ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫৪
তাজরীন ফাতিহা
১৫ই মাঘ, ১৪১৬ বঙ্গাব্দ
শীতের প্রায় শেষ। চারপাশ কুয়াশার চাদরে আচ্ছাদিত। ভোরের এই সময়টায় সূর্য মামার উপস্থিতি একেবারেই নগণ্য। কনকনে ঠান্ডায় হাত, পা অবশ হওয়ার দশা। সারি সারি পত্রবিন্ত বৃক্ষেও জমেছে শিশির বিন্দু। মাটির কাঁচা রাস্তায় হেঁটে চলেছে দুজন তাগড়া যুবক। গলায় মাফলার প্যাঁচানো, হাতে ও পায়ে মোজা, জিন্সের প্যান্টের সাথে লেদারের জ্যাকেট পরনে। একজন প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে অপরজনের কথা শুনে হেঁটে চলছে অপরজন হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিছু বলে চলছে এক নাগাড়ে। একজনের চোখে মুখে উদ্বেগ, অপরজন একেবারেই নির্লিপ্ত।
“আচ্ছা নম্বর ওয়ান, তোর লোকটাকে সন্দেহ হচ্ছেনা?”
মারওয়ান অদূরে তাকিয়ে বলল,
“আপাতত হচ্ছে না। দেখি সামনে হয় কিনা।”
ইহাব মাফলার ভালো করে গলায় পেঁচিয়ে বলল,
“আমার যথেষ্ট সন্দেহ হয়। শ্লার ব্যাটা ঢাকা থেকে এখান পর্যন্ত চলে এসেছে।”
“হতে পারে এটা তার গ্রামের বাড়ি।”
মারওয়ানের নির্লিপ্ত উত্তর। ইহাব মুখ কুঁচকে বলল,
“নিকুচি করি তার বাড়ির। শ্লা এক নম্বরের ভন্ড।”
“হুম, হতে পারে আবার নাও পারে।”
ইহাব মারওয়ানের গলা এক হাতে পেঁচিয়ে বলল,
“চল রফিক মামার বিখ্যাত গরম গরম মাটির ভাঁড়ে চা খেয়ে আসি।”
মারওয়ান ইহাবের পেটে ফিরতি কনুই দিয়ে গুতো মেরে বলল,
“লেটস গো।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
দুই বন্ধু এগিয়ে চলল সামনে। রফিক মামার দোকানে এসেই দেখল ভিড় লেগে আছে। একটা টেবিল দখল করে আছে হাসান, আসিম, মুহিব, পল্লব আর সাব্বির। ওরা দুজন সেদিকে এগিয়ে যেতেই উল্লাসে ফেটে পড়ল পুরো দোকান। বহুদিন পর কাছের বন্ধুদের দেখলে মনের মধ্যে একধরনের উদ্দীপনা কাজ করে। তারাও ব্যতিক্রম নয়। সবাই একে একে ঝাপটে ধরল দুই বন্ধুকে। শিক্ষাজীবনে মারওয়ানের কলেজ পর্যন্ত আর ইহাবের স্কুল পর্যন্ত সহপাঠী ছিল তারা। বন্ধুদের মধ্যে কেউ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ রাজশাহীতে আবার কেউ স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে।
ইহাব, মারওয়ান উভয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সে অধ্যয়নরত।
সব বন্ধুদের মধ্যে তারছিঁড়া একমাত্র মারওয়ানই। কারণ সে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) কিংবা মেডিকেলে চান্স পেয়েও সেদিকে আগায়নি। ইহাবের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স নিয়ে পড়ছে। চাইলে একজন ইঞ্জিনিয়ার ও ডাক্তার হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতেই পারত কিন্তু উলটাপালটা যুক্তিতে মারওয়ানের জুড়ি মেলা ভার। যেখানে ইঞ্জিনিয়ার ও ডাক্তার হতে দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী মুখিয়ে থাকে সেখানে মারওয়ানের মুখ ঘুরিয়ে ফেলাটা পিতা মাহাবুব আলমকে ভীষণ পীড়িত করেছিল। যখন পুত্রকে এই অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড করতে দেখেছিলেন তখন প্রশ্ন করেছিলেন,
“এত চমৎকার সুযোগ পায়ে ঠেলে দিচ্ছ কেন? মানুষ সুযোগ পায়না আর তুমি সুযোগ পেয়েও পা দিয়ে মাড়িয়ে ফেলছ এটার রিজন কী?”
