইরা আজকে শাড়ি পড়ে জিনানের সামনে ঘুরঘুর করছে। জিনানের এদিকে একদমই মনোযোগ নেই। সে এক ধ্যানে ল্যাপটপের দিকে চেয়ে। ইরা জিনানের পাত্তা না পেয়ে চুড়ির আওয়াজ করতে লাগল জোরে জোরে। কানের কাছে চুড়ির রিনঝিন আওয়াজে কাজে ব্যাঘাত ঘটল জিনানের। বিরক্তিসূচক শব্দ করে শুধালো,
“তোমার সমস্যা কী ইরা?”
ইরা ঠোঁট উল্টে বলল,
“সেজেছি তুমি দেখছ না কেন?”
জিনান ল্যাপটপ শাটডাউন করে বলল,
“আশ্চর্য তোমার মনে হচ্ছে আমি রঙ ঢঙের মুডে আছি? অলওয়েজ তুমি কাজের সময় ডিস্টার্ব করো কেন?”
ইরা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল,
“আমার থেকেও তোমার কাজটা ইম্পর্ট্যান্ট নীলাভ্র?”
“ইয়েস। আমি পুরো দেশের জন্য কাজ করি। ডু ইয়্যু নো এই দেশে কত কোটি মানুষ আছে? প্রত্যেকটা মানুষের নিরাপত্তাসহ আরও অনেক কিছু আমাদের নজরদারিতে রাখতে হয়। এখন যদি সিনেমার ডায়লগ দিয়ে বলি কোটি কোটি মানুষ চুলোয় যাক তুমিই আমার জীবনে সবকিছু তাহলে কাজকর্ম ফেলে রেখে আসো তোমার সাথে রোমান্স করি।”

ইরা ছলছল নেত্রে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। জিনান পাত্তা দিল না। একটু পর আবারও আসবে কোনো বাহানা নিয়ে। মেয়েটা পাগল কিসিমের, একটা না একটা নতুন কান্ড করবে তার সামনে। বেশি পাত্তা দিলে ঘাড়ে উঠে নাচা শুরু করে। তাই মাঝে মধ্যে রুড ব্যবহার করতেই হয়।
ঘন্টা খানিক বাদেও যখন ইরার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না জিনানের একটু টনক নড়ল। ল্যাপটপ কোল থেকে নামিয়ে পাশের রুমে উঁকি দিল। কেউ নেই। রাগ টাগ করে আবার চলে গেছে নাকি? যেতেও পারে যেই পাগল এই মেয়ে। জিনান সব রুম তল্লাশি করে বারান্দার দিকে এগোতেই শুনল,
“শোনো পাপা, বিয়ে টিয়েতে কিন্তু আমি রাজি ছিলাম না। শুধুমাত্র তোমার কারণে তোমার ভাইয়ের ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি নাহলে ওই রোবট কিসিমের বিদেশি মালকে ভূতের মাও বিয়ে করত না। সারাদিন কাজ কাজ আর কাজ, যত্তসব। রাখো তো ফোন।”

বলেই ফোন কেটে দিল। জিনান টাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল,
“ও ভূতের মায়ের আত্মীয়, এক কাপ কফি বানিয়ে দাও।”
ইরা ফোনের দিকে তাকিয়ে মুখের উপর বলল,
“পারব না। নিজে বানিয়ে খাও।”
“নিজে বানাতে পারলে কি তোমায় বলি ভূতের মায়ের সখী?
ইরা এতক্ষণ খেয়াল করেনি এখন ফট করে মাথা তুলে বলল,
“কী বলে সম্বোধন করলে তুমি?”
“ভূতের মায়ের সখী।”
ইরা জিদ নিয়ে বলল,
“ভূতের মায়ের সখী আবার কেমন নাম?”
“পছন্দ হয়নি? আচ্ছা যাও ভূতের মায়ের আত্মীয়ই সই।”

ইরা এগিয়ে এসে বলল,
“ভূতের মায়ের আত্মীয় আবার কী?”
জিনান ইরার মুখের সামনে মুখ এগিয়ে বলল,
“তার আমি কী জানি। তুমিই না ভালো জানো।”
ইরা মাথা একটু পিছনে হেলে বলল,
“আমি ভালো জানি মানে? হেঁয়ালি করে কথা বলবে না। হেঁয়ালি আমার একদম পছন্দ না।”
“একটু আগে কে জানি ফোনে বলছিল আমাকে সে বিয়ে না করলে ভূতের মাও নাকি বিয়ে করতো না। তো কথা হলো ভূতের মাও যে বিয়ে করতো না সেটা সে কিভাবে জানল? নিশ্চয়ই সে ভূতের ক্লোজ কেউ হবে। লাইক আত্মীয়, সখী টাইপ। অ্যাম আই রাইট?”
ইরা পা দাপিয়ে জিনানকে ধাক্কা দিয়ে বারান্দা থেকে বেরিয়ে গেল। জিনান পিছন থেকে জোরে বলল,
“আস্তে হাটো। টাইলস ভাঙলে বাড়িওয়ালা এসে ঘাড় মটকাবে তখন তোমার আত্মীয়, সখী এরা কিচ্ছু করতে পারবে না।”