মারওয়ান শান্ত স্বরে বলেছিল,
“দেখ বাবা, ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা ডাক্তারি কোনোটাই হেলাফেলার সাবজেক্ট নয়। বহু সাধনা করে একজন যোগ্য ইঞ্জিনিয়ার অথবা ডাক্তার হয়ে বেরুতে হয়। সেই ধৈর্য আমার নেই। পড়ালেখা আমার কাছে স্রেফ একটা এক্সপেরিমেন্ট। এটা করে আমাকে বড় বড় জায়গাতেই যেতে হবে এটার কোন ভিত্তি নেই। জীবনটা আমার কাছে মুক্ত বিহঙ্গের মতো। যখন ইচ্ছে উড়ো আবার যখন ইচ্ছে থেমে যাও।”
পুত্রের এমন ছন্নছাড়া যুক্তি শুনে মাহাবুব আলম ফের জিজ্ঞেস করেছিলেন,
“এই সিদ্ধান্ত কি চেয়ারম্যানের নাতির জন্য নিলে তুমি?”
মারওয়ান কোনো জবাব না দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিল। হয়তোবা এই চরম সত্য কথাটা বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বলার সাহস তার ফুরিয়েছিল। বস্তুত মারওয়ান ছোটবেলা থেকেই কিছুটা উদাসীন চরিত্রের। ভবিষ্যৎ নিয়ে তার চিন্তাভাবনা একেবারেই গৌণ। নিজের মর্জি মাফিক চলাফেরা করতেই সাচ্ছন্দ্যবোধ করে সে। তবে প্রচণ্ড জেদি মারওয়ান।
দশম শ্রেণীতে থাকাকালীন একজন শিক্ষক তার এসব হেঁয়ালিপনার কারণে যখন মাহাবুব আলমকে ডেকে এনে ভরা টিচার্স রুমে মারওয়ানকে সহ অপমান করেছিলেন তখন নিজের শিক্ষক সমতুল্য পিতার অপমানে তার আঁতে ঘা লেগেছিল। এটাও বুঝেছিল উদ্দেশ্যপ্রণদিতভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে তাকে। সারাজীবন শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় নিয়োজিত থেকেও পুত্রের কারণে কটাক্ষের শিকার হয়ে মাহাবুব আলম বিছানাগামী হয়েছিলেন। সেই অপমানের জবাব স্বরুপ এসএসসি ও এইচএসসিতে সম্পূর্ণ চট্টগ্রাম বোর্ডে নিজের অবস্থান করে উক্ত শিক্ষকের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছিল মারওয়ান আজাদ।
চাঁদপুরের সবচেয়ে বড় এসএসসি ও এইচএসসি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সেই শিক্ষক যখন মাহাবুব আলমকে ডেকে এনে খাতির যত্ন করছিল মারওয়ানের তখন পৈশাচিক আনন্দ অনুভূত হয়েছিল। ক্রেস্ট, মেডেল, ফুলের তোড়া পেয়ে সেই শিক্ষকের সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল,
“নিন, ধরুন।”
শিক্ষক প্রশ্নবোধক চাহনিতে চেয়ে ছিল। মারওয়ান হেঁসে বলেছিল,
“ধরুন স্যার?”
“আমি ধরব কেন?”
মারওয়ান পাগলের মতো হেঁসে বলেছিল,
“ওমা সেকি, ধরবেন না কেন? আপনার কাছে প্রাইভেট পড়তাম না বলে সেদিন ওই মাঝ বয়সী শ্রদ্ধেয় মানুষটাকে অপমানিত হতে হয়েছিল। আপনি ধরবেন না তো কে ধরবে?”
“আজাদ!!”
শিক্ষকের ধমকের বিপরীতে মারওয়ান শুধু লাগামহীন ভাবে হেঁসেছিল। তারপর হাসি থামিয়ে বলেছিল,
“প্রাইভেট না পড়লেই একজন ছাত্র আপনাদের চক্ষুশূল হয়ে যায় কেন? যারা প্রাইভেট পড়ে তাদের এক্সট্রা সুবিধা দেন আর যারা পড়ে না তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন। যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে অপমান, অপদস্ত করেও ক্ষান্ত হননা পিতামাতাকে ডেকে এনেও অপমান, কটাক্ষ করেন। আইনস্টাইনের বংশধর ডাকতেন না আমাকে? স্যার আলবার্ট আইনস্টাইনকেও কিন্তু শিক্ষকরা কটাক্ষ করতেন। তিনি কি থেমে গিয়েছিলেন?”
স্যারকে ধীর স্বরে প্রশ্নটি করে স্টেজে উঠে পিতার হাস্যোজ্বল মুখের দিকে দৃষ্টি রেখে সেদিনের কয়েক ফোঁটা অশ্রু ফেলার স্মৃতি স্মরণ করে ক্রেস্ট উঁচিয়ে ধরে বলেছিল,
“এটা আমার শিক্ষক তুল্য পিতার। এই স্মারক আমি তার অশ্রু দিয়ে কিনেছি।”
ছেলের কথায় মাহাবুব আলম আবেগে আপ্লুত হয়ে চেয়ে ছিলেন ঝাপসা চোখে। অদূরে দাঁড়ানো সেই শিক্ষকের মাথা নুয়ে পড়েছিল লজ্জায়। তারপর গলার মেডলটি উঁচিয়ে বলেছিল,
“এটা আমার পরিবারের।”
তারপর ফুলের তোড়া ইহাবের দিকে ছুঁড়ে মেরে বলেছিল,
“আর এটা আমার কেন্দ্রবিন্দু হাবের।”
মাহাবুব আলম এবং ইহাবের চোখের কোণে সেদিন আনন্দ অশ্রু জ্বলজ্বল করছিল। মারওয়ান আজাদ নামক অদ্ভুত দীপ্ত ছেলেটির দুর্বলতা সেদিন উপস্থিত জনতা ভালোভাবেই টের পেয়েছিল। সবশেষে সার্টিফিকেট হাতে পেয়ে মারওয়ান সেদিনের লজ্জিত হওয়া শিক্ষকের কাছে গিয়ে বলেছিল,
“মাথা নিচু করবেন না স্যার। আপনারা শিক্ষক। আমাদের জীবনে আপনাদের ভূমিকা অপরিসীম।তাদের দুচোখে দেখবেন না। অনেকের প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য থাকে না, আপনাদের এমন দ্বিমুখী আচরণ ছাত্রজীবনে প্রভাব ফেলে। এই সার্টিফিকেট আপনার। সেদিন অপমান না করলে এসএসসি কিংবা এইচএসসি কোনোটাতেই হয়তোবা আজকের অবস্থানে থাকতাম না।”
শিক্ষক ভেজা চোখে মারওয়ানকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তার চোখের সামনে যে পর্দা আটকানো ছিল সেটা খুলে দেয়ার খুশিতেই বোধহয় চোখ দুটো ভিজেছিল। ইহাব শিস দিয়ে চিল্লিয়ে উঠে বন্ধুর খুশি উদযাপন করছিল। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া মুখ কালো করে পুরো অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তার বাবা ইফতেখার ভুঁইয়া অর্থাৎ ইহাবের দাদা ছিলেন প্রধান অতিথি। যদিও মেডেল বাদে ইহাব ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট সবই পেয়েছিল তবে মারওয়ানের এত প্রশংসা ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার কাছে বিষতুল্য ঠেকছিল। তার বিষতুল্যতা আরও বাড়াতে ইহাবের কর্মকাণ্ড যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছিল। যখন নিজের ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট এবং ফুলের তোড়া সব মারওয়ানকে উৎসর্গ করেছিল, প্রকাশ না করলেও ছেলের ছেলেমানুষীতে ভিতরে ভিতরে তিনি রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন।
স্কুলের শিক্ষক, ছাত্র এমনকি গ্রামের মানুষদেরও বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গিয়েছিল মারওয়ান এবং ইহাব একই সুতোয় বাঁধা দুটো প্রাণ। পৃথিবী ওলোট পালোট হয়ে যাবে, সাগরের পানি শুকিয়ে যাবে তবে এই দুজনের বন্ধন কোনোদিন ছিঁড়বে না। দুজনের পাগলামির শেষ ছিল না। মারওয়ান, ইহাব উভয়ই ছিল বাঁধনহারা। নিজের মর্জিমাফিক চলত।
গ্র্যাজুয়েট কমপ্লিট করে ক্যারিয়ার ভাবনায় অন্যরা মুখিয়ে থাকলেও উভয়ই ছিল নির্লিপ্ত। ইহাবের নির্লিপ্ততা মানা যায় কারণ সে শুয়ে বসে অজন্মকাল খেতে পারবে কিন্তু মারওয়ানের উদাসীন মনোভাবের কোনো কারণ পিতা মাহাবুব আলম পাননি। ছেলের সবকিছুতে হেঁয়ালিপনা তাকে বিরক্তি ও বেদনার উচ্চসীমায় পৌঁছে দিয়েছিল। ছেলের চিন্তায় অস্থির হয়ে আবারও শয্যাশায়ী হয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ একদিন খবর পান মারওয়ান গোপন কোনো কাজের সাথে যুক্ত। খবরটা মারওয়ানই দিয়েছিল। ছেলে বিপথে চলে গিয়েছে ভেবে একেবারেই ভেঙে পড়েছিলেন মাহাবুব আলম। তবে ঝটকাটা তখন খান যখন শুনেছিলেন মারওয়ান আজাদ এবং ইহাব ভুঁইয়া উভয়ই গোয়েন্দা সংস্থার লোক। এসব পুত্রের গোপনীয় বিষয়। তাই লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখতে তিনি কোনো কার্পণ্য করেননি। এমনকি পরিবারের কেউ আজ পর্যন্ত মারওয়ানের কর্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়।