“ডিল্যুশনাল ডিজঅর্ডার (Delusional Disorder) এক ধরনের মানসিক ব্যাধি। যেখানে মানুষ অন্যদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট একটা ভ্রান্ত ধারণা পুষে রাখে অথচ তার বাকি মানসিক ক্রিয়াকালাপ মোটামুটি স্বাভাবিক থাকে। মিসেস ভুঁইয়ার ব্যাপারটা ঠিক তেমনই। তিনি মনে মনে ধারণা করে রেখেছেন আপনি কিংবা তার বউমা তাকে মারতে চান কিন্তু আদতে ব্যাপারটা তেমন নয়।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া কপালে দুই আঙুল ঠেকিয়ে বললেন,
“এর চিকিৎসা আছে কোনো?”
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা.ফজলে কবীর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
“চিকিৎসা তো অবশ্যই আছে তবে সেটা দীর্ঘমেয়াদী। পরিবারের প্রত্যেকে যদি বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করে, সাপোর্ট দেয় তবে দ্রুতই রিকভারি করার চান্স আছে। যেহেতু তার মেডিকেল হিস্ট্রি তেমন ভালো নয় সেহেতু একটু হলেও বেগ পোহাতে হবে।”

ঠিক তখনই ইহাব মানহা চেয়ারম্যান বাড়িতে প্রবেশ করল। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া তাদের দেখে একটু বিব্রত হলেন। ইহাব তাদের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে। মানহাকে ইশারা দিয়ে উপরে যেতে বলল। মানহা ইহাবের কথা মতো উপরে চলে গেল। ইহাব সোফায় বসে শুধাল,
“কিসের বেগ পোহানোর কথা হচ্ছে?”
ডাক্তার ফজলে কবীর সবকিছু খুলে বললেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া কিছু বলতে চাইলে ইহাব হাত দিয়ে থামিয়ে বলল,
“একটা কথাও বলবে না পাপা। মমের রোগ সম্পর্কে এতদিন আমাকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করোনি? কেন এত লুকোচুরি পাপা? মমের সঙ্গে আমি না জেনে কত খারাপ আচরণ করেছি অথচ বুঝতেও চাইনি আমার এত ভালো আম্মু হঠাৎ করে এমন হয়ে গেল কেন? সন্তান হওয়ার কোনো যোগ্যতাই আমার নেই।”
বলেই মুখে দুই হাত ঠেকিয়ে রাখল। হাত সরাতেই ইমতিয়াজ ভুঁইয়া দেখলেন চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। ইহাব খানিকক্ষণ ধাতস্থ হয়ে বলল,

“আংকেল আমাকে এই রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। এটা কেন হয়? স্পেসিফিক কোনো রিজন আছে কী?”
ডা. ফজলে কবীর বলেন,
“মস্তিষ্কের ডোপামিন নামক একধরনের নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্য নষ্ট হলে এসব বিভ্রান্তি বা ডেলিউশন তৈরি হয়। তবে অতিরিক্ত মানসিক চাপ, দীর্ঘদিনের উদ্বেগ বা বড় কোনো আঘাত (ট্রমা) থেকেও এমন সমস্যা শুরু হতে পারে। তোমার মায়ের সম্ভবত অতীতের কোনো ট্রমা এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের জন্য দায়ী যা বর্তমানে ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে।”
ইহাব হাঁটুর উপর কনুইয়ের ভর দিয়ে মাথা নিচু করে সবকিছু শুনে গেল। ডাক্তার চলে গেলে ইহাব মাথা নিচু রেখেই বলল,
“সবই কর্মফল। কারো উপরে আঙুল তুললে বাকি চারটা আঙুল যে নিজের দিকেই তাক হয় ভুলে গিয়েছিলাম। আমি এত খারাপ কেন পাপা?”
ইহাব ভেঙে পড়ল। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া ছেলেকে আগলে নিলেন। তার চেহারায় অবসাদ, ক্লান্তি, চিন্তা কিংবা অতীতের কোনো পাপের প্রায়শ্চিত্তের মূর্ছনা। দেরি হয়ে যায়নি তো আবার?