৬ অগ্রহায়ণ, ১৪২১
কয়েকদিন ধরে ইহাবের সন্দেহ হচ্ছে তাকে কেউ ফলো করছে। আজ সকালেই ইহাবের কাছে একটা পার্সেল এসেছে। গ্রাম থেকে আসার পর আজকেই প্রথম পার্সেল এল। পার্সেলের ভেতর একটা পেনড্রাইভ ও চিরকুট। ইহাব ভ্রু কুঁচকে চিরকুট খুলে দেখল সেখানে লেখা,
বন্ধুকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে নেই। আপনার প্রাণাধিক প্রিয় বন্ধু যে গোপন তথ্য লিক করে সেটা সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখেন? একজন গোয়েন্দা বিভাগের লোক হয়ে এমন অবিশ্বস্ত মানুষ দেশের জন্য শুধু ক্ষতি বয়েই আনবে না এই পেশার জন্যেও সর্বাধিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
(কেউ একজন)
এইটুকুই লেখা কাগজে। ইহাব উক্ত কাগজের কোনো কথাই বিশ্বাস করেনি। পৃথিবী উল্টে গেলেও মারওয়ান সম্পর্কে তার ধারণা এক বিন্দুও পাল্টাবে না। মারওয়ান যদি তার সামনে খুনও করে তবুও সে মারওয়ানকে খুনি সাব্যস্ত করবে না। এর পিছনে যুক্তি না থাকলে মারওয়ান এই কাজ ভুলেও করবে না তাও ইহাব জানে। তাই নিশ্চিন্তে চিরকুট ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিল। ইহাব, মারওয়ান দুজন দুজনকে এক কথায় অন্ধবিশ্বাস করে। এসব পেশায় এরকম কত কিছু আসে সবকিছু বিশ্বাস করতে নেই। তাছাড়া তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ মিশন চলছে এইসময় শত্রুপক্ষের কোনো চাল কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন!
এর কিছুদিন পর আবারও একটা চিরকুট ইহাবের দোরগোড়ায় পৌঁছেছিল। চিরকুটে লিখা ছিল,
অন্ধবিশ্বাস ক্ষতির কারণ। আপনি যেমন আপনার বন্ধুকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেন তিনিও কি আপনাকে তেমনই বিশ্বাস করেন? আর সেদিনের পেনড্রাইভটি নিশ্চয়ই দেখেননি। দেখলে অন্ধবিশ্বাস খানিক হলেও কমতো।
(কেউ একজন)
চিরকুটটি পড়ে ইহাবের টনক নড়েছিল। পেনড্রাইভটা তো সে আসলেই সেদিন দেখেনি। অকাজের ভেবে ফেলে রেখেছিল। দ্রুত পেনড্রাইভটি ল্যাপটপে সেট করে দেখেছিল আসলেই শত্রুপক্ষকে তথ্য ফাঁস করছে মারওয়ান। বেশ কয়েক স্থানে তার তথ্য ফাঁস করার, শত্রুদের সাথে হাত মেলাবার ছোট ছোট ক্লিপ ভিডিও, অডিও ইহাবের চোখের সামনে উন্মোচিত হচ্ছিল আর তার বুকে ব্যথা বেড়ে যাচ্ছিল। ইহাব প্রথমে বিশ্বাস করেনি এই ভিডিও কিংবা অডিও। এডিট ভেবেছে। তারপর পরীক্ষা করে দেখেছে এটা আসল ভিডিও। কোনোটাই এডিটেড নয়। তবুও নিজেকে আশ্বাস দিয়েছে মারওয়ানের এই কাজের পিছনে নিশ্চয়ই কোনো যুক্তি আছে। চোখের সামনে প্রমাণ উপস্থিত থাকার পরেও ইহাব মারওয়ানকে অবিশ্বাস করতে নিমরাজি ছিল।
বেশ কয়েকদিন ইহাব রাতে ঘুমাতে পারছে না। কোনো কাজেও মনোযোগ দিতে পারছে না। মারওয়ান চট্টগ্রামে একটা মিশনে গেছে। কবে আসবে ঠিকঠিকানা নেই। ইহাব নিজেকে দমাতে না পেরে চিঠি লিখতে বসল,
প্রাণাধিক নম্বর ওয়ান,
কেমন আছিস তুই? আমি ভালো নেই। বেশ কয়েকদিন হয় ঘুম চোখ থেকে উধাও হয়ে গেছে। কোনকিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছি না। কাজ শেষ করে শীগ্রই ঢাকামুখী হবি। তোর সাথে জরুরি বিষয়ে আলাপ আছে। আচ্ছা, আমাকে তুই কতটুকু বিশ্বাস করিস? যদি কোনোদিন দেখিস আমি তোর সাথে নেই তাহলে কী আমার উপরে আস্থা হারাবি?
ইতি
তোর কেন্দ্রবিন্দু
চিঠির ফিরতি উত্তর এল দুদিন পর। সেই চিরায়ত রূপে লেখা চিঠি। ইহাবের চিঠির ফটোকপি শুরুতে লাগিয়ে মারওয়ানের টানা টানা হাতের লিখিত চিঠি।
কেন্দ্রবিন্দু,
কাজ নিয়ে প্রচুর ব্যস্ততা যাচ্ছে। শীঘ্রই তোর সাথে একত্রিত হব। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে সন্ত্রাসীদের আস্তানায় ঘাঁটি স্থাপন করতে হয়েছে। খুবই রিস্কি কাজ। চিঠিটা খুবই গোপনে লিখতে হচ্ছে। তাই বেশি কিছু বলার সুযোগ নেই। শোন, বেশি চিন্তা করবি না। যত্ন নিস শরীরের। আমি এসেই তোর মন খারাপ ভ্যানিশ করে দেব। আর তোকে আমি আমার নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি। আমাকে অবিশ্বাস করতে পারব কিন্তু তোকে না। সেদিন কোনোদিন আসবে না যে তুই আমার সাথে থাকবি না। তাই আস্থা হারানোর প্রশ্নই আসেনা।
ইতি
……
পড়া শেষে চিঠির উপরে ইহাব বার কয়েক হাত বুলাল। নিজের নাম কোনোদিনও শেষে লেখে না মারওয়ান। সবসময় ডট ডট ব্যবহার করে। সবকিছু যেন এমন ঠিকঠাক থাকে সেই প্রার্থনা করল ইহাব। তার কেন যেন মনে হচ্ছে বিরাট একটা ঝড় আসতে চলেছে তাদের জীবনে। যা তাদের সবার জীবনকে উলটপালট করে দেবে।
ইহাবকে তছনছ করতে সেবারের মিশন প্রধান অর্থাৎ SAD প্রধানের একটা ফোনকলই যথেষ্ট ছিল। মারওয়ান সম্পর্কে তার কাছে নেগেটিভ অনেক তথ্য পৌঁছে গিয়েছিল। ইহাব এসম্পর্কে জেনেও কেন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি তার জবাবদিহি চেয়েছেন ডিপার্টমেন্টের হেড। ইহাব হয় এর ব্যবস্থা নেবে নয়তো চিরকালের জন্য তাকে এবং মারওয়ানকে সাসপেন্ড করে জেলে পুড়ে দেয়া হবে। হয়তো এই দ্বিচারিতার জন্য উভয়কে দেশদ্রোহী মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হবে। এর শাস্তি অবশ্যই মৃত্যুদন্ড নিশ্চিত করবেন হেড।
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া ততদিনে গ্রামের চেয়ারম্যান আসনে নির্বাচিত হয়েছেন। কোনভাবে এসব খবর তার কানে পৌঁছুলে ইহাব মারওয়ান সম্পর্কে যা জানে তা যেন SAD (Secret Affairs Division) ডিপার্টমেন্টের হেডকে দিয়ে দেয় তা নিয়ে জোরজবরদস্তি শুরু করেন। তার মতে, অন্যের দোষ নিজের ঘাড়ে টানার কোনো কারণ নেই। দোষ করেছে মারওয়ান সেখানে ইহাব কেন ফাঁসবে? এসব বলে ছেলেকে ফুসলাতে থাকেন তিনি। মাহাবুব আলমের মতো ইমতিয়াজ ভুঁইয়া ছাড়া পরিবারের আর কেউই ইহাবের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জ্ঞাত নয়। যারা গোয়েন্দা সংস্থার লোক তারা নিজেদের আসল কাজ সম্পর্কে পরিবারকে জানাতে পারেনা। উপর থেকেই নিষেধ করা থাকে।
ইহাবকে এতো চাপ দেয়ার পরেও যখন সে মারওয়ান সম্পর্কে কোনো কথা বলেনি তখনই তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়। দুই দিনের রিমান্ড শেষেও যখন কোনো কাজ হচ্ছিল না তখন SAD এর হেড শপথ করালেন, হয় দেশের পক্ষে থাকবে নয়ত দেশদ্রোহীর পক্ষে। ইহাব নিজের পেশায় যুক্ত হবার দিনই ওয়াদা করেছিল মৃত্যুকে গ্রহণ করবে কিন্তু দেশের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করবে না আবার নিজের প্রিয় বন্ধুর বিপক্ষে সাক্ষ্য দিতেও তার কলিজা ছিঁড়ে যাবে। সেদিন চিৎকার করে পুরো অফিসকক্ষের সামনে কেঁদেছিল ইহাব। তবে হেড কিংবা অন্যান্য এজেন্ট কারোরই তাতে মন গলেনি। ততদিনে সবাই মারওয়ান আজাদের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল মিশন শেষ করে এলেই জেলে ঢোকানো হবে তাকে।
মারওয়ানকে নিজের মিথ্যা অসুস্থতার কথা জানিয়ে মিশন স্থগিত করে দ্রুত ঢাকায় চলে আসার জন্য ইহাব চিঠি লিখেছিল। দেশ অথবা দেশদ্রোহিতার ভিতরে নিজের দেশকেই বেছে নিয়েছে সে। মারওয়ানের আরও বিভিন্ন ক্লিপ ও ঘৃণ্য তথ্য তার চোখের সামনে যখন জ্বলজ্বল করে ধরা দিচ্ছিল তখন নিজেকে আর বন্ধুত্বে স্থির রাখতে পারেনি সে। নিজের বন্ধুত্বের জন্য চোখের সামনে থাকা প্রমাণে আর কত অবিশ্বাস করবে ইহাব? সবার আগে সে একজন গোয়েন্দা তারপর বন্ধু। এই শপথ করেই তো সে গোয়েন্দাগিরিতে নিযুক্ত হয়েছিল।
মারওয়ান যেদিন ঢাকায় এসে পৌঁছুল ততদিনে আবেগ, অনুভূতি সব কবর দিয়ে পাথরে পরিণত হয়ে গিয়েছিল ইহাব। মারওয়ান ইহাবকে দেখেই জড়িয়ে ধরেছিল। ইহাব কোনো আগ্রহ দেখায়নি। মারওয়ান তা দেখে বলল,
“শরীর, মন বেশি খারাপ নাকি? চিন্তা নেই আমি এসে পড়েছি না?”