নিশাত ঘরের কিছু দরকারি জিনিস কিনতে মার্কেটে এসেছে। কিছু প্লেট, বাটি কিনবে। ছেলেকে মারওয়ানের কাছে রেখে এসেছে। বেশ কয়েকটি দোকান ঘুরে দরকারি জিনিসপাতি কিনে বের হতে নিলে মারওয়ানকে সামনের ‘Starlight Cafe’ তে ঢুকতে দেখল। নিশাত ভ্রু কুঁচকে মনে মনে বলল,
“আমাকে দিতে বললে এক টাকাও বের হয়না আর এখানে তিনি কফিশপে কফি খেতে এসেছেন। যেই আমি বেরিয়ে এসেছি অমনি ছেলেকে নিয়ে বাইরে চলে এসেছে। দাঁড়াও মজা দেখাচ্ছি। আজকে টাকা না খসিয়ে ছাড়ছি না বাছাধন।”
নিশাত ব্যাগ থেকে ফোন বের করে মারওয়ানের নম্বরে ডায়াল করল। কয়েকবার বেজে গেল কেউ ধরল না। বেশ কয়েকবার অনবরত ফোন দিতেই মারওয়ান ধরল,

“হ্যালো।”
কণ্ঠটা কেমন ঘুম ঘুম শোনালো। নিশাত মারওয়ানের ভন্ডামি বুঝে গেল। ধীর গলায় বলল,
“আসসালামু আলাইকুম। আপনি কোথায়?”
মারওয়ান ওপাশ থেকে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“কোথায় মানে? ফালতু প্রশ্ন করতে ফোন করেছ?”
“আরে বলুন কোথায়?”
মারওয়ান গম্ভীর গলায় শুধাল,
“বাসায় ছাড়া আর কোথায় হবো?”
নিশাত মারওয়ান অভিনয় করছে বুঝতে পেরে ঠোঁট টিপে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে, রাখি।”

বলেই ফোন কেটে দিল। মারওয়ান বিরক্তি নিয়ে ফোন সরিয়ে রাখল। নিশাত ক্যাফেতে ঢুকে দেখল মারওয়ান কোনার দিকের একটা টেবিলে সেদিনের মতো পোশাক আর কালো চশমা পড়ে বসে আছে। মাস্ক নামিয়ে কফি খাচ্ছে বিধায় চেহারাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নিশাত ছেলেকে আশেপাশে দেখতে পেল না। চিন্তিত হলো। বাচ্চাটাকে রেখে এসেছে নাকি? সে দ্রুত সেই টেবিলের সামনে গিয়ে বলল,
“এটা আপনার বাসা তাই না? ছেলে কই?”
মারওয়ান চোখ তুলে চাইল তবে প্রতিউত্তর করল না। নিশাতকে আগা গোড়া পর্যবেক্ষণ করল। কেমন গলায় যেন ডাকল,
“ফৌজিয়া নিশাত।”

নিশাতের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। গলাটা কেমন অদ্ভুত শোনাল। নিশাত বসে বলল,
“এভাবে কথা বলে লাভ নেই। আমি ভয় পাব ভেবেছেন? সেদিনও এভাবে কথা বলে অজ্ঞান করে ফেলেছিলেন তবে আজকে আর সেই ভুল করছি না মিস্টার। আপনার অফিস টাইম চলছে নাকি? নাহওয়ান কই? আজকেও ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছেন?”

মারওয়ান বাঁকা হেঁসে তাকালো। নিশাত কিছুক্ষণ একা একা বকবক করে হালকা নিকাব উঠিয়ে কফি খেল। মারওয়ানকে দ্রুত ওঠার তাগাদা দিল। মারওয়ান কফি শেষ করে বিল দিল। নিশাতের দুই হাত ভর্তি জিনিস এখন মারওয়ানের হাতে। ছেলের চিন্তায় নিশাতের আশেপাশে ধ্যান কম। দ্রুত বাসায় যাওয়ার তাগাদা তার মধ্যে। নিশাত আর মারওয়ান রিকশার সামনে আসতেই মারওয়ানের কল আসায় সে নিশাতকে রিকশায় তুলে দিল। নিশাত হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাল।

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪৯ (২)

বাসায় ফিরতেই নিশাত খেয়াল করল দরজায় তালা দেয়া নেই। তারমানে ভেতরে কেউ আছে? মারওয়ান এত তাড়াতাড়ি এসে পড়েছে নাকি কাউকে ছেলের কাছে রেখে গিয়েছে? সে চিন্তিত হয়ে নক করতেই গেট খুলে গেল। নিশাত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সামনে তাকিয়ে রইল।

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫১+৫২