বলে আবারও বন্ধুকে জোরে চেপে ধরল। মারওয়ান যদি জানত যাকে জড়িয়ে ধরেছে সে শুধুই বন্ধুর খোলস কিন্তু ভেতরে একজন গোয়েন্দা তাহলে বোধহয় জড়িয়েও ধরত না আবার তার অসুস্থতার চিঠি পেয়ে হুড়োহুড়ি করে মিশন স্থগিত করেও আসত না। ইহাব রোবটের মতো বলল,
“কাল অফিসে দ্রুত আসিস।”
“তা আসব। তুই রেস্ট না নিয়ে অফিসে যাচ্ছিস নাকি?”
ইহাব প্রত্যুত্তর করেনি। মারওয়ান বলল,
“কী হলো? বেশি খারাপ লাগলে চল কোথাও ঘুরে আসি।”
“প্রয়োজন নেই।”
এটুকু বলেই ইহাব প্রস্থান করল। মারওয়ান ইহাবের অদ্ভুত আচরণের কোনো কারণ খুঁজে পেল না। শরীর খারাপ ভেবে আর ঘাটলো না।
৫ই কার্তিক, ১৪২২ বঙ্গাব্দ
পরেরদিন অফিসে পা রেখেই মারওয়ানের সবকিছু কেমন অদ্ভুত লাগছিল। অন্য সময়ে কোনো কাজ শেষ করে ফিরলে বাকি এজেন্টরা এসে কোলাকুলি করত কিন্তু এবার সকলের চোখমুখ কুঁচকে ছিল। ইহাবকে আশেপাশে কোথাও দেখল না। তাকে অফিসে আসতে বলে নিজেই গায়েব। হেড তার সামনে এসে দাঁড়াতেই মারওয়ান সালাম দিল। তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বললেন,
“গোয়েন্দা তথ্য ফাঁস করার অপরাধে তোমাকে সাসপেন্ড করা হলো সেই সাথে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করা হবে।”
মারওয়ান আকাশ থেকে পড়েছে এমন ভঙ্গিমায় হেডের দিকে চাইল। অবাক গলায় বলল,
“এসব কী বলেছেন স্যার”
হেড রাগান্বিত গলায় বললেন,
“যা শুনলে তাই বলেছি।”
“আপনার সম্ভবত কোথাও ভুল হচ্ছে।”
“আমার কোথাও ভুল হচ্ছে না।”
মারওয়ান পুরো অফিসরুমের সবার দিকে চাইল। প্রত্যেকের চোখে ঘৃণা। সকলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে কটাক্ষের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। এতদিন এরাই তাকে স্যার স্যার বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলত অথচ আজ তাদের সবার মুখ ঘৃণা ও তিক্ততায় কুঁচকে আছে। হেড মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে মারওয়ানের এযাবৎ কালের সকল কুকীর্তি দেখালেন। মারওয়ান অবিশ্বাস্য নজরে সেদিকে চেয়ে রইল। নিজের চোখের সামনে নিজেকে যেন অবিশ্বাস হচ্ছে। এ কিভাবে সম্ভব? মারওয়ান তো এমন কিছু কোনোদিন করেনি। তাহলে এই ভিডিও কারা করেছে? সে চিল্লিয়ে বলল,
“এগুলো এডিটেড স্যার? এটা আমি নই।”
এজেন্ট তাহমিদ বলল,
“এডিট করে এত রিয়েল ভিডিও বানানো সম্ভব?”
হেড তাচ্ছিল্য হেঁসে বললেন,
“এডিট নাকি রিয়েল সবই পরীক্ষা করা হয়েছে। কোনোটাই এডিট নয়। তোমার কাছে এধরনের জালিয়াতি, বিশ্বাসঘাতকতা আমি আশা করিনি।”
মারওয়ান চিৎকার করে বলল,
“বিশ্বাস করুন স্যার এসব মিথ্যা, ভুয়া।”
এজেন্ট তাহমিদ আবারও বলল,
“চোখের সামনে দেখছি আপনি অথচ এখন বলেছেন এগুলো ভুয়া, মিথ্যা? মিথ্যা ধরা পড়ে যাওয়ায় মাথা আউলিয়ে গিয়েছে নাকি মিস্টার?”
সকল এজেন্ট হেঁসে উঠে এজেন্ট তাহমিদকে সমর্থন করল। মারওয়ান লজ্জায় অপমানে মাথা নিচু করে ফেলল। ইহাব অফিসরুমে এসে দেখল মারওয়ান মাথা নিচু করে আছে। হেড তাকে দেখা মাত্রই বললেন,
“আসো।”
ইহাবকে দেখে মারওয়ানের বুকে আশার আলো জ্বলল। এগিয়ে এসে বলল,
“হাব দেখ, সবাই কিসব বলছে? তুই তো জানিস আমি কেমন? সবাইকে বল প্লিজ। আমি কোনোদিন বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি তুই বল?”
হেড ইহাবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“কিভাবে কী পেয়েছ সব খুলে বলো।”
ইহাব মারওয়ানের দিকে এক পলক চেয়ে বিগত কয়েকমাসের সবকিছু খুলে বলল। মারওয়ানের চারপাশে যেন বজ্রাঘাত হলো। কেমন ঘোলাটে লাগছে সবকিছু। ইহাব! যাকে সে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে, বিশ্বাস করে সে তার বিরুদ্ধে বলছে! এও সম্ভব? এসব কিছু মিথ্যা? হাব এসব বলতেই পারেনা? সে নিশ্চয়ই ভুলভাল দেখছে। অফিসরুমের প্রত্যেকটি এজেন্ট তাকে ধিক্কার জানাল। অপমান, অপদস্ত করে সেদিন তাকে সাসপেন্ড করে দেয়া হলো।
এত চাপ সহ্য করতে না পেরে মারওয়ান মারাত্মক জ্বর নিয়ে গ্রামে চলে এল। কারো সঙ্গে কোনো আলাপ না করে একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। মাহাবুব আলম ছেলের শরীরের কন্ডিশন এত খারাপ দেখে ডাক্তার দেখালেন। ডাক্তার দেখে জ্বর ও মানসিক চাপের ওষুধ দিল। তিনদিন পর কিছুটা সুস্থ হলে মাহাবুব আলম কিছু হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলেন। মারওয়ান ইশারায় জানাল কিছু হয়নি।
দুদিন পর খবর এল চেয়ারম্যান বাড়িতে ডাক পড়েছে। মারওয়ান যেতে রাজি হলো না। মাহবুব আলম ভাবলেন জরুরি তলব করেছে একবার শুনে আসা দরকার। তাই অসুস্থ ছেলেকে কোনরকম বুঝিয়ে নিয়ে এলেন চেয়ারম্যান বাড়ি। চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে এসে দেখলেন পুলিশের জিপ গাড়ি দাঁড় করানো। গ্রামের গণ্যমান্য অনেকেই উপস্থিত সেখানে। মারওয়ান ও মাহাবুব আলমকে দেখে ইমতিয়াজ ভুঁইয়া বললেন,
“এত নিকৃষ্ট একটা কাজ করতে তোমার বিবেকে বাঁধল না মারওয়ান? তোমাকে তো যথেষ্ট ভালো ছেলে জানতাম। ছিঃ ছিঃ এই জঘন্য কাজটা করতে তোমার বাঁধেনি?”
মাহাবুব আলম বললেন,
“এসব আপনি কী বলেছেন চেয়ারম্যান সাহেব?”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া মুখ ঘুরিয়ে বললেন,
“আপনার ছেলেকেই জিজ্ঞেস করুন কি বলছি?”
মাহাবুব আলম মারওয়ানের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল। মারওয়ান প্রত্যুত্তর না করে মাথা নিচু করে দাঁড়ানো। মারওয়ানকে কোনো কথা না বলতে দেখে ইমতিয়াজ ভুঁইয়া উঠে এসে কানে কানে সব ঘটনা খুলে বললেন। মাহবুব আলম বিশ্বাস করলেন না। তারপর ইমতিয়াজ ভুঁইয়া ভিডিও দেখালে না চাইতেও বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন। চোখের সামনে ছেলের অধঃপতন কোনো বাবাই সহ্য করতে পারেন না। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া চেয়ারে বসে গ্রামের সকলের দিকে চেয়ে বললেন,
“অফিসের টাকা চুরি করার দায়ে মারওয়ানকে পুলিশ গ্রেফতার করতে এসেছে।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া পুরো গ্রামের সামনে আসল কথাই বলতে চেয়েছিলেন তবে ইহাবের অনুরোধে মিথ্যা বানোয়াট কথা বলতে হলো। গোয়েন্দাগিরি সিক্রেট জিনিস। এই পেশা সম্পর্কে সবাইকে জানানো যায়না। তাদের নিষেধ করা থাকে। ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার কথায় উপস্থিত জনতায় ছিঃ ছিঃ রব পড়ে গেল। অনেকে বিশ্বাস করতে চায়নি। মারওয়ান সম্পর্কে যথেষ্ট সুধারণা তাদের। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া হিংসা থেকে এসব বলছেন তাও অনেকে কানাঘুষা করল। এসব শুনে তিনি ক্ষোভে ফুঁসতে লাগলেন। নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে ইমতিয়াজ ভুঁইয়া নিজের ছেলেকে ডেকে এনে বললেন,
“এসব সত্যি কিনা বলো ইহাব?”
ইহাব মাথা নামিয়ে সম্মতি জানাল। যারা বিশ্বাস করেনি তারাও বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো। কারণ মারওয়ানের জানে জিগার দোস্ত তো আর মিথ্যা বলবে না। মারওয়ান হাসল কেবল। গ্রামের একজন গণ্যমান্য বৃদ্ধ লোক বললেন,
“আজ পর্যন্ত যা হয়নি তা এই ছোকরার জন্য হলো। গ্রামে পুলিশ এসেছে কোনোদিন কেউ শুনছেন?”
সকলে ‘না না’ করে উঠল। তিনি আবারও বললেন,
“তোমারে তো ভালো ভাবছিলাম মাহাবুবের পোলা। কি সাংঘাতিক কাণ্ড, টাকা চুরি! ছেলেরে নি এই আদর্শবান বানাইছ মাহবুব?”
শেষের প্রশ্নটি মাহাবুব আলমের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন বৃদ্ধ ব্যক্তিটি। মাহাবুব মারওয়ানকে ছেড়ে কঠোর দৃষ্টিতে চেয়ে ভরা চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা চড় লাগালেন। মারওয়ান শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে চড় খেল। তার চোখ দুটো রক্ত জমে লালাভ হয়ে আছে। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া বললেন,
“আল্লাহ কত মেধা দিছে অথচ কাজ কামে ঢেঁড়স। পুরা মাথাটা কাটা গেল এই পোলার জন্য।”
মারওয়ান নিজের রক্তাক্ত চোখ দুটো মেলে ইমতিয়াজ ভুঁইয়ার দিকে চাইল। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া বলল,
“কতবড় বেয়াদব! আবার আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়। চাপকে পিঠের ছাল তুলে ফেলব বেয়াদব কোথাকার। সন্ত্রাসী, গুণ্ডার মতো আচরণ। নিয়ে যান একে।”
শেষ কথাটা পুলিশদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়লেন তিনি। পুলিশরা গ্রাম ভর্তি লোকের সামনে টেনে হিঁচড়ে মারওয়ানকে নিয়ে গেল। এক গ্রাম মানুষের সামনে অপমানিত হয়ে এবং ছেলের নিন্দা ও ধিক্কার শুনে মাহবুব আলম স্ট্রোক করলেন।
দুদিন পর ইহাব জেলে মারওয়ানকে দেখতে গেলে মারওয়ান একবারের জন্যও তার দিকে তাকালো না। দেয়ালে হেলান দিয়ে এক হাঁটুর উপরে হাত রেখে দৃষ্টি উপরে রেখে পলকহীন চেয়েছিল। ইহাব ওপাশ থেকে বার বার ডাকলেও সেই ডাকে আর সাড়া দেয়নি মারওয়ান আজাদ। শুধু একবার ঘাড় কাত করে হো হো করে হেঁসে বলল,
“বন্ধুত্ব নাকি ছলনা!”
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫৩
সেইযে কথা ফুরালো এরপর ইহাব নামক যে অধ্যায় ছিল তা একেবারে দাফন করে ফেলেছিল মারওয়ান। পারলে মারওয়ান আজাদ নামটার কবরও বোধহয় সেদিন দিয়ে দিত। ইহাব নিজেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। মারওয়ানের দোষ থাকা সত্ত্বেও ইহাবকে দোষী করাটা তার মোটেও পছন্দ হয়নি। মারওয়ানের দশ বছরের জেল হয়েছিল। তবে উড়ো খবর শুনেছিল ইহাবের কারণে সেই জেলের সময়সীমা তিনমাস নির্ধারিত হয়। তিনমাস পর জেল থেকে বেরিয়ে এসেছিল নির্লিপ্ত, উদাসীন, ভবঘুরে, ছন্নছাড়া মারওয়ান আজাদ। আগের কোনো বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে আর বিদ্যমান ছিল না। সবকিছু ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে তবেই জেল থেকে বেরিয়েছে সে